আমি সবার মাঝে হারিয়ে যেতে চাই !!!
জহির রায়হানের
ঢাকা, ৩০ জানুয়ারি- বাংলাদেশের শেকড় সন্ধানে, এদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় একজন চলচ্চিত্রকারের স্বরূপ আবিষ্কারে বারবার যে নামটি উচ্চারিত হবে তিনি জহির রায়হান। ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট ফেনী জেলার অন্তর্গত মজুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। শৈশবে কিছুকাল কলকাতায় বসবাস করলেও দেশ বিভাগের পর থেকে এই ভূখণ্ডেই বেড়ে ওঠেন। তার জীবনভ্রমণের দিকে তাকালে আমরা একজন সাহিত্যিক জহির রায়হানের পাশাপাশি শেষপর্যন্ত একজন তুমুল চলচ্চিত্রকার সত্তাকে উদ্ভাসিত হয়ে উঠতে দেখি তার ভেতর।
ছোটকাগজ ম্যাজিক লণ্ঠনের পক্ষ থেকে ২০১২ সালের ১৪ মে একটি আসরে নির্মাতা ও গবেষক নুরুল আলম আতিক চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানকে নিয়ে তার একটি লেখা বক্তৃতা আকারে উপস্থাপন করেন।
‘জহির রায়হানের খোঁজ পাওয়া গেছে’ শিরোনামের সে লেখাটিতে জহির রায়হানের চলচ্চিত্র ও চলচ্চিত্র কেন্দ্রিক সংগ্রাম যেমন উঠে এসেছে তেমনি উঠে এসেছে এদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় একজন নির্মাতার সঙ্কট ও করণীয়। পাশাপাশি জহির রায়হানের চলচ্চিত্রগুলো নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনাও করেছেন তিনি। পাশাপাশি লেখাটির মধ্যদিয়ে হারিয়ে যাওয়া জহির রায়হানকেও নতুন করে অনুসন্ধানে নেমেছেন।
জহির রায়হানের অন্তর্ধান অথবা মৃত্যুবার্ষিকী ৩০ জানুয়ারি। এ উপলক্ষ্যে ম্যাজিক লণ্ঠনের সে আসরে নুরুল আলম আতিকের বক্তৃতার অনুলিপি দুই কিস্তিতে পাঠকদের জন্য প্রকাশিত হলো।
১.
জহির রায়হানকে কেনো প্রয়োজন পড়ছে আমাদের? কারণ, আমরা সিনেমায় গল্প বলতে ভুলে গেছি। সিনেমায় শেষ পর্যন্ত একটি গল্প বলা হয়। জহির রায়হান এই ক্ষেত্রে আমাদের জন্য একটি প্রতীকী মানুষ। তার নিখোঁজ হওয়ার ৩০ তারিখের একটি রাজনৈতিক কারণ রয়েছে। আমরা বলছিলাম, তার বিভ্রান্তির কথা, আজমির শরীফ দৌড়ানোর কথা।
যিনি লেট দেয়ার বি লাইট নামে একটি ছবি তৈরি করতে চেয়েছিলেন। সেই ছবি অসমাপ্তই থেকে গেল, সত্তর সালে উনি নির্মাণকাজ শুরু করছিলেন। একাত্তরে তার তত্ত্বাবধানে চারটি ছবি তৈরি হয়। যার দুটি উনি নিজে নির্মাণ করেন, স্টপ জেনোসাইড। এই ছবিটি কি আপনাদের দেখবার সুযোগ ঘটে থাকবে কোনোভাবে? (একজন দর্শকের উত্তর- হলে দেখিনি, ইন্টারনেটে আংশিক দেখা যাচ্ছে)।
কোনোদিন যদি সম্ভব হয় আমাদের…স্টপ জেনোসাইড দেখবেন। টেলিভিশনে এখন প্রায়ই দেখানো হয়। ১৬ ডিসেম্বর নইলে ২৬ মার্চ কিংবা ২১ ফেব্রুয়ারি দেখা যায় তার জীবন থেকে নেয়া। আমাদের আজকের যে জাতীয় সংগীত- রবী ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা…’ সত্তর সালে উনি তার জীবন থেকে নেয়া ছবিতে পিক্চারাইজ করলেন। ঊনসত্তরের গণআন্দোলন, অসহযোগ, পাকিস্তানি সামরিকজান্তার নিষ্পেষণ… আমি তার লিখা ছোট্ট একটা বক্তব্য আপনাদেরকে পড়ে শোনাতে চাই।
আন্দাজ করি সেই সময় জহির রায়হানের এই ‘জীবন থেকে নেয়া’র একটা বড়ো ভূমিকা থাকবে সত্তর-একাত্তরে। সঙ্কট আছে, আপনারা বিভিন্ন রাজনৈতিক-দর্শন ভাবনার মানুষজন। এই যে উনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সিনেমা তৈরি করলেন। পশ্চিমবঙ্গে আমাদের যে গভর্নমেন্ট, প্রবাসী গভর্নমেন্ট ছিল, এটি কিন্তু প্রবাসী গভর্নমেন্টের ফসল নয়, এই চারটি ছবি। উনি হাত পেতে, চাঁদা তুলে এই চারটি ছবি নির্মাণ করেছিলেন।
আমাদের গভর্নমেন্টের একটি ১৪ মিনিটের প্রোডাকশন ছিল। সেটি কে করলেন? এই যে আমাদের পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রথম চলচ্চিত্র যিনি তৈরি করলেন মুখ ও মুখোশের পরিচালক, আব্দুল জব্বার খান, উনি প্রবাসী সরকারের চলচ্চিত্র বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। আমাদের প্রবাসী গভর্নমেন্টের একাংশ এবং তাদের তাঁবেদারেরা এই স্টপ জেনোসাইড যেনো চিরতরে স্টপ হয়ে যায়, তার জন্যে লিখিতভাবে অভিযোগ তুললো জহির রায়হানের বিরুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গের এইসব চলচ্চিত্রের শ্যুটিংয়ের সময় আমাদের সরকারের প্রতিনিধিরা তাকে রণাঙ্গনে ঢুকতে দেন নাই।
যাই হোক, পরে সম্ভবত আগস্ট-সেপ্টেম্বরের দিকে তারই বড়ো ভাই শহীদুল্লাহ্ কায়সারের কিছু বন্ধুজন, যাদের ভারতীয় সরকারের সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্টতা ছিল, তাদের রিকুয়েস্টে ইন্দিরা গান্ধী স্টপ জেনোসাইড ছবিটাকে ভারতে দেখানোর অনুমোদন দিলেন- এ ছবি দেখানো হলো।
অথচ আমাদের এই স্বাধীন দেশ নিয়ে যাদের এতো বড়ো বড়ো কথা তাদের মাঝে অনেকেই সেদিন চান নাই ছবিটা দেখানো হোক। কেনো চান নাই? এই স্টপ জেনোসাইড শুরু হয় ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের একটা উক্তি থেকে। আমাদের জাতির পিতার ছবি সেখানে কেনো নাই, তাই নিয়ে তাদের সঙ্কট। কিন্তু যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে যখন একটা বিপন্নতার গল্প অন্যদেরকে জানান দিতে হয় তখন বিপন্ন গণমানুষের গল্পটাই যে বলা জরুরি তা তাদের কে বোঝাবে? আমরা সব জায়গায় হাজির করে ফেলতে চাই- আমি, আমিত্ব, আমার হাজিরা। সমস্ত জায়গায় চর দখলের মতো।
এখন আমাদের প্রয়োজন একজন জহির রায়হানকে খোঁজ করা- যিনি এই বোধটুকু রাখেন। দেশি সিনেমার এই বিপন্নতার সময়ে আমাদের জানান দেয়ার প্রয়োজন- দেশের প্রয়োজনে এই জাতিগোষ্ঠীর মানুষজন কীভাবে হাজির আছে অথচ আমার নিজের হাজির নাই।
আজকে প্রতিবছর ১৬ ডিসেম্বর, ২৬ মার্চ, ২১ এ ফেব্রুয়ারি টেলিভিশন চ্যানেলে প্রয়োজন পড়ে ‘জীবন থেকে নেয়া’ হাজির করার। আমি একবার দেখলাম, চারটা টেলিভিশন চ্যানেল একদিনে দেখালো। ‘জীবন থেকে নেয়া’ কেনো দেখানোর প্রয়োজন পড়লো? আজকে আমাদের ক্যাথারসিস হয়ে গেছে।
আর প্রয়োজন নেই, এই বিপন্নতার গল্প বলবার। কিন্তু আজকে এই শোক আনন্দের হয়ে উঠুক। ২১ এ ফেব্রুয়ারি সেখানে আছে, আছে আমাদের ১৬ ডিসেম্বর, তার আগে একাত্তরের সমস্ত দুঃস্বপ্নের কথামালা। তার ইঙ্গিতগুলো পুরোপুরি এখানে আছে।
জহির রায়হান অনেক আওয়াজি মানুষ ছিলেন, দুই দিন পরপরই এক-একটা ঘোষণা দিতেন-ওমুক ছবি বানাচ্ছি তমুককে নিয়ে।
এবং উনি আমাদের প্রথম রঙিন ছবি তৈরি করলেন ‘সঙ্গম’। প্রথম সিনেমাস্কোপ ছবি এবং সেটা বাহানা। তখন এখানে, আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে সেরকম ব্যবস্থা নাই; তবু ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ঘোষণা দিয়ে ফেললেন, ২১ এ ফেব্রুয়ারি নিয়ে তিনি পঁয়ষট্টি সালে সিনেমা বানাবেন। মুর্তজা বশির একটি স্ক্রিপ্ট লিখলেন, সেই স্ক্রিপ্ট হারিয়ে গেলো।
ছয়-সাত বছরে কোনো খবর নাই। …দুই দিন পরপরই উনি বিভিন্ন রকম আওয়াজ তুলতেন।
তার আওয়াজটা পাকিস্তানি সরকার, মিলিটারি সরকার বিভিন্ন সময় মনিটর করতো। তাকে এক দিন তুলে নিয়ে যাওয়া হলো এফডিসি থেকে। শ্যুটিং ফ্লোর থেকে।
জীবন থেকে নেয়ার শ্যুটিংয়ের সময়। এফডিসির ডিরেক্টর, দেখেন আজকের ডিরেক্টর হলে- ‘স্যার নিয়ে যান। হ্যাঁ এ্যরে বাইন্ধ্যা নিয়া যান। ’ কিন্তু সেসময় এফডিসির ডিরেক্টরকে রাও ফরমান আলী খান বলছেন- ‘এর প্রোডাকশন ক্যানসেল করে দাও’, ‘স্যার আমরাতো ক্যানসেল করতে পারি না। আমাদের সেরকম এখতিয়ার নাই।
ওটা সেন্সর বোর্ডের দায়িত্বে…এখানে একটা প্রডাকশন শুরু হয়। এটা শেষ করাটাই আমাদের কাজ’। আজকের আমাদের স্বাধীন দেশের পতাকা ওড়ানো দেশে, যার একটি নিজস্ব মানচিত্র আছে… সেখানে কাউকে যদি এরকম বলা হয়? ‘ওকে বেঁধে নিয়ে যান… ক্রসফায়ারে দিয়ে দেন’। তো উনাকে সেট থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হলো। মিষ্টি করে উনি সবাইকে বললেন, ‘আমি আসবো, তোমরা থাকো, ফিরে আসছি।
আবার কাজ শুরু হবে। ’
উনি কী কথা বলছিলেন? সত্তর সালে উনার একটা লেখার থেকে দুইটা লাইন আমি পড়তে চাই। আমি হয়তো অনেক অপ্রাসঙ্গিক কথা বলবো। আর আমি আপনাদের কাছ থেকে সেই অপ্রাসঙ্গিক কথার প্রাসঙ্গিক প্রশ্নমালা শুনতে চাইবো। সত্তর ১২ ফেব্রুয়ারি উনি একটা প্রেস কনফারেন্স করছিলেন।
ওই আওয়াজি প্রকল্প; দুই দিন পরপরই যা করতেন। এবার লেট দেয়ার বি লাইট বানানোর কথা। ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ স্ক্রিপ্ট লিখবেন। তার ভাই শহীদুল্লাহ্ কায়সার ইংরেজিতে ডায়লগ লিখবেন। কেউ রুশ ডায়লগ লিখবেন।
এরকম বিবিধ রকমের গপ্পো উনি দুই দিন পরপরই আওয়াজ দিতেন। আর ওনার জীবনটাও ছিল অন্যরকম, তখনতো পত্রিকায় সিনেমা বিষয়ক নায়ক-নায়িকা বিষয়ক অনেক রকমের কৌতূহল ছিল আমাদের। সেই সূত্রে উনিও অনেক গসিপের কেন্দ্রেই ছিলেন।
যাই হোক উনি ১২ ফেব্রুয়ারি সত্তর সালে এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলছেন- আমি প্রাসঙ্গিকতা তৈরি করতে চাই গণযোগাযোগ প্রসঙ্গে। উনি কী বলছেন, উনি বলছেন, ‘আমাদের ছবিতে আজ অবধি রাজনৈতিক জীবন স্থান পায়নি।
অথচ জনতার সঙ্গে এ জীবনের একটা গভীর যোগাযোগ রয়েছে। রাজনৈতিক উত্থান-পতনের সঙ্গে দেশের সব কিছু নির্ভরশীল। তাই এদেশের কথা বলতে গেলে রাজনৈতিক জীবন তথা গণআন্দোলনকে বাদ দিয়ে চলচ্চিত্র সম্পূর্ণ হতে পারে না। আমি তাই গণআন্দোলনের পটভূমি নিয়ে ছবি করতে চাই, বাধা চলবে না। পত্রিকা জনতার সঙ্গে কথা বলে।
চলচ্চিত্রও জনতার সঙ্গে কথা বলে। জনতার আন্দোলন, জনতার মিছিল, গুলির সামনে ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক এদেশের জনতার ঢলে পড়বার ছবি আর খবর পত্রিকার পাতায় ছাপা হতে পারলে সেলুলয়েডে কেনো ধারণ করা যাবে না। ’ এই ছিল তার প্রত্যাশার কথা।
সত্তর সালের ১২ ফেব্রুয়ারি উনি যা প্রত্যাশা করলেন বা যা দাবি করলেন সেই দাবি আজ পর্যন্ত সিনেমা করিয়েরা অর্জন করতে পারেন নাই। খবরের কাগজে আপনি রাজনৈতিক যেকোনো অনুষঙ্গ নিয়ে হাজির হতে পারেন।
মন্ত্রীর ঘুষ খাওয়া, র্যাব কখন কাকে তুলে নিয়ে গুলি করলো, কোন্ নেতা বা ব্যবসায়ী গুম হলো সে গল্প। বোমাবাজি, মৌলবাদের আগ্রাসন-আস্ফালন, ওমুক সেলিব্রেটির মৃত্যু বা তার অন্যতর এলেবেলে গপ্পো। যেগুলো কাগজে ছাপা হয়, যেগুলো টেলিভিশনে দেখা যায়; কিন্তু আপনি নাটক, সিনেমায় দেখতে পাবেন না। টকশোতে দেখতে পাবেন, এই টকশোগুলো সাজানো গোছানো বানানো কথামালা। এবং যেকথা এই চ্যানেলে, সেকথা অন্য চ্যানেলে, যে ইনি এখানে তিনি আবার অন্য সেখানে।
সমস্তই একটি সাজানো গোছানো আয়োজন মাত্র। সহজ সাধারণ জীবনের সংবেদনা, পরিপার্শ্বের এই বিপন্নতার গল্প আপনি যদি বলতে চান সিনেমায় সম্ভব নয়।
তাহলে আপনি কী করে সিনেমা করবেন? আমাদের জন্যে সিনেমা একটা বড়ো সম্ভাবনা। সমস্ত আয়োজনকে নস্যাৎ করবার ক্ষমতা আমাদের নাই। কিন্তু এই সমস্ত আয়োজনকে পাশ কাটিয়ে নিজের মতো করে হাজির থাকবার সম্ভাবনা আছে।
টেকনোলজি। সিনেমা করতে কোটি কোটি টাকার প্রয়োজন। এবং সব সিনেমা করতে কোটি টাকার প্রয়োজন নাই। আপনাদের যদি মনে পড়ে সময় টেলিভিশনে একটা ছোট ফিচার, একজন কেউ সেলফোনে ধারণ করলো। কী সেটা? ছিনতাইকারী বা ইয়ে সন্দেহে তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হলো।
পুলিশ নিয়ে এলো। জনগণের হাতে তুলে দিয়ে বলা হলো ‘একে মার!’ আমজনতা গায়ের ঝাল মিটিয়ে, ইটা দিয়ে ছেঁচে পুলিশের গাড়িতে তুলে দিল; পুলিশ পুরো ঘটনাটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলো। একটি সামান্য সেলফোন। আমি বলছি না যে সেলফোনেই আপনাকে সিনেমা তৈরি করতে হবে। সম্ভব, হাজার হাজার মানুষের আকাঙ্ক্ষা এখন সিনেমা তৈরিতে।
এটি সবচেয়ে বড়ো সম্ভাবনার জায়গা…সম্ভাবনার জায়গাটা করে দিল টেকনোলজি।
এখন আমাদের আরেকটু খেয়াল রাখতে হবে…আমি টেলিভিশনে কাজ করি, আমি টেলিভিশন করে খাই। বলা ভালো টেলিভিশনে নাটক বানাই। আর কী কথা বলছি? সিনেমার কথা। সেই টেলিভিশন যার কথা বলছি, যার কোনো ভিশন নাই।
আবার বলছি টেলিভিশন কিন্তু বোকা-বাক্স নয়। টেলিভিশন ভীষণ চালাক। এই বিভীষণের হাত থেকে রেহাই নাই; এদিকে লঙ্কা পুড়ে যাচ্ছে। আমাদের প্রয়োজন নিজেদের সংরক্ষণ। কী সংরক্ষণ করবো আমরা? সময়, তারুণ্যের শক্তি, আর অন্তর্গত ভালোবাসা।
ভালোবাসা ছাড়া রেহাই নেই। ভালোবাসার অ্যাক্টিং নয়। আমি সিনেমা বানাবো-সিনেমা বানাবো বলে ঘুরে বেড়াবো, বন্ধুদের কাছে থেকে পাট নিয়ে বলবো আমিতো ওমুক সিনেমা বানাচ্ছি। ‘আরে দেখছিস ওমুকের ছবি? আর ব্রেঁসো কী বলছে শোন…আর তারকোভস্কি- অ্যা গুরু একখান’ এই করে নিজেকে না ঠকাই। এই কাজটা আমরা করতাম, আমি নিজে করে আসছি।
আর তার জন্যেই হয়তো আপনাদের কাছে এই হাজিরা…আপনারা সময় অপচয় না করে আমার মতো এই ভঙ্গির-রাস্তায় হাজির না হোন। আর তারুণ্যের অপচয় মানে আমাদের কোনো বেড়ে ওঠা নেই। আপনার দায় নেই সিনেমা বানানোর। সিনেমা নিয়ে যদি আপনি স্বপ্ন দেখেন, আপনি তো অন্তত আন্দাজ করতে পারবেন কোন্ সিনেমা আমার (নিজের)। কোন্ সিনেমা আমার পরিপার্শ্বের জন্যে; এই দেশের জন্যে, জীবনের জন্যে।
কোন্টা ধ্বংসগামী, কোন্টা বেড়ে উঠবার, লালন করবার। আমরা কী লালন করতে চাই? কী চাইবো? সবাই মিলে ভালো থাকি, তাইতো? আচ্ছা সিনেমা শিল্প, সিনেমা আর্ট সেইগুলো আপনারা নিজেরা জানেন। আরও আরও বিবিধ আর্টের সঙ্গে কী ফারাক, কতোটা সম্মিলন, কতোটা দূরত্ব, কী সম্ভাবনা, কী অসম্ভাবনা? আপনাদের আমার বলবার কথা শুধু সিনেমা আগামীকাল না থাকলেও কিছু আসে যায় না, কিন্তু আপনি যদি মনে করেন কোনোভাবে সিনেমা আপনাকে টানে এবং সিনেমায় আপনার সেই প্রেমের প্রকাশটুকুন দেখতে পান-তাহলে সেই সিনেমার জন্যে আরেকটু যত্নশীল হই, একটু কথা কই, একটু প্রেমালাপ করি, যদি পারি ঝাঁপাইয়া পড়ি। আর না পারলে দূরে থাকি, দূর থেকে তাকে লালন করি।
আমরা জহির রায়হানে আবার ফেরত যেতে চাইবো।
জহির রায়হানের প্রথম ছবি নিয়ে আমরা কথা বলছিলাম কখনো আসেনি। কিন্তু তার আগে ঊনষাট সালে মুক্তি পাওয়া আকতার জং কারদারের ‘জাগো হুয়া সাভেরা’য় তিনি সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। সম্ভবত সাতান্নতে ছবিটির কাজ শুরু হয়। কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ পদ্মানদীর মাঝি নিয়ে স্ক্রিপ্ট লিখলেন জাগো হুয়া সাভেরার। সাধন রায় নামে আমাদেরই একজন ক্যামেরাপার্সন কাজ করলেন সেই ইউনিটে।
তৃপ্তি মিত্র এলেন অ্যাক্টিং করতে, খান আতা সেখানে মেজর ক্যারেক্টার করলেন, আর জহির রায়হান ছিলেন ওই ছবির একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট। তখন জহির রায়হান বাংলা ডিপার্টমেন্টে পড়েন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে। কোনো না কোনোভাবে সম্ভবত শহীদুল্লাহ্ কায়সারের সূত্রেই তার সেই হাজিরা। তো উনি সিনেমা বানাবেন এরকম কোনো ইয়ে তার ছিল না তখন। এমন কোনো আকাঙ্ক্ষা বড়ো কোনো আকাঙ্ক্ষা, সিনেমা করে তাকে বড়ো হতে হবে, ফিল্মমেকার হতে হবে সেরকম কোনো বিষয় তার ছিল না।
যাই হোক জাগো হুয়া সাভেরার অভিজ্ঞতা তাকে সিনেমায় টেনে আনতো। উনি প্রথম কী সিনেমা তৈরি করলেন? একজন শিল্পীর অন্তর্দ্বন্দ্ব। কীসের সেই অন্তর্দ্বন্দ্ব, আমরা আর্টিস্ট নিয়ে আরও বিভিন্ন ধরনের কাণ্ড-কারখানা আমাদের সিনেমায় দেখবো কিন্তু একজন শিল্পী, একজন পেইন্টারের জীবন নিয়ে এই কতো সাল হবে, উনিশশো একষট্টিতে কখনও আসেনি সিনেমাটা করলেন। আর কোনো সিনেমা করিয়ে একজন ব্যক্তি হিসেবে, শিল্পীর জীবনযাপন, তার অন্তর্দ্বন্দ্ব নিয়ে সিনেমা তৈরি করেন নাই। এটা দুঃসাহস, একটা নতুন ইন্ডাস্ট্রির মধ্যে থেকে এই ধরনের একটি ছবি এবং প্রথম ছবি করা মুশকিলের কথা।
উনি এধরনের দুঃসাহস বারবার করে থাকবেন।
তারপরের বছরই সম্ভবত উনি একটা ছবি করলেন। আমি সেই ছবিটি দেখি নাই। ‘সোনার কাজল’ বাষট্টি সালে। ‘কাঁচের দেয়াল’ যদি আপনাদের দেখবার সুযোগ হয়…আমার দেখা থাকবে।
মিডল্ ক্লাস ফ্যামিলির অর্থনৈতিক টানাপোড়েন, তার সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক চাপ সেই সিক্সটি থ্রিতে। কী সেই চাপ? আমরা কিছুকালের মধ্যেই জানবো, আমাদের কেনো রবী ঠাকুরকে ঠাকুর পূজা করতে হবে, কারণ আরেকজন ঠাকুরকে হঠাইতে হবে। আবার হারমোনিয়াম, তবলা থাকে প্রতি বাড়িতে, গান তারা শিখবেন, যদিও মোসলমানের পুত্র-কন্যা। রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কারণ যুগপৎ মধ্যবিত্তে একটা সঙ্কট তৈরি করবে। অন্য ধর্মাবলম্বীদের এই সঙ্কট ছিল না, মোসলমানেদের মধ্যে এই প্যাঁচ ছিল…।
আমরা দেখতে পাবো সেরকম একটি মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারে টানাপোড়েনের গল্প। অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক টানাপোড়েনের গল্প, প্রায় পুরোটা এফডিসির সেটে তৈরি। একটা-দুইটা শট আউটডোরে এবং কখনও আপনার মনে হবে না এটা চেম্বার মুভির জায়গা থেকে যে, এটি বোরিং বা আপনাকে কোনো না কোনোভাবে মনে করিয়ে দিচ্ছে আমি একটা বাক্সের মধ্যে আছি। কারণ এর প্রত্যেকটা মুহূর্ত আপনার চেনা। এই বাঙালি জানে, বাঙালি মোসলমান জানে, এই দেশের মানুষজন প্রত্যেকটা মুহূর্ত জানে।
ওই শোবার ঘরে, পড়ার ঘরে, রান্না ঘরে যেই মানুষটা এই মুহূর্তে হাজির আছে তাদের উপস্থিতিতে আমরা বুঝি বাইরের কী গল্প-চাকরি-বাকরির হালচাল, রাজনীতি, বাজার-সদাই…আমরা জানি দুই বোন পরস্পরের সঙ্গে কী আচরণ করে, কার কী সাধ, কী ঘটে অন্তরে।
যাই হোক, ‘কাঁচের দেয়াল’ এর পরে আমরা একই জিনিস আমরা পরবর্তীতে জীবন থেকে নেয়াতেও দেখবো। কাঁচের দেয়াল এর পরে ওনার সেই ছবিটি (সঙ্গম চৌষট্টিতে) আমার দেখার সুযোগ হয় নাই। হঠাৎ করে উনি আওয়াজ তুললেন, রঙিন ছবি বানাবেন। উনি একুশ দিনে একটা রঙিন ছবি তৈরি করে ফেললেন।
এবং সেই ছবি পশ্চিম পাকিস্তানি মেকারের আগেই কমপ্লিট করবেন। পশ্চিম পাকিস্তানে সেটা শো হচ্ছে, পাকিস্তানে নির্মিত প্রথম রঙিন ছবি হিসেবে…ঢাকায় হচ্ছে মানে বাংলাদেশে কয়েকটা হলে। আপনারা চাইলে ইন্টারনেটে এই সঙ্গম এর গান দেখতে পাবেন, এখন কেউ সেটা আপলোড করে থাকবে। অদ্ভূত সুন্দর তার পিকচারাইজেশন।
আচ্ছা যাই হোক আমরা হিন্দি ছবি দেখে আপ্লুত হই সেই সময়…আপনি জহির রায়হানের ছবি দেখলেও একই রকমভাবে আপ্লুত হবেন।
কারণ এই ছবিগুলো আমরা দেখতে পাই না, দেখার সুযোগ ঘটে না। পরের বছর পঁয়ষশট্টি সালে পাকিস্তানের প্রথম সিনেমাস্কোপ ছবি বাহানা নির্মাণ করলেন। উনি বাহানা করলেন সিনেমাস্কোপ ছবি, আবারও তাকে সিনেমাস্কোপে ছবি করতে হবে। কিন্তু আমাদের এখানে কোনো টেকনিক্যাল ইয়ে নাই, আয়োজন নাই। এফডিসিতে লেন্স নাই।
উনি সিনোমাস্কোপ ছবি করবেন। কোনো প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান তাকে বলে থাকবেন যে আমরা এগুলা অ্যারেঞ্জ করবো। আলটিমেটলি উনি এগুলো নিয়ে অনেক হাঙ্গামা করতে শুরু করলেন। এরপর হঠাৎ করে তার বেহুলা বানানো, ষিষট্টি সালে। তার আগের ছবিগুলির প্রায় সবকটি একেবারেই ফ্লপ।
কখনো আসেনি, কাঁচের দেয়াল কোনোটাই ব্যবসা করতে পারেনি। সঙ্গম করে তিনি কোনোরকমভাবে একটু ফেরত আসতে পারলেন। বাহানা করে কিন্তু উনি রূপবানের পথে পা বাড়ানো শুরু করলেন।
রূপবান একটা বড়ো ঘটনা বাংলাদেশের সিনেমায়। এতোকাল আমাদের সিনেমা দর্শক ছিল শুধুমাত্র মিডলক্লাস।
রূপবান নিম্ন আয়ের মানুষজন, কৃষিভিত্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষজনকে সিনেমা হলে নিয়ে আসলো। সিনেমা হলগুলো হঠাৎ করে চাঙ্গা হয়ে গেলো। নৌকার মধ্যে খাবার-টাবারের আয়োজন করে তিন গ্রাম, পাঁচ গ্রাম পরে কোথাও একটা সিনেমা হল আছে, হয়তো টিনের একটা ঘর, সেখানে গিয়ে মানুষ হাজির হলো। তিন দিনের জার্নি করে এসেও মানুষ সিনেমা দেখেছে। রূপবান বাংলাদেশের সিনেমার জন্য একটা অনেক বড়ো ব্যাপার।
উনি সেই পথে পা বাড়াইলেন- এগুলো আমাদের মাথায় রাখা জরুরি। কারণ যেই লোক বাহান্ন সালের ১৪৪ ধারা ভাঙতে প্রথম ১০ জনের মধ্যে হাজির হন, আটান্ন সালে সামরিক আইনের কবলে জেলখানায় যান তিনিই আবার উর্দুতে ছবি বানান। একটু পরিষ্কার করে বলে রাখা প্রয়োজন, আমরা এই আজকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস করি। কী করি? আমার দেশের কতোগুলো জনগোষ্ঠী আছে যারা বাংলা ভাষাভাষী নন। তাদের মাতৃভাষায় আমরা শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারি নাই।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস করি আমরা, শহীদ মিনারে ফুল দিতে যাই। কী কথা, কী আচরণ করে যাচ্ছি আমরা? একজন মান্দির (আদিবাসী গোষ্ঠীর নাম) কী সঙ্কট যে তাকে আমরা কেনো তার ভাষায়, মাতৃভাষায় পড়তে দিতে পারলাম না; অন্তত প্রাথমিক শিক্ষাটুকু? অনেকে দাবি করলেন, আমি অনেকের সঙ্গে ইন্টারভিউ করছিলাম, ভাষা নিয়ে একটা এপিসোড, ‘চন্দ্রবিন্দু’ নামে একটা অনুষ্ঠানের জন্য। সিলেটের মণিপুরী একজন শিক্ষক বলছেন, ‘দেখেন আমরাতো বাংলা ভাষায় কথা বলি, বাংলাভাষাতো ঠিক আছে, এটা প্রয়োজন। কিন্তু আমার এ বাচ্চাগুলোকেতো হঠাৎ করে বাংলায় টেনে আনা মুশকিল…প্রথম, প্রাইমারি স্কুলটাতে আমরা যদি আমাদের নিজেদের মণিপুরী ভাষায় পড়াতে পারতাম। তাহলে বাংলা ভাষায় এদের জন্য পরবর্তী শিক্ষা সহজ হতো’ -সহজ সাধারণ কথা।
বাহান্নতে এই একই দাবি নিয়ে আমরা হাজির হলাম, অথচ আজ আমরা অন্য কারও কথা শুনতে রাজি না।
আমরা মাতৃভাষা দিবস, আন্তর্জাতিকতা করি…আচ্ছা কী প্রসঙ্গে যেনো এটা বলতে গেলাম? অ্যা জহির রায়হান, উনি উর্দুতে ছবি তৈরি করতে গেলেন। আবার দেখেন এখন আজকে বেশিরভাগ মানুষের কাছে, উর্দু মানেই হচ্ছে- আমরা সেজান জুস খাবো না- পাকিস্তানি; আচ্ছা ক্রিকেট টিমকে কে সমর্থন করলো? আমরা উর্দু ভাষা পড়া বন্ধ করে দিলাম। এটা আরেক রকমের খারাপ আচরণ। এটা আবারও একটা খারাপ রাজনীতির অংশ।
এ রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে আমাদের বের হওয়া প্রয়োজন, যেনো এগুলো আমরা আমাদের কাজের মধ্যে, সিনেমার মধ্যে দেখতে পাই, সেইটুকুন। আচ্ছা জহির রায়হানকে হাজির হতে হলো। উনি উর্দুতে সিনেমা তৈরি করতে থাকেন। শুধু উর্দুতে না, উনি এমন আয়োজন করলেন- চাইনিজ ভাষায়, রুশ ভাষায় কী কী যেন…ডাবিং করে উনি লেট দেয়ার বি লাইট করবেন। তখন আওয়াজ দিয়ে ফেলছে, সিক্সটি ফাইভে; ওই সময় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় কেবলমাত্র ভারতীয় বাংলা সিনেমার আসা একটু বন্ধ হলো।
কিন্তু ততোদিনে আমাদের সারাদেশে কলকাতার বাংলা ছবি, হিন্দি ছবি, ইউরোপিয়ান ছবি, ফ্রেঞ্চ বলেন, ইতালিয়ান বলেন, রুশ বলেন- সেগুলো এই দেশে শো হচ্ছে। যখন সিক্সটিফোরে আমরা আবার ফিল্ম সোসাইটিও তৈরি করলাম, পাকিস্তান ফিল্ম সোসাইটি পরবর্তীতে বাংলাদেশ ফিল্ম সোসাইটি…তো এই ফাঁদে পা দিয়ে নিজে কিছুদিন বাদে হয়তো টের পেলেন, তিনি একটা ফাঁদে পা দিয়েছেন। সেটা হচ্ছে রূপবানের ফাঁদ। কী সেই ফাঁদ?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।