আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মরমি কবি হাছন রাজা

পঙ্খিরাজে চাদেঁর দেশে

বাড়ির পাশে হাছন রাজার রামপাশা ফয়জুল আলম বেলাল হাছন রাজা! নামটির সাথে ছোটবেলা থেকে পরিচিত। তবে মরমী কবি হিসেবে নয়; দুর্দান্ত জমিদার হিসেবে। আমাদের বাড়ির পাশেই তাঁর বিখ্যাত জমিদারী ‘রামপাশা’। যেখানে চিরনিন্দ্রায় শায়িত আছেন তার পুত্র দেওয়ান একলিমুর রাজা চৌধুরী সাহিত্যবিশারদ ও পৌত্র দেওয়ান তৈমুর রাজা চৌধুরী। কবিতায় লেখেছি ‘মরমী সুর আমার মনে জাগায় ভালোবাসা,/ উত্তরেতে হাছন রাজার রঙ্গেঁর রামপাশা’।

আমাদের এলাকায় বয়োজ্যেষ্টদের মুখে তাঁর সুখ্যাতির চেয়ে কুখ্যাতি বেশি শুনা যেত। কেউ হয়তো তাঁকে দেখেছেন। আবার কেউ কেউ না দেখেও লোকমুখে শুনে এসব কথা বলতেন। কিন্তু কেন জানি কেউ তাঁর সম্পর্কে বাজে কিছু বললে আমার কচি মনে খুব আঘাত পেতাম। কিন্তু যত শুনি তত তাঁকে জানার আগ্রহ জাগে।

আমার চাচা শাহ্ মখলিছুর রহমান বলেছেন, তিনি বড় দাদাকে (দাদার বড় ভাই হাজী শাহ্ রহিম আলী) জিজ্ঞেস করেছিলেন হাছন রাজা দেখতে কেমন ছিলেন? তিনি বলেছেন রাজার বেটা রাজা, যেমন লম্বায় তেমন দেহে। বিশিষ্ট গবেষক সৈয়দ মুর্তাজা আলী রচিত ‘হজরত শাহ্জালাল ও সিলেটের ইতিহাস’ গ্রন্থে লেখেছেন হাছন রাজা ছিলেন পরম সুপুরুষ। তার বর্ণ ছিল কাঞ্চন সদৃশ। দীর্ঘায়ত চক্ষু, উন্নত নাসিকা ও প্রশস্ত ললাট তার বদন মন্ডলে শোভা বর্ধন করত। ছেলেবেলায় তাকে দ’ুএকদিন দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।

হাছন রাজা ঘোড়ায় চড়ে মাঝে মাঝে তাঁর জমিদারীর সীমান্ত ঘুরে দেখতেন। আমাদের বাড়ির পাশে তাঁর জমিদারীর এক সীমান্ত ছিল। হাসন নগর নামে পরিচিতি। কিন্তু কালের গর্ভে এই নাম বিলীন হয়ে গেছে। বর্তমান প্রজন্ম ভুলেও এই নাম শুনেনি।

পুরাতন সরকারী কাগজপত্রে এখনো পাওয়া যায়। দুই হাজার ছয় সালের ভোটার তালিকা লিপিবদ্ধ করার জন্য দায়ীত্বশীল কর্মীরা বাড়িতে আসেন। তারা আমাদের বাড়ির ভোট নিবন্ধন করে বলেন, ইলামের গাঁও কি আর কোন ঘর আছে? আমার বড় চাচা হাজী শাহ্ ওয়ারিছ আলী হাত দিয়ে সারা গ্রাম দেখান! তারা বলেন ঐ দিক তো হাছন নগর। তিনি বলেন এই নামতো বিলিন হয়ে গেছে। এখনো দেখি তোমাদের রেকর্ডে রয়ে গেছে।

সুভাগ্যক্রমে ঐদিন আমি বাড়ি ছিলাম এবং ঐ নাম দেখার সুযোগ হয়েছিল। নতুবা আমারও অজান্তে থেকে যেত। হাছন রাজার ‘রামপাশা’র বাড়ি থেকে আমাদের বাড়ি মাইল দেড়েক দক্ষিণে। ছোটবেলা থেকে জানতাম এটাই তার একমাত্র বাড়ি। কিন্তু যেথায় তাঁর জন্ম ও মৃত্যু সেই সুনামগঞ্জের লক্ষণশ্রী সম্পর্কে কিছুই জানতাম না।

রামপাশায় অর্ধনির্মিত পরিত্যক্ত বাড়ি দেখেই মনে হত ‘লোকে বলে বলেরে/ ঘর বাড়ি ভালানায় আমার/ কি ঘর বানাইমু আমি/ শুন্যের ও মাঝার...। হাছন রাজার এই ভাঙ্গা বাড়ি দেখে ছোট বেলা থেকে অভ্যস্থ। বাড়ির পাশ দিয়ে অনেকবার গিয়েছি। কখনো জমিদারের বা মরমী কবির বাড়ি হিসেবে দেখার আগ্রহ জাগেনি। কিন্তু যখন শুনি লক্ষণশ্রীর কথা, সেখানে তাঁর কবর অবস্থিত।

সদ্যোত্তীর্ণ কিশোর মন খুব উদগ্রীব হতে থাকে দেখার জন্য। দিন দিন তাঁর গানের প্রতি ও আকর্ষণ বাড়তে থাকে। দশ-বরণ্য কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ ‘আগুনের পরশমনি’ চলচ্চিত্রে শাম্মি আখতারের কণ্ঠে ‘নিশা লাগিল... গানটি বিপাশা হায়াতের অভিনয়ে চিত্রায়িত করেন। এই গানের মাধ্যমে আমাদের প্রজন্মের কাছে হাছন রাজার গান ব্যাপকভাবে পরিচিতি লাভ করে। শাম্মি আখতারের কণ্ঠে একটি লাইভ অনুষ্ঠানে গানটি শুনে আরো মুগ্ধ হই।

হুমায়ূন আহমেদ ও একটি লেখক পাঠক মুখোমুখি অনুষ্ঠানে বলেন, তিনি ঢাকা শহরে রাস্তায় ফুল বিক্রেতা মেয়ের কণ্ঠে গানটি প্রথম শুনে মুগ্ধ হন। তারপর সংগ্রহ করে চলচ্চিত্রে চিত্রায়িত করেন। হাছন রাজা সম্পর্কে তারচেয়ে বেশি ধারণা ছিলনা। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৩০ সালে অক্সফোর্ড এ অনুষ্ঠিত হিবার্ট লেকচারে তাঁর সম্পর্কে কি বলেছেন! কিংবা বাংলা সাহিত্যের বরপুত্র সুনীল গঙ্গোঁপাধ্যায় ‘হাছন রাজার বাড়ি’ কবিতায় কি লেখেছেন, তা ও জানতাম না! ১৯৯৫ সালে ১০ জুন, তিন সহপাঠী আসাদ, শাহেদ, মোস্তফা ও আমাদের সিনিয়র নজরুল ভাই (বর্তমানে ব্রাডফোর্ড বাস করেন) কে নিয়ে সিলেট থেকে হাছন রাজার বাড়ি দেখতে সুনামগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই! আমার ঐ দিনের স্মৃতি ডাইরীর পৃষ্টা থেকে রোমন্তন; পবিত্র আশুরা উপলক্ষে আজ শনিবার ১০জুন ১৯৯৫ইং ছুটির দিন ছিল। দিনটি ভ্রমণের জন্য সিদ্ধান্ত করি।

আমরা চারজন হাছন রাজার বাড়ি কবরস্থান ও পাগলার মসজিদ দেখার জন্য সকাল দশটার দিকে মেস হতে বের হই। আম্বরখানা থেকে সুনামগঞ্জের গাড়িতে উঠি। কয়েকটি বাজার ও একটি ফেরী যাওয়ার পথে পাই। সব অতিক্রম করে সুনামগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে নেমে রিক্সায় শহরে যাই। যে শহরের রূপে গুণে মুগ্ধ হয়ে প্রয়াত পৌর সভার চেয়ারম্যান মমিনুল মউজদিন কবিতার বই লেখেছিলেন ‘এ শহর ছেড়ে আমি পালাবো কোথায়’! সত্যি পালানো যায় না।

বিস্তৃর্ণ হাওর অঞ্চলের মধ্যে একটুকরো ভূখন্ড। আমরা রিক্সা থেকে নেমে হেঁটে লক্ষণশ্রী গ্রামে হাছন রাজার বাড়ি পৌঁছি। সুরমা নদীর তীরে বাড়ি অবস্থিত। যেভাবে তিনি বলেছেন ‘সুখের আশায় করছিলাম পিরিত/ নদীর কুলে বইয়া....। ’ কিংবা ‘আমারে ভাসাইলায় আল্লাহ/ সুরমা নদীর গাঙে...।

’ আমরা বাড়ির একটি রুমে প্রবেশ করি। যেখানে হাছন রাজার একটি আর্ট করে বড় ফটো রাখা হয়েছে। দর্শনার্থীদের জন্য রুমটি খোলা। দুইটি সোফা ও কয়েকটি চেয়ার। রুমে আরো কয়েকটি ফটো তাঁর এবং ছেলেদের রয়েছে।

এক শোকেসের মধ্যে দুই জোড়া খড়ম। এক জোড়া তাঁর এবং এক জোড়া তাঁর অন্যতম স্ত্রী লবজান চৌধুরীর। তাছাড়া তাঁর জামা, তরবারী, একটি লাটি, পানদান ইত্যাদি সংরক্ষিত আছে। একটি বড় ফ্রেইমে বাঁধানো তাঁর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি। সহজে তাঁর জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো পড়ে জানা যায়।

তন্মধ্যে একটি ঘটনা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কয়েকজন বিদেশী পর্যটক একবার বাড়ির কাছে এসে তাঁকে জিজ্ঞেস করেন আমরা মরমী কবি হাছন রাজার বাড়ি যাব! কোন দিকে বলতে পারবেন কি? তিনি তাদের নিয়ে কবরস্থানে যান। যেখানে নিজের কবরস্থান ঠিক করে রেখেছেন। সেখানে গিয়ে বলেন এই আমার বাড়ি। পর্যটকরা বুঝে যায় তিনি-ই মরমী কবি হাছন রাজা।

তিনি এক সাথে রামপাশা ও লক্ষণশ্রী’র জমিদার ছিলেন। উভয় স্থানে পালকি চড়ে আসা-যাওয়া করতেন। পালকি অনেক বড় ছিল। তিনি ভিতরে ঘুমাতেন। হুক্কা ও প্রয়োজনীয় জিনিস ভিতরে থাকত।

আটজন বেহারা পালকি বহন করত। আমরা ঘন্টা খানেক তাঁর ব্যবহৃত জিনিস দেখে কবরস্থানের দিকে বের হই। বাড়ি থেকে খানিক দূরে পারিবারিক গোরস্থানে শায়িত আছেন। তাঁর কবর আলাদা দেয়ালের বেষ্টনিতে রাখা। কবরের দেয়ালে সফেদ পাথরের গায়ে খোদাই করে লেখা তাঁর অবিস্মরনীয় গানের চার লাইন ‘লোকে বলে বলেরে/ ঘর-বাড়ি ভালানায় আমার..’।

হাছন রাজার পূর্ব পুরুষের বাসস্থান ভারতের অর্ন্তগত বর্তমান মধ্য প্রদেশের বায়বেরিলিতে। তারা বাসস্থান ত্যাগ করে যশোহর জেলার কাপড়িয়া গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। বর্তমানে এই গ্রামের নাম কুনাউড়া। কয়েক পুরুষ অতিবাহিত হওয়ার পর তাঁর পিতা দেওয়ান আলী রাজা চৌধুরী সুনামগঞ্জের উপকণ্ঠে লক্ষণশ্রী গ্রামে এসে বসতি স্থাপন করেন। হাছন রাজার জন্ম ১২৬১ বাংলা ১২ই পৌষ।

তিনি গৃহেই বিদ্যার্জন করেন। পিতা ও বড় ভাইর অকাল মৃত্যুতে বিশাল জমিদারীর উত্তরাধিকারী হন। তিনি অত্যন্ত সুপরুুষ ছিলেন। শিকার তাঁর প্রিয় বেশন ছিল। সঙ্গিঁতে ব্যুৎপত্তি ছিলেন।

অশ্বারোহনে ছিলেন সুপটু। দান খয়রাত মুক্ত হস্তে করতেন। শোনা যায় তিনি এক প্রার্থীকে হস্তী দান করেছিলেন। নৃত্য গীতে সর্বদা বিভোর হয়ে থাকতেন। তিনি যে সব গান রচনা করতেন, তাল লয় সহকারে পরিজনের মধ্যে শিক্ষা দিতেন।

তাঁর ঐশ্বর্যের অভাব ছিল না। হাতি শালায় হাতি ছিল, ঘোড়া শালায় ঘোড়া। তিনি ঘোড়া দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করতেন। এই সম্পর্কে তাঁর অশ্বগুলির যথেষ্ট সুখ্যাতি ছিল। নৌকা বিহারে খুব শখ ছিল।

তিনি যেমন বিলাসী তেমন বৈরাগী ও ছিলেন। সহজ সরল জীবন যাপন করতেন। নয়নাভিরাম পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যান ২২শে অগ্রহায়ন ১৩২৯ বাংলা। যেভাবে তিনি বলেছেন ‘একদিন তোর হইবরে মরণরে/ হাছন রাজা......। ’ হাছন রাজার গানকে বিশ্ব দরবারে পরিচিত করার নৈপথ্যে যে ভূমিকা রাখেন তিনি প্রভাত কুমার শর্মা।

১৯২৪ সালে এম সি কলেজের ছাত্রাবস্থায় তিনি কলেজের পত্রিকায় ‘মরমী কবি হাছন রাজা’ শীর্ষক প্রবন্ধ লেখেন। এটি পাঠকের কাছে সমাদৃত হয়। তিনি বিপুল উৎসাহে হাছন রাজার আটটি গান নিয়ে শান্তি নিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে যান। কবি গুরু পড়ে আরো গান পড়ার আগ্রহ দেখান। প্রভাব কুমার পরে ডাকযোগে আরো পঁচাত্তরটি গান পাঠান।

ভারতীয় দর্শন কংগ্রেসের অধিবেশনে ১৯ ডিসেম্বর ১৯২৫ সালে কবিগুরু বলেন পূর্ব বঙ্গেঁর এক গ্রাম্য কবির গানে দর্শনের একটি বড় তত্ত্ব পাই। সেটি এই যে, ব্যক্তি স্বরূপের সহিত সম্বন্ধ সূত্রেই বিশ্বসত্য। তিনি ১৯৩০ সালে ম্যানচেষ্টার কলেজ অক্সফোর্ড এ অনুষ্ঠিত হিবার্ট লেকচারে প্রথম বাঙ্গালি আমন্ত্রিত হন। সেখানে মরমী কবির দুটি গান উল্লেখ করে তাঁকে বিশ্ব সভায় উপস্থাপন করেন। গান দু’টি (১) মম আঁিখ হইতে পয়দা আসমান জমীন..।

(২) রূপ দেখিলামরে নয়নে আপনার রূপ দেখিলামরে..। ১৯৩২ সালে ডিসেম্বর মাসে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র অধিবেশনে সুসাহিত্যিক কাজী আব্দুল ওদুদ, হাছন রাজাকে ‘প্রথম শ্রেণীর বাউল’ বলে উল্লেখ করেন। সুনীল গঙ্গোঁপাধ্যায়ের ভাষায় ‘এখানে এখন শুধু মুখোমুখি বসে রবো আমি আর হাছন রাজা... কওতো হাছন রাজা, কি বৃত্তান্ত বানাইলে মেনোহর বাড়ি? শিওরে শমন, তুমি ছয় ঘরে বসাইলে জানালা চৌখুপ্পি বাগানে এত বাঞ্চাকল্প তরুর কেয়ারি দুনিয়া আন্ধার তবু তোমার নিবাসে কত পিদ্দিমের মালা। ’ মরমী বাউল রাধা রমন, যে ভাবে বলেছেন গানের রাজা রাজা হাছন পাইলাম না তাঁর চরণ দর্শন! আমি তার মত আক্ষেপ বুকের ভিতর লালন করে চলছি।


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।