আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিমানবালা মার্কেট থেকে কেনা চোরাই পণ্যের রমরমা বাণিজ্য



সুপার শপগুলোতে যে কোনো পণ্য কিনলেই ক্রেতাকে ৪ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়। অথচ সুপার শপগুলো ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে আনা চোরাইপণ্য গোপন বাজার থেকে সংগ্রহ করে। এ ধরনের পণ্য সরবরাহের জন্য রাজধানীতেই বেশ কয়েকটি বড় সিন্ডিকেট গজিয়ে উঠেছে। যারা লাখ লাখ টাকার ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে বিপুল পরিমাণ পণ্য চোরাই পথে নিয়ে আসে। সুপার শপগুলোর কল্যাণে এ চক্র নিশ্চিত ও নিরাপদ উন্মুক্ত বাজার খুঁজে পেয়েছে।

ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে আনা চোরাইপণ্য একবার সুপার শপে ঢুকে গেলেই সেগুলো হয়ে যায় উন্নতমানের ও আমদানিকৃত পণ্য। ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে আনা মান যাচাইহীন এসব বিদেশী পণ্যের বিষয়ে আসল তথ্য জানতে সংশ্লিষ্ট কয়েকটি গোপন স্পট ও সুপারশপে গিয়ে যুগান্তরের পক্ষ থেকে ব্যাপক অনুসন্ধান চালানো হয়। এতেই বেরিয়ে আসে বিস্ময়কর নানা তথ্য। নকল ও বিদেশের ফুটপাতে বিক্রি হওয়া নিম্মমানের এসব পণ্য দ্বিগুণ ও তিনগুণ দামে সুপারশপগুলোতে বিক্রি করা হচ্ছে। এগুলোকে খুব ভালোমানের বিদেশী পণ্য হিসেবে কিনে ক্রেতারা হচ্ছেন প্রতারিত।

বিমানবালা বাজার : সুপার শপগুলোতে এমন অনেক পণ্য বিক্রি হয় যেগুলোতে আমদানিকারকের নাম লেখা থাকে না। এসব পণ্য দেশে অনুমোদিত কিনা বা কোথায় উৎপাদিত তাও বলা থাকে না। অনুসন্ধানকালে বিএসটিআইয়ের একটি সূত্র জানায়, লাগেজ পার্টির মাধ্যমে চোরাই পথে আসা পণ্য কিনে বিক্রি করা হচ্ছে সুপার শপগুলোতে। শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আনা এসব পণ্য নামমাত্র মূল্যে কিনে উচ্চমূল্যে বিক্রি করা হয়। এ বিষয়ে লিখিতভাবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়ে একাধিকবার চিঠি দিয়েছেন বিএসটিআই ও জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা।

প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে অনুসন্ধান করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে রাজধানীর তিনটি স্থানে থাকা চোরাই পণ্যের এরকম তিনটি অস্থায়ী গোপন বাজার। এসব স্থানে প্রায় দিন ভোর বেলা বিমানবালা ও কেবিনক্রুদের একটি গ্র“প বিদেশী কসমেটিকমস ও খাদ্যজাতীয় বিভিন্ন পণ্য সামগ্রী এনে অপেক্ষাকৃত কম দামে বিক্রি করে। ক্রেতারা কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। যাদের কাছ থেকে এসব পণ্য আবার উচ্চ মুনাফার জন্য রাজধানীর বিভিন্ন সুপার শপগুলো কিনে থাকে। এমন বিকিকিনির সরেজমিন যাচাই করতে ২২ জুলাই গুলশান-১ এর ডিসিসি মার্কেটে উপস্থিত হয় যুগান্তরের অনুসন্ধান টিম।

তখন ভোর সাড়ে ৫টা। প্রাপ্ত তথ্যের সঙ্গে বাস্তবতার প্রমাণও মিলে যায়। দেখা গেল মার্কেটের দোতলায় কিছু লোকের জটলা। সেখানে বড় বড় লাগেজ থেকে বিদেশী পণ্য বের করে দরদাম ঠিক করা হচ্ছে। উপস্থিত ১০/১২ জনের মধ্যে ৩ জন মহিলাও আছেন।

যাদের পোশাক ও কথাবার্তা শুনে উচ্চ শিক্ষিত মনে হচ্ছিল। নিচে নেমে এসে দেখা গেল দুটি প্রাইভেটকার থেকে আরও দু’জন মহিলা ও ৪ জন পুরুষ নামছেন। নেমেই তারা পেছনের বনেট খুলে বেশ কয়েকটি লাগেজ বের করলেন এবং তারাও লাগেজ নিয়ে উপরে উঠে গেলেন। তখন ভোর ৬টা। উপস্থিত নিরাপত্তা প্রহরীদের ক’জনকে এদের বিষয়ে জানতে চাইলে তারা উত্তর এড়িয়ে উল্টো প্রতিবেদকের পরিচয় জানতে চান।

নিজেকে ব্যবসায়ী পরিচয় দিলে একজন একটু সামনে এসে বলেন, ‘স্যার মাল কিনলে উপরে যান। দেরি করলে পাবেন না। এটা তো বিমানবালাদের ১ ঘণ্টার বাজার। ’ নিরাপত্তাকর্মীর এ বক্তব্যে প্রাপ্ত তথ্যের সত্যতা অনেকটায় স্পষ্ট হয়ে যায়। প্রশ্ন করা হয়, এরা কি প্রতিদিন এখানে আসেন? জবাবে তিনি বলেন, ‘স্যার, আগে নিয়মিত আসত।

কিন্তু র‌্যাব রেড দেয়, আর পুলিশও ঝামেলা করে বলে এখন এখানে সবাই সব সময় আসেন না। শুনেছি আশপাশের কিছু হোটেলে বসে বেচাকেনা করেন। ’ আমদানিকারকের আড়ালে যা চলে : আরেক নিরাপত্তা প্রহরী জানান, ডিসিসি মার্কেটের কিছু ব্যবসায়ীর সঙ্গে বিমানবালাদের ‘হট কানেকশন’। তাদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগের মাধ্যমে এখন বেশিরভাগ বেচাকেনা হয় অন্য কোথাও। নিরাপত্তা প্রহরীরা জানান, মার্কেটের দোতলায় এমন অনেক দোকান আছে যেগুলোতে বিমানবালাদের কাছ থেকে কেনা সব ধরনের বিদেশী পণ্য পাওয়া যায়।

মোবাইল ফোনে বিমানবালাদের কাছ থেকে পণ্য কেনার একটি পুরো প্রক্রিয়া দেখতে সাহায্য নেয়া হয় ডিসিসি মার্কেটের একজন বিদেশী চকলেট আমদানিকারকের। তিনি জানান, বিমানবালাসহ বিমানক্রুরা ফ্লাইট থেকে নেমে সোজা হোটেলে উঠেন। হোটেল থেকেই তারা তাদের চেনা-জানা কিছু নির্দিষ্ট ব্যবসায়ীর (ক্লায়েন্ট) সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এরপর হোটেলে গিয়ে লেনদেন সম্পন্ন করেন ব্যবসায়ীরা। তিনি জানান, যে কোনো দিন হোটেল সোনারগাঁও, রূপসী বাংলা বা গুলশানের ওয়েস্টিন হোটেলের লবিতে দাঁড়ালে সবকিছু পরিষ্কার বোঝা যাবে।

ওই চকলেট আমদানিকারককে সঙ্গে নিয়ে ২৪ জুলাই সন্ধ্যা ৭টায় যুগান্তরের অনুসন্ধান টিম উপস্থিত হয় পাঁচতারকা হোটেল সোনারগাঁওয়ের লবিতে। সোনারগাঁও হোটেলের জনসংযোগ শাখা নিশ্চিত করে হোটেলে বেশ কয়েকটি এয়ারলাইন্সের ১৭ জন কেবিনক্রু অবস্থান করছেন। দিনের বিভিন্ন সময়ে তারা হোটেলে উঠেছেন। লবিতে বসে চোরাইপণ্য কেনাবেচার দৃশ্য দেখার অপেক্ষা চলতে থাকে। রাত ৮টায় হোটেলের লবিতে ঘোরাফেরা করতে দেখা যায় সন্দেভাজন দু’ব্যক্তিকে।

সঙ্গে থাকা সোর্স বললেন, এ দু’জনই সম্ভবত ‘পার্টি’। রাত ৮টা ৪০ মিনিটে দুটি বড় স্যুটকেস নিয়ে লবিতে নেমে এলেন এক বিদেশিণী। তিনি হাতে ইশারা করলেন। এগিয়ে গেলেন সোর্সের চিনিয়ে দেয়া ওই ‘দুই ব্যক্তি’। সংক্ষিপ্ত কথা শেষে লাগেজ হাতবদল হয়ে গেল।

লাগেজ বুঝে নিয়ে বিদেশিণীর হাতে একটি কাগজের প্যাকেট ধরিয়ে দিলেন তারা। কিছুক্ষণ পর তারা লাগেজ দুটি নিয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে গেলেন। অবৈধ বিমানবালা বাজার ও চোরাইপথে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আনা পণ্যের অবাধ ব্যবসা সম্পর্কে জানতে চাইলে ডিসিসি মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির চেয়ারম্যান শের মোহাম্মদ খান যুগান্তরকে বলেন, ডিসিসি মার্কেটে কোনো ধরনের ‘বিমানবালা’ বাজার থাকার কথা তার জানা নেই। তিনি বলেন, এ মার্কেটে অনেক আমদানিকারক আছেন যারা সততার সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করছেন। তবে এদের মধ্যে যে দু’একজন খারাপ কাজ করেন না তা হলফ করে বলা যাবে না।

’ তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা যখন বিদেশে যান তখন কিছু ‘জিনিসপত্র’ নিজের সঙ্গে নিয়ে আসেন। তাতে তার যাওয়া-আসার খরচ উঠে যায়। এটাকে কেউ চোরাইপণ্যের ব্যবসা বললে বলতে পারেন। তবে এ কাজ অনেকেই করেন। ’ অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিমানবালারা যে শুধু ডিসিসি মার্কেটেই পণ্য বিক্রি করেন তা নয়, তারা তো আরও অনেক জায়গায় যাতায়াত করেন।

বিএসটিআইয়ের ফিল্ড অফিসার খালিদ রেজা চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, তারা একাধিকবার গুলশান-১ এর ডিসিসি মার্কেটে অভিযান চালাতে গিয়েছিলেন। কিন্তু এখানকার সংঘবদ্ধ চোরাকারবারিদের প্রবল প্রতাপের মুখে শেষ পর্যন্ত তাদের পিছু হটতে হয়েছে। যেসব পণ্য আসছে : বিমানবালা ও লাগেজ পার্টির সদস্যদের কাছ থেকে সুপার শপগুলো যেসব পণ্য সংগ্রহ করে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- বিদেশী চকলেট, দুধ, কর্নফ্লেক্স, ডায়াপার, জুস, কোমল পানীয়, জ্যাম, জেলি, শোপিস, সুভ্যেনির ও নানা ধরনের কসমেটিকক্স। গুলশান-১ এর ডিসিসি মার্কেট, উত্তরার রাজলক্ষ্মী মার্কেট ও বিমানবন্দর এলাকার কয়েকটি ভাসমান বাজারের পণ্য সুপার শপগুলোতে বিক্রি হচ্ছে প্রকাশ্যেই। শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আনা এসব পণ্যের মান সম্পর্কে বিএসটিআইয়ের সহকারী পরিচালক আবু সাঈদ যুগান্তরকে বলেন, ঢাকার ফুটপাতে যেমন অতিশয় নিুমানের পণ্য সস্তায় কিনতে পাওয়া যায়।

তেমনি মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের দেশগুলোতেও ফুটপাতে নিুমানের পণ্য বিক্রি হয়। বিমানবালা ও কেবিনক্রুরা বিদেশের ফুটপাত থেকে ওইসব নিুমানের পণ্য অতি সস্তায় কিনে আনেন। সেগুলোই সুপার শপগুলোতে বিদেশী পণ্য হিসেবে বিক্রি হয়। বিএসটিআই সূত্র জানায়, কয়েকটি সুপার শপ পুরান ঢাকার চকবাজার ও মৌলভিবাজার থেকেও স্থানীয় নকল পণ্য কিনে এনে মোড়কের গায়ে সুবিধামতো বিভিন্ন দেশের স্টিকার লাগিয়ে দেয়। এ রকম নকল পণ্যের রমরমা চাহিদার কারণে পুরান ঢাকায় বেশ কয়েকটি চক্র গড়ে উঠেছে।

যারা নামিদামি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের পণ্য হুবহু নকল করে বাজারজাত করছে। গোপন তথ্য দিলেন সফিকুল : নকল ও নিুমানের পণ্য কিভাবে সুপার শপে উন্নত পণ্য বলে বিক্রি করা হয় তা জানার জন্য র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের সহায়তা নেয়া হয়। ২১ জুলাই র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত যুগান্তরের অনুসন্ধান টিমকে সঙ্গে নিয়ে উত্তরা ৩নং সেক্টরে অবস্থিত ট্রাস্ট ফেমিলি নিডস নামের একটি বহুতল সুপার শপে অভিযান চালায়। অভিযানের সময় সুপার শপ থেকে অন্তত ৪ লাখ টাকার পণ্য জব্দ করে তা ধ্বংস করা হয়। এসব পণ্যের মধ্যে ছিল বিদেশী শ্যাম্পু, সাবান, টুথপেস্ট, গুঁড়ো দুধ, চকলেট ও বিস্কুট।

নকল ও ভেজাল পণ্য বিক্রির অপরাধে ট্রাস্ট ফ্যামিলি নিডসের মালিক সফিকুল ইসলামসহ তার প্রতিষ্ঠানের ৯ কর্মচারীকে আটক করা হয়। অভিযানকালে সফিকুল যুগান্তরের কাছে নানা গোপন তথ্য প্রকাশ করেন। তিনি জানান, গুলশান-১ এর ডিসিসি মার্কেটের কয়েকজন আমদানিকারক ও বিমানবন্দরকেন্দ্রিক কয়েকটি চক্রের সঙ্গে তার চুক্তি রয়েছে। বিদেশী মোড়কে এসব ভেজাল ও নকল পণ্য তাদের কাছ থেকেই তিনি সস্তায় কিনে আনেন। তিনি ডিসিসি মার্কেটের কয়েকজন অসাধু আমদানিকারকের নামও জানান (র‌্যাবের গোয়েন্দা অনুসন্ধান অব্যাহত থাকায় নাম প্রকাশ করা হল না)।

নেসলে ব্র্যান্ডের হুবহু নকল একটি গুঁড়ো দুধের প্যাকেট দেখিয়ে সফিকুল বলেন, এ ধরনের দুধের প্যাকেট তিনি চোরাবাজার থেকে মাত্র ২০০ টাকায় কিনে ৮/৯শ টাকায় বিক্রি করেন। সুপার শপটিতে যখন অভিযান চলছিল তখন সেনসোডিন নামের একটি বিদেশী টুথপেস্ট কিনে মূল্য পরিশোধের জন্য কাউন্টারে দাঁড়িয়েছিলেন সাজ্জাদ আলী নামের এক ক্রেতা। যুগান্তরের অনুসন্ধান টিম সাজ্জাদ আলীর কেনা টুথপেস্টটি সফিকুলকে দেখিয়ে জানতে চায় সেটি আসল না নকল। সফিকুল অকপটে স্বীকার করেন টুথপেস্টটি নকল। এ কথা শুনে ক্রেতা সাজ্জাদ আলী হতভম্ব হয়ে যান।

তিনি বলেন, সেনসোডিন ব্র্যান্ডের টুথপেস্ট বহু বছর ধরে তিনি ব্যবহার করছেন। তিনি বিশ্বাসই করতে পারছেন না এত নিখুঁতভাবে একটি পণ্য নকল করা কীভাবে সম্ভব। র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আনোয়ারা পাশা নকল ও ভেজাল পণ্য বিক্রির অভিযোগে ট্রাস্ট ফেমিলি নিডসের মালিক সফিকুলকে ১৭ লাখ টাকা জরিমানা করেন। আইনের প্রতি ড্যামকেয়ার : ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯-এর ৩৭ ধারায় বলা আছে, ‘পণ্যের গায়ে ওজন, উপাদান, ব্যবহার বিধি, উৎপাদনের ও মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার তারিখ স্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ থাকতে হবে। ’ তাছাড়া আমদানি পণ্যের ক্ষেত্রে মোড়কের গায়ে আমদানিকারকের নাম-ঠিকানা স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকাও বাধ্যতামূলক।

অন্যথায় সংশ্লিষ্ট বিক্রেতাকে কমপক্ষে ১ বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের কথা আইনে বলা হয়েছে। কিন্তু আইনের এই বিধিনিষেধ তোয়াক্কা না করেই অবাধে আমদানিকারকের নাম উল্লেখ ছাড়াই সুপার শপগুলোতে পণ্য বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া সুপার শপগুলোতে বিএসটিআইয়ের অনুমোদন বা সিলবিহীন অপরীক্ষিত পণ্যও বিক্রি হচ্ছে অবাধে। বেশিরভাগ ক্রেতা এ নিয়ে কখনও কোনো প্রশ্ন তোলেন না। কারণ সুপার শপগুলোতে পণ্যের বাহারি উপস্থাপন ভঙ্গির কারণে ক্রেতারা ধরেই নেন এগুলো পরীক্ষিত ও উন্নতমানের।

সুপার শপে ভেজাল বা মানহীন পণ্য বিক্রি হতে পারে তা অনেক ক্রেতা কল্পনাও করেন না। এ বিষয়টি হাতেনাতে প্রমাণ করতে যুগান্তরের অনুসন্ধান টিম ১৭ আগস্ট আগোরা সুপার শপের উত্তরার আউটলেটে অনুসন্ধান চালায়। মাত্র দুই ঘণ্টা ঘুরে অন্তত ২০টি আমদানিকৃত পণ্য পাওয়া যায়, যেগুলোতে আমদানিকারক ও বাজারজাতকারকের নাম-ঠিকানা নেই। তিন ধরনের বিদেশী জুস পাওয়া যায় যেগুলোর প্যাকেটের গায়ে কোরিয়ান ও চাইনিজ ভাষায় লেখা। এছাড়া আমদানিকারকের নাম-ঠিকানা ছাড়াই বিদেশী কর্নফ্লেক্স ও চকলেট পাওয়া যায়।

আগোরার উত্তরা শাখা থেকে এ ধরনের ১ হাজার ২৯৮ টাকার পণ্য কেনা হয়। এরপর আগোরার উত্তরা শাখার ইনচার্জ মনোয়ারার মুখোমুখি হন অনুসন্ধান টিমের সদস্যরা। মনোয়ারাকে এসব পণ্য দেখিয়ে জিজ্ঞেস করা হয় বিদেশী জুস, এনার্জি ড্রিং, কর্নফ্লেক্স ও চকলেটের প্যাকেটে আমদানিকারকের নাম থাকা বাধ্যতামূলক হলেও এগুলোতে নেই কেন। মনোয়ারা পণ্যগুলো নেড়েচেড়ে দেখে আমতা আমতা করে বলেন, ‘তাই তো এখানে এসব কিছু লেখা নেই দেখছি। আচ্ছা ঠিক আছে আসুন পাল্টে দিচ্ছি।

’ পুরো ঘটনাটি যুগান্তরের অনুসন্ধান টিমের কাছে থাকা গোপন ভিডিও ক্যামেরায় ধারণ করা হয়, যা সংরক্ষিত আছে। এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে আগোরার মার্কেটিং ম্যানেজার আশরাফুল হাসান যুগান্তরকে বলেন, আগোরা কখনই কোনো লাগেজ পার্টির কাছ থেকে পণ্য কেনে না। প্রতিটি পণ্য কার কাছ থেকে, কখন, কত দামে কেনা হয়েছে তার রেকর্ড রয়েছে। নিুমানের পণ্যের ইচ্ছেমতো মূল্য আদায় : সুপার শপগুলো বিদেশ থেকে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আনা পণ্যগুলোর মোড়কে ইচ্ছেমতো মূল্য বসিয়ে দেয়। এছাড়া স্থানীয় বাজার থেকে বিভিন্ন ধরনের পণ্য কিনে সেগুলোর প্যাকেটের গায়ে থাকা সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ঢেকে অতিরিক্ত মূল্যযুক্ত স্টিকার লাগিয়ে দেয়া হয়।

অথচ আইন অনুযায়ী সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের উপর নতুন করে আবার মূল্য নির্ধারণ করা দণ্ডনীয় অপরাধ। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের ৪০ ধারায় এ অপরাধের শাস্তি হিসেবে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে প্রকাশ্যেই এ কাজ করে যাচ্ছে সুপার শপগুলো। বিষয়টি সরেজমিন হাতেনাতে প্রমাণ করতে যুগান্তরের অনুসন্ধান টিম ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের সহায়তা নেয়। ৪ আগস্ট যুগান্তরের অনুসন্ধান টিমের সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে স্বপ্ন সুপার শপের গুলশান আউটলেটে অভিযান চালান ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মনিরুজ্জামান।

৩০ মিনিটেরও কম সময় তল্লাশি করেই তিনি বিভিন্ন ধরনের ৭টি পণ্য আটক করেন। যেগুলো সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের অতিরিক্ত দামে বিক্রি করা হচ্ছিল। ‘রেডবুল’ নামের একটি বিদেশী ব্র্যান্ডের কোমল পানীয়র বোতলে নির্ধারিত খুচরা মূল্যের অতিরিক্ত মূল্যযুক্ত স্টিকার লাগানো ছিল। এ বিষয়ে স্বপ্নের গুলশান আউটলেটের ম্যানেজার শ্যামল কস্তাকে জেরা করা হলে তিনি ভুল স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। অভিযানের সময় বিএসটিআইয়ের অনুমোদনহীন দই বিক্রির অপরাধে স্বপ্নের গুলশান আউটলেটকে ২৫ হাজার টাকা জরিমানা ও এ ধরনের অপরাধ থেকে বিরত থাকতে সতর্ক করে দেয়া হয়।

গত বছরের ১৩ মে স্বপ্নের গ্রিন রোড শাখা থেকে কূল ডিওডোরান্ট ও বডিস্প্রে কিনে প্রতারিত হন কুদরত-ই খুদা নামের এক ক্রেতা। তার অভিযোগ পেয়ে অধিদফতরের উপ-পরিচালক শাহ আলম অভিযান চালিয়ে ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করেন। কিন্তু পরের মাসেই (১০ জুন) স্বপ্নের খিলগাঁও শাখা থেকে ক্লোজআপ কিনে প্রতারিত হন আনোয়ার হোসেন। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় স্বপ্নের খিলগাঁও শাখাকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। একই অভিযোগে ১৭ অক্টোবর স্বপ্নের বাসাবো শাখাকেও ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বিভিন্ন সময়ে খুচরা মূল্যের উপর নতুন করে মূল্য লাগানো শতাধিক পণ্যের নমুনা সংগ্রহ করেছে। এসব পণ্য ক্যাবের কার্যালয়ে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। ক্যাবের চেয়াম্যান কাজী ফারুক আহামেদ যুগান্তরকে বলেন, সুপার শপগুলো যে ব্যবসা করছে তার ভেতরের খবর জানলে এদের ডাকাত না বলে উপায় নেই। এরা আসলে মানুষের পকেট কাটার ব্যবসায় নেমেছে। তাদের অবস্থা অনেকটা ‘বাইরে ফিটফাট ভিতরে সদরঘাটের মতো’।

র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আনোয়ার পাশা যুগান্তরকে বলেন, বেশ কয়েকটি সুপার শপে এ ধরনের অতিরিক্ত মূল্য সংযোজন দেখে তিনি হতবাক হয়েছেন। তিনি বলেন, একটি অভিযানে তিনি দেখতে পান কয়েকটি সুগন্ধির বোতলে ৮০০ টাকা করে মূল্য লেখা রয়েছে। পরে সুপার শপ কর্তৃপক্ষকে তিনি সুগন্ধিগুলোর ক্রয় ভাউচার আনতে বলেন। ভাউচারে দেখা যায়, সেগুলো প্রতিটি কেনা হয়েছে মাত্র ৮০ টাকায়। যেগুলো ছিল নকল ও অতিশয় নিম্নমানের।

সুপার শপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন যুগান্তরকে বলেন, বেশিরভাগ সুপার শপের মালিক সততার সঙ্গে ব্যবসা করতে চান। দু’একজন হয়তো অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত। এদের বিরুদ্ধে অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এসব বিষয়ে সরকারকে আরও নজরদারি বাড়ানোর আহ্বান জানান তিনি। সুপার শপের অনিয়ম নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করায় তিনি যুগান্তরকে ধন্যবাদও জানান।

উৎসঃ যুগান্তর

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।