মেঘমুক্ত নীলাভ দিঘীর কবোষ্ণতা খুঁজছে মন!
আমাদের ইশকুলটা শহরের একেবারে শেষ মাথায়। পায়ে হাঁটা পথ থেকে অনেকটা উঁচুতে। দূর থেকেই দেখা যেত ওর লাল চূড়া। ইশকুলে পৌঁছতে হাঁটতে হয় বেশ খানিকটা।
মা বলেন, আমাদের শহরটা খুব ছোট, এত ছোট যে সবাই সবাইকে খুব ভালো করে জানে।
এটা অবশ্য ঠিকই। ইশকুলের আইসক্রিমওয়ালা কাফি ভাইর কথাই ধরো না; আমাকে দেখলেই বলবে, 'অন্তু ভাইজান, কুলফি খাইবেন! '
দর্জি সেলিম মিয়া, দোকানওয়ালা জলিল ভাই, পোস্ট অফিসের চৌধুরী কাকু-সবাইকে আমরা অনেক দিন ধরে জানি।
অবশ্য আমাদের শহরটা ছোট, এ ব্যাপারে আমি মোটেও একমত নই। আমার বন্ধু রকিও আমার মতোই ভাবে। ও বলে, মানুষের অভ্যাসই এমন, চেনা জায়গাকে ছোট মনে হয়, আর অচেনাটা বড়।
কেননা সারা দিন হাঁটলেও আমাদের শহরটা পুরো দেখা শেষ হয় না, বাকি রয়ে যায় বিস্তর।
সেদিন ইশকুলে পৌঁছতেই ঘণ্টা পড়ে গেল। ক্লাসে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে দেখি, এখনো টিচার আসেননি। তাই খুব হল্লা হচ্ছে। রোমেল বেঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে পানির বোতলকে গিটার বানিয়ে গাইছে।
ও বরাবরই গাইতে ভালোবাসে, তবে ওর গানের কোনো মানে হয় না, বোঝা যায় না কিছু। তাই ক্রিকেট খেলার মাঠে ও গান শোনাতে চাইলে আমরা সবাই অনেক মাথা নেড়ে বারণ করি।
এক কোণে টুশি আর রাগিব মারামারি করছে। রাগিব একদমই জিততে পারবে না-যা খামচি মারে টুশি। ওদিকে সজিব কী করবে ভেবে না পেয়ে শুধু লাফাচ্ছে।
একেবারে পেছনের বেঞ্চে রকি আর কাকন ঠাকুর বসে বসে গল্প করছিল চোখ বড় বড় করে। অর্থাৎ কিনা, কাকন বলছিল আর রকি হাঁ করে শুনছিল। কাকন হচ্ছে কথাসাহিত্যিক। ও কারও সঙ্গে প্রথম দেখা হলে নিজের পরিচয় দেয় তা-ই বলে। অবশ্য কথাসাহিত্যিক না বলে কখনো আবার কথাশিল্পীও বলে।
তাই তো নামের শেষে ঠাকুর যোগ করে ব্যাপারটা পাকাপোক্ত করতে চায়।
আমি বেঞ্চে ব্যাগ রাখতেই রকি আমার দিকে ফিরে বলল,'কাকন তো, মারাত্মক একটা গল্প বলছে রে, নির্ঘাত ছাপা অক্ষরে কোথাও বেরিয়ে যাবে। এই, তুই আবার গোড়া থেকে শুরু কর না। '
কাকন মহা উৎসাহে প্রথম থেকে শুরু করল-
'এক ছিল মাছ। মাছটা ভারি অলস।
ঠিকমতো খায় না, ঘুমায় না, এমনকি গোসলও করে না-তাই গা ভর্তি ভীষণ মেছো গন্ধ। '
'মাছরা গোসল করে নাকি!' আমি অবাক।
-নিশ্চয়ই করে, না করার কী আছে, আমিও তো করি, শুনেছি তোরাও করিস, মাছ করবে না কেন?
-কী দিয়ে গোসল করে, মানে বলছিলাম অত পানির ভেতর গোসলের পানি আলাদাভাবে কোথায় রাখে?
'অত কথা বলতে পারব না। ' কাকন সাফ জানায়। 'তা ছাড়া গল্পের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা নেই।
আর শোন, আমি হলাম কথাশিল্পী, আমার সঙ্গে তর্কে যাসনে, গীতাঞ্জলি আমার পুরো পড়া আর ম্যাক্সিম গোর্কি আমার প্রিয় ঔপন্যাসিক-এখন বল, আর প্রশ্ন করবি? আমি বললাম, 'না। '
'তো হলো কি,' কাকন আবার শুরু করে, 'মাছটার গায়ে তাই বেজায় মেছো গন্ধ। একদিন খুব গরম পড়েছে। মাছটার তখন ভারি তেষ্টা পেল। গলা শুকিয়ে একেবারে ধু-ধু মরুভূমি।
মাছটা যখন চোখে অন্ধকার দেখছে তখন হঠাৎ খেয়াল করল, সামনে এক নীলবসনা মাছি সুরার পেয়ালা হাতে দাঁড়িয়ে। '
'মাছি?' ফের আরেকটা প্রশ্ন মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, 'মশা-মাছিও আছে গল্পে। '
'আরে না না হাঁদা কোথাকার,' কাকন বলে, 'মাছি বুঝছিস না-মেয়ে মাছ, গল্পের প্রধান নারী চরিত্র···। '
গল্পটা আর শুনতে পারলাম না, হঠাৎ ক্লাসে স্যার এসে উপস্থিত হলেন। স্যারের নাম আজগর স্যার।
খুব মারতে পারেন। স্যারের নিয়ম হচ্ছে পড়া না পারলে কোনো সমস্যা নেই, পড়া না-পারাটা নাকি ছাত্রজীবনে খুবই সম্ভব। কিন্তু ক্লাস চলাকালে কোনো কথা বলা খুব বাজে কাজ-তার জন্য কড়া শাস্তি। তাই স্যার আসতেই আমরা সবাই হয়ে উঠি এক একটা পাথরের মূর্তি।
স্যারের সঙ্গেই ক্লাসে ঢুকল নতুন একটা ছেলে।
এক মাথা কোঁকড়া চুল, চোখে গোল ফ্রেমের চশমা। হাত-পা এমন সরু যে পিঠের মস্ত ব্যাগটা নিয়ে ঠিক-ঠিক দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে বলে বিশ্বাস হয় না।
স্যার বললেন, 'ওর নাম শান্ত। তোমাদের ক্লাসে আজই ভর্তি হলো। ' তারপর স্যার ওর নাম প্রেজেন্ট খাতায় তুলে বসতে বললেন।
ছেলেটাও চটপট সামনের বেঞ্চে বসে খাতা-কলম হাতে নিয়ে স্যারের একঘেয়ে কথাবার্তা কান খাড়া করে শুনতে লাগল। আর ক্লাসের ফাঁকে আড়চোখে আমাদের দেখছিল। আমরা অবশ্য সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে সরাসরিই ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। নতুন কেউ এলে আমাদের খুব আগ্রহ হয়।
হঠাৎ ছেলেটা করল কি, সরু গলাটা যতটা সম্ভব উঁচু করে বলল, 'স্যার, আমার একটা প্রশ্ন ছিল।
'
আমরা সঙ্গে সঙ্গে খুশি হয়ে উঠলাম। কারণ, পড়ার মাঝখানে এভাবে প্রশ্ন করলে স্যার এত চমৎকার এক ধমক দেন যে আমাদের কানে খাটো হেডস্যারও তার রুমে বসে বেশ শুনতে পান। এবং তার সঙ্গে সুন্দরবন থেকে বিশেষভাবে বানিয়ে আনা বেতের হাফ ডজন ঘা বসিয়ে বুঝিয়ে দেন প্রশ্ন করাটা কী রকম বিশ্রী কাজ। প্রথম দিনই নতুন ছেলেটা এই শাস্তি পাবে, ভাবতেই আমাদের আনন্দ হচ্ছিল। কিন্তু আমাদের অবাক করে দিয়ে স্যার মনোযোগ দিয়ে ওর প্রশ্নটা শুনলেন, তারপর বাকি ক্লাসটার অধিকাংশ সময় প্রশ্নটা নিয়ে আলোচনা করলেন, এবং সঙ্গে সঙ্গে এও বললেন যে ও যেন কিছু না বুঝলে সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করে স্যারকে বাধিত করেন।
এমন পক্ষপাতমূলক আচরণে আমরা খুবই খেপে উঠলাম নতুন ছেলেটার প্রতি।
ক্লাস শেষ হতেই রকি ওর কাছে গিয়ে বলল, 'আমার সঙ্গে মারামারিতে পারবি?'
ছেলেটা কিন্তু 'হ্যাঁ'ও বলে না, 'না' ও বলে না। চশমার মোটা কাচের ওপাশের ড্যাবডেবে চোখ দুটো দিয়ে কেমন করে যেন ওর দিকে তাকিয়ে রইল।
কিরে জবাব দিচ্ছিস না যে, ভয় পেলি তো! তবে স্বীকার কর, ভয় পেয়েছিস। ' রকি বলে।
'আহ্, ভয় পাব কেন। ' ছেলেটা হঠাৎ ঝাঁপিয়ে ওঠে। 'তোর মতো কত ছেলেকে আমি গোলাম বানালাম। ’
-কী, গোলাম বানিয়েছিস?
-নয় তো কী, আগে যে স্কুলে পড়তাম, সেখানে আমার ক্লাসের সবাই আমার গোলাম, আমার পাড়ার নিচের ক্লাসের সবাই আমার গোলাম। আর দেখিস, তুইও আমার গোলাম হবি।
এই কথায় রকি ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কত বড় সাহস! বলে কিনা গোলাম বানাবে! মারামারি চলছিল খুব। রকির সঙ্গে মারামারিতে পেরে ওঠা মুশকিল। নতুন ছেলেটার শার্টের যা হলো না, ধুলোয় একেবারে মাখামাখি, দু-একটা বোতামও ছিঁড়ে গেছে বোধ হয়।
তবে ছেলেটার কথা খুব অদ্ভুত।
এমন অদ্ভুত কথা আগে কারও কাছে শুনিনি। এমন কথা শোনার পর আমাদের সবারই খুব মেজাজ খারাপ হলো ছেলেটার ওপর।
এমন সময় হঠাৎ সজিব চেঁচাল, 'হেডস্যার আসছে রে···। '
শুনে সঙ্গে সঙ্গে আমরা হুড়মুড়িয়ে নিজ নিজ বেঞ্চে গিয়ে একেবারে স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে যাই। রকিও নতুন ছেলেটাকে ছেড়ে বেঞ্চে ফিরে আসে।
হেডস্যারকে আমরা সবাই যা ভয় পাই না! স্যার ক্লাসে এসেই বললেন, 'এটা ক্লাস ফোর না?'
'জি স্যার। ' আমাদের সম্মিলিত জবাব।
'আচ্ছা, আজকে নতুন একটা ছেলে ভর্তি হয়েছে না তোমাদের ক্লাসে, ও কোথায়?'
ওকে দেখিয়ে দিতেই স্যার তো প্রথমে ভাষা হারিয়ে ফেললেন। মেঝের ধুলা লেগে জামা-কাপড়ের বিশ্রী অবস্থা, মারামারি করলে যা হয় আর কি। রকি ওর চুলগুলোও টেনে টেনে খুব এলোমেলো করে দিয়েছে।
ওকে দেখে স্যার এবার হুঙ্কার ছাড়লেন, 'কোন বদমাশ ওর সঙ্গে মারামারি করেছে?'
আমরা সবাই মারাত্মক ভয় খেলাম। রকিকে না জানি আজ কত মার খেতে হয়। হয়তো আমাদের সবাইকেই মার খেতে হবে। পুরো ক্লাসের সবাইকে মারার ব্যাপারে স্যারের অনেক রেকর্ড আছে। তাতেও কারোর ভাগে কম পড়ে না।
হেডস্যারের মারার ধরনই এই যে-পুরো এক শটা করে সরু বেতের বাড়ি জনপ্রতি। এর চেয়ে কম হয় না কখনো।
কিন্তু আমাদের অবাক করে দিয়ে নতুন ছেলেটা বলল, 'স্যার, মারামারির জন্য নয়, আসার সময় পথে পড়ে গিয়েছিলাম, তাই শার্টের এ অবস্থা। '
'ঠিক বলছিস তো, তোর সঙ্গে বদমাশগুলো কোনো বাজে ব্যবহার করেনি তো?'
'না, না স্যার,' ও আবার বলে, 'ভালো ব্যবহার করেছে বলেই তো মনে হলো। '
শুনে আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি।
স্যারও শান্ত হন। আর আমাদের বললেন, 'তোরা শান্তর সঙ্গে ভালোভাবে চলিস, বুঝেছিস। ও আমার বন্ধু রমিজ সাহেবের ছেলে। ওরা এই শহরে নতুন এসেছে। '
তারপর বললেন, 'ও ক্লাস থ্রিতে যে স্কুলে ছিল, সেখানে ফার্স্ট ছিল, এ স্কুলেও ফার্স্ট হবে বলেই আমার ধারণা।
' বলেটলে স্যার চলে গেলেন।
স্যার বেরিয়ে যেতেই শান্ত করল কি, সামনের বেঞ্চে দাঁড়িয়ে ঠিক নেতারা যেভাবে মঞ্চে উঠে ভাষণ দেয়, তেমনিভাবে বলা শুরু করল, 'তোদের সবাইকে আমি একটা কথা বলতে চাই। আগামীকাল কিন্তু আমি সত্যিসত্যিই রাস্তায় গড়াগড়ি খেয়ে তবে ইশকুলে আসব। '
শুনে তো আমরা থ। পাগল নাকি! ও বলে চলছে, 'হ্যাঁ, তা-ই করব।
কারণ, আজ যে মিথ্যা বললাম, সেটা কাটা দিতে হবে না!'
বাহ্! বাহ! আমরা বলে উঠি। কয়েকজন তো হাততালিই দিয়ে ফেলে। ছেলেটা দেখছি দারুণ সত্যবাদী আর ভালো। ওর সঙ্গে একটু আগের আচরণের জন্য আমাদের আফসোস হয়। কাকন ঠাকুরের চোখ ছলছল করে ওঠে।
ও আবার বলা শুরু করল, 'কিন্তু সমস্যা কী জানিস, তার পরও কিন্তু আমার মিথ্যা কাটবে না। তাই কালকে সেই ধুলো লাগা জামা নিয়ে হেডস্যারের কাছে গিয়ে বলব, তোরা সবাই আমাকে খুব মেরেছিস। '
অ্যাঁ, পাগল নাকি? আমরা সবাই শিউরে উঠি।
'হ্যাঁ, আমি খুব সত্যবাদী। কালকে তাই এটা আমাকে বলতেই হবে।
' মুখ শক্ত করে বদমাশটা বলতে থাকে।
'তবে আজ বললি না কেন?' আমরা জিজ্ঞেস করি।
'তোদের একটা সুযোগ দেওয়ার জন্য। ' হাসিমুখে ও বলে।
'সুযোগ!' আমরা অবাক।
'হ্যাঁ, সুযোগ,' শান্তকণ্ঠেই বলে চলে শান্ত, 'শুধু একটা কাজ করলেই তোরা রেহাই পাবি। আমি তাহলে কিছুই করব না। তোরা স্বীকার করবি, তোরা আমার গোলাম!'
আমাদের কোনো উপায় ছিল না। তাই প্রথম দিনেই আমরা সবাই শান্তর গোলাম হয়ে গেলাম। অন্যদের গোলাম বানানোই ওর জীবনের উচ্চতম লক্ষ্য।
ও আমাদের সবার নাম লিখে নাম্বারিং করে রাখল ওর ডায়েরিতে। ওর ডায়েরিটা হলো ওর সব গোলামের হিসাব বহি। আমার বেলায় লিখল-অন্তু, গোলাম নম্বর-৮২৭।
প্রকাশিত: ১৯ ডিসেম্বর,২০০৮ গোল্লাছুট, প্রথম আলো, 'ক্লাসে নতুন ছেলে' শিরোনামে :: লিঙ্ক
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।