আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জেলহত্যাকাণ্ডঃ ক্যাপ্টেন মনসুর আলী মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম কাণ্ডারী

মানুষ আর প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য হলো-চেতনাগত ও সংস্কৃতিগত।

ক্যাপ্টেন মনসুর আলী মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম কাণ্ডারী ৩ নভেম্বর জেলহত্যা দিবস। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর ষড়যন্ত্রকারীরা জাতিকে মেধাশূণ্য ও পুরোপুরি পঙ্গু করার জন্যই জেলহত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করে। ঘাতকদের ইচ্ছা ছিল ১৫ আগস্ট রাতেই বঙ্গবন্ধু চার সহকর্মী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, এ এইচ এম কামরুজ্জামান ও ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে হত্যা করতে চেয়েছিল। সেদিন সময় স্বল্পতা এবং এই চার নেতার বাসস্থান বিভিন্ন স্থানে হওয়ার কারণে ঘাতকরা সিদ্বান্ত পালটায়।

১৫ আগষ্টের পর চার জাতীয় নেতাকে গ্রেফতার করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটকে রাখে। ৩ নভেম্বর এই অবিসংবাদিত চার নেতাকে জেলের মধ্যে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডই বাংলাদেশের ইতিহাসে জেল হত্যাকাণ্ড নামে পরিচিত। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুরের মুজিব নগরে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী ছিলেন মনসুর আলী। তাঁর জন্ম ১৯১৯ সালের ১৬ জানুয়ারি।

সিরাজগঞ্জ জেলার রতনকান্দি ইউনিয়নের ‘কুড়িপাড়া’ গ্রামে। বাবা হরফ আলী সরকার। ৪ ভাই, ১ বোনের ছোট মনসুর আলী। পড়াশোনার হাতেখড়ি পরিবারে। তারপর প্রাইমারী।

এরপর ভর্তি হন কাজিপুরের গান্ধাইল হাই স্কুলে। সেখান থেকে চলে যান সিরাজগঞ্জ বি.এল, হাইস্কুলে। এখান থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তি হন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন এই কলেজ থেকে। শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় জায়গির থেকে পড়াশোনা করেছেন তিনি।

উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর পড়াশুনার জন্য চলে যান কলকাতায়। ১৯৪১ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে বি.এ পাসের স্বীকৃতি পান। এরপর ভর্তি হন আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৪৫ সালে এখান থেকেই অর্থনীতিতে এম.এ এবং ‘ল’ এল.এল.বি-তে প্রথম শ্রেণী অর্জন করেন। ১৯৪৪ সালে তিনি গাইবান্ধার পলাশ বাড়ির আমির উদ্দিন সরকারের কন্যা আমেনা খাতুনকে সহধর্মীনী করেন।

তাঁর শ্বশুর ছিলেন মুন্সেফ। তাঁর ইচ্ছা ছিল মেয়ের জামাই জজ হোক। কিন্তু তিনি চাকুরি করতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি স্বাধীন পেশা ওকালতিকেই পরবর্তীতে নিজের পেশা হিসেবে বেছে নেন। ১৯৫১ সালে আইন ব্যবসা শুরু করেন।

পাবনা জেলা আদালতে। আইনজীবী হিসেবে তিনি ছিলেন একজন সফল ব্যক্তি। পাবনা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ছিলেন তিনি। ১৯৫২ সাল। সারা দেশে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ছে।

মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকারের দাবিতে আন্দোলন-সংগ্রামে মেতে ওঠে ছাত্র-যুবসহ সকল শ্রেণিপেশার মানুষ। পাবনা শহর এই সংগ্রামের বাইরে ছিল না। এ সময় শহরে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন এম. মনসুর আলী। গ্রেফতার করা হয় তাঁকে। ভোগ করতে হয় কারা নির্যাতন।

আলীগড় থেকে দেশে ফিরে তিনি মুসলিম লীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত হন। ১৯৪৬-৫০ সাল পর্যন্ত পাবনা জেলা মুসলিম লীগের সহ-সভাপতি ছিলেন। ১৯৪৮ সালে তিনি যশোর ক্যান্টনমেন্টে প্রশিক্ষণ নেন। ওই তিনি পিএলজি’র ক্যাপ্টেন পদে অধিষ্ঠিত হন। এ সময় থেকেই তিনি ক্যাপ্টেন মনসুর নামে পরিচিত হতে থাকেন।

ইসলামিয়া কলেজে পড়ার সময় তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে পরিচিত হন। তাঁদের মাঝে সহজ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কলকাতা থেকে দেশে ফেরার পর স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আমজাদ হোসেন, আব্দুর রব বগা মিঞা, জনাব আমিন উদ্দিন অ্যাডভোকেট প্রমুখের সাথে তাঁর রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। এভাবে তিনি রাজনীতির অঙ্গনে নিজেকে নিয়ে আসেন। তিনি সপরিবারে বসবাস করতেন পাবনা শহরে।

কিন্তু রাজনীতিতে সক্রিয় হবার কারণে এবং জাতীয় রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করার জন্য তাঁকে মাঝে মাঝেই ঢাকা আসতে হতো। ১৯৫১ সালে তিনি আওয়ামী-মুসলিম লীগে সাথে সরাসরি যুক্ত হন। জড়িয়ে পড়েন ওই দলের সক্রিয় রাজনীতিতে। তিনি আওয়ামী মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন।

এ সময় তিনি পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এ নির্বাচনে পাবনা-১ আসনের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আব্দুল্লাহ্ আল মাহমুদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন তিনি। এ আসন থেকে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন মনসুর আলী। এই নির্বাচনে আব্দুল্লাহ্ আল মাহমুদের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়। এরপর যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে যায়।

১৯৫৬ সালে আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে বিভিন্ন সময় পূর্ববঙ্গ কোয়ালিশন সরকারের আইন ও সংসদ বিষয়ক, খাদ্য ও কৃষি এবং শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৫৮ সালে দেশে জারি হয় সামরিক শাসন। এ সময় তাঁকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয়। কারা থেকে ১৯৫৯ সালের শেষের দিকে মুক্তি পান। বাঙালির মুক্তির সনদ ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

১৯৭০ সালের ১৭ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনে তিনি প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচন করেন। পাবনা-১ আসন থেকে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালে মুজিব নগর সরকারের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন তিনি। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্যদিয়ে জন্ম নিল স্বাধীন বাংলাদেশ। আর জাতির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে পাকিস্তানি কারাগার থেকে দেশে ফিরে মন্ত্রী পরিষদ পুনর্গঠন করেন।

এই মন্ত্রী পরিষদে মনসুর আলী দায়িত্ব নেন প্রথমে যোগাযোগ ও পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। যুদ্ধ বিধ্বংস্ত বাংলাদেশ। সারা দেশে বিশৃঙ্খলা, যুদ্ধে, বোমায় বিধ্বস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা। রাস্তাঘাট, স্কুল, কলেজসহ সকল অবকাঠামো। তিনি দক্ষ তত্‍পরতায় যোগাযোগের ক্ষেত্রে দ্রুত পদক্ষেপ নেন।

হার্ডিঞ্জ ব্রিজ তৈরিতে রাখেন ভূমিকা। ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চের নির্বাচনে মনসুর আলী পুনরায় পাবনা-১ আসন থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ওই বছর তিনি আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি দলের সদস্য নির্বাচিত হন। ওই দেশ দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হয়। দেশের অর্থনৈতিক ও খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা হুমকির মুখে পড়ে।

এরকম অবস্থায় সারাদেশকে একটি সংঘবদ্ধ একক কাঠামোয় রূপদানের জন্য শেখ মুজিবুর রহমান সকল দলকে একত্রিত করার মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার পদ্ধতি চালু করেন। এ সময় ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ মনসুর আলী বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিসভার প্রধান মন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। ১৯৭৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক গঠিত বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের (বাকশাল) সেক্রেটারি জেনারেলও ছিলেন এ সময় ক্যাপ্টেন মনসুর। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্টে শেখ মুজিবকে হত্যার পর তাঁকে গৃহবন্দি করা হয়।

এরপর ২৩ আগস্ট মোশতাক সরকার কর্তৃক গ্রেফতার হন তিনি। ৩ নভেম্বর মধ্যরাত্রিতে অন্য চার জাতীয় নেতার সাথে তাঁকে হত্যা করা হয়।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।