আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জীবনানন্দ দাশের কবিতায় বিচ্ছিন্নতার রূপায়ণ / এ ম. আ ব দু ল আ লী ম



জীবনানন্দ দাশের কবিতায় বিচ্ছিন্নতার রূপায়ণ এ ম. আবদুল আ লী ম ====================================== তিরিশোত্তর বাংলা কাব্যের প্রধান কবি কবি জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪)। তিনি যুগের বৈনাশিকতায় বিচ্ছিন্নতার যন্ত্রণা ভোগ করেছেন এবং লিখেছেন_ 'সকল লোকের মাঝে বসে/আমার নিজের মুদ্রাদোষে/আমি একা হতেছি আলাদা?' কবির বিচ্ছিন্নতাদীর্ণ কবিসত্তার এই আত্মস্বীকৃতির বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় তাঁর কবিতার বিষয় ও প্রকরণশৈলীর মধ্যে। ফলে আধুনিক কবিদের মধ্যে সবচেয়ে নির্জন; অন্ধকারের নির্জন কবি; পৃথিবী পলাতক কবি; বিষণ্ন বেদনার সিন্ধুতটে নিক্ষিপ্ত কবি প্রভৃতি অভিধা জীবনানন্দের জন্য অনিবার্যভাবেই জুটে গেছে। 'অস্তিত্বের যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট, যান্ত্রিক যন্ত্রণায় পিষ্ট, মৃত্যু যন্ত্রণায় আড়ষ্ট এবং মানসিক ও আত্মিক সংকটে নিমজ্জিত' এই কবি পারিপাশ্বর্িক পরিবেশ; পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রিক এমনকি বৈশ্বিক পরিম-লের কোন কিছুর সঙ্গে অন্বয় খুঁজে পান নি। প্রেম, নারী, প্রকৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য, যুগজীবনের জটিলতা এবং সমকালীন মানুষের ক্লেদাক্ত জীবনের বহু-বর্ণিল চিত্র রূপায়ণের ক্ষেত্রে সর্বত্রই তিনি নিঃসঙ্গতা ও বিচ্ছিন্নতার মর্মবিদারী যন্ত্রণার কথা বলেছেন।

তাঁর কবিচেতনার মর্মমূলে সংগ্রথিত ছিল বিচ্ছিন্নতার প্রাণবীজ। জীবনানন্দের অনতিক্রান্ত এই বিচ্ছিন্নতা যাকে তিনি এড়াতে পারেন না বলে সহজ স্বীকারোক্তিতে মেনে নিয়েছেন, সেটা শুধু বক্তব্যে ও চিন্তায় কাব্যদেহে সমাচ্ছন্ন হয়নি। কবিতার প্রকরণে, শব্দে-শব্দে, বাক্যে-চরণে সর্বত্র বিচ্ছিন্নতার প্রচ্ছাপ ছড়িয়ে গেছে। ব্যক্তিজীবনের সীমাহীন দুর্ভোগ এবং যুগমানসের জটিলতায় তিনি মুষড়ে পড়েছিলেন। তিনি নিমজ্জিত হয়েছিলেন হতাশা, ক্লান্তি, নৈরাশ্য, বিচ্ছিন্নতা আর একাকিত্বের গভীরে।

'যুগধর্মের বৈনাশিকতায় তাঁর মানসপ্রান্তর হয়েছিল বৃত্তাবদ্ধ-জীবনসন্ধিগ্ধ-শিকড়উন্মূলিত-বিশ্বাসবিচ্যুত, কখনো-বা সত্তাবিচ্ছিন্ন। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় পৌনঃপুনিকভাবে চিত্রিত হয়েছে অনাশ্রয়ী পৃথিবীর ছবি, শিল্পিত হয়েছে তাঁর নৈঃসঙ্গ্যপীড়িত বিপন্ন সত্তার বহুভুজ যন্ত্রণার কথা'। 'ঝরাপালক' (১৯২৭) থেকে শুরু করে 'ধূসর পা-ুলিপি' (১৯৩৬), 'বনলতা সেন' (১৯৪২), 'মহাপৃথিবী' (১৯৪৪), 'সাতটি তারার তিমির' (১৯৪৮) প্রভৃতি কাব্য এবং অগ্রন্থিত কবিতাসমূহের মধ্যে তিনি বিচ্ছিন্নতার শৈল্পিক রূপায়ণ ঘটিয়েছেন। ইংরেজি ধষরবহধঃরড়হ শব্দের বাংলা পরিভাষা বিচ্ছিন্নতা। 'বিচ্ছিন্ন' শব্দের আভিধানিক অর্থ সম্পূর্ণ বা সম্যক ছিন্ন, পৃথককৃত, বিযুক্ত এবং খ-িত ।

'কোন কিছুর গুণ বা শক্তিকে তার মূল আধার নিরপেক্ষভাবে স্বকীয় সত্তা হিসাবে প্রতিপন্ন করাকে দর্শনে বিচ্ছিন্নতা বলা হয়। ' শুদ্ধস্বত্ব বসু বলেছেন : 'বিচ্ছিন্নতা আসলে এক ধরনের মানস অনুভূতিজ্জযে অনুভূতির ফলে মানুষ নিজের সত্তাকে আর নিজের শাসনাধীন বলে ভাবতে পারে না। এই অনুভূতির জন্যই সে নিজেকে সম্পূর্ণ একা মনে করতে বাধ্য হয়, সমাজ-সংসার তার কাছে নিজের আত্মীয় বলে মনে হয় না, এদের থেকে সে পর পর ভাবে একাকীত্বের সংবেদনে নিজেকে নিজের মধ্যে গুটিয়ে নেয়। সমাজের একজন বলে তখন নিজেকে জাহির করা তার পক্ষে কষ্টের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। হেগেল এবং মার্কস ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি এবং ভাবচেতনার আলোকে বিচ্ছিন্নতার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন।

তবে পরবর্তীকালে দার্শনিক ও সমাজতাত্তি্বকের ব্যাখ্যায় বিচ্ছিন্নতা বিষয়ে মার্কসীয় ধ্যান-ধারণাই সর্বাধিক গুরুত্ববহ হয়েছে। আধুনিককালে বিচ্ছিন্নতা সব সমাজেই এক জটিল সঙ্কট সৃষ্টি করেছে। ফলে সমাজতাত্তি্বক, অর্থনীতিবিদ, দার্শনিক এবং মনস্তত্ত্ববিদ সকলের কাছেই বিচ্ছিন্নতা বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছে। বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেন_ 'মূলত, সভ্যতার অভিশাপজীর্ণ ও সমাজের অভ্যন্তর দ্বন্দ্বশাসিত আধুনিক মানুষের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, অভিশঙ্কা-চিত্তবৈকল্য এবং বহিশ্চাপ-অন্তশ্চাপই ব্যষ্টি-চেতনে সৃষ্টি করে বিচ্ছিন্নতাবোধ। ' আধুনিক যুগে পুঁজিবাদ মানুষের বিবেক, নীতিবোধ এবং সামাজিক মূল্যবোধ কেড়ে নিয়েছে।

ফলে ব্যষ্টি-চেতনে বাসা বেঁধেছে বিচ্ছিন্নতার কর্কট-রোগ। রেনেসাঁ পরবর্তী সময়ের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ, পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত বৈপরীত্য এবং তার ভেতর-বাহির কাঠামোর দ্বন্দ্বের ফলেই আধুনিক যুগের মানুষের মনে বিচ্ছিন্নতার উন্মেষ ঘটেছে। জীবনানন্দ দাশের কবিচেতনায় বিচ্ছিন্নতার প্রকোপ সম্পর্কে বিশ্লেষণ করতে গেলে কতকগুলো বিষয়ের উপর আলোকপাত করা অত্যাবশ্যক। সেক্ষেত্রে প্রথমেই আসে কবির ব্যক্তিজীবন, তারপর আসে তাঁর সমকালীন জীবনের মূল্যায়ন, আসে সমকালীন সাহিত্যের নানা প্রবণতা এবং সেগুলোর সঙ্গে কবির সম্পৃক্ততার প্রসঙ্গ। জীবনানন্দ দাশের ব্যক্তিজীবন ছিল প্রতিকূল পরিস্থিতির সামূহিক বৈনাশিকতায় পর্যুদস্ত; তিনি ছিলেন লাজুক, গম্ভীর, স্বল্পবাক এবং প্রচার বিমুখ মানুষ।

সাংসারিক কাজকর্মেও কতকটা উদাসীন ছিলেন। তাঁর জীবনের অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা খুব চরিতার্থতা লাভ করে নি। ভাগ্যের প্রসন্ন দৃষ্টি থেকেও তিনি বঞ্চিত হয়েছেন। ইংরেজি সাহিত্যে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করার পরও প্রত্যাশানুরূপ চাকরি পাননি, দীর্ঘদিন তাঁকে বেকারত্বের গদ্বানি সহ্য করতে হয়েছে। চাকরিচ্যুত হওয়ার মতো বেদনাদায়ক ঘটনাও তাঁর জীবনে ঘটেছে।

জীবিতকালে জীবনানন্দ দাশ কবি হিসেবে তেমন মূল্যায়িত হননি; বরং তাঁর কবিতা সম্পর্কে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ও তীর্যক সমালোচনা করা হয়েছে। কবি-'গ-ার'; ভাবান্তরহীন কবি প্রভৃতি নামে আখ্যায়িত করে অনেকেই তাঁকে প্রাণঘাতী যন্ত্রণা দিয়েছেন। তাঁর চেতনায় বিচ্ছিন্নতা বাসা বাঁধার মূলে বরিশাল ত্যাগ করে কলকাতার জটিল যান্ত্রিক জীবনে বসবাসও বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। বরিশালের শ্যামলিম প্রকৃতির মধ্যে অতিবাহিত হয়েছে তাঁর শৈশব-কৈশোর; বলা চলে বরিশালের প্রকৃতির সি্নগ্ধ পরিবেশের সঙ্গে জীবনানন্দ একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতির বাস্তবতা তাঁকে এই প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে।

কলকাতার ফাঁপা মানুষ আর যান্ত্রিক জীবন তাঁর দুর্বিষহ মানসিক যাতনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ফলে বিচ্ছিন্ন হওয়া ছাড়া তাঁর কোন উপায় ছিল না। জীবনানন্দ দাশের দাম্পত্য জীবনও সুখের হয়নি। এর মূলে বিশেষভাবে দায়ী অর্থনৈতিক অনটন। তাছাড়া কবির ধীর, স্থির ও স্থিতধী জীবনযাপন স্ত্রী লাবণ্য দাশের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব বাড়িয়ে দেয়।

স্ত্রীর আচরণে জীবনানন্দ দাশ অসহনীয় মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করেছেন। কবির ভ্রাতুষ্পুত্র অমিতানন্দ দাশ বলেছেন : 'জীবনানন্দের বিয়ে সম্বন্ধ করে হয়েছিল, তাঁর সম্মতিতেই। ...কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ওঁদের দু'জনের মধ্যে ভালো মনের মিল হয়নি্ত তার প্রতিফলন রয়েছে জীবনানন্দের কবিতার মধ্যে। ' যুগজীবনের জটিলতা তাঁকে নিক্ষেপ করেছে একাকিত্ব অর্ণবে, তাঁকে জর্জরিত করেছে রোমান্টিক বিষণ্নতায়, আত্মসমাহিত করেছে মর্মান্তিক বেদনায় আর বিচ্ছিন্নপীড়িত করেছে তাঁর মানসচারিত্র্যকে। বিদেশী সাহিত্যের অধ্যয়নলব্ধ জ্ঞান জীবনানন্দের কাব্য ভাবনায় বিচ্ছিন্নতার সনি্নপাত ঘটাতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে।

যুদ্ধসৃষ্ট যন্ত্রণায় ক্ষত-বিক্ষত হয়ে জীবনানন্দ দাশ উচ্চারণ করেছেন : 'এখন অপর আলো পৃথিবীতে জ্বলে;/কি এক অপব্যয়ী অক্লান্ত আগুন'! এতে স্যাসুন এবং ওয়েনের কবিতার সুস্পষ্ট প্রভাব পরিদৃশ্যমান। যুদ্ধের ভয়াবহতা, অবক্ষয়, ক্লান্তি, হতাশা, বিচ্ছিন্নতা প্রকটভাবে চিত্রিত হয়েছে টি. এস. এটিয়টের ্তুঞযব ডধংঃব খধহফ্থ, ্তুএবৎড়হঃরড়হ্থ, ্তুঞযব ঐড়ষষড় িগবহ্থ ইত্যাদি কবিতায়। এসব কবিতার প্রত্যক্ষ প্রভাব পরিদৃষ্ট হয় জীবনানন্দের কাব্যে বিধৃত বিচ্ছিন্নতার মধ্যে। এক কথায় বলা যায়, ইংরেজি সাহিত্যের অধীত জ্ঞান তাঁর বিচ্ছিন্নতা বা অনন্বয়বোধকে তীব্র ও গভীরতর করেছে। 'জীবনানন্দ প্রকৃত কবি; প্রকৃতির কবি' হলেও প্রকৃতি তাঁর বিচ্ছিন্নতাপীড়িত কবিচৈতন্যে সৃষ্টি করেছে অনিঃশেষ নিঃসঙ্গতা।

এ-জন্যই 'রূপসী বাংলা' কাব্যের কবিতাগুলো তিনি পত্রিকা কিংবা গ্রন্থে প্রকাশ না করে বাক্সবন্দি করে লোকচক্ষুর অন্তরালে রেখেছিলেন। কবিতা রচনায় সূচনালগ্ন থেকেই তাঁর কবিসত্তায় হানা দিয়েছে নিরাকপরা প্রকৃতির শূন্যরূপ। ফলে প্রথম কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতাতেই তিনি উচ্চারণ করেছিলেন : 'আমি কবি,জ্জসেই কবি,জ্জ/আকাশে কাতর অাঁখি তুলি হেরি ঝরা পালকের ছবি'! অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তিনি প্রকৃতির ধূসর-ঊষর রূপচ্ছবি অবলোকন করেছেন। ফলে প্রকৃতিকে তিনি উপস্থাপন করেছেন হেমন্তের ভয়ংকর শূন্যতার আস্তরণে। হেমন্তের ধূসর জীর্ণ-শীর্ণ প্রকৃতি, রিক্ত মাঠ, শূন্য প্রান্তর ঘুরেফিরে এসেছে তাঁর কবিতায়।

জীবনের জ্বালাকে, নিঃসঙ্গ চিত্তের বেদনাকে প্রকাশ করতে তিনি হেমন্তকেই বেছে নিয়েছিলেন। কবিসত্তার বিচ্ছিন্নতার কারণে জীবনানন্দের প্রিয় ঋতু হেমন্ত তাঁর চেতনায় প্রাচুর্য নিয়ে উপস্থিত হয়নি, উপস্থিত হয়েছে শূন্যতা, রিক্ততা এবং বেদনা নিয়ে। প্রকৃতির মোহনীয় রূপমাধুরী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছিলেন বলে সবুজ রূপের মহিমা নয়, হেমন্তের নেতিবাচক ভাবলোকই ভিড় করেছে তাঁর কবিচেতনায় : 'প্রথম ফসল গেছে ঘরে, ্ত/হেমন্তের মাঠে-মাঠে ঝরে/শুধু শিশিরের জল;/অঘ্রাণের নদীটির শ্বাসে/হিম হয়ে আসে/বাঁশ-পাতা্তমরা ঘাস্তআকাশের তারা!' হেমন্তের শূন্য প্রান্তরের পাশাপাশি কুয়াশাচ্ছন্ন পরিপার্শ্ব, পাখির নষ্ট নীড় আর প্রকৃতির বিধ্বস্ত রূপের ভয়াল চিত্র পাওয়া যায় জীবনানন্দের কবিতায়। কেবল হেমন্তের বিষণ্নতা নয়, শীতের রিক্ততাও জীবনানন্দের বিচ্ছিন্নতাক্লিষ্ট কবিচিন্তায় প্রকাশ পেয়েছে। মাঘ সংক্রান্তির রাত যেমন বার বার স্থান পেয়েছে তাঁর কবিতায়, তেমনি রূপায়িত হয়েছে পৌষের কুয়াশাচ্ছন্ন প্রকৃতির বিষণ্নমূর্তি 'পউষের কুয়াশায় সাপের খোলস, পাতা, ডিম/প'ড়ে আছে ঘাসে/কেন যে করুণ চোখ পথ ভুলে ভেসে গেল/ময়জানি নদীটির পাশে।

' নিঃসঙ্গতাপীড়িত কবি জীবনানন্দ প্রকৃতির নেতিবাচক চিত্রই তাঁর কাব্যে অঙ্কন করেছেন। নিসর্গের সতেজ, সৌন্দর্যম-িত, প্রাণোচ্ছল ছবি তিনি অাঁকেননি। শুধু তাই নয়, হেমন্তের ঝড়, সবুজ রোমশ নীড়, বাসি পাতা ভূতের মতন, হলুদ জ্যোৎস্না, হলুদ নদী, সোনালী ডিমের মত ফা-ুনের চাঁদ, নীল হাওয়ার সমুদ্র, শিঙের মত বাঁকা নীল চাঁদ, কমলা রঙের রোদ, শতাব্দীর নীল অন্ধকার, সোনালি সোনালি চিল প্রভৃতি সব অস্বাভাবিক নৈসর্গিক প্রসিদ্ধি ব্যবহৃত হয় তাঁর কবিতায়। তাঁর বিচ্ছিন্নতার যন্ত্রণাদগ্ধ কবিমানসে প্রকৃতি লাভ করে ধূসর রং। পরিবার ও প্রেম বিচ্ছিন্নতা জীবনানন্দের কবিমানসের অন্যতম মৌল উপাদান।

পিতা-মাতা, ভাইবোনের সম্মিলনে যে শিক্ষিত, সাংস্কৃতিক, সাহিত্যিক ও আদর্শিক পারিবারিক আবহাওয়ায় জীবনানন্দ বড় হয়েছেন বাস্তবতার নির্মমতায় সে পারিবারিক বন্ধন ছিন্ন হয়ে যায়। মায়ের সঙ্গে ছিল কবির অন্তরঙ্গতা। মঞ্জুশ্রী দাশ জানিয়েছেন : 'আমার ঠাকুমা ছিলেন বাবার সবচেয়ে প্রিয়জন। ঠাকুমার মৃত্যুর সময়ে দেখেছি বাবার মুখে অফুরান বেদনা। কিন্তু চোখে জল নেই।

' পারিবারিক জীবনে মাতৃনির্ভরতা কবিকে অনেক সময় মানসিক প্রশান্তি দিয়েছিল। সংসারকর্মে উদাসীন, জীবন সংগ্রামে পর্যুদস্ত, ভাগ্যের প্রসন্ন দৃষ্টি থেকে বঞ্চিত কবি জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে তাঁর মায়ের উৎকণ্ঠার শেষ ছিল না। তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন জীবনানন্দের মানসিক শান্তি বজায় রাখার জন্য। তিনি যাতে সুস্থিরভাবে কাব্যচর্চা করতে পারেন সেজন্য কবিমাতা সারাক্ষণ তাঁকে আগলে রাখতেন। জীবনানন্দের সহোদরা সুচরিতা দাশ লিখেছেন : 'দাদা যে ঠিক সাংসারিক মানুষ নন, তাঁর জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষা খুব যে চরিতার্থতা লাভ করে নি, ভাগ্যের প্রসন্ন দৃষ্টি যে অনেক ক্ষেত্রেই তিনি লাভ করলেন না, সেজন্য অন্তত তাঁর কাব্যসাধনার জন্য একটুখানি অনুকূল পরিবেশ থাক, আর সেইখানে থাক অন্তত একটু সান্ত্বনা, সারাজীবন ধরে সেই চেষ্টাই করে গেছেন মা।

' জীবন ও সময়ের তাড়না এবং মহাকালের অমোঘ বিধান জীবনানন্দকে মা-বাবা, ভাইবোনের অন্তরঙ্গতায় গড়া পারিবারিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। পরিবার বিচ্ছিন্নতা তাঁর মধ্যে অনন্বয় সৃষ্টি করে। প্রেম বিচ্ছিন্নতা জীবনানন্দের ব্যক্তিজীবন ও কবিসত্তাকে সবচেয়ে বেশি নৈঃসঙ্গ্যপীড়িত করেছে। 'অপ্রেম' শব্দটি জীবনানন্দই শিখিয়েছেন আমাদের। ব্যক্তিজীবনের নানা পরিসরে তিনি প্রেয়সী কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন।

তাঁর প্রেমের কাহিনী এখন আর কল্পকথা নয়। 'বরং পেয়ে হারানোর ট্র্যাজেডিই সত্য হয়ে উঠেছে তাঁর জীবনে। ' কিশোর বয়সের প্রেমিকা, পরিণত বয়সের প্রেমিকা সবাই তাঁর কাছ থেকে দূরে চলে গেছে। স্ত্রীও প্রেম দিয়ে তাঁর মনের অলিন্দ পরিপূর্ণ করেননি; বরং উপেক্ষার বিষাক্তবাণে তাঁর হৃদয়কে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করেছেন। এ সম্পর্কে আহমদ রফিক বলেছেন : 'দিনলিপিতে কথিত গ্রামীণ কিশোরী (রুরাল গার্ল)-কে অনিবার্য কারণে সরে যেতে হয়; কারণ হতে পারে মৃত্যু অথবা সামাজিক বাধ্যবাধকতা।

তেমনি সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে পরিণত বয়সী নাগরিক প্রেমিকাকে (দিনলিপির 'ণ' চিহ্নিত নারী) কবি'র জীবন থেকে সরে যেতে দেখা যায়। কবির প্রগাঢ় আহ্বানে প্রেমিকার তরফ থেকে সাড়া মেলে না। একটি সংরক্ত প্রেমের মৃত্যুই সত্য হয়ে ওঠে। এ ধরনের ঘটনা জীবনানন্দ দাশের আপাত শান্ত জীবনে ঝড় তুলেছিল, চেতনা বিপর্যস্ত করে তুলেছিল। ' বিবাহোত্তর পর্বেও দু'দ- শান্তির উৎসব তাঁর জীবনের জন্য তৈরি হয়নি।

প্রেম প্রত্যাখ্যাত হওয়ার বেদনা জীবনানন্দের চিত্তকে বিধ্বস্ত করেছে। তাঁর কবিতার পরতে পরতে সনি্নবেশিত হয়েছে প্রেমের অপ্রাপনীয়তার বেদনাগাঁথা : 'তারে আমি পাই নাই;্ত কোন এক মানুষীর মনে/কোনো এক মানুষের তরে/যে- জিনিস বেঁচে থাকে হৃদয়ের গভীর গহ্বরে!্ত/নক্ষত্রের চেয়ে আরো নিঃশব্দ আসনে/কোন এক মানুষের তরে এক মানুষীর মনে!' যে প্রেয়সী জীবনানন্দকে ব্যথা দিয়ে দূরে চলে গেছে তাকে তিনি ভুলতে পারেননি কখনো। বার বার তার কথা স্মরণ করেছেন। প্রেয়সীর বিচ্ছেদ যন্ত্রণায় তিনি ছটফট করেছেন। তাঁর মানসী বনলতা সেন, সুচেতনা, সুদর্শনা, সুরঞ্জনা, সবিতা, বেহুলা, শ্যামলী, শঙ্খমালা সবাই অনন্ত কালের পরিচিত হয়েও যেন চির অচেনা, তারা তাই অধরা প্রতিমারূপে ধরা দিয়েছে।

কাব্যজীবনের সূচনা থেকে তিনি নির্বেদ নিঃসঙ্গতার দুর্মর আবর্তে নিমগ্ন হলেও, কোন নারী এসে সেখান থেকে তাকে মুক্তির অমরাবতীতে নিয়ে যেতে পারেনি, তাই একাকিত্ব আর নৈঃসঙ্গ্যতার বেদনায় দীর্ণ জীবনানন্দ প্রেমের অধরা রূপ ফুটিয়ে তোলেন তাঁর কবিতায়। নারীকে ভেবেছেন ঘাইহরিণী। প্রেমের পাত্রীর মধ্যে দেখেছেন মেকি কৃত্রিমতা : 'চেয়ে দেখি, ্তদুটো হাত, ক'খানা আঙুল/একবার চুপে তুলে ধরি;/চোখ দুটো চূন-চূন, ্তমুখ খড়ি-খড়ি!/থুত্নিতে হাত দিয়ে তবু চেয়ে দেখি/সব বাসি, সব বাসি,্তএকেবারে মেকি!' প্রেম বিচ্ছিন্নতা জীবনানন্দের কবিসত্তায় অনন্ত শূন্যতা সৃষ্টি করেছে। এই শূন্যতাকে ব্যাপকতা দান করেছে ধানসিঁড়ি নদীর পাশে ভিজে মেঘের দুপুরের চিলের ডাক। বিচ্ছিন্নতার বেদনায় মুষড়ে পড়ে কবি উচ্চারণ করেছেন : 'হায় চিল, সোনালি ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে/তুমি আর কেঁদো নাকো উড়ে উড়ে ধানসিড়ি নদীটির পাশে!/তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো তার সস্নান চোখ মনে আসে!/.../কে হায় হৃদয় খুঁড়ে/বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!' এই বেদনা প্রেম বিচ্ছিন্নতার বেদনা।

জীবনানন্দ দাশকে বলা হয় 'এক বিমূঢ় যুগের বিভ্রান্ত কবি। ' তাঁর কবিতা রচনার কাল ছিল নানা কারণে দ্বন্দ্ব-সংঘাত এবং বিপর্যয়ের কর্কটরোগে আক্রান্ত। মানুষের স্বার্থপরতা, হীনম্মন্যতা, হিংসা, সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ধ্বংসযজ্ঞ, ফ্যাসীবাদের তা-বলীলা সমকালীন যুগের এই নির্মম অসঙ্গতিগুলো জীবনানন্দের কবিচিত্তকে আহত করেছিল। পৃথিবীর অসুন্দর রূপ ও যুগজ্বর দেখে ক্লান্ত, নিরাশ এবং হতাশাগ্রস্ত হয়ে তিনি উচ্চারণ করেছিলেন : 'ছিঁড়ে গেছি,্ত ফেঁড়ে গেছি,্ত পৃথিবীর পথে হেঁটে-হেঁটে...। ' কখনো বলেছেন : 'আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন...।

' অধঃপাত কবলিত যুগের বিপন্ন অবস্থা দেখে তিনি শূন্যতা ও হাতাশায় জর্জরিত হয়েছেন। তিনি অনুভব করেছেন : 'পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন'। সমকালীন জীবনকে মর্ম দিয়ে উপলব্ধি করে আর্থ-সামাজিক-নৈতিক ও মানবিক অবক্ষয়ের চূড়ান্ত পরিণতির রূপ দেখে কবির ধারণা জন্মেছে সবকিছুর মতোই মানুষের হৃদয়ও আজ শেয়াল-শকুনের খাদ্যে পরিণত হয়েছে। পুঁজিবাদের নির্মমতা যুগের যে অবস্থা সৃষ্টি করেছে তার উদ্ভাসন জীবনানন্দের কবিতায় : 'কিন্তু সেই শুভ রাষ্ট্র ঢের দূরে আজ। /চারিদিকে বিকলাঙ্গ অন্ধ ভিড়্ত অলীক প্রয়াণ।

/মন্বন্তর শেষ হ'লে পুনরায় নব মন্বন্তর;/যুদ্ধ শেষ হ'য়ে গেলে নতুন যুদ্ধের নান্দীরোল;/মানুষের লালসার শেষ নেই/উত্তেজনা ছাড়া কোন দিন ঋতু ক্ষণ/অবৈধ সংগম ছাড়া সুখ/অপরের মুখ সস্নান করে দেওয়া ছাড়া প্রিয় সাধ/নেই। ' যুগজীবনের জটিল রূপ দেখে জীবনানন্দ অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। ফলে তাঁর পারিপাশ্বর্িক পরিম-ল এমনকি আপন সত্তার মধ্যেও দানা বেঁধেছে বিষণ্নতা। তাঁর চোখে পড়েছে : 'ভোরের বেলায় আজ একটি কঠিন অবসাদ/বিকেল বেলায়ও আজ একটি কঠিন/বিষণ্নতা লেগে আছে পৃথিবীর বুকে। ' তিনি আরও অনুভব করেছেন : 'মৃত্যু আর মাছরাঙা ঝিলমিল পৃথিবীর বুকের ভিতরে/ চারিদিকে রক্ত ঋণ গ্লানি ধ্বংসকীট নড়েচড়ে'।

এ সবকিছু অবলোকন করে কবির ধারণা জন্মেছে,_ 'অদ্ভুত অাঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ'। সমাজ, পরিবার তথা জগৎ-জীবনের সমস্ত কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে উচ্চারণ করেন : 'আলো-অন্ধকারে যাই্তমাথার ভিতরে/স্বপ্ন নয়,্ত কোন এক বোধ কাজ করে;/স্বপ্ন নয়,্ত শান্তি নয়্ত ভালোবাসা নয়,/হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়!' ক্লান্তি আর অবসাদভরা মন নিয়ে তিনি যেদিকে তাকিয়েছেন, সেদিকেই দেখেছেন শূন্যতা। বিচ্ছিন্নতাবোধ থেকেই জীবনানন্দ দাশ তাঁর ইতিহাস চেতনার মধ্যে ভয়াবহ বেদনার চিত্র অঙ্কন করেছেন। অতীত ইতিহাসের কোথাও গিয়ে তাঁর কবিসত্তা স্বস্তি পায় নি। আঘাতের পর আঘাত, বেদনার পর বেদনার অভিঘাতে তিনি একবারে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিলেন।

তিনি দেখেছেন : 'সময়ের হাতে সবি বিচ্ছিন্ন ভঙ্গুর। ' কোথাও তিনি আশার আলো দেখতে পাননি; কারণ : 'একটি পৃথিবী নষ্ট হ'য়ে গেলে এবারে মানুষ/চেয়ে দেখে আরেক পৃথিবী বুঝি ধ্বংসপ্রায়;/লোভ থেকে লোভে তবু ্ত ভুল থেকে ভুলে/শূন্যতার থেকে আরো অবিকল শূন্যতার দিকে/আবর্ত ক্রমেই আরো দ্রুত হ'য়ে আসে। ' এই হতাশা, অবসাদ ও নৈরাশ্য তাঁর হৃদয়ে স্থায়ী আসন পেতে বসেছিল। হতাশা ও নৈরাশ্য থেকে তিনি বিচ্ছিন্নতায় আক্রান্ত হয়েছেন। বিচ্ছিন্নতার যন্ত্রণায় ছটফট করেছেন এবং নক্ষত্রের দিকে চেয়ে উচ্চারণ করেছেন : 'সন্ধ্যার নক্ষত্র, তুমি বলো দেখি কোন্ পথে কোন্ ঘরে যাবো!/কোথায় উদ্যম নাই, কোথায় আবেগ নাই,্ত চিন্তা স্বপ্ন ভুলে গিয়ে/শান্তি আমি পাবো?/রাতের নক্ষত্র তুমি, তুমি বলো দেখি কোন্ পথে যাবো?' সত্যিই কোন পথ তিনি পাননি, যে পথে শান্তি আছে, আছে আলো।

অন্ধকার সমুদ্রের তিমির মতো রাত্রির ভয়াবহতা ছাড়া আর কিছুই দেখেননি তিনি। বিচ্ছিন্নতা ধীরে ধীরে কবির নিজের কাছেই নিজেকে অপরিচিত করে তুলেছে। মার্কসীয় তত্ত্বে দেখা যায় বিচ্ছিন্নতা যেভাবে শ্রমিকের কাছে শ্রমিকের নিজের কাজকে অপরিচিত (ওহফরভভবৎবহঃ) বলে মনে হয়, জীবনানন্দেরও ঠিক তেমনি নিজের সত্তাকে, নিজের ভুবনকে অপরিচিত মনে হয়েছে। নিজের প্রতি সংশয়িত ্তনিজের সত্তার প্রতি দ্বিধান্বিত হয়ে কবি উচ্চারণ করেছেন : 'যারা পৃথিবীর বীজক্ষেতে আসিতেছে চ'লে/জন্ম দেব্তে জন্ম দেবে ব'লে :/তাদের হৃদয় আর মাথার মতন/আমার হৃদয় নাকি? ্ত তাহাদের মন/আমার মনের মতো না কি?' কখনো সত্তা বিচ্ছিন্নতার জ্বালায় ক্ষত-বিক্ষত হয়ে বলেছেন : 'কোনোদিন মানুষ ছিলাম না আমি। /হে নর, হে নারী,/তোমাদের পৃথিবীকে চিনি নি কোনদিন;/আমি অন্য কোন নক্ষত্রের জীব নই।

/যেখানে স্পন্দন, সংঘর্ষ গতি, যেখানে উদ্যম, চিন্তা, কাজ,/সেখানেই সূর্য, পৃথিবী, বৃহস্পতি, কালপুরুষ, অনন্ত আকাশ গ্রন্থি,/শত শত শূকরের চিৎকার সেখানে,/শত শত শূকরীর প্রসববেদনার আড়ম্বর;/এইসব ভয়াবহ আরতি!/গভীর অন্ধকারের ঘুমের আস্বাদে আমার আত্মা লালিত;/আমাকে কেন জাগাতে চাও?' পরিবার, সমাজ, নৈতিক-সামাজিক মূল্যবোধ এমনকি আপন সত্তা থেকে বিচ্ছিন্নতার পর যে ক্লান্তিচেতনা ও নৈঃসঙ্গ্য সৃষ্টি হয় তার চূড়ান্ত রূপায়ণ ঘটে মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে। কার্ল মার্কস বিচ্ছিন্নতা থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে সমাজ পরিবর্তনের কথা বলেছেন। শিল্পের যে অগ্রগতি বুর্জোয়া শ্রেণী না ভেবেই বাড়িয়ে চলে, তার ফলে শ্রমিকদের মধ্যে প্রতিযোগিতাহেতু বিচ্ছিন্নতার জায়গায় আসে সম্মিলনহেতু বৈপ্লবিক সংযুক্তি। বুর্জোয়ার পতন ও প্রলেতারিয়েতের জয় লাভের ভেতরে ধনতান্ত্রিক বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটে। জীবনানন্দের সমসাময়িক কবিদের মধ্যে বিষ্ণু দে ও সমর সেন মার্কসবাদে দীক্ষিত হয়ে বিচ্ছিন্নতা উত্তরণের রসদ খুঁজেছেন।

কিন্তু জীবনানন্দ না ধর্ম, না মার্কসবাদ_ এ দুয়ের কোন কিছুকে অন্বিষ্ট করতে পারেননি। কাব্য সাধনার প্রথম পর্যায়ে মৃত্যু তথা জীবন থেকে পলায়নকে তিনি বিচ্ছিন্নতা উত্তরণের উপায় ভেবেছিলেন। তিনি কখনো ঘাস, কখনো কমলালেবু, কখনো বনহংস, কখনো শঙ্খচিল শালিকের বেশে জন্মগ্রহণ করতে চেয়েছেন। কিন্তু বিচ্ছিন্নতার মর্মভেদী যন্ত্রণা যখন ভোগ করেছেন, তখনই মৃত্যুর মাধ্যমে জীবনের জ্বালা মিটিয়ে বিচ্ছিন্নতা উত্তরণের পথ খুঁজেছেন : 'মৃত্যুরে বন্ধুর মত ডেকেছি তো, জ্জপ্রিয়ার মতন!্ত/চকিত শিশুর মত তার কোলে লুকিয়েছি মুখ;/...। ' শরীরের অবসাদ, হৃদয়ের জ্বর থেকে মুক্তি পেতে এবং বিচ্ছিন্নতার অভিঘাত দূর করতে তিনি মৃত্যুকেই ভেবেছেন কাঙ্ক্ষিত মুক্তির পথ।

এভাবে জীবনানন্দ 'যতদিন বেঁচে আছি,' 'যেদিন মরিয়া যাব,' 'ঘুমায়ে পড়িব আমি,' 'যখন মৃত্যুর ঘুমে,' 'যদি আমি ঝ'রে যাই', 'মনে হয় একদিন,' 'একদিন কুয়াশায়' প্রভৃতি কবিতায় প্রত্যক্ষভাবে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জীবনের জ্বালা দূর করার কথা বলেছেন। আত্মহত্যার চিন্তায় মগ্ন হয়ে লিখেছেন 'আট বছর আগের একদিন' কবিতাটি। জীবনানন্দের কবিতায় বিষয়ের পাশাপাশি প্রকরণশৈলীর মধ্যে বিচ্ছিন্নতার প্রকোপ পরিদৃষ্ট হয়। বিচ্ছিন্নতার যন্ত্রণাজাত অস্থিরতা, ক্লান্তি, মৃত্যুচিন্তা ও বিষণ্নতা তাঁর কাব্য-কবিতার নামকরণ, চরণ ও শব্দবিন্যাস এবং ছন্দ-অলঙ্কার প্রয়োগের মধ্যেও আভাসিত হয়। 'ঝরা পালক', 'ধূসর পা-ুলিপি,' 'সাতটি তারার তিমির,' 'বেলা অবেলা কালবেলা' _কাব্যের এ জাতীয় নামকরণের মধ্যে শূন্যতা, বিবর্ণতা এবং বিচ্ছিন্নতার আবহ ঘনীভূত হয়।

কবিতার নামকরণের মধ্যেও এ বৈশিষ্ট্য পরিদৃশ্যমান। 'মরীচিকার পিছে', 'জীবন-মরণ দুয়ারে আমার', 'অস্তচাঁদে', 'ছায়া প্রিয়া', 'শ্মশান', 'মরুবালু', 'নির্জন স্বাক্ষর', 'স্বপ্নের হাতে', 'হায় পাখি একদিন', 'যদি আমি ঝরে যাই', 'ভিজে হয়ে আসে মেঘ', 'হায় চিল', 'নগ্ন নির্জন হাত', 'অন্ধকার', 'ধান কাটা হয়ে গেছে', 'অঘ্রাণ প্রান্তরে', 'নিরালোক', 'শব', 'স্থবির যৌবন', 'মৃত্যু স্বপ্ন সংকল্প', 'হে হৃদয়', 'একটি নক্ষত্র আসে', 'মানুষের মৃত্যু হলে', 'মৃত মাংস'্ত কবিতার এসব নাম বিচ্ছিন্নতার ভাবকে প্রকাশ করে। কাব্যভাষায় বক্তব্য সনি্নবেশে জীবনানন্দের অনন্বয়বোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। তাঁর ভাবনা কখনো এলোমেলো, কখনো আবার পরস্পরবিরোধী। একইসঙ্গে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর কাব্যভাষায় সঞ্চারিত হয়েছে।

অনেক সময় কবিতার মধ্যে বিপরীতধর্মী বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। বেদনার উল্লাস, ভয়াবহ স্বাভাবিক, ভীষণ সুন্দর, উল্লাসের মতন যন্ত্রণা প্রভৃতির ব্যবহার বিচ্ছিন্নতাবোধের পরিচায়ক। একই কবিতার মধ্যে বক্তব্যের বৈপরীত্য আনয়ন করে জীবনানন্দ দাশ বিচ্ছিন্নতাকে প্রগাঢ়তর করেছেন। তিনি একবার লেখেন : 'মড়ার কবর ছেড়ে পৃথিবীর দিকে তাই ছুটে গেল মন'। ঐ কবিতাতেই আবার লিখেছেন : 'ঘুমাব বালির পরে জীবনের দিকে আর যাব নাকো ছুটে'।

এভাবে কাব্যভাষায় ও ভাবে জীবনানন্দ বিচ্ছিন্নতার এক জটিল গ্রন্থি রচনা করেছেন। শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও হতাশা, ক্লান্তি, অবসাদ, ব্যর্থতা এবং সংশয়ের যন্ত্রণা লক্ষ্যগোচর হয়। কাতর অাঁখি, স্তম্ভিত নয়নে, দুরাশার মোহে, কুহকের কুলে, দুপুরের আকাশ, ঝরা পাতা, ভিজে মেঘের দুপুর, মরা দরিয়া, চিলের কান্না, ঘুমসাগরের রাতে, নিখিলের নীরবতা, ধূসর মেঘের ফাঁক, পউষ নিশা, শিরশিরে পুবালী হাওয়া, শ্মশান, মরুবালি, ভাঙ্গা হাল, আলেয়া, অন্ধকার, হায়, নষ্টশসা, পচা চাল কুমড়া, প্রলাপপা-ুর, বৃশ্চিক- গ্রথিক অাঁধার,্ত এসব শব্দ চয়নের মধ্যে এক ধরনের রিক্ততা ও বিষণ্নতার আবহ সৃষ্টি হয়্ত যা জীবনানন্দের কবিতায় বিচ্ছিন্নতা বোধকে শাণিত করে। কাব্যে ছন্দ-অলঙ্কার-চিত্রকল্প এবং প্রতীক ব্যবহারের ক্ষেত্রেও জীবনানন্দ বিচ্ছিন্নতার স্ফুরণ ঘটিয়েছেন। যুগের ক্লান্তি, তিক্ততা, হতাশা প্রভৃতি ফুটিয়ে তুলতে যে ছন্দের প্রয়োজন, তিনি সে ছন্দেই কবিতা লিখেছেন।

নির্জনতা, একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতার রূপনির্মাণে কবি অজস্র প্রতীক ব্যবহার করেছেন। নির্জন খড়ের মাঠ, ইঁদুর, পেঁচা, নক্ষত্র, ঝিঁঝির ডাক, রাতের তারা, নীরব চাঁদ্ত এসব নির্জনতার প্রতীক। কাজেই জীবনানন্দের কবিতার শৈল্পিক পরিসরেও বিচ্ছিন্নতার উদ্ভাসন পরিলক্ষিত হয়। বিচ্ছিন্নতা জীবনানন্দ দাশের কবিসত্তার মর্মমূলে প্রোথিত। ব্যক্তিজীবনের দুর্ভোগ; দৈশিক, বৈশ্বিক এবং কালিক জীবনের জটিলতা তাঁকে নৈঃসঙ্গ্যপীড়িত করেছে।

কবিতার পরতে পরতে, ভাবে এবং ভাষার মধ্যে বিচ্ছিন্নতাদীর্ণ কবিচেতনাকে তিনি বাঙ্ময় করে তুলেছেন। ধনতান্ত্রিক শোষণ-নিষ্পেষণ, যান্ত্রিক জীবনের অভিঘাতে তিনি পরিবার, সমাজ, সমস্ত মূল্যবোধ এমনকি আপন সত্তা থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। বিচ্ছিন্নতা থেকে মুক্তির জন্য কখনো প্রকৃতির বুকে লীন হতে চেয়েছেন, কখনো প্রেমের মহিমাতে হয়েছেন অবলীন, কখনো আবার মৃত্যুর কোলে মাথা রেখে ঘুমাতে চেয়েছেন। সবদিক বিচারে বলা যায়, বিচ্ছিন্নতার রূপায়ণে জীবনানন্দ সার্থক। কাব্যের বিষয় এবং আঙ্গিক সবকিছুতেই তিনি নির্মাণ করেছেন অতলান্ত নিঃসঙ্গতা, দুঃসহ বিচ্ছিন্নতা এবং দুর্ভর যন্ত্রণার শিল্পপ্রতিমা।

# --------------------------------------------------------------------- দৈনিক সংবাদ সাময়িকী / ২২ অক্টোবর ২০০৯

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১২ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।