মানুষ আর প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য হলো-চেতনাগত ও সংস্কৃতিগত।
‘আজ এই আম্রকাননে একটি নতুন জাতি জন্ম নিল। বিগত বহু বছর যাবত বাংলার মানুষ, তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি-ঐতিহ্য-অধিকার নিয়ে এগুতে চেয়েছেন। কিন্তু পাকিস্তানী কায়েমী স্বার্থ কখনই তা হতে দিল না। ওরা আমাদের ওপর আক্রমন চালিয়েছে।
আমরা নিয়মতান্ত্রিক পথে এগুতে চেয়েছিলাম, ওরা তা দিল না। ওরা আমাদের উপর বর্বর আক্রমন চালাল। তাই আজ আমরা লড়াইয়ে নেমেছি। এ লড়াইয়ে আমাদের জয় অনিবার্য। আমরা পাকিস্তানী হানাদারদেরকে বিতাড়িত করবোই।
আজ না জিতি কাল জিতিবো। কাল না জিতি পরশু জিতবোই। আমরা বিশ্বের সব রাষ্ট্রের সাথে শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান চাই। পরস্পরের ভাই হিসেবে বসবাস করতে চাই। মানবতার, গণতন্ত্রের এবং স্বাধীনতার জয় চাই।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------আমাদের রাষ্ট্রপতি জননন্দিত মহাপুরুষ, নির্যাতিত মানুষের মূর্ত প্রতীক শেখ মুজিব। তিনি বাংলার মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের জন্য লড়াই-সংগ্রাম করে আজ কারাগারে বন্দী। তাঁর নেতৃত্বে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম জয়ী হবেই’-- অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। (১৭ এপ্রিল ১৯৭১ সালে মুজিব নগরে (মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথ তলা) শপথ অনুষ্ঠান শেষে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এক সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন, তার কিছু অংশ উল্লেখ করা হল)।
ইংরেজ বাধ্য হয়ে চলে গেল।
সৃষ্টি হলো পাকিস্তান। পাকিস্তানী শাসন-শোষণ, নিপিড়ন, নির্যাতন ও নৃশংসতার বিরুদ্ধে দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র-রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে জন্ম নিল স্বাধীন বাংলাদেশ। স্থপতি জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁকে হত্যা করলো (১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট) তাঁরই সহচর খন্দকার মোশতাক। তাঁরপর ওই মোস্তাক গংরা ২০ আগস্ট জাতীয় চার নেতা_অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহম্মেদ, অর্থমন্ত্রী এম মনসুর আলী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ.এইচ.এম কামারুজ্জামানসহ ২০ জনকে গ্রেফতার করে।
তারা ১৯৭৫ সালের ৩ নবেম্বর জাতীয় ৪ নেতাকে জেলখানার মধ্যে হত্যা করে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এই জাতীয় চার নেতার অবদান শুধু উল্লেখ্য নয়, চিরস্মরণীয়। আজ বৈরী পরিবেশের কালপ্রবাহে স্বাধীনতা সংগ্রামের এই কালজয়ী লড়াকু যোদ্ধারাদের অমার্জনীয় বিস্মৃতির অতলে ঠেলে দেবার যতই অপচেষ্টা করা হোক না কেন_তা বাংলার ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। বাংলাদেশ সৃষ্টির পূর্বে জাতীয় ইতিহাসের একটি গুউরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে তাদের ভূমিকা চির উজ্জ্বল ও ভাস্কর হয়ে থাকবে। এ জাতি কোনো দিনও তাঁদের ভুলবে না।
সৈয়দ নজরুল ইসলামের জন্ম ১৯২৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি। কিশোরগঞ্জ জেলার সদর থানার যশোদল দামপাড়া গ্রামে। পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবার থেকে। তারপর মিডল ইংলিশ স্কুলে। এরপর কিশোরগঞ্জ আজিমুদ্দিন হাই স্কুল ও ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে পড়াশুনা করেন।
ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে ১৯৪১ সালে তিনি প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক ও ১৯৪৩ সালে আনন্দমোহন কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আই.এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালইয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের থাকাকালে তিনি রাজনীতির সাথে যুক্ত হন। এই হলের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে তিনি ক্রীড়া সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৭-৪৮ সালে সলিমুল্লাহ্ মুসলিম হলের সহ-সভাপতি ও কিছুদিন পরে মুসলিম ছাত্রলীগের সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৪৮ সালে মাষ্টার্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পূর্বে তিনি আনন্দমোহন কলেজে অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন। পরবর্তীকালে অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ইতিহাসে প্রথম শ্রেণীতে মাষ্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৪৯ সালে সি.এস.পি পরীক্ষা দেন এবং এতে উত্তীর্ণ হয়ে কর বিভাগে অফিসার পদলাভ মাত্র এক বছর সেই চাকরী করেন।
১৯৫০ সালে তিনি ভালোবেসে কটিয়াদীর নাফিসা ইসলামকে সহধর্মিনী করেন। ১৯৫১ সালে তিনি সরকারি চাকুরীতে ইস্তফা দিয়ে ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে পুনরায় অধ্যাপনায় ফিরে আসেন।
অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি আইন পড়া শুরু করেন। আইনে পাশ করে তিনি ১৯৫৫ সালে ময়মনসিংহ বার কাউন্সিলে যোগ দিয়ে এই পেশাকে জীবনের ব্রত হিসেবে বেছে নেন।
তিনি শেখ মুজিবের রাজনৈতিক দর্শন ও ভাবাদর্শের অংশীদার ছিলেন। তাঁর দ্বারা প্রভাবিতও ছিলেন। দেশপ্রেমের মন্ত্রে ছিলেল উজ্জীবিত।
তাই সাধারণ মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন করার লক্ষ্যকে সামনে রেখে জন্য যোগ দেন আওয়ামী লীগেক। ১৯৫৭ সালে তিনি বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। রাজনীতি তাঁর ধ্যান-জ্ঞানে পরিণত হয়। আওমীলীগকে সংগঠিত ও শক্তিশালী করার জন্য তিনি চষে বেড়িয়েছেন সারা দেশ। এ কারনে সারা দেশে তাঁর ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা ছিল।
তাই শেখ মুজিবুর রহমান বিভিন্ন সফরে তাকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। ১৯৬৪ সালে তিনি অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে সিনিয়র সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়ে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত এ পদে অসীন ছিলেন। ১৯৬৬ সালে তিনি দেশব্যাপী ৬ দফার পক্ষে প্রচারণা চালান ও জনমত গড়ে তোলেন। ১৯৬৬ সালের ৯ মে দেশের সঙ্কটময় মুহূর্তে সৈয়দ নজরুল আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। নিষ্ঠার সাথে সে দায়িত্ব পালন করেন ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত।
১৯৬৮ সালে শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামী করে আগড়তলা ষড়যন্ত্র (তথাকথিত রাষ্ট্রদ্রোহী) মামলা দায়ের করা হয়। সৈয়দ নজরুল এ মামলায় শেখ মুজিবুরের অন্যতম আইনজীবীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যূত্থানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ‘ডেমক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি’ নামে একটি সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠন করে। তিনি এই কমিটির গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে নেতৃত্বের অগ্রভাগে চলে আসেন। তিনি ‘ডেমক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি’র আট দফা এবং ছাত্রসমাজের ১১ দফা কর্মসূচি খুবই দক্ষতার সাথে সমন্বয় সাধন করেন।
গণঅভ্যূত্থানের প্রবল জনমতের চাপে শেখ মুজিবসহ জাতীয় নেতৃবৃন্দ মুক্তি পান। সৈয়দ নজরুল ১৯৭০-এর নির্বাচনে ময়মনসিংহ-১৭ আসন থেকে এম.এন.এ নির্বাচিত হন। তিনি সেই ঐতিহাসিক নির্বাচনে জয়লাভের পর আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের উপনেতা নির্বাচিত হন। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বাংলার মানুষের রায়ে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাংলার মানুষের হাতে ক্ষমতা দিতে অস্বীকার করে।
সারা বাংলা জুড়ে শুরু হয় আন্দোলন-সংগ্রাম। বাঙালি দাবানলের মতো জ্বলে ওঠলো। নানা টালবাহানা শেষে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাংলার নিরীহ-নিরাস্ত্র জনতাকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গভীর রাতে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। ২৫ মার্চ দুপুরবেলা শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব-পাকিস্তান ডি.এফ.আই চিফ মারফত গোপন খবরে অবগত হন যে, রাতে ঢাকায় ক্রাকডাউন হতে যাচ্ছে। দ্রুত শেখ মুজিব হাইকমান্ড এবং অন্যান্য নেতাদের গোপন আশ্রয়ে যাবার নির্দেশ দেন।
২৫ মার্চ রাতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাড়ি থেকে শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হলে সৈয়দ নজরুল ইসলাম আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২৫ মার্চের ধ্বংসযজ্ঞের পরদিন আওমীলীগ ও কমিউনিষ্ট পার্টির নেতারা গোপনে যোগাযোগ রেখে প্রায় সকলে সীমান্ত পার হয়ে ভারতে চলে যান। ভারত সরকারের সাথে আলাপ-আলোচনা করে মুক্তিযুদ্ধকে পরিচালনা এবং দেশকে পরিচালনার জন্য একটি সরকার কাঠামো তৈরি করলেন।
তাজউদ্দিন আহমদ শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি এবং তাঁর অনুপস্থিতিতে উপ-রাষ্টপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং নিজে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিলেন। ১০ এপ্রিল তিনি রেডিওতে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভাষণ দেন।
১৭ এপ্রিল শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের হাইকমান্ডকে নিয়ে গঠিত সরকার মেহেরপুরের বদ্যিনাথ তলার আম্রকাননে শপথ গ্রহণ করে। এ শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাঁর ভাষণে বলেন- ‘যদি বিশ্বাসঘাতকতা করি, তবে আস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করবেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সাথে সুচিন্তিত মতামত বিনিময়ের মাধ্যমে তাঁরা সরকার পরিচালনা ও যুদ্ধকে এগিয়ে নিতে থাকেন। উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের যোগ্য নেতৃত্ব এবং বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল আক্রমনের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতার দিকে একটু একটু করে এগিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু অন্য রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি তখনও পায়নি বাংলাদেশ।
অক্টোবর মাসে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেভ দিল্লী সফরে আসেন। তখন ইন্দিরা গান্ধী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কমরেড মনি সিংহ, তাজউদ্দীন এবং ব্রেজনেভের মধ্যে রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয়। সে বৈঠকে ইন্দিরা গান্ধীর কাছে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের স্বীকৃতির দাবী করেন। সময় এগিয়ে যেতে থাকে৷ চিঠির মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে বেশ কয়েকবার ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্বীকৃতির আবেদন জানানো হয়। ভারত সরকার স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় ৬ ডিসেম্বর।
ভারতীয় সেনাবাহিনী মুক্তিবাহিনীর সাথে যৌথভাবে যুদ্ধে অংশ নেয়। ৭ ডিসেম্বর যশোর সেনানিবাসের পতন হয়। এরপর যশোর আসেন সৈয়দ নজরুল এবং সেখানে তাঁর বক্তব্যে সাম্প্রদায়িক দলগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে জন্ম নেয় স্বাধীন বাংলাদেশ।
স্বাধীন দেশে শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফেরার পর সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় সৈয়দ নজরুল ইসলাম শিল্প মন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
সংবিধান প্রণয়ন কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। ১৯৭২ সালে সংসদের উপনেতা নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালে ময়মনসিংহ-২৮ আসন থেকে পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পুনরায় নির্বাচিত হন সংসদীয় উপনেতা। শিল্পমন্ত্রী থাকাকালে, শিল্প-কারখানা জাতীয়করণ করেন।
১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি হলে তিনি উপ-রাষ্ট্রপতি হন। ওই সময় তিনি বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল)-এর সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।