একদিন কবিমন মেলেছিল পাখা। হৃদয়ের আকাশ ফুড়ে সে উড়েছিল দূরে। একদিন বড় সাধ জেগেছিল লেখনীর আঙুলে তুলে জীবনকে চেখে দেখার।
এক.
হুড়মুড় করে ভেঙেচুরে আছড়ে পড়ে সব।
এ ঠিক তখন একটু একটু করে যখন সবকিছু গুছিয়ে এনেছি মনের ভেতর।
রাষ্ট্রীয় উত্থান-পতন, রাজনৈতিক ডামাডোল, পারিবারিক কোলাহল, ব্যবসায়িক লাভলোকসান- সবকিছুকে একপাশে ঠেলে চেয়ারে-টেবিলে আমি, সফেদ সাদা কাগজ, কালো কালির কলম আর ঠেলেঠুলে লাইনে এসে দাঁড়ানো আমার জীবনের স্মৃতিগুলো। সারিতে স্থির কেউ, কেউ ব্যস্ত পাশ কাটিয়ে চলে আসতে সামনে। ক্লান্ত কেউ। কেউ বাধা দেয় বিশৃঙ্খলায়। কেউ আবার অন্যকে ঠেলে দেয় লাইনের বাইরে।
কেউ অনেক দূর থেকে ইশারায় জানান দেয়, ‘এই যে আমি। আছি। আমিও কিন্তু রাঙিয়েছিলাম তোমার জীবনকে কিছু। ভুলো না আমায়। ’
কোত্থেকে একটা ঝড় উঠে আসে।
অথবা ক্রমাগত ঝড়। একটার পরে আর একটা। প্রচণ্ড তাদের শক্তি। প্রবল তাদের বেগ। তছনছ করে দেয় স্মৃতির আরণ্যক বিন্যাস।
উড়িয়ে নেয়, তাড়িয়ে নেয়, ভাসিয়ে নেয়। স্মৃতি তো বটেই- জীবনের আরো অনেক কিছু।
ঝড় এলে ঝড় থামে। জীবন ও প্রকৃতির এই নিয়ম। একদিন ঝড় থেমে যায়।
ঝড় থেমে গেলে স্মৃতিরা আবার ফিরে আসে। একা একা অথবা দল বেঁধে। চেনাসূত্রে কখনো, কখনো অজানা সূতার টানে।
আবার লেখার টেবিলে একদিন। কিন্তু লেখনী আর আমার নিরবিচ্ছিন্ন মিলন সে আর হয়ে ওঠে না কিছুতেই।
অথচ-
একদিন কবিমন মেলেছিল পাখা।
হৃদয়ের আকাশ ফুড়ে সে উড়েছিল
দূরে।
একদিন বড় সাধ জেগেছিল
লেখনীর আঙুলে তুলে
জীবনকে চেখে দেখার।
এই যে এক জীবন- জীবনের চারপাশে এত মানুষ। মানুষের পাশে মানুষ।
মানুষকে ঘিরে মানুষ। মানুষে মানুষে এত দেয়া নেয়া। এত ভালোবাসা। দুঃখ। শোক।
কষ্ট। আনন্দ। সুখ। যুদ্ধ। জয়।
পরাজয়। গ্লানী। হিংসা। ক্ষোভ। বিক্ষোভ।
এক জীবনের কত রঙ, কত রূপ রস গন্ধ। কিন্তু কী একমুখো তার গতি। সরলরেখার এক অদৃশ্য প্রান্ত ধরে আসে আরেক অদৃশ্য প্রান্তে যায় হারিয়ে। এই জীবনটাকে আলো ফেলে ফেলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কেটে-চিঁড়ে-খুলে দেখাবার ইচ্ছা জেগেছিল মনে।
কিন্তু হায়! জীবনের শেষ প্রান্তে এসে সে সময় ও সুযোগ এখন নিঃশেষিত প্রায়।
তবে আজ যখন জীবনের খেরোখাতা মেলাতে বসেছি, তখন এও মনে হয়, জীবনের কোনো এক অপূর্ণ সাধ যদি বাধের পাহাড় ডিঙোতে ডিঙোতে হারায় কোনো খাতে-বাঁকে-উপত্যকায় তবে তাকে নিয়ে দুঃখ বা শোকের কিইবা আছে। কীসের মোহে সাধের পূর্ণতা খোঁজা? একক মানুষই তো তার নিজের জীবনেরই এক ক্ষুদ্রতম খণ্ডিত রূপ।
রাশি রাশি মানুষ আমার চারপাশে
কেউ কেউ মুখ টিপে টিপে হাসে
তারপর যারা যারা আছে পাশে পাশে
তারাও।
মুচকি দিয়ে
খেকখেকিয়ে
ব্যাঙ্গ করে
রঙ্গ মেরে
মিষ্টি করে
খলবলিয়ে
কলকলিয়ে
খিলখিলিয়ে
মিনমিনিয়ে
রম্নদ্ধশ্বাসে
অট্টহাসে
বোকা বোকা
চোখা চোখা
গাল ফুলিয়ে
টোল ঢুকিয়ে
হাসতে হাসতে সব আমার গায়ের উপরে এসে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে। আমি স্মৃতিকাতুরে চোখে তাকাই ওদের দিকে।
তাকিয়ে থাকি। একে একে সবার চোখে আমার চোখ। ধীরে ধীরে, আস্তে আস্তে সবাই নীরব হয়ে যায়।
নীরব।
নিস্তব্ধ।
মাথার উপরে ইলেক্ট্রিক পাখা শা শা করে ঘুরছে পূর্ণ গতিতে।
মন বলে, আমি পারবো তো।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।