সুফিবাদী, যোগতান্ত্রিক, মরমি ধারায় সর্বোচ্চ মোক্ষমলাভের সাধনায় হাছন রাজার গানে এক নশ্বর দেহে অবিনশ্বর সত্তার বসত। এ ক্ষেত্রে গবেষক শামছুজ্জামান খানের সঙ্গে অনায়াসেই একমত হওয়া যায়- 'সামগ্রিকভাবে বাংলার এবং বিশেষভাবে সিলেটের বহু ধর্ম-দর্শন-পুরাণ'-এর সমন্বয়ে গড়া মরমিবাদ এবং নানা লোক-ধর্মের মানবিক চৈতন্যে ভাস্বর এক নিবিষ্ট-চিত্ত সাধক হাছন রাজা। ' ১৮৭৭ সালের আগে হাছন রাজার জন্মস্থান 'সুনামগঞ্জ' নামের কোনো অঞ্চলের অস্থিত্ব ছিল না, কিন্তু লক্ষনশ্রী নামে একটি পরগনা ছিল। সুনামগঞ্জ নামের উদ্ভবের ইতিহাসটি এই সূত্র ধরেই হাছন রাজার সঙ্গে মিশে আছে। আজ থেকে ৯০ বছর আগে কবির জ্যেষ্ঠপুত্র দেওয়ান গণিউর রাজা এই কৌতূহলপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন।
হাছন রাজার পূর্বপুরুষ
হাছন রাজার পূর্বপুরুষ ভরদ্ধাজগোত্রীয় সূর্যবংশোদ্ভূত রাজা রামচন্দ্র সিংহদেব যার বসবাস ছিল ভারতের বানারসে। উত্তরসূরি তিলোত্তম চন্দ্র সিংহদেব এক অজানা কারণে বানারস থেকে রায়বেরিলিতে এসে অযোধ্যার রাজ্যের আউদ রাজবংশীয় রাজকন্যাকে বিয়ে করেন। আউদ বংশী বিজয় সিং পরে বাংলাদেশে পাড়ি জমান। তিনি বর্ধমান, যশোর হয়ে সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার কোনাউরা গ্রামে আশ্রয় নেন। রাজা রনজিৎ সিংহদেব মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে তার নিজের আবাসস্থলটিকে স্থানান্তরিত করেন পার্শ্ববর্তী রামপাশা গ্রামে।
বংশ পরম্পরায় বসবাসের নিমিত্তে এ ধরনের অন্যত্র স্থানান্তর সত্যি এক কৌতূহলপূর্ণ ইতিহাস।
হাছন রাজারা ছিলেন চার ভাইবোন। বড়ভাই ওবায়দুর রাজা [১৮৩২-১৮৭১], বোন সহিফা বানু [১৮৫১-১৯১৭], মোজাফ্ফর রাজা [১৮৫৩-১৮৯৯] এবং কনিষ্ঠ হাছন রাজা [১৮৫৪-১৯২২]। হাছন রাজার জন্মের বছরটিতে বাংলাদেশে প্রথম চায়ের চাষ শুরু হয় এবং পঁচিশ-ছাবি্বশ বছর পর লাক্কারতুরা টি-গার্ডেনের গোড়াপত্তন ঘটে। তার জন্মের পর থেকেই মা হুরমতজান বিবি শিশুপুত্র হাছনকে যক্ষের ধনের মতো আগলিয়ে রাখতেন।
তার ছেলেবেলা ছিল অত্যন্ত আনন্দরসেপূর্ণ। হঠাৎ একদিন সেই শিশুর চোখে সেদিনের আবছা জগৎ যেন অনেক বড় হয়ে ওঠে। প্রকৃতির সঙ্গে হাছন রাজার পরিচয় শিশুকাল থেকেই। আর সুনামগঞ্জের প্রকৃতির প্রভাব আজীবন তাকে প্রভাবিত করেছে। মাটি, মানুষ আর প্রকৃতি এই তিন মিলে তার চিন্তাভাবনা, চেতনা, ভাষা আর শব্দচয়নের একটি মানসপট তৈরি হয়।
ছেলেবেলাতেই তার বাবা তাকে একবার সিলেটের একটি মাদ্রাসায় প্রাথমিক শিক্ষা নেওয়ার জন্যে পাঠিয়েছিলেন। আর এটাই হয় তার জীবনের একমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভ। এখানেই তার শিক্ষাজীবনের শুরু ও সমাপ্তি। তিনি আর একাডেমিক পড়াশোনা করেননি। কিন্তু শিক্ষা বিষয় নিয়ে হাছন রাজার সুদূরপ্রসারী মনের তাগিদ ও কর্মযজ্ঞ থেকে যায় পরবর্তীকালের জন্য।
অসাম্প্রদায়িক হাছন রাজা
হাছন রাজা ছিলেন একজন উদার অসাম্প্রদায়িক আর জাতিভেদহীন সমন্বয়বাদী সাধক কবি। সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে জাতি, শ্রেণী, মানুষে মানুষে মিলন কামনা করেছেন। তার দয়াময় প্রেমাস্পদকে চিনে নিয়ে সব মানুষকে এক হতে বলেছেন। সব জাতের আমিত্ব বিলীন করে মূর্তমান হয়েছে তার গানে- 'জাতে জাত মিশিয়ে যাবে/ আমিত্ব না রহিবে/ এক জাত হইয়া যাবে, হাছন রাজা কয়। '
তখনকার দিনে ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা, ঈদে মিলাদুন্নবী, মুহাররম পালিত হতো মহা ধুমধামের সঙ্গে।
লক্ষ্মীপূজা, সরস্বতীপূজা, কালীপূজা, দুর্গাপূজা আর জগন্নাথ পার্বনের রথযাত্রায় ধুমধামে ঢোল, ঢপকি, বাঁশি, কাঁসর, সারেঙ্গীর সুরধ্বনি, রঙিন পোশাকের সমারোহ আর নানা রঙের ছড়াছড়িতে হাছন রাজার রঙিন জগতটা যেন হয়ে উঠত কৃষ্ণলীলাময়।
হাছন রাজার ১৫ বছর বয়সে অবারিত জলরাশিতে প্রথম প্রেমের মোহাবিষ্টতা। তার অন্য একটি গানে সে কথার ইঙ্গিত রয়েছে- 'ঝলমল ঝলমল করেরে তারা/ ঝলমল ঝলমল করে/ নূরের বদন সই প্রেয়সিরে/নূরের বদন সই/ কেমনে করি তারে ছাড়া,/ বাড়িত আমি রই। / ওরে আমার আরিপরি ভাই/ হিন্দু আর মুসলমান আমি, কিছুই বুঝি নাই। ' কিন্তু কিছুদিনের মাঝে হাছন রাজা থেকে সেই অপূর্ব জনপ্রিয় গানটি কাব্যের রূপ ধারণ করল- 'দেওয়ানা বানাইল মোরে, পাগল করিল/ আরে না জানি কি মন্ত্র পড়িয়ে যাদু করিল।
' রামপাশায় বড় ভাই ওবায়দুর রাজার শরীরের অবস্থা আশঙ্কাজনক। একদিন সবার উপস্থিতিতেই ১৮৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ওবায়দুর রাজা ৩৯ বছর বয়সে অকালে মৃত্যুবরণ করেন। শোকাভিভূত হাছন রাজা ও বাবা আলী রাজা। আর ঠিক উনচলি্লশ দিনের মাথায় ইহলোক ত্যাগ করলেন বাবা আলী রাজা নিজে। আকাশ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা হলো হাছন রাজার।
'হাছন রাজা' চলচ্চিত্র ও তার স্ত্রীগণ
নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেকের যৌবনকালে উদ্দীপনা আর চঞ্চল-উচ্ছল প্রকৃতি মানুষের স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততা। হাছন রাজার জীবনেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। কিন্তু কোনো কোনো লেখক ও চলচ্চিত্রনির্মাতা তাদের বই কিংবা চলচ্চিত্রে হাছন রাজার স্বভাব প্রকৃতিকে সাজিয়েছেন বস্তুনিষ্ঠার বাইরে অতিরঞ্জন হিসেবে। এই আলোকে তার জ্যেষ্ঠপুত্র গণিউর রাজার দেওয়া তথ্য থেকে জানা গেছে, হাছন রাজা অল্প বয়সে এক কঠিন অবস্থার মাঝে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন। যখন রামপাশায় অবস্থান নিতেন, তখন বৃদ্ধ কটাইর মা'র ঘরটিতে তক্তা মোড়া দিয়ে একটি কাঠের বাঙ্রে মতো করে তাতে তিনি রাতযাপন করতেন।
কটাইর মা'র নিরাপদ আশ্রয়দান হাছন রাজা কোনোদিন ভোলেননি, স্নেহ-উপকারের স্বীকৃতিস্বরূপ হাছন রাজা তার জন্য জমি, নিয়মিত ভাতা ও আবাসের ব্যবস্থা করেন।
হাছন রাজা তার বাড়ির পরিচয় দিয়েছেন এভাবে- 'হাছন রাজা মইরা যাইব না পুরিতে আশা/ লক্ষণছিরির জমিদারী বাড়ী রামপাশা। ' লক্ষণশ্রী সুনামগঞ্জের একটি অন্যতম বৃহত্তর পরগণা। হাছন রাজার সময়কালে বর্তমান সুনামগঞ্জ শহরটি এই পরগণার অধীনে ছিল।
হাছন রাজার বয়স তখন ষাট।
ক'জন বিদেশি ভদ্রলোক তার বাড়ি দেখতে যান। হাছন রাজার তখন কবর তৈরি হচ্ছিল। সেই চিরদিনকার বাড়ির দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে তিনি নিজেই লিখেছেন- 'এই দেখুন আমার বাড়ী। ' হাছন রাজার এই আত্দানুভূতি এবং পরমাত্দানুভূতি দুই মিশিয়ে এক উচ্চানুভূতিতে ধরা পড়েছে তার মনস্তাত্তি্বক ঘরবাড়ির নিদর্শন। শুধু তাই নয়, বাড়ি সংক্রান্ত আরও তথ্য পাঠককে নুতন চিন্তার দ্বার উন্মোচন করাবে।
দুর্যোগকালে হাছন রাজা
১৮৬৯ এবং ১৮৯৭ সালের প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় মানুষের দুঃখ-দুর্দশায় হাছন রাজা মর্মাহত। কিন্তু হাছন রাজা যেমন দুর্যোগের ভয়াবহতায় তটস্থ, ঠিক তেমনি গানের আসরের এক নিবেদিতপ্রাণ 'জীবনের মা'র খবরটুকু নিতেও ভোলেননি। এমন মহাপ্রাণই সব প্রাণের স্পর্শে উদ্গ্রীব ছিলেন। ভূমিকম্পের কিছুদিন পর একদিন মামাতো ভাই আবদুল জব্বার চৌধুরী তাকে জিজ্ঞাসা করলেন- দেশের লোকে বলছে এ কেমন দৈন্যদশা হাছন রাজার বাড়ির! কবে এই বাড়িকে সুন্দর প্রাসাদতুল্য বানাবেন? উত্তরে রাজা বলেন- 'লোকে বলে, বলেরে ঘর-বাড়ী ভালা নয় আমার/ কি ঘর বানাইমু আমি শূন্যের মাঝার। / লোক-প্রীতির প্রবল টানে বিচারকার্য।
' চলি্লশোর্ধ্ব বয়স-সীমায় অসংখ্য সামাজিক ও সাধারণ বিষয়-আশয় নিয়ে বিচার-অভিযোগগুলো তিনি সন্তোষজনকভাবে সুরাহা করে দিতে থাকেন।
আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক হাছন রাজা
গাছপালার গুণাগুণে হাছন রাজার আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা- জ্ঞানের কথা শুনলে সত্যি শ্রদ্ধাভরে মাথা নত করতে হয়। স্বাস্থ্য সচেতনতাবোধই তার এই আয়ুর্বেদ চিকিৎসা বা হেকিমি চিকিৎসা-জ্ঞানের প্রতি আগ্রহ জন্মিয়েছিল। আরও বৃত্তান্তের সঙ্গে জানা যাবে তার 'হেকিমি চিকিৎসা শাস্ত্র' নামক বইটি বড় কন্যা রওশন হোসেন বানুর কাছে রক্ষিত ছিল।
মানুষের হৃদয়ে হাছন রাজা
মানব প্রেমী, অনুন্নাসিক হাছন রাজা সবসময়ই মানুষের মাঝে খুঁজেছেন সৃষ্টির উৎস- পরমসত্তা।
হাছন রাজার মানসলোকের পরিচয় তার রচিত গানের ভেতর। বাস্তবজীবনের পরিচয় ফুটে উঠেছে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনার মধ্যে। বৌদ্ধ, বৈষ্ণব ও সুফি সাধনা-চিন্তা-চেতনা সমন্বিত হাছন রাজার চিত্ত তথা পরম প্রজ্ঞা 'হাছনজান'কে পেয়েছেন অতি কাছে। তাই তো তার কথা- 'আমি ভিন্ন এ সংসারে কিচ্ছু নাই আর/ আগে হাছন পাছে হাছন/ হাছন রাজাই সার/ হাছন রাজা ভিন্ন সংসারে কিচ্ছু নাই আর' আবার, 'আমি হইতে আসমান জমিন/ আমি হইতে সব। / আমি হইতে ত্রিজগৎ/ আমি হইতে রব'
হাছন রাজা উন্নাসিক নয় বা দাম্ভিক নয়।
প্রেমাস্পদের বাইরে কোনো জগৎ নেই বলে তিনি কখনো বলতে পারেন নি 'আমি কখনোই আসমানি খোদাকে মান্য করি না। ' বরঞ্চ আসমান জমিন একাকার করে তিনি ত্রিজগতের সেই পরম সত্তার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলেন, তাকে অনুধাবন করেই তার পদে লুটিয়ে পড়ার আকাঙ্ক্ষায় ছটফট করছিলেন। আর সেজন্য জমিদার হওয়া সত্ত্বেও ভাবুক হাছন রাজার মাঝে সম্পূর্ণভাবে অত্যাচার-অবিচার প্রবণতার অভাব ছিল। স্বার্থের ঊর্ধ্বে থেকে পরোপকারই বড় করে দেখেছেন। জানতে পারেন- কেনো হাছন রাজাকে ভুল বুঝা হলো।
নিচের গানটি লক্ষণীয়- 'কেন যে আসিলায় ভবে, মানুষ যদি হইলায় না/ মানুষ কেন হইলায় নারে, পরের কার্য করলায় নারে। / মানুষের উপকার করা, সে বিনে আর কিছু নয়রে / হাছন রাজার এই নয় মত, নয় ভাই এই পন্থ/ পরোপকার কর যত পার, মন্দ কারো করিও নারে / এ ব্যাপরে বিষদ নূতন তথ্যের উদঘাটন রয়েছে নূতন আলোকে। '
পর্যটক হাছন রাজা
হাছন রাজার মরমি দার্শনিক বিচরণ বলতে মূলত তার নৈসর্গিক এক পর্যটকের পরিক্রমণের মতো ছিল। সেই পর্যটনে তার ভেতর-বাইর বিচরণ করে রঙের মানুষকে খোঁজে দেখার এক অন্তহীন প্রয়াস। প্রিয়ার জন্য তিনি পাগল হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন জীবনভর।
'ঘরে থাকে বাইরে থাকে/ থাকে সে অন্তরে/ তার লাগিয়া পাগল হইয়া/ হাছন রাজা ফিরে। ' এ বিশ্ব সংসারকে একটি বিস্তৃত মহাসাগর-রূপ নিজের চোখে অঙ্কিত করেছেন এবং নিজেকে এক ভাসমান তৃণখণ্ডরূপে ধারণা করে বলেছেন- 'আল্লা ভব সমুদ্দরে ও আল্লা ভব সমুদ্দরে/ তরাইয়া লও মোরে...। ' কিন্তু এই মরমি পরিক্রমণের বাইরে হাছন রাজা তার বাস্তব জীবনে দেশ, অঞ্চল পর্যটন করেছিলেন কী?
তার জ্যেষ্ঠ পুত্র দেওয়ান গনিউর রাজার লেখায়- হাছন রাজা মূলত একজন ভ্রমণবিলাসী জমিদার। তার অনুসন্ধিৎসু মনের কারণেই তিনি ছিলেন একজন সচেতন পর্যটক। ছেলেবেলায় যেমন পাখির পিছন পিছন ঘুরে বেড়িয়েছেন, টাঙ্গুয়ার হাওর, কাঙলার হাওর, দেখার হাওর, ঝাওয়ার হাওর, কুইয়া বিল, চন্দার বিল, রক্তি নদী প্রভৃতি ঠিক তেমনি দূরে দৃষ্টি নিয়ে বরাক নদীর উৎস থেকে সুরমা-কুশিয়ারা বিভক্তিতে, আজমিরিগঞ্জ পার হয়ে মেঘনার উপত্যকায় কিংবা গোয়ালন্দ পর্যন্তও নৌ-ভ্রমণে কসুর করেননি।
বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার আশপাশ ঘুরতেও হাছন রাজার সুযোগ হয়েছিল প্রচুর। কলকাতার সর্বপ্রথম ভ্রমণকালে ইংরেজদের কর্তৃক নির্মিত আলীপুর চিড়িয়াখানাটি দেখে নেন। তার তিরিশ বয়সে, পূর্বসূরিদের সময়ের আসামের রাজধানী হিসেবে চেরাপুঞ্জি দেখার কৌতূহলে ১৮৮৪ সালে হাছন রাজা সেই দুর্গম স্থানে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন। সঙ্গে আরপিন নগর নিবাসী কাদির বঙ্ মিয়া। ওই সময় চেরাপুঞ্জি থেকে ফেরার পথে মুসমাই, মহাদেব বাজার এবং মহাদেব টিলা পার হন।
১৮৯৪ সালের দিকে ঘোড়দৌড় উপলক্ষে ঢাকায় হাছন রাজা আসেন রেসকোর্স ময়দানের পাশর্্ববর্তী কালীবাড়ি মন্দিরটি পরিদর্শন করতে। কলকাতায় হাছন রাজার জীবনের শেষ সফরটি ছিল ১৯১৪ সালে। ১৯১৬ সালে ঢাকায় শেষবারের মতো সফর করেন ।
তার সৌন্দর্যবোধ ও প্রকৃতিপ্রেম
'সুনামগঞ্জের আধা-গ্রাম শহরে তখন গাড়িঘোড়া যানবাহন বলতে কিছুই ছিল না, সেই সময় হাছন রাজার বৈকালিক ভ্রমণের একটি সুন্দর চিত্র খুঁজে পাওয়া যায়। জোছনা রাতে হাছন রাজার বজরাতে গানের আসর।
ভাসমান বাড়ির মতো ছিল তার বজরা। গানের জলসা ঘর, তার ও স্ত্রীদের জন্য দুটি শোয়ার কক্ষ, বাবুর্চিখানা, পরিচারক-পরিচারিকাদের সতন্ত্র কক্ষ এবং সেই আমলে এই নৌকায় গোসলখানা ও সৌধখানার অস্তিত্ব। শেষ বয়সে এই শখের বজরাখানি তার দ্বিতীয় পুত্র দেওয়ান হাছিনুর রাজার কাছে চলে যায়।
হাছন রাজা ছিলেন চরম সৌখিন মানুষ। কুড়া, দোয়েল, ময়না, সারস ও মুনমুনিয়া পাখি ছাড়াও তিনি হাতি, ঘোড়া নিয়ে তার বহু কাহিনী ও মজাদার গল্প রয়েছে।
এদের বিবরণে হাছন রাজার ২৯১টি কুড়ার নাম, দোয়েল, ময়না, হাতি, ঘোড়ার বিশদ বিবরণ উঠে এসেছে। ১৮৯৪-৯৫ খ্রিস্টাব্দের দিকে হাছন রাজার জাঁদরেল ঘোড়া জংবাহাদুর আর চান্দমুস্কি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে নওয়াব আহসান উল্লাহর অপরাজিত দরিয়াবাজ ঘোড়াকে পরাজিত করে। এই স্মৃতিকে চির জাগরুক রাখার উদ্দেশ্যে তিনি তার জমিদারিতে একটি নতুন গ্রাম স্থাপন করেন 'দরিয়াবাজ' নামে। পশু পাখির প্রতি অদম্য আগ্রহ ছাড়াও হাছন রাজার যে দাবাখেলা ও পাশাখেলার দারুণ শখ ছিল- তা বিস্তারিত জানতে গেলে সত্যি অভিভূত হতে হয়। তার গানে- 'রসিক হাছন রাজা/পাগল হাছন রাজায়/ কিসেতে কি কয়/ মরব, মরব দেশের লোক/ মোর কথা যদি লয় ' হাছন রাজা নিজেকে পাগল ঠাউড়াচ্ছেন অথচ আশা করছেন দেশের লোকে যদি তার কথাটি শুনে।
কেমন তরো এই কবি হাছন রাজা। তাও আবার জানিয়ে দিচ্ছেন উনার মরনের কথাটি। দেখা যায় হাছন রাজার প্রচুর গানে এই ধরনের চটুল বাক্য কিংবা কৌতুকপূর্ণতা খুঁজে পাওয়া যায় তার মরমি গানের একটি আলাদা বৈশিষ্ট্য হিসেবে। রস কথায় প্রথিতযশা ও বিখ্যাত 'দেশে বিদেশে'র লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী হাছন রাজাতে পেয়েছেন প্রচুর রসবোধ। সুনামগঞ্জ, বিশ্বনাথ এলাকায় মেলা বসানোর কাহিনী।
সে-সময় হিন্দু-মুসলমানদের নিয়ে এই মেলার কমিটি হতো। তার মেলার খবর তখন গ্রাম গ্রামান্তরে, শহর শহরান্তরে পৌঁছে যেত। তার গান শুনতে গায়করা ভিড় জমাত।
গুরু মুর্শিদের দেখা
ইতিহাসের পাতায় ১২ জুন ১৮৯৭ সালে আসাম ও সিলেটজুড়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় একটি ভূমিকম্প হয়েছিল ৮.৮ রিকটার স্কেলে। হাছন রাজার বয়স ছিল তখন ৪৩ বছর।
সীমাহীন ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞে হাছন রাজার অন্তরাত্দা কেঁপে ওঠে। দেখা হয় তার বন্ধের সাথে। 'ভৈশালের বৎসরে বন্ধে দরশন দিলরে/ দয়া করিয়া আমার সঙ্গে কথাবার্তা কইলরে। ' সেই সঙ্গে গুরু মুর্শিদ অন্বেষণে বেরিয়ে পড়েন হাছন রাজা।
তার শেষ সময়
নানা সম্ভাবনাময় দিকগুলো বিবেচনা সাপেক্ষে বলা যায় যে, হাছন রাজার বয়স্কালে তার চিন্তাশক্তির প্রখরতা ছিল অনেক ঊধের্্ব।
ষাটোধর্্ব হাছন রাজার তখন একটি প্রেরণাই ছিল তার গানের খাতা গানে গানে ভরিয়ে দেওয়া। সে-কারণে হাছন রাজার ওপর বেশ কিছু চিন্তক-চিন্ময় ব্যক্তি মনে করেন যে, হাছন রাজা যে পরিমাণে গানের সম্ভার লিখেছিলেন সেই পরিমাণ গান এখন পর্যন্ত পর্যাপ্ত উদ্ধার করা বা প্রকাশ করা যায়নি। আর এমনি অবস্থায় এক দিন তিনি বাইরে-ভেতরে স্বজন-পর সব লোকের কোলাহল থেকে মুক্ত হয়ে সম্পূর্ণ একাকী হয়ে যান। নির্লিপ্ততার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তার গানের ভুবনে এত কাছে থেকে কারা সুরের জলসার পরিবেশটি জিইয়ে রেখেছিলেন। ১৯১৭ সালে বোন সঈফা বানুর পরলোকগমন কালে তিনি সেদিন সিলেটে ছুটে এসেছিলেন।
এই আধ্যাত্দিক কবি হাছন রাজার মানসচক্ষে ধরা পড়ে পৃথিবীর শূন্যতা। তিনি অনুভব করেন এই মায়াবিনী পৃথিবীতে আল্লাহ ছাড়া সবই শূন্য। তিনি নিজেই সে কথা বলেছেন- 'কান্দিয়া হাছন রাজায় বলে আল্লা কর সার/ কি ভাবিয়া নাচ হাছন শূন্যেরও মাজার। ' হাছন রাজার সবংশেষ ১৯২০ সাল সিলেট এসেছিলেন। তিনি তখন ভীষণ অসুস্থ।
বিদায়ের ঘণ্টা শোনার আগে কীভাবে সিলেট শহর এবং তার রঙিন রামপাশাকে বিদায় দিলেন। মর্মকাতর সেই সময়টিতে কীভাবে হাছন রাজা তার গানের এক পাগল ভক্ত বলরিয়াকে দিয়ে এই গানটি গাইয়ে নিলেন- 'আর কতদিন ভাঙ্গা বজরা ঠেলিব/ বজরা যে পুরান হইছে,/ রুককাঠ পচে গেছে,/ হুতারগিরি নাহি জানি/ কেমনে গড়িব/ বজরা যে পুরানা মোর,/ কেমনে থাকি তার অন্দর/ বজরা দেখি লোকে হাসে, ছাড়িয়া যাইব। '
১৯২২ সালের ৬ ডিসেম্বরে তার তিরোধানে হাজার হাজার ভক্ত, অনুরক্ত, বন্ধু, পোষ্য, প্রজা এবং প্রকৃতিকে ছেড়ে দেওয়ান হাছন রাজা, তার একান্ত কাঙ্ক্ষিত সর্বশক্তিমান প্রেমাস্পদের কাছে প্রত্যাবর্তন করলেন। এই খবর চতুর্দিকে প্রচারিত হলে দূরদূরান্ত থেকে বিভিন্ন ধর্মের অসংখ্য মানুষ তাকে শেষবারের মতো দেখার জন্য ছুটে আসে। তার তিরোধানে আত্মীয়স্বজনসহ সবাই শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে।
এই ভাবুক মনের কবিকে হারিয়ে সেকালের সুনামগঞ্জ এলাকা ছাড়িয়ে সমগ্র সিলেটের লোকেরাই একটি গভীর শোকের ছায়া দ্বারা আবৃত হলেন। হাছন রাজার প্রকাশিত বই তিনটি যথা- 'হাছন উদাস', 'হাছন বাহার' এবং 'সৌখিন বাহার'। তিনি প্রায় সাতশ গান লিখেছিলেন। আজও হাছন রাজা রয়েছেন মানুষের প্রাণে। তার গান চিরকাল বাঙালির প্রাণে বেজেই চলবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।