আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জহির রায়হানঃ বাংলাদেশে তৃতীয় ধারার চলচ্চিত্রের বংশীবাদক

আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনই,তুমি কি অপরুপ রুপে বাহির হলে জননী ১৯৬০ সালে বিপ্লব-পরবর্তী কিউবায় একটি নতুনধারার চলচ্চিত্র প্রসার লাভ করে। এই ধারার চলচ্চিত্রে দর্শককে লড়াকু হতে উৎসাহিত করা হয়,রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতাকে বিশ্লেষণের আতশ কাঁচের নিচে ফেলতে উৎসাহ দেয়। ১৯৬৪ সালে ব্রাজিলের সামরিক জান্তার কারণে যখন “সিনেমা নোভো” আন্দোলন দমে যায়,তখনই দমে যাওয়া আন্দোলন থেকে জন্ম হয় চলচ্চিত্রের এই নতুন ধারার-যার নাম দেওয়া হয় তৃতীয় ধারা। যা পরবর্তীতে লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশ,আফ্রিকা,এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বিস্তার লাভ করে। এই ধারাকে ভিন্নধারা,নব্যধারা,প্রতিবাদীধারা,রাজনৈতিক চলচ্চিত্রধারা ইত্যাদী নামেও চিহ্নিত করা যায়।

কেননা এই ধারার চলচ্চিত্র নির্মাতারা রাজনৈতিকভাবে অধিক সচেতন ছিলেন। পশ্চিম বাংলায় যাদের চলচ্চিত্রে তৃতীয় ধারার প্রভাব লক্ষণীয় সেই ঋত্বিক,মৃণালরা সাংস্কৃতিক মতাদর্শে ছিলেন কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন। সেই কমিউনিস্ট ভাবধারায় বেড়ে উঠে বাংলাদেশে তৃতীয় ধারায় চলচ্চিত্র এনেছিলেন জহির রায়হান। ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট ফেনী জেলার মজুপুর গ্রামে জন্ম নেওয়া আবু আবদার মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ,পিতৃপ্রদত্ত “জহির” আর কমরেড মনি সিং এর দেয়া “রায়হান” নামে জহির রায়হান পরিচিতি পান। আট ভাইবোনের মধ্যে তৃতীয় জহিরের সখ্যতা ছিল বেশি বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারের সাথে।

বড় ভাইয়ের হাত ধরেই কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান এবং চলচ্চিত্র জগতের দিকে এগিয়ে যাওয়া। ১৯৫০ সালে প্রথম শ্রেণীতে মেট্রিক এবং ১৯৫৩ সালে আইএসসি পাশ করা জহির রায়হান এর চলচ্চিত্রের প্রথম পাঠ হয়েছিল কলকাতার প্রমথেশ বড়ুয়া মেমোরিয়াল ফটোগ্রাফিক স্কুলে। আর চলচ্চিত্র নির্মাণে হাতেখড়ি হয়েছিল আখতার জং কারদার এর সহকারী পরিচালক হিসেবে “পদ্মা নদীর মাঝি”র উর্দুরুপ “জাগো হুয়া সাভেরা”র নির্মাণে। আর্জেন্টিনার চলচ্চিত্রকর্মীরা যাঁদের গেরিলা চলচ্চিত্রকার হিসেবে কল্পনা করেছিলেন,যে তৃতীয় চলচ্চিত্রের রুপরেখা তারা হাজির করেছিলেন,বাংলাদেশে জহির রায়হান ছিলেন তারই প্রতিভূ। তৃতীয় চলচ্চিত্র আন্দোলনের কর্মীরা মনে করেন,বিপ্লবী ছবি নির্মাণের জন্য বিপ্লবী সরকার কিংবা অনুকূল পরিবেশের দরকার নাই।

শত প্রতিকূলতা আর সীমাবদ্ধতার ভেতরই উজ্জীবিত করার মত ছবি তৈরি সম্ভব। লাতিন আমেরিকায় বিপ্লব এর জোয়ার থেকেই তৃতীয় চলচ্চিত্রের ধারণার উদ্ভব। বাংলাদেশের মানুষের ওপর যে অন্যায় অত্যাচার চলছিল সেটার জবাব দিতে এদেশের বাঙ্গালী ও আদিবাসীরা তুলে নিয়েছিলেন অস্ত্র,জহির রায়হান ও সামিল হয়েছিলেন তাদেরত সংগে,তার অস্ত্র ছিল ক্যামেরা। বন্দুক বা ক্যামেরা হাতে সমাজকে পালটে দেয়ার সংগ্রামে উভয়ই গেরিলা। বাংলাদেশেও গেরিলা জহির রায়হান দেখিয়েছিলেন ক্যামেরা হাতে যুদ্ধ করা সম্ভব।

১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে যদিও গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করছিলেন তবুও জহির রায়হানের মন ভরছিল না। বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে বললেন, “বড়দা,আমি চলে যাব। এখানে থেকে আমি কিছু করতে পারবো না। এবার আমি আমার স্বপ্নকে কাজে লাগাবো। ক্যামেরায় ধরে রাখতে হবে আমাদের সংগ্রামের ইতিহাস।

এতদিন শুধু ক্যামেরা নিয়ে নাড়াচাড়া করেছি। এবার দিন এসেছে মানুষের জন্য কাজে লাগাতে হবে আমার ক্যামেরা”। (পান্না কায়সার,অনুপম হায়াৎ এর উদ্ধার ২০০৭:৪৩) জহির রায়হান কলকাতা গেলেন এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে। ভারতে আশ্রয় নেয়া মুক্তিকামী সব চলচ্চিত্র শিল্পীদের সমন্বয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের সপক্ষে কি করা যায় এমন চিন্তা থেকে মে মাসের শেষের দিকে প্রতিষ্ঠিত হয় “বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী ও কলাকুশলী সমিতি”,যার সভাপতি হলেন জহির রায়হান আর সাধারণ সম্পাদক হলেন সৈয়দ হাসান ইমাম। খুবই স্বল্প বাজেটে ২৪ মিনিটের মুক্তিযুদ্ধের উপর পাঁচটি প্রামাণ্যচিত্র করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

সিদ্ধান্ত হল-“বার্থ অব এ নেশন”-নামে পাঁচটি পর্বে পাঁচটি ছবি হবে। প্রথমে তিনটি পর্ব হবে। পয়সা যোগাড় হলে পরে অন্য দুইটি করা হবে। প্রথম তিন পর্বের মধ্যে একটি হবে বাচ্চাদের নিয়ে, একটি হবে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে,আর একটি হবে কেন আমরা বিচ্ছিন্ন হতে চাইছি পাকিস্তানীদের কাছ থেকে? পাকিস্তানীদের ব্যবহার আমাদের প্রতি কিরুপ? কিভাবে তারা আমাদের উপর অত্যাচার করছে এবং কিছু রাজনৈতিক বক্তব্য। ছবিটির নাম হবে “স্টপ জেনোসাইট”।

মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে তৈরী ছবিটির নাম হবে “লিবারেশন ফাইটারস” আর বাচ্চাদের নিয়ে তৈরী ছবিটার নাম হবে “ইনোসেন্ট মিলিয়নস”। বাংলাদেশের প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অন্যতম উল্লেখ্যযোগ্য ছবি হল স্টপ জেনোসাইট। বিশ মিনিটের এই ছবির ধারা বর্ণণা,রচনা ও পাঠ করেন আরেকজন খ্যাতনামা চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবির। ক্যামেরায় ছিলেন অরুন রায় এবং সম্পাদনা করেন দেবব্রত সেনগুপ্ত। ছবিটি ৩৫ মি.মি. ফরম্যাটে তৈরী হয়।

সাদা কালো এই ছবি ইংরেজি ভাষায় করা হয়। দিগন্ত বিস্তৃত আধামরা মানুষের চলমান মিছিল,যারা দেহের শেষ শক্তি নিয়ে চলেছে পার্থিব জীবনের শেষ সম্বলকে মাথায় করে। উদ্ভ্রান্ত এইসব মানুষের চোখে মুখে মানুষ হত্যার বিভৎস অভিজ্ঞতা লেগেছিল। ভাবলেশহীন এইসব মানুষ ক্ষুধার্ত জীর্ণদেহে হেঁটে এসেছে পঁচিশ,পঞ্চাশ কিংবা একশ মাইল। কোথায় গন্তব্য তারা নিজেরাও জানে না।

১৯৭১’র ২০ জুলাই যখন বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত এলাকা বনগাঁও-য়ে এই দৃশ্য ক্যামেরা বন্দী হচ্ছিল তখনই নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে উচ্চারিত হচ্ছিল মানবতার বুলি। অথচ সেদিনই মার্কিন জেট ফাইটার,হেলিকপ্টার আর গানশিপগুলো ভিয়েতনামের গ্রামাঞ্চলে নৃশংস রকেট হামলা চালিয়ে হাজার হাজার নিরীহ সরল মানুষের দেহ ঝাঁঝরা করে দিয়েছে। বি-ফিফটি টু বোমারু বিমান সাইগনে পনের হাজার পাউন্ড ওজনের ডিউজিক আটার নামের নতুন বোমার পরীক্ষা মূলক ব্যবহারও করেছে। সেই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দোসর পশ্চিম পাকিস্তানের নৃশংস গণহত্যাকে ধমক দিতেই রায়হান তৈরি করেন “স্টপ জেনোসাইট”। জহির রায়হান ক্যামেরায় চোখ লাগিয়ে শুনেছেন রাজশাহী জেলার একগ্রাম থেকে পালিয়ে আসা আশি বছরের এক বৃদ্ধের করুণ কথা,কিভাবে পাকিস্তানী হানাদাররা বর্বরভাবে শত শত পুরুষকে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করেছে,নারীদের ধর্ষণ করেছে আর যাবার সময় গ্রামের সব বাড়ি ঘরে আগুন লাগিয়ে ছাই করে দিয়েছে।

আশি বছরের বৃদ্ধ জানেন না কেন তাদের উপর এই অত্যাচার করা হলো। পছন্দের ব্যক্তিকে বা দলকে ভোট দেওয়াই কি এত বেশী অপরাধের! জহির রায়হান আর সহ্য করতে পারেন নি,ক্যামেরার ওপার থেকেই চিৎকার করে বলে উঠলেন “স্টপ...স্টপ দিস ব্লাডি জেনোসাইট”। এই বন্ধ করার ধমক তখন বিশ্ব মানবতার আহবানে রূপ নেয়। জাতীয় মুক্তির আন্দোলন মানবতার বৃহত্তর লড়াইয়ে উন্নীত হয় এই চলচ্চিত্রে। বিশ্বের অন্যান্য যেসব দেশে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মজানুষ লড়াই সংগ্রাম করছে, এই ছবি হয়ে উঠেছে তাদেরও কন্ঠস্বর।

তিনি বিষয়টা এমন ভাবে দেখান যে, চলমান এই বিধ্বস্ত মানুষরাই যেন হাজার বছরের বিধ্বস্ত মানুষের মিছিল। ইয়াহিয়ার বর্বরতা ফুটে উঠেছে হিটলার,মুসোলিনীদের পটভূমিতে। মুক্তিযুদ্ধের সময় জহিরের দ্বিতীয় প্রামাণ্য চিত্রটি হুচ্ছে “এ স্টেট ইজ বর্ণ”। ১৯ মিনিটের সাদা কালো এই ছবিতেও ক্যামেরাম্যান ছিলেন অরূণ রায়। ধারা বিবরণী রচনা ও পাঠ করেন আলমগীর কবির।

ছবিটি হচ্ছে বাঙ্গালীদের স্বাধিকার আন্দোলন,স্বাধীনতার সংগ্রাম এবং পাকিস্তানীওদের নির্যাতন নৃশংসতার প্রামাণ্য ইতিহাস। এই ছবিতে ৪৭’ থেকে ৭১’ পর্যন্ত বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং স্বাধীন বাংলা সরকারের মন্ত্রীসভার সদস্যদের সাক্ষাৎকার সাল অনুযায়ী ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হয়। এই ছবির একটা ক্লোজ আপে দেখা যায়,একটি লাশের বুক থেকে গল গল করে রক্ত বেরিয়ে আসছে আর সেই সময় যখন ধারা বিবরণীতে শোনা যায় ‘এন্ড মোর ব্লাড ফ্লোজ’,তখন দর্শক প্রত্যয়ী হয় নৃশংসতার অবসান ঘটিয়ে সত্য প্রতিষ্ঠার। কলকাতা থেকে জহির যখন বাংলাদেশে প্রবেশ করছেন ১৮ ডিসেম্বর,তখনও একনিষ্ট চলচ্চিত্র কর্মীর মত ক্যামেরায় ধারণ করছিলেন বিজয়ের স্মৃতি। বড় ভাবী পান্না কায়সারের স্মৃতি থেকে জানা যায়, “পাগলের মত কাজ করে যাচ্ছে ক্যামেরা নিয়ে।

ভুলেই গেল বাড়িতে ওর বড়দা-মা-ভাই-বোন অপেক্ষা করছে ওর জন্য” (হায়াৎ ২০০৭:৪৬)। জহিরের জীবনে সবচেয়ে প্রিয় হচ্ছেন বড়দা শহীদুল্লাহ কায়সার। এই বড়দাই তাকে পৃথিবী চিনিয়েছেন। ১৮ ডিসেম্বর ব্যস্ত জহির খবর পেলেন তার বড়ভাই ১৪ তারিখ থেকে নিখোঁজ। ক্যামেরা সহকারী ওয়াহিদের হাতে দিয়ে ছুটলেন বাড়ীর দিকে।

শুরু হল নতুন সংগ্রাম;বুদ্ধিজীবী হত্যার নেপথ্যের চক্রকে ধরতে উঠে পড়ে লাগলেন। গঠন করলেন বুদ্ধিজীবী হত্যা তদন্ত কমিটি। “সংগ্রহ করেন হানাদার বাহিনীর অনেক সহযোগীর নাম,বুদ্ধিজীবী হত্যার জন্য দায়ী করেন সরকারকে। সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে ঘোষণা করেন যে, তিনি শ্বেতপত্র প্রকাশ করবেন এবং মুজিবনগর সরকারের অনেক গোপন তথ্যও ফাঁস করে দিবেন” (শাহরিয়ার কবির,হায়াৎ এর উদ্ধার ৪৬-৪৭)। ৩০ জানুয়ারী ফোন এলো,জানানো হলো শহীদুল্লাহ কায়সার মিরপুরের বার নম্বর সেকশনের একটি বাড়ীতে বন্দি হয়ে আছেন।

শাহরিয়ার কবির ও আরো কয়েকজন নিকটাত্মীয়। তখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্ট সেই এলাকার দায়িত্বে। সেখানে ছিলেন লেফটেন্যান্ট ইব্রাহিম আর মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী। তাদের সহায়তা চাইলেন জহির ভাইকে খুঁজে বের করতে। সেইদিনই ক্যাপ্টেন মোরশেদ খানের নেতৃত্বে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর যৌথ প্রচেষ্টায় সেই হল অভিযান।

দলে নিরস্ত্র বলতে ছিলেন একমাত্র জহির রায়হান। বিহারীদের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত সেই এলাকায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে পুলিশকে পিছু হটতে হয়েছিল। আর বড়দা’র খোঁজ আনতে গিয়ে হারিয়ে গেলেন তাঁর কুরিয়ার জহির রায়হান। বাংলাদেশে চলচ্চিত্রের যে ধারা জহির রায়হান সেই প্রতিকূলতায় শুরু করেছিলেন,স্বাধীনতার পরবর্তী অনুকূল পরিবেশে তাঁর সহযোগীদের কাউকেই আর সে পথ মাড়াতে দেখা যায়নি। তৃতীয় ধারার প্রতিবাদী চলচ্চিত্রের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রাম তাই জহির রায়হানের হাত ধরে বাংলাদেশে এসে আবার তাঁর সাথেই হারিয়ে গেছে বললে অত্যুক্তি হবে না।

 ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ২৩ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.