জীবনশক্তি নিঙড়ে নিয়েছে রেলদপ্তর
ক্ষতিপূরণে নীরবতার শিকার বৃজি-পাটুলী মৎস্যজীবীরা
একসময় নিউ গড়িয়ার শেষপ্রান্তে এই বিস্তীর্ণ জমি ছিলো জলাশয়, ছোট ছোট ভেড়ি। সারা বছর এখানকার গরিব মৎস্যজীবীরা সেই কোন কাকভোরে এই জলাশয় থেকে মাছ তুলতো। সেই মাছ চলে যেতো গড়িয়ার আশপাশের বাজারগুলিতে। এখানকার গরিব মানুষের রুজি বলতে ছিলো এই ভেরিগুলিতে চাষ করা মাছই। মাছের পোনাকে খাবার দেওয়া, ভেরির জল পরিষ্কার রাখা, সেই পোনাকে বড় করা সব মিলিয়ে এই ভেরিগুলি যেন ছিলো গরিব পরিবারগুলি প্রাণ।
সেই ভেরিগুলি আজ মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। মেট্রোরেল টালিগঞ্জ থেকে নিউ গড়িয়া পর্যন্ত দ্বিতীয় পর্যায়ে সম্প্রসারিত হওয়ায়, নিউ গড়িয়ার শেষপ্রান্তের মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ স্থানীয় মৎস্যজীবী সমবায়ের লিজ নেওয়া সাড়ে চার হেক্টর জলা বিনা নোটিশে, বিনা ক্ষতিপূরণে ভরাট করেছে। শোনা যাচ্ছে, সমপরিমাণ জলা পুনরায় ভরাট হবে। এমনই আশঙ্কায় ঘুম কেড়েছে যাদবপুর বৃজি-পাটুলি পাড়ার গরিব মৎস্যজীবীদের।
কী হবে এই মৎস্যজীবী পরিবারগুলির? কোথায় যাবেন তাঁরা? ক্ষতিপূরণের আশায় দীর্ঘদিন ধরে ‘বৃজি পাটুলী মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি’ বিভিন্ন দপ্তরে দপ্তরে ঘুরে বেরিয়েছেন, রেলমন্ত্রীর কাছেও আবেদন করেছেন, কিন্তু কেউই সাড়া দেয় নি।
একসময় লোকসভার সি পি আই (এম) সাংসদ বাসুদেব আচারিয়া এই মৎস্যজীবী পরিবারগুলির জন্য ক্ষতিপূরণের জন্য উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ক্ষতিপূরণের আবেদন জানিয়েছিলেন সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রীয় মন্ত্রকের কাছে। কিন্তু কোনো সদুত্তর মেলেনি। সম্প্রতি ক্ষতিপূরনের আবেদন জানিয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রের নবনির্বাচিত সাংসদ কবীর সুমনকেও। তাতেও কোনো লাভ হয়নি।
‘গত প্রায় দুই বছর ধরে কার্যত মারো-ধরো-কাটো নীতিতে যে তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা ব্যানার্জি সিঙ্গুর থেকে নন্দীগ্রামসহ রাজ্যের কিছু অঞ্চলে জমির প্রশ্নে কতো আন্দোলন করেছেন, রেলমন্ত্রী হওয়ার পর সেই মমতা ব্যানার্জি বৃজি-পাটুলীর জমিহারা মৎস্যজীবীদের প্রশ্নে এতো নীরব কেন? তবে কী রাজনীতিতে শুধুমাত্র নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য গরিব মানুষকে ব্যবহার করে যাচ্ছেন?’ প্রশ্ন তুলছেন গরিব মৎস্যজীবীরাই। একথা ঠিক এই প্রকল্পটির জন্য রাজ্য সরকার টাকা ব্যয় করেছে অনেক। পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছে সরে যেতে বাধ্য হওয়া মানুষের জন্য। জমির বন্দোবস্ত করেছে। এমনকী প্রকল্পটি ভণ্ডুল করার জন্য মরিয়া তৃণমূল-নকশালদের যাবতীয় বন্ধ, অবরোধ, আইনশৃঙ্খলার সমস্যার মোকাবিলা করতে হয়েছে রাজ্য সরকারকেই।
টালিগঞ্জ থেকে গড়িয়া পর্যন্ত মেট্রোরেল সম্প্রসারণের সেই প্রকল্প দীর্ঘদিন ধরে বানচাল করার ‘আন্দোলন’-এর সংগঠক মমতা ব্যানার্জিই গত ২৩শে আগস্ট ঐ প্রকল্পের উদ্বোধনও করেছেন। মৎস্যজীবীরা চাইছেন তাঁদের ক্ষতিপূরণের বিষয়টি এবার ভাবুক রেলমন্ত্রক। রবীন মণ্ডল, শচীন নষ্কররা আজ বলছেন, ‘তৃণমূল কংগ্রেস নিজেকে গরিবদরদী সাজাতে তো ভোটের ইশ্তেহারে লিখেছে, আমাদের স্লোগান সবার পেটে ভাত, সবার জন্য কাজ। তাহলে রেলমন্ত্রী এবার বৃজি পাটুলী মৎস্যজীবীদের হারানো জমির ক্ষতিপূরণ দিক। কই, মৎস্যজীবীদের ক্ষতিপূরণের আবেদনে তিনি তো কোনো সাড়া দিচ্ছেন না।
গরিব মানুষদের নিয়ে কেন এই হিংসার রাজনীতি করছেন?’
প্রসঙ্গত, মেট্রোরেলের এই সম্প্রসারণের জন্য রাজ্য সরকার ব্যয় করেছে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। ঐ প্রকল্পের জন্য প্রায় পাঁচশো পরিবারকে টালিনালার ধার থেকে সরিয়ে তাদের অন্যত্র পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছে রাজ্য সরকারই। টালিগঞ্জ থেকে গড়িয়া পর্যন্ত টালিনালার দু’ধারে মেট্রোরেলের স্টেশনের জন্য জমির বন্দোবস্ত রাজ্য সরকারই করেছে। তা বাবদ রাজ্য সরকার কোনো টাকা নেয়নি। এমনকী মেট্রোর কারশেডের জন্য জমিও দিয়েছে রাজ্য সরকার।
জনস্বার্থে ঐ জমি দেওয়া হয়েছে সামান্য টাকায়। আবার যে পরিবারগুলিকে টালিনালার ধার থেকে সরিয়ে দিতে হয়েছিল, পুনর্বাসনে তাদের মধ্যে ৩৭৫টি পরিবারকে আবাসন দেওয়া হয়েছে। আরো প্রায় ১০০পরিবারকে দেওয়া হয়েছে ই এম বাইপাস সংলগ্ন পাটুলিতে জমি। কিন্তু মেট্রোরেলের ঐ সম্প্রসারণের কাজ আটকানোর জন্য ১৯৯৭-’৯৮ থেকে ২০০৬-’০৭ পর্যন্ত লাগাতার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন মমতা ব্যানার্জি। সেদিন বন্ধ,অবরোধ কিছুই বাদ দেননি তিনি।
আর সেদিনও তাঁর সঙ্গে ছিল নকশালপন্থীদের কিছু অংশ।
এই মৎস্যজীবীরা তফসিলী ও মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত। একসময় এদের সকলের জীবিকা ছিলো কৃষি। ক্ষুদ্র কৃষক হিসেবে সেসময় যে ছোট ছোট জমিতে এরা চাষ করতেন, নগরায়নের স্বার্থে কৃষকরা সেই জমি তুলে দিয়েছিলেন রাজ্য সরকারের হাতে। নিচু জমি মাটি দিয়ে ভরাট করতে পাটুলী উপনগরী অঞ্চলে তৈরি হয় একাধিক জলাশয়।
রাজ্য সরকারের জমিহারা কৃষকদের নিয়ে সমবায় গঠন করে উপনগরী অঞ্চলের ৩৪টি জলাশয় লীজ দিয়ে মাছ চাষের সুযোগ করে দিয়েছিলো। দু’দশক ধরে সেই জলায় চাষ করে স্থানীয় মৎস্যজীবীরা নিজেদের জীবন-জীবিকা টিকিয়ে রেখেছিলো। আজ সেই জীবিকা আক্রান্ত। মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ স্থানীয় মৎস্যজীবী সমবায়ের লিজ নেওয়া সাড়ে চার হেক্টর জলা বিনা নোটিশে, বিনা ক্ষতিপূরণে ভরাট করায় প্রায় দশ হাজার শ্রম দিবস এবং বছরে প্রায় পাঁচ লক্ষ টাকা উপার্জন থেকে বঞ্চিত হয়েছেন গরিব মৎস্যজীবীরা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।