আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

Buddha Collapsed Out of Shame 2007 - Hana Makhmalbaf

mail.aronno@gmail.com

ছবি দেখার সময় সাধারণত আমি আবেগী হয়ে পড়িনা। যদি কখনো হয়েও যাই, তবে চেষ্টা করি সেই অংশটাকে মনের উপর তার প্রভাব ফেলা থেকে বিরত রাখতে। জীবনে প্রথম ও শেষবার ছবি দেখে কেঁদেছিলাম, তাও বছর দশেক আগে, আলমগীর-শাবানা অভিনীত ’মরণের পরে’ নামে একটি বাংলা ছবি দেখে। আর গত ষোল-সতের বছর ধরে দেখা ছবিগুলোর মধ্যে, যে দৃশ্য আমাকে সবচে’ বেশি আবেগে আপ্লুত করেছিল, সেটা ছিল ’কাস্ট এ্যাওয়ে’ ছবিতে নির্জন দ্বীপ থেকে ঘরে ফেরার সময়, চারবছর ধরে সাথে থাকা বলটি সমুদ্রের জলে ভেসে যাওয়ায় টম হ্যাঙ্কসের আকুল কান্না দেখে। অথচ সম্প্রতি ইরানি এই ছবির যে দৃশ্য দেখে আমি শুধু আবেগী নয়, বরং বিমূঢ়তায় আচ্ছন্ন হয়ে বসেছিলাম ছবি দেখা বন্ধ করে, সেটা ছিল এক কিশোরীর বাজারে ডিম বিক্রি করার দৃশ্য, যে স্কুলে যাবার জন্য নোটবুক কিনবে বলে, বাড়ি থেকে চুপ করে চারটি ডিম নিয়ে বাজারে এসে, ’ডিম কিনবে, ডিম কিনবে’ বলে সবার কাছে যাচ্ছে, কারণ সে জানেনা, ডিম কার কাছে বিক্রি করতে হয় ও কত দামে।

ফলে সে চায়ের দোকান থেকে শুরু করে সাধারণ লোকজন, কশাইখানা, ঘড়ি মেরামতের দোকান, কামারশালা সবখানেই যাচ্ছে, আর ’ডিম কিনবে, ডিম কিনবে’, বলে হাকাচ্ছে। এরপর যখন সে একটা দোকানের সামনে এসে, হাতে ডিম উঁচিয়ে ধরে বলতে লাগল, ’ডিম কিনবে, ডিম’, অথচ দোকানি ও খদ্দের কেউ-ই ওর দিকে লক্ষ্য না করে, নিজেদের হাতে ধরে রাখা বান্ডিল বান্ডিল টাকা গুনতে থাকল, তখন মেয়েটির এই প্রশ্ন সত্যিই আমাকে বাধ্য করেছিল ছবি দেখা বন্ধ করতে; ”তোমরা অত টাকা দিয়ে কি করবে? একটা ডিম তো মাত্র পাঁচটাকা। আমাকে স্কুলের জন্য খাতা কিনতে হবে!” ইরানি ছবিগুলো আমার দেখা হয়নি, কারণ ’আব্বাস কিরোস্তামি’ ও ’মাজিদ মাজিদির’ কয়েকটা ছাড়া অন্যান্য ছবিগুলো পারিনি সংগ্রহ করতে। যদিও ’চিলন্ড্রেন অব হেভেন’ দেখার পর খুব ইচ্ছে হয়েছিল ইরানি ছবিগুলো দেখার, যা এতদিন পর পুনরায় জেগে উঠেছে, ২০০৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ’হানা মাখলবাফ’-এর ’বুদ্ধা কোলাপস্ আউট অব শেম’ নামে ৮১ মিনিটের এই ছবিটি দেখে। এটা সত্যি যে, ছবিটি বিশ্বসিনেমার তেমন উল্লেখযোগ্য কোন কাজ নয়, তবুও সেটা দেখার পর মনে হয়েছে, বাস্তবিক প্রেক্ষাপটে মুসলিম নারীদের উপর সমাজিক নির্যাতন ও নিপীড়নের এমন চমৎকার সেলুলয়েড নির্মাণ গত কয়েক বছরে দুটো হয়নি।

যদিও কিছুদিন আগে সিদ্দিক বারমাকের আফগান নারীদের নির্মম বাস্তবতা নিয়ে বানানো ’ওসামা’ নামের অনুরুপ একটি ছবি দেখেছিলাম, কিন্তু সেটা আমাকে এতটা নাড়া দেয়নি। কৌশল ও গুণগতমানের বিচারে ’ওসামা’ এগিয়ে থাকলেও, হানা মাখলবাফের এই ছবিটি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির এমন একটা জাগায় আঘাত করে, যে সেটি দেখামাত্রই তাৎক্ষণিক ভাললাগা তৈরী হয়ে যায়। তছাড়া ছবিটির যে তথ্য সবাইকে চমকে দিতে পারে, তা হল, ছবিটি পরিচালনা করেছে ১৯বছর বয়সী এক তরুণী, এবং এটিই তার প্রথম ছবি। ছবিটি শুরু ও শেষ হয় ২০০১ সালের একটি ডকুমেন্টারির ফুটেজের মাধ্যমে, যেখানে দেখা যায়, আফগানিস্তানের বাহমিয়ান গ্রামের দু’হাজার বছর পুরনো বুদ্ধের বিশাল মূর্তিটি তালেবান যোদ্ধারা কিভাবে বোমা মেরে ধ্বংস করে দিচ্ছে। ছবিটি সেখানেই শুট করা, যেখানে দেখানো হয়েছে, পাহাড়ের গুহায় বসবাসকারী একটি পরিবারের ’বাখ্তা’ নামের পাঁচ-ছয় বছরের কিশোরী, তার প্রতিবেশী বালক ’আব্বাসের’ বই পড়া দেখে কিভাবে উজ্জীবিত হয়, এবং তার কথামত স্কুলে যাবার নোটবুক ও পেন্সিল কেনার জন্য, নিজের অবুঝ ভাইটিকে দড়ি দিয়ে বেঁধে, ঘর থেকে চারটি ডিম নিয়ে দোকানে যায়।

দোকানদার তাকে জানায় যে ডিমের বদলে সে নোটবুক, পেন্সিল বিক্রি করেনা, বরং তাকে বাজারে গিয়ে ডিম বিক্রি করে টাকা আনতে বলে। সাথে এও বলে দেয়, যেন সে প্রতারিত না হয়, আর একেকটা ডিম পাঁচ টাকার কমে বিক্রি না করে। এভাবেই শুরু হয় বাখতার ডিম বিক্রি করা, নোটবুক কেনা, আব্বাসের সাথে ছেলেদের স্কুলে যাওয়া, এবং সেখান থেকে বিতাড়িত হয়ে, নদীর ওপারে মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার সময় পথিমধ্যে অনেকগুলো বালকদের দ্বারা বন্দি হওয়া, যারা তালেবান ও আমেরিকান সেজে নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলছিল। ছবির কয়েকটা দৃশ্য দেখে আমি বেশ তাজ্জব হয়েছি ইরানি চলচ্চিত্রের সর্বকনিষ্ঠ এই পরিচালকের দৃষ্টিভঙ্গি ও সৃজনশীলতার কথা ভেবে। যেমন বাখতা যখন ডিম নিয়ে বাজারে যায়, আর সেখানে কারো ধাক্কায় হাত থেকে পড়ে একটি ডিম ভেঙে যায়, তখন ভেঙে যাওয়া ডিমের খোসা হাতে তার অসহায় মুখোভঙ্গি আমাদের বাকরুদ্ধ করে।

কিংবা নোটবুক কেনার পর যখন সে আব্বাসের সাথে ছেলেদের স্কুলে যায়, আর শিক্ষক তাকে জানায় যে এটা ছেলেদের স্কুল, এখানে মেয়েদের পড়ানো হয়না, বরং নদীর ওপারে মেয়েদের যে স্কুল সেখানে যেতে। তখন কিছুদুর গিয়ে বারবার শিক্ষকের কাছে ফিরে এসে, ওর জানানো বিভিন্ন অনুরোধ আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয় অসহায় এক বোধের সামনে। অথবা তালেবান ও আমেরিকান সেজে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় বালকেরা যখন তাকে স্কুল যাওয়া, সাথে লিপিষ্টিক রাখা ইত্যাদি অপরাধে বন্দী করে দাঁড় করিয়ে, তার চারপাশে ধুলোর বৃত্ত এঁকে বলে, ’এটা স্রষ্টার বিধিরেখা, এর বাইরে যেয়োনা’, তারপর সবাই মিলে ওকে মাটিতে পুঁতে পাথর নিক্ষেপ করে মেরে ফেলার জন্য গর্ত খুঁড়তে শুরু করে, তখন কোন কিছু না ভেবেই সে বৃত্তের বাইরে চলে আসে। এভাবে কয়েকবার সে বৃত্তের বাইরে বেরিয়ে আসে, আর বালকদের নেতা প্রতিবারই নতুন আরেকটা বৃত্ত এঁকে তা লঙ্ঘন করতে বারণ করে। অথচ সে প্রতিবারই বেরিয়ে আসে, আর একসময় ধুলোয় আঁকা বৃত্তের মধ্যে লাফিয়ে লাফিয়ে খেলা শুরু করে, তখন কিছুক্ষণের জন্য হলেও আমরা সন্দিহান হয়ে পড়ি তথাকথিত ধর্মীয় বিধি-নিষেধের অস্তিত্বে।

এসব ছাড়াও ছবিটিতে এমন আরও অনেক দৃশ্য আছে যেগুলো অনায়াসেই দর্শকের মনে গেঁথে যাবে। যেমন বালকদের দ্বারা গুহায় বন্দী অবস্থায়, কয়েকটি কিশোরীর সাথে বাখ্তার কথোপকথন ও একটি ছোট্ট কিশোরীকে লিপিষ্টিক দিয়ে সাজিয়ে দেয়া, যা সে পেন্সিল কিনতে পারেনি বলে মাকে না জানিয়ে ঘর থেকে নিয়ে এসেছিল, তা দিয়ে লিখবে বলে। কিংবা নদীর ওপারে স্কুলে গিয়ে ক্লাসরুমের সমবয়সী অন্যান্য মেয়েদের সেই লিপিস্টিক দিয়ে সাজিয়ে দেয়ার চমৎকার দৃশ্যায়ন। পুরো ছবিতে পরিচালক যেভাবে তুলে এনেছেন আফগান নারীদের বাস্তবচিত্র, তা অবশ্যই প্রশংসার দাবী রাখে। সেই সাথে তার দৃষ্টিভঙ্গিরও, যেখানে তিনি পুরো ছবিটাই নির্মাণ করেছেন শিশুদের দৃষ্টিকোণ থেকে, এমনকি আফগান-আমেরিকানদের যুদ্ধকেও দর্শকের সামনে তুলে ধরেছেন শিশুসুলভ খেলার মাধ্যমে, চরমভাবে, বিন্দুমাত্র বাস্তব যৃদ্ধদৃশ্যের নির্মমতা না দেখিয়েই।

পরিশেষে বলতে চাই বিশ্বচলচ্চিত্রে শিশুরা যে কত বড় অবদান রাখছে, এবং কী অসাধারণ ও সাবলীল অভিনয় উপহার দিয়ে যাচ্ছে আমাদের, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে হানা মাখলবাফের এই ছবিটি। বিশেষ করে এর প্রধান চরিত্রে অভিনয় করা ’বাখ্তা’ নামে ’নিবাখত্ নওরোজের’ অভিনয় আমাদের মুগ্ধ না করে পারেনা। ধন্যবাদ হানাকে, এরকম একটি অনবদ্য ছবি চলচ্চিত্রপ্রেমিদের উপহার দেয়ার জন্য, যেখানে তিনি চোখে আঙুল দিয়ে আমাদের দেখিয়েছেন, কিভাবে নারীরা রোজ রোজ নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, যা থেকে মুক্তির জন্য শেষ পর্যন্ত তারা বেছে নিচ্ছে বাখ্তার মত স্বেচ্ছা মৃত্যুকে। ছবির শেষে বালকদের খেলাচ্ছলে করা গুলিতে বাখ্তার মিথ্যে মৃত্যুদৃশ্য অনন্ত সেই বার্তায় পৌঁছে দেয় আমাদের ঘুণে ধরা মানবতার কাছে।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.