বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
অনেক অনেক দিন আগেকার কথা। ঈজিয়ান সমুদ্রে থাসোস নামে একটি দ্বীপ ছিল। সেই থাসোস দ্বীপের রাজা ছিলেন আরিওন; ভারি দয়ালু আর প্রজাবৎসল রাজা ছিলেন আরিওন: সেই সঙ্গে ধর্মপ্রাণও ছিলেন; প্রতি মাসের পূর্ণিমার রাতে সমুদ্রপাড়ে দেবতা পোসেইদোনের পবিত্র উপাসনালয়ে দুটি বলিষ্ট ষাঁড় বলি দিতেন রাজা আরিওন ।
রাজা আরিওন-এর মনোরম রাজপ্রাসাদটি ছিল একেবারে সমুদ্রের পাড় ঘেঁষে। কালচে পাথরের প্রাসাদটি বিশাল; দীর্ঘ তার শত স্তম্ভের সমুদ্রমুখি অলিন্দটি। সেই দূরন্ত বাতাসের খোলা অলিন্দে দাঁড়ালে নিচে পাথুরে উপকূল, থাসোস দ্বীপের জমজমাট বন্দর ও ঈজিয়ান সমুদ্রের নীল জলের বিশাল বিস্তার চোখে পড়ে। রাজপ্রাসাদের ছাদটিও মনোরম ও বিশাল; এবং নানা রকম ফুলের গাছে পরিপূর্ন। রাজকন্যার জন্মের পর রাজা শখ করে ছাদের ওপর বাগান করেছেন।
রাজকন্যার নাম আডোনিয়া: গত বসন্তে অস্টাদশ বছরে পা দিয়েছে রাজকন্যদ ভারি সুন্দরী; নীলনয়না, তন্বী ও স্বর্ণকেশী। রাজকন্যা আডোনিয়া শুধু সুন্দরীই ছিল না, রাজকন্যার অনেক গুনও আছে। রাজকন্যা যেমন মৃদুভাষিনী, তেমনি বুদ্ধিমতী-প্রায়ই রাজা আরিওনকে রাজকার্যে পরামর্শ দেয়। তাছাড়া রাজকন্যা কবিতা লিখে, সে কবিতায় সুর করে লিরা বাজিয়ে গানও গায়।
এ সমস্ত গুণের কারণেই ঈজিয়ান দ্বীপের রাজারা ও রাজপুত্ররা রাজকন্যা আডোনিয়াকে বিয়ে করবার জন্য অধীর হয়ে উঠেছে।
রাতের বেলায় চাঁদ উঠলে রাজকন্যা আডোনিয়া রাজপ্রাসাদের ছাদে বসে গান গায়। বসন্তের জোছনার রাত রাজকন্যার ভারি প্রিয়। রাজকন্য আডোনিয়া যখন বসন্তের জোছনার রাতে রাজপ্রাসাদের ছাদে বসে গান গায়- তখন সে গানের সুর বহুদূর ছড়িয়ে যায়-এমনকী সে গানের সুর থাসোস দ্বীপের বন্দরের নাবিকদের উদাস করে দেয় ।
তেমনি এক বসন্তে রাতে রাজকন্যা আডোনিয়া রাজপ্রাসাদের ছাদে বসে লিরা বাজিয়ে গান গাইছিল।
আমি তো রয়েছি বসে একাকী নিরালায়,
বসন্তের সুমধুর বাতাসে পরশে যে আমায়;
আমায় খুঁজছে যে সে আমায় পাবে ...
রাজকন্যা আডোনিয়া যখন রাজপ্রাসাদের ছাদে বসে লিরা বাজিয়ে গান গাইছিল, আগুনের দেবী হেস্টিয়া সে সময় আকাশপথে উড়ে যাচ্ছিলেন।
দেবী গানের সুরে মুগ্ধ হয়ে চোখের পলকে সুন্দরী নারীর রুপ ধারণ করে নেমে এলেন রাজপ্রাসাদের ছাদে। সুন্দরী নারীর বেশে দেবী হেস্টিয়া কে দেখে রাজকন্যা আডোনিয়া চমকে না-গেলেও ভীষণ অবাক হল। লিরাটি নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আপনি?
আমি? আমি হেস্টিয়া ... আগুনের দেবী। দেবী হেসে বললেন।
ওহ্!
দেবী হেস্টিয়া বললেন, আমি যাচ্ছিলাম ক্রিট দ্বীপে, আকাশপথে যেতে যেতে তোমার গান শুনতে পেলাম।
তুমি এত ভালো গাও। ভাবলাম তোমার একপলক দেখে যাই।
ওহ্!
দেবী হেস্টিয়া বললেন, অনেকদিন আগে এখানেই তোমার মাকে আমি দেখেছিলাম । তখন এখানে বাগান ছিল না। তোমার মা ছিল ভীষণ সুন্দরী।
আমি তোমার মায়ের রুপে মুগ্ধ হয়ে গেছিলাম। তবে তোমার মা ছিল ভীষণ দুঃখী।
কেন?
তোমার বাবা লেসবিয় দ্বীপের এক দাসীর প্রেসে আসক্ত হয়ে পড়েছিল।
বাবা!
হ্যাঁ। দেবী হেস্টিয়া মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন।
রাজকন্যা আডোনিয়া অনেকটা আপনমনেই বলল, সবাই বলে রাজা আরিওন ভারি দয়ালু, প্রজাবৎসল ও ধর্মপ্রাণ; প্রতি মাসের পূর্ণিমার রাতে সমুদ্রপাড়ে ... সেই যে দেবতা পোসেইদোনের পবিত্র উপাসনালয়টি আছে- সেখানে দুটি বলিষ্ট ষাঁড় বলি দেন বাবা ।
দেবী হেস্টিয়া ঠোঁট উলটে বললেন, আমি অনেক দেখেছি। পুরুষের পক্ষে ধর্মপ্রাণ সম্ভব না। যাক। আমি তোমার মাকে বললাম: তোমার দুঃখ আমায় ভীষণ কাতর করে তুলেছে রানী আগনেটা, এখন তুমি আমার কাছে কি বর চাও বল? আমার কথা শুনে তোমার মা ক্ষাণিক ভেবে বলেছিল আমি সর্বগুণে গুণান্বিতা সুন্দরী এক কন্যার জননী হতে চাই ।
আমি ...আমি তোমার মায়ের ইচ্ছে পূরণ করেছিলাম।
ওহ্!
দেবী হেস্টিয়া জিজ্ঞেস করলেন, এখন তুমি বল আডোনিয়া তুমি আমার কাছ থেকে কি বর নেবে?
আমি আর কি বর নেব? রাজকন্যা আডোনিয়া ইতস্তত করে। চুপ করে থাকে। তখন দেবী হেস্টিয়া মিষ্টি হেসে বললেন, আগুন নেবে আগুন?
আগুন! রাজকন্যা আডোনিয়া বিস্মিত হয়ে যায়। তারপর দেবী হেস্টিয়ার চোখের দিকে চেয়ে তীক্ষ্ম স্বরে বলল, আমি আগুন নিয়ে কি করব?
আগুন তোমার কাজে লাগবে।
দেবী হেস্টিয়া রহস্য করে বলেন।
আগুন আমার কাজে লাগবে? রাজকন্যা আডোনিয়ার কন্ঠস্বর কেমন ঘোর লাগা।
হ্যাঁ।
কেন?
সময় হলেই জানতে পারবে? দেবী হেস্টিয়া রহস্য করে বলেন।
রাজকন্যা আডোনিয়ার বুকটা কাঁপছে।
প্রায় ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, আপনি কি করে জানলেন?
দেবীরা সব জানতে পারে। তুমি গানও ভুলে যাবে।
আমি গান ভুলে যাব মানে?
ও কিছু না ... এখন এই বালাদুটি পর তো। বলে দেবী হেস্টিয়া আডোনিয়ার দু হাতে দুটি রুপার বালা পরিয়ে দিলেন। তারপর বললেন, এ বালা দুটি ঘঁষলেই দাউদাউ করে আগুন ধরে যাবে।
রাজকন্যা আডোনিয়া কি বলতে যাবে। তার আগেই দেবী হেস্টিয়া অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
রাজকন্যার ঘোর আর কাটে না। দেবী হেস্টিয়া আমাকে বর দিলেন। আমার গান ভালো লাগে বললেন।
কিন্তু, আমি আগুন জ্বালিয়ে কি করব। রাজকন্যা বালা দুুটি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে। রুপার তৈরি। দুটি বালাতেই দেবী হেস্টিয়ার চিহ্ন অঙ্কিত। কিন্তু, আগুনের কথা বললেন কেন দেবী? তখন অনেক রাত।
চাঁদটা ঠিক আকাশের মাঝখানে। রাজকন্যা আডোনিয়ার দু চোখে ঘুম জমে উঠছে। রাজকন্য লিরাটি হাতে নিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। হঠাৎ চোখে পড়ল সিঁড়ির কাছে কে যেন দাঁড়িয়ে;- কে ওখানে? রাজকন্যার কন্ঠ থেকে ভয়ার্ত প্রশ্ন ছিটকে বেরোয়।
আমি।
ফিসফিসে চাপা পুরুষকন্ঠ। কে হতে পারে? আমি কে? বলে রাজকন্যা কৌতূহলবশত কয়েক পা এগিয়ে আসে।
আমি। আমি দাস অ্যাড্রিয়ানো।
ওহ্! তা তুমি কী চাও এখানে?
দাস অ্যাড্রিয়ানো চুপ করে থাকে।
দাস অ্যাড্রিয়ানো সদ্য রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরে কাজকর্মে সদ্য যোগ দিয়েছে। রাজকন্যা আডোনিয়া তীক্ষ্মকন্ঠে বলে ওঠে, তোমার এত সাহস ! এখানে কেনএসেছ? প্রহরীরা জানতে পারলে তোমাকে হত্যা করবে। তোমার কি মৃত্যুভয় নেই? দাস অ্যাড্রিয়ানো তখন বলল আমি অনেক আগেই মৃত্যুভয় ত্যাগ করেছি। রাজকন্যা আডোনিয়া বিস্মিত হয়ে বলে, মৃত্যুভয় ত্যাগ করেছ? কেন? দাস অ্যাড্রিয়ানো বলল, রাজকন্যা, আমি তোমাকে প্রথম যেদিন দেখেছি সেদিনই আমি মরে গেছি। আমার আর মৃত্যুভয় নেই।
এই কথা শুনে রাজকন্যা আডোনিয়া কেমন নরম হয়ে গেল। আজ রাতে গাওয়া গানের কথা মনে পড়ে গেল। আমায় খুঁজবে যে / আমায় সে পাবে / আমাকে সে পাবে ...রাজকন্যা গত বসন্তে অস্টাদশ বর্ষে পা দিয়েছে। তবে জীবনে এখনও পুরুষের ছোঁওয়া পায়নি। রাজকন্যা আডোনিয়া আরও কয়েক পা এগিয়ে যায়।
দাস অ্যাড্রিয়ানোর দীর্ঘ বলিষ্ট শরীর। সে শরীরের নোনা গন্ধ পায় রাজকন্যা আডোনিয়া এবং টের পায় ওর তলপেট থেকে উঠে আসছে এক বিধ্বংসী তাপ, নিঃশ্বাস ঘন হয়ে উঠতে থাকে ... টের পায় স্তনবৃন্তের কাঁপন। সিঁড়ির আধো অন্ধকারের দিকে দাস অ্যাড্রিয়ানোকে টেনে নিয়ে যেতে থাকে রাজকন্যা।
লিরাটি রাজকন্যার হাত থেকে খসে পড়ে যায়।
পরের দিন সকালবেলায় রাজকন্যা আডোনিয়া প্রাসাদের বিশাল অলিন্দে দাঁড়িয়ে ছিল।
অলিন্দজুড়ে ঝিকমিকে রোদ, বাকুম বাকুম করা পায়রা। দূরে ঝলমলে বন্দর, জাহাজ জ্বলজ্বলে সমুদ্র, । এই সকালেও বন্দরে জমজমাট ভিড়। ক্ষীন গুঞ্জন কানে আসে । নীল আকাশে সাদা রঙের সমুদ্র পাখি।
রাজকন্যার শরীরে সুখের শিহরণ । দাস অ্যাড্রিয়ানোর তামাটে শরীরের তাপ যেন এখনও লেগে আছে।
রাজা আরিওন এসে দাঁড়ালেন। বেশ বয়স্ক মানুষ। পলিত কেশ, কিছুটা স্থূল।
রাজা আরিওন বললেন, মা, শুনেছিস তো, সামোস দ্বীপের রাজপুত্র লিয়ানড্রো আসছে।
রাজকন্যার ভুরু কুঁচকে যায়। অলিন্দে ভীষণ বাতাস। রাজকন্যা চুল সরিয়ে জিজ্ঞেস করে, না। কেন?
সামোস দ্বীপের রাজপুত্র লিয়ানড্রো বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে অনেক আগেই।
আমি মত দিয়েছি।
রাজকন্যা আডোনিয়া ভয়ানক চমকে ওঠে। দাস অ্যাড্রিয়ানোর ঘামে ভেজা শরীরটি মনে পড়ে যায়।
কিন্তু বাবা-
বল মা।
আমি ... আমি ...
হ্যাঁ, বল-
আমি ঠিক করেছি আমি কবিতা গান নিয়েই থাকব।
রাজা খুশি হয়ে বললেন, সে তো ভালো কথা-কবিতা/গান তো বিয়ের পরও করা যাবে।
রাজকন্যা আডোনিয়া চুপ করে থাকে।
সিংহাসনে বসতে হবে, দেরি হয়ে যাচ্ছে। রাজা চলে গেলেন।
রাজকন্যা আডোনিয়া অস্থির বোধ করে।
ঝলমলে আকাশের দিকে তাকায়। কখন রাত হবে।
যথাসময়ে থাসোস দ্বীপে দিনের শেষে নেমে এল রাত্রি। রাত্রি খানিক গভীর হলে রাজকন্যা আডোনিয়া ছাদে উঠে এল। আজ আর রাজকন্যার লিরাটি নিতে মনে ছিল না।
দেবী হেস্টিয়ার কথা মনে পড়ল রাজকন্যার : তুমি গান ভুলে যাবে ...আজ রাতে রাজকন্যা আর ছাদে গেল না। বরং অন্ধকার সিঁড়িঘরের দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে দাস অ্যাড্রিয়ানোর জন্য অপেক্ষা করতে লাগল । চোখ বুঁজলেই দাস অ্যাড্রিয়ানোর পুরুষ্ট দুটি উরু ভেসে উঠছে। গুমোট রাত। খুব ঘেমে যাচ্ছে।
অবশ্য বাতাস আসছিল ঈজিয়ান সমুদ্রের।
মাঝরাতের কিছু পরে দাস অ্যাড্রিয়ানো এল। আসতেই রাজকন্যা দাস অ্যাড্রিয়ানোর মুখটি আঁকড়ে ধরে পাগলের মতো চুমু খেতে লাগল। অবশ্য সতর্ক থাকল বালা দুটি যেন একটি অন্যটির সঙ্গে ঠুকে না যায়-ঠুকে গেলেই যে আগুন ধরে যাবে! দাস অ্যাড্রিয়ানো এরপর রাজকন্যাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে- যেন পিষে মারবে। যেন এক্ষণি সে তার বহুদিনের লুকানো আকাঙ্খা পরিপূর্ন করবে।
দু-বছর আগে সে রাজকন্যাকে প্রথম সমুদ্র পাড়ে দেবতা পোসেইদোনের উপাসনালয়ের সিঁড়িতে দেখেছিল। স্বর্ণকেশী নীলনয়না রাজকন্যাকে দেখেই চমকে উঠেছিল। তার পরপরই বিপদজনক পথটি বেছে নিয়েছিল সে। রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরীন বিশ্বস্ত দাস নির্বাচিত হওয়ার আগে তাকে কয়েকটি খুন করতে হয়েছে!
অনেকক্ষণ পর। সিঁড়িঘরের আধো-অন্ধকারে পাথরের মেঝের ওপর দুজন পাশাপাশি শুয়ে আছে।
বাতাসে জলপাই তেলের পোড়া গন্ধ; দাস অ্যাড্রিয়ানোর শরীরের ঘামের গন্ধ, রাজকন্যা আডোনিয়ার শরীরের ঘামের গন্ধ। তাপ নেমে যাওয়ায় রাজকন্যা আডোনিয়ার শরীরটি ভিজে ঠান্ডা হয়ে আছে। একটু পর রাজকন্যা ফিসফিস করে বলল, সামোস দ্বীপের রাজপুত্র লিয়ানড্রো আমাকে বিয়ে করার জন্য থাসোস দ্বীপে আসছে।
জানি। গম্ভীর স্বরে দাস অ্যাড্রিয়ানো বলল।
এখন কি করব?
দাস অ্যাড্রিয়ানো চুপ করে থাকে।
রাজকন্যা আডোনিয়া জিজ্ঞেস করল, তুমি না বলেছিলেন আমার জন্য তুমি মরতেও পারবে?
হ্যাঁ।
দাস অ্যাড্রিয়ানোর ঘেমে যাওয়া বুকে মাথা রেখে রাজকন্যা আডোনিয়া ফিসফিস করে শুধোয়, তা হলে তুমি আমার সঙ্গে সামোস দ্বীপে যাবে?
যাব। ঘাড় ফিরিয়ে দূরের আকাশের ঝলমলে নক্ষত্রের দিকে চেয়ে দাস অ্যাড্রিয়ানো বলল। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে আমি জাহাজে উঠব।
আমি ... আমি যেদিন তোমাকে প্রথম দেখেছি সেদিনই আমি মরতে চেয়েছি।
রাজকন্যা আডোনিয়া কেঁপে ওঠে।
আর কদিন পরেই রাজকন্যা আডোনিয়ার বিবাহ। সমস্ত থাসোস দ্বীপটি সেজে উঠেছে। দ্বীপবাসীর ঘরে ঘরে আনন্দ।
রাজকন্যা আডোনিয়া থাসোস দ্বীপের প্রিয় রাজকন্যা। সেই রাজকন্যার শুভবিবাহে আনন্দ তো হবেই। তবে রাজকন্যা তো বিয়ে পরে এ দ্বীপ ছেড়ে চলে যাবে। সেই আসন্ন বিরহের কথা ভেবে দ্বীপবাসী কিঞ্চিৎ বিষন্নও বটে।
সব দেখেশুনে রাজা আরিওনও ভারি সন্তুষ্ট।
তিনি সমুদ্র পাড়ে দেবতা পোসেইদোনের উপাসনালয়ে সাতশ ষাঁড় বলি দিলেন। দরিদ্র জেলেদের গ্রামে অন্ন ও বস্ত্র বিতরণ করলেন। সবাই জানে থাসোস দ্বীপের রাজা আরিওন ভারি দয়ালু, প্রজাবৎসল এবং ধর্মপ্রাণ।
দেবতা পোসেইদোনের উপাসনালয়ের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে বহুদিন বাদে রাজার তার স্ত্রীর কথা মনে পড়ল। রাজকন্যা আডোনিয়ার জন্মের পরপরই প্রাসাদের ছাদ থেকে নিচে সমুদ্রের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে রানী আগনেটা আত্মহত্যা করেছিল।
রানীর মনে অনেক দুঃখ ছিল। মিলেনা নামে লেসবস দ্বীপের এক কুৎসিত দাসীর প্রেমে নিমজ্জিত হয়েছিলেন রাজা- রানী আগনেটা সে ভয়ানক অপমান সইতে পারেনি। দাসী মিলেনার গর্ভবতী হওয়ার পর পরই রাজা তাকে প্রাসাদ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। সাগর পাড়ের এক জেলে গ্রামে একটি পুত্র সন্তান জন্মের পরই দাসী মিলেনা মারা যায়। দাস অ্যাড্রিয়ানো সেই দাসী মিলেনার সন্তান।
বিশ্বস্ত চরের মাধ্যমে রাজা সবই জানেন। অনেক আগে থেকেই অ্যাড্রিয়ানো কে চোখে চোখে রেখেছিলেন রাজা।
সেই অ্যাড্রিয়ানোই এখন...
রাজা তার দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতায় জানেন: মানুষকে তার লুকানো পাপ নিয়েই বেঁচে থাকতে হয়। অতএব-
যা হোক। এর কিছুদিন পর এক ভোরবেলা সামোস দ্বীপের রাজপুত্র লিয়ানড্রোর সতেরোটি সুসজ্জিত জাহাজ থাসোস দ্বীপের বন্দরে ভেড়ে।
সে দিনই ধুমধাম করে সামোস দ্বীপের রাজপুত্র লিয়ানড্রোর সঙ্গে থাসোস দ্বীপের রাজকন্যা আডোনিয়ার বিয়ে হয়ে যায়। রাজকন্যা আডোনিয়াকে ভারি সুন্দর লাগছিল। খুব কাঁদছিল রাজকন্য। স্বাভাবিক। রাজকন্যা আজ প্রিয় থাসোস দ্বীপ ছেড়ে চলে যাবে।
বিয়ের দিন সন্ধ্যা বেলা সামোস দ্বীপের উদ্দেশে পাত্রপক্ষের জাহাজ ছাড়বে। রাজপুত্র লিয়ানড্রো তার নবপরিণিতা স্ত্রীকে নিয়ে এরি মধ্যেই জাহাজে উঠে গেছে। তার আগেই দাস অ্যাড্রিয়ানোও রাজপুত্র লিয়ানড্রোর এক বিশ্বস্ত অনুচরকে হত্যা করে তার ছদ্মবেশ ধারণ করে জাহাজে উঠে গেছে।
সন্ধ্যার পরপরই ফুটফুটে জোছনা ফুটেছে। বন্দরসহ সমুদ্রের অনেকটাই পরিস্ফুট।
রাজপ্রাসাদের অলিন্দে দাঁড়িয়ে রাজা আরিওন নিচের বন্দরের দিকে তাকিয়ে আছেন। রাজপুত্র লিয়ানড্রোর জাহাজটি মাঝখানে রেখে বাকি জাহাজগুলি ধীরে ধীরে বন্দর ত্যাগ করছে। রাজা আরিওনকে ভয়ানক বিষন্ন দেখাচ্ছিল। আর কি কোনওদিন রাজকন্যা আডোনিয়া ফিরে আসবে?
খানিকবাদে রাজা আরিওন ভয়ানক চমকে উঠলেন। মাঝখানের জাহাজে দাউদাউ করে আগুন ধরে গেছে।
নিচের বন্দর থেকে আর্তচিৎকারও শুনতে পাচ্ছেন তিনি। বন্দরের লোকজন সবাই অগ্নিময় জাহাজটি দেখতে পেয়েছে। রাজা আরিওনও যেন টের পাচ্ছেন আগুনের দাহ। তিনি নিজেও যেন পুড়ে যাচ্ছেন সে আগুনে। নির্বাক রাজা দেখছেন আগুনের রূপ।
রাত্রির সমুদ্রের বুকে কী বিচিত্র তার বিস্তার, কী বিচিত্র তার রূপ। অন্ধকার সমুদ্রের বুকে রাজকন্যা আডোনিয়ার মুখটি যেন শেষবারের জন্য ফুটে উঠল। রাজা ম্লান হাসেন। রাজা তার দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতায় জানেন: একদিন এভাবে বিচিত্র ঐ আগুনের রূপে ছেয়ে যাবে সমগ্র জগৎ ...
(উৎসর্গ: গ্রিক নাট্যকার ইউরিপিদেস। )
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।