আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার উল্টামুখে চলা---স্কুল অধ্যায়

I am what I am and that's how I would be. No I am not stubborn. I just want to be myself.

You must stand out!! You have to be THE ONE!! আমার স্কুল-পড়া সময়ে কে-যেন আমাকে কানের কাছে একগাদা লেকচারের মাঝে এই কথাটা বলেছিল। মনে নেই কে বলেছিল। আসলে ছোটবেলা থেকে এত বেশীমাত্রায় লেকচার শুনেছি; লেকচারকারীদের হাত থেকে পালিয়ে বেড়ানোটাই মূখ্য করে লুকিয়ে বেড়িয়েছি। তবুও উপরের কথাদুইটা কিভাবে যেন মনে গেঁথে গিয়েছিল। কে-যে বলেছিল, সেটা মনে থাকলে আজ তাকে খুঁজে বের করে অ্যান্টি-লেকচারের উড়াধুরা বন্যায় ভাসিয়ে দিতাম।

আমাকে সবার থেকে আলাদা হতে হবে। সচেতনে-অবচেতনে আমি এই টার্গেট নিয়ে চলা শুরু করলাম। স্কুলে আমার বড়বোনেরা রীতিমত লেজেন্ড একেকজন! পড়াশুনায়, গানে, হস্তাক্ষরে, শিষ্টাচারে...তুলনাহীন! আমি ভর্তি হওয়ার পরই টের পেলাম আমাকে স্কুলের ইট-কাঠ-দেয়াল থেকে শুরু করে টিচার এমনকি বুয়ারা পর্যন্ত পরম্পরার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। কেউ সরবে, কেউ নীরবে। কেউ ভর্তসনায়, কেউ অগ্নিদৃষ্টিতে।

তখনই সংকল্প নিলাম, আমাকে ওদের চেয়ে আলাদা হতে হবে। ওরা গায়িকা, আমাকেও তাই ধরেবেঁধে তুলে দেওয়া হলো মঞ্চে। গাইতে জানিনা বললে হবেনা। অমুক তো নজরুল গায় আর তমুক তো রবীন্দ্রসংগীতে তুখোড়! তবে তুমি কেন পারবেনা? আর কিছু না-করো, কোরাসে তো নাম দাও!! তাই-ই সই। আমার বোনদের মান গেলো, আমি পেলাম সান্ত্বনা, কিছুটা তো অন্যরকম হতে পারলাম! হাতের লেখা বাজে।

না-না-কিছুতেই আমি হস্তাক্ষর কম্পিটিশনে নাম দেবনা! তবুও পরম্পরার ঠেলায় নাম আমার ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। যাচ্ছেতাই লেখা, টিচাররা হতাশ, আমার মনে পৈশাচিক উল্লাস! আমার বোনেরা কেউ খেলোয়াড় ছিলনা। আমি তাই খেলার খাতায় নিয়মিত নাম লেখালাম। বৃত্তিবাজ ছিল সবাই, ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পরীক্ষায় আমি ফেইল। ঘরে বাইরে সবার চোখ-রাঙানির ভেতরে আমার কঠিন আত্মতৃপ্তি "আমি আলাদা!!" এইটে মিড-টার্মে অংকে ফেইল।

টিচার আমার আম্মুকে ডেকে পাঠালেন। "আমি ভাবতেই পারিনা অমুক-তমুকের বোন কি করে ফেইল করে?" পাশ থেকে আরেক টিচার ফোড়ন কাটলেন "আরে আপনার মেয়ে তো গ্যাং লীডার!" আরেকজন বল্লেন "আরে এই মেয়ে কে তো দেখলাম সেদিন দলবল নিয়ে স্কুল-মাঠে ডাংগুলি খেলছে!!" ওয়াও, যেন ডাংগুলি খেলা বিশা-আ-ল কোনও অপরাধ!! ঠাস্!!, খেলাম মায়ের হাতে চড়। ঘরে রাখা হলো এক ছাত্র মাস্টার। সেই মাস্টারকে জ্ঞান দেওয়ার অভিলাষে আমার পড়া হয়ে গেলো অনেকদূর, পেলাম এইটে বৃত্তি। তবুও আমি ওদের চেয়ে আলাদা, ট্যালেন্টপুলে ছিলাম না।

ক্লাস নাইনে স্কুল পালালাম। দরকার ছিলনা কোনও। স্কুল আমার ভালোই লাগতো। তবুও পালালাম। আমাদের স্কুলের কঠীন নিরাপত্তা ভেদ করে পালানো একেবারেই অসম্ভব ছিল।

সেই অসম্ভব কে সম্ভব করার তীব্র বাসনায় আমি সাথে আরেক বান্ধবী নিয়ে স্কুলের পেছনের কনভেন্টের গেইট দিয়ে সিস্টারদের চোখ এড়িয়ে রাস্তায় চলে গেলাম। ছুটি পর্যন্ত লাওয়ারিশ ঘোরাঘুরি করে ছুটি-শেষে খোলা মেইনগেইট দিয়ে ঢুকে পড়লাম। কয়েকজনের প্রশ্নের সম্মুখীন হলেও ম্যানেজ করে নিলাম। মনে কয়েক ডজন ফুর্তি, আবার অনেকের চেয়ে আলাদা হলাম! আমি স্কুল ক্যাপ্টেন হবোনা। কিন্তু সেসময়ে ক্লাসমেটরা ভোট দিয়ে ভাইস-ক্যাপ্টেন বানাতো; নাইন থেকে দুইজন, টেন থেকে দুই।

এই চারজন থেকে একজন ওভারঅল পপুলারিটির ভিত্তিতে হতো স্কুল ক্যাপ্টেন। আমি যখন হয়ে গেলাম, তখন মনে পড়লো, হায় হায় আমার এক বোন তো ছিল স্কুল ক্যাপ্টেন!! আমাদের তৎকালীন হেডমিস্ট্রেস অবশ্য আমাকে খুব একটা সুনজরে দেখতেন না। ভেটো দিয়েছিলেন, বরাবর স্কুল ক্যাপ্টেন ভালো ছাত্রীরাই হয়ে এসেছে...কিন্তু আমার ফ্যান-ক্লাব তথা স্কুলের মেয়েরা বিপূল ভোট দেওয়ায় লাভ হয়নি। মাথায় ভুত চাপলো। বোন কলেজে ভর্তি হয়েছে, আমি তার সাথে কলেজে ক্লাস করতে যাবো।

স্কুল ফাঁকি দিয়ে। চিটাগাং কলেজ, না-জানি কী! আব্বু আম্মু থেকে শুরু করে চৌদ্দ গুষ্ঠি এই কলেজের পূনর্মিলনীতে সারিবেঁধে যোগ দেয়, আমি যেহেতু পরীক্ষা দিয়ে চান্স পাবোনা, এখন বরং দেখে আসি কলেজটা কী এমন!! একটা অ্যাপ্রণ জোগাড় করে বোন ও তার বান্ধবীদের ছত্রছায়ায় ক্লাস করে আসলাম। আমার সেসময় সালওয়ার কামিজ ছিলনা, অ্যাপ্রনের নীচে দেখা যাবেনা ভেবে শার্ট প্যান্ট পরেছিলাম। কিন্তু বাধ সাধলো আমার শার্টের কলার আর বব-কাট চুল। এর আগে কখনও ছেলেদের হাঁকডাক শুনিনি, সেবার প্রথম শুনলাম ছেলেপেলে দূর থেকে এটা সেটা বলে, হাততালি দেয়...বোনের ইজ্জত গেলো।

আমার কলেজ সফরের ইতি। স্কুলে দুইদিন মিস্ দেওয়ায় আমাকে বাদ দেওয়া হলো ক্যাপ্টেন থেকে। হেডমিস্ট্রেস নতুন নিয়ম জারী করলেন, ভাল ছাত্রীকে ক্যাপ্টেন করা হবে, যে কিনা স্কুলে নিয়মিত উপস্থিত থাকবে। ভোটাভুটি বাদ। কলেজের স্বাদ পেতে গিয়ে আমি দুইদিন অনুপস্থিত, তাই বরখাস্ত।

বাহ্, আবার হয়ে গেলাম অন্যরকম। স্কুলের ইতিহাসে আমিই মনে হয় প্রথম বরখাস্ত হওয়া ক্যাপ্টেন। (আরও লেখার ইচ্ছে ছিল, কারণ আসল পয়েন্টেই এখনও আসতে পারিনি। কিন্তু আমার আবার লেখার কলেবর বৃদ্ধিতে অ্যালার্জি আছে... আমার উল্টামুখে চলা---বিরতির পর

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।