কালুর পরিচয় কেয়ারটেকার হলেও আসলে সে বাড়ীর দারোয়ান। কারণ এতবড় বাড়ী খালি পড়ে থকালেও সেখানে তার থাকার কোন অনুমতি নেই। সে থাকে গেইটের সাথে লাগোয়া পাঁচফুট বাই পাঁচফুট পাহারা দেয়ার খোঁয়াড়টিতে। মুখে তার মৌলানার মত দাঁড়ি, থুতনির দিকে সবটাই পাকা। সে কিন্তু মোটেও ধার্মিক নয়।
শেভ করার টাকা বাঁচাতে গিয়ে তার দাঁড়ির এ হাল হয়েছে। তবে এই দাঁড়ি তার চেহারায় একটা নূরানী ভাব নিয়ে এসেছে। সে যে হাড়ে হাড়ে বজ্জাত সেটা ওপর থেকে দেখে বোঝার কোন উপায় নেই। তৈরী বাড়ীটা আফরান কাজী কিনেছিলেন দু’বছর আগে। তিনি ছয় মাস অন্তর বউ বাচ্চা নিয়ে একবার দেশে আসেন, পনের বিশ দিন থেকে আবার কানাডায় ফিরে যান।
তাঁর ছোট ভাই গোফরান কাজী অফিস থেকে ফেরার পথে মাঝে মাঝে বিনা নোটিশে এখানে চলে আসেন। এসব দারোয়ান টারোয়ানদের কোন বিশ্বাস নেই। গোফরান কাজী ভীষন কড়া লোক। চুন থেকে পান খসলেই বলে ওঠেন, ‘চাবিটা দে, বিদায় হ.. আমি অন্য লোক দেখব। ’ কালু শুরু থেকেই এ বাড়ী দেখাশোনা করে আসছে।
ঝাড়ু থেকে শুরু করে বাড়ীর প্রায় সব কেনাকাটা বাবু করে দিয়েছে। সাথে অবশ্য কালুও ছিল। শেয়ার বাজারে বাবুর কিছু টাকা লগ্নি করা আছে যাতে রনির অংশই বেশী। রনি তার বাবা মা’র সাথে কানাডাতেই থাকে। প্রচন্ড আলসে এই বন্ধুটিকে রনি খুবই পছন্দ করে।
যেহেতু চাকরি বাকরি তার ধাতে নেই তাই ব্যবসা করে হলেও যাতে সে দাঁড়াতে পারে এই জন্যে রনি টাকা গুলো দিয়েছে। নইলে শেয়ার ব্যবসায় তার বিন্দুমাত্র উৎসাহ নেই। বাবু আজ দশ বছর যাবত শুধু পাত্রীই দেখে আসছে। সে অবিবাহিত জানার পর থেকেই কালু টোপ ফেলতে শুরু করেছে। একদিন সাহস করে বলেই বসেছে, ‘ঘরটা খালি পড়ে থাকে, মাঝে মাঝে এসে আপনি বিশ্রাম নিতে পারেন.. তালাচাবি তো আমার কাছেই থাকে।
’ শুক্রবার বাসায় নানা ধরনের কাজকর্ম থাকে, শনিবার স্টক এক্সচেঞ্জ বন্ধ। কালুর টোপটা গিলে তারপর থেকে প্রায় শনিবার দুপুরে এখানে এসেই বিশ্রাম নেয় বাবু। অবশ্য কালুকে সে বলে দিয়েছে বিষয়টা যাতে গোপন থাকে, নয়তো কোন একদিন কালুর জায়গায় গোফরান সাহেব তাকেই কেয়ারটেকারের দায়িত্ব নেয়ার জন্য অনুরোধ করে বসতে পারেন। এভাবে দিন যেতে যেতে একদিন আসল টোপটা ফেলল কালু, ‘বিয়া শাদী এখনও করেন নাই.. একা একা বিশ্রাম করতে কি আর ভাল লাগে.. ইচ্ছা করলে সাথে করে বন্ধু বান্ধবও নিয়ে আসতে পারেন। ’ বাবুর মত আদর্শবান লোক দ্বিতীয় টোপটাও গিলে ফেলল অনায়াসে।
শুরু হয় বিশ্রামের দ্বিতীয় পর্ব। এই নতুন এবং গোপন অভিসারে পার হয়ে যায় গোটা পাঁচেক শনিবার। একদিন, নরম বিছানায় বিশ্রামটা দীর্ঘ হতে হতে বাবু তার সাথীকে নিয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। কালু ভাবল এবার বুঝি সময় হল বড়শিতে টান দেয়ার। রাত সাড়ে আটটায় যখন মহারাজের ঘুম ভাঙ্গল তখন চারিদিকে অন্ধকার।
অন্ধকারে বাতির সুইচটাও খুঁজে পাওয়া যায় না। মোবাইলের টর্চটাও নষ্ট হয়ে গেছে। হাতরে হাতরে দরজার কাছে গিয়ে দেখে বাইরে থেকে তালা দেয়া। কালুকে ডাকতে গিয়ে কি ভেবে সে আর ডাকে না। মোবাইলে ফোন করে কালুকে আসতে বলে।
কালু বিড়ালের মত এসে জানালায় টোকা দেয়। জানালা একটু ফাঁক হলে ফিসফিস করে সে জানায়, বড় ভাইজান এসেছেন, গেইটের কাছে দাঁড়িয়ে কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছেন। তারপর গলাটা আরেকটু খাদে নামিয়ে বলল, ‘দরজা খোলা দেখলে ফাজিল ব্যাটা গালাগালি করবে তাই তালা দিছি.. বাত্তি জ্বালায়েন না। ’ ইতিমধ্যে মহারানীও জেগে উঠেছেন, বিছানায় শোয়া অবস্থায় বাবুকে বলল, ‘সর্বনাশ! রাত হয়ে গেছে? বাতিটা জ্বালান। ’ বাবু চুপিচুপি বলল, ‘একটু সমস্যা হয়ে গেছে, আওয়াজ করোনা।
’ মেয়েটা অস্থির হয়ে উঠেছে, ‘আমার অন্য জায়গায় প্রোগ্রাম আছে। ’ বাবু তাড়াতাড়ি লুসির মুখ চেপে ধরল, ‘প্লিজ তোমাকে আরো পাঁচশ টাকা বাড়িয়ে দেব, কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাক। ’ বাবু প্রচন্ড ভাবে ঘামছে। মাথার উপর ফ্যান কিন্তু ছাড়তে সাহস হচ্ছে না। তার চোখের সামনে শুধু গোফরান সাহেবের বিশাল চওড়া গোঁফ জোড়া ডানা মেলে উড়ছে।
যা রাগি মানুষ! সে বিক্ষিপ্ত মনটাকে অন্যদিকে ফেরানোর চেষ্টা করল। আচ্ছা মেয়েটার নাম কি সত্যিই লুসি? কে জানে, এরা কি কখনও আসল নাম বলে? গত চার শনিবারে তিনজন মহারানী এ বাড়ীতে এসেছেন। তাদের মধ্যে লুসিই এসেছে দুইবার। বাকিদের চাইতে তার চাহিদা দুইশ টাকা বেশী। হঠাৎ জানালায় টোকা শুনে বাবু চমকে ওঠে।
কালু এসে জানাল গোফরান সাহেব চলে গেছেন। আহ্ মনে হল গোফরান সাহেব যাননি, যেন পথ ভুলে চলে গেছেন আজরাইল। কালুর কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে আলো জ্বেলে সুইচবোর্ডটা খুঁজে নিল বাবু। এবাড়ীর প্রায় সবকিছুই তার নখদর্পনে শুধু সুইচবোর্ডটাতে একটু গন্ডগোল হয়ে যায়। কালুর খসখসে কাশির আওয়াজ শুনে বাবু অবাক হয়ে ফিরে তাকায়, ‘দাঁড়িয়ে আছো কেন? দরজা খোল তাড়াতাড়ি।
’ এরপর কালু ভয়াবহ সংবাদটি রসিয়ে রসিয়ে পরিবেশন করলো, ‘ইয়ে.. চাবিটা বড় ভাইজান নিয়ে গেছেন। ’ লুসি মুখে একটা ভেংচির ভাব দেখিয়ে টয়লেটে ঢুকে পড়ল আর বাবু মাথায় হাত দিয়ে ফ্লোরে বসে পড়ল। প্রায় দু’মিনিট দু’জনেই চুপচাপ থাকার পর বাবু নিরবতা ভাঙ্গল, ‘আপনি কোন ব্যবস্থা করতে পারেন না আঙ্কেল?’ কালু মুখে কিছু না বলে ইশারায় অপারগতা প্রকাশ করল। তারপর কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বলল, ‘ভাইজানের বিশ্রাম কেমন হল?’ বাবু মনে মনে বলল, ‘ওরে.. তুই নিষ্ঠুরের মত প্রশ্ন করছিস কেন বাপ্?’ একটু পরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কালু বলল, ‘আমারো কি মাঝে মাঝে এরকম বিশ্রাম করতে ইচ্ছা করেনা?’ বাবু অবাক হয়ে কালুর দিকে ফিরল। মিনতি করে বলল, ‘কাকা..কাকা.. এরপর থেকে না হয় আমি বেরিয়ে আসার পর তুমিও খানিক্ষণ বিশ্রাম নিও।
’ কালু হঠাৎ অন্যদিকে ফিরে উদাস হয়ে গেল। বাবুর ঠোঁট দু’টি শুকিয়ে খসখসে হয়ে আছে। সে আবারো বলল, ‘চাবিটা কোন ভাবেই কি ম্যানেজ করা যায় না ভাইজান?’ এবার কালু একটু নড়ল বলে মনে হল। যেতে যেতে বলল, ‘বড় ভাইকে ফোন করে দেখি, কাছাকাছি থাকলে না হয় চাবিটা নিয়ে আসলাম। ’ লুসি টয়লেট থেকে বেরিয়ে এসেছে, ‘কি হল, আমি এবার যাব.. তাড়াতাড়ি টাকা দেন দেড় হাজার।
’ বাবু চোখ বড় বড় করে তাকাল, ‘দেড় হাজার কেন?’ লুসি হেসে বলল, ‘বারে, আপনি বললেন না পাঁচশ বাড়িয়ে দেবেন। ’ বাবুর মুখটা কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল। এমন সময় দরজার তালা খোলার শব্দ পাওয়া গেল। আরে এক মিনিটও হয়নি এর মধ্যেই চাবি কোথায় পেল শালা? কালু রুমে ঢুকে হাসতে হাসতে বলল, ‘বড় ভাইকে ফোন করার জন্য মোবাইলে হাত দেয়া মাত্র গাড়ীর হর্ণ শুনতে পেলাম, আমাকে ডেকে বললেন ভুলে নাকি চাবি নিয়ে গেছেন। ’ লুসি ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘কই, কোন হর্ণ শুনলাম না তো।
’ কালু দাঁত কেলিয়ে হাসলো। লুসিকে সাথে নিয়ে রাগে ফুসতে ফুসতে বের হয়ে গেল বাবু।
পরের শনিবার সকাল ন’টার দিকে কালু যখন বাবুকে ফোন করে তখন সে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। কালু জানাল তার সন্ধানে নাকি একটা ডানা কাটা পরী আছে। বাবু ঘুম চোখে কোন উত্তর না দিয়ে হাই তোলে।
কালু আমতা আমতা করে জানাল পরী’র ডিমান্ড নাকি দু’জনের জন্য তিন হাজার, তার মধ্যে আবার অগ্রীম চায় দু’হাজার। বাবু দুপুর দু’টায় আসবে বলে অগ্রীমটা কালুর কাছ থেকে দিয়ে দিতে বলে। কিন্তু কালু জানাল তার কাছে টাকা নেই, সে নাকি বেতনই পায় তিন হাজার। হঠাৎ গত শনিবারের কথা মনে পড়ায় বাবু নিরবে একটু হাসে। সে পরে পরিশোধ করে দিবে বলে অগ্রীম টাকাটা কালুকে কোন ভাবে যোগাড় করে নিতে বলে।
কালু একটি আয়েশী ঢেকুর তুলে পাজামার গিঁটটা লাগাল। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে আজ খুবই খোশমেজাজে আছে। দেখতেও দারুন লাগছে তাকে। শুধু জুলপি দু’টো পেকে সাদা হয়ে আছে। সকালে সুন্দর করে চুল ছেঁটেছে।
জুলপিতে একটু কলপ করিয়ে নিলে ভাল হত। মসৃন মুখটাতে দাঁড়ির ছিটেফোঁটাটি নেই। তেলতেলে মুখে আলো পড়ে পিছলে যাচ্ছে। পরী বাথরুম থেকে বেরিয়ে চুল ঠিক করতে করতে বাকি এক হাজার টাকা চাইল। কালু বলল, ‘কোন সমস্যা নাই.. অপেক্ষা কর, একটু পরে আরেকজন এসে পড়বে।
’ পরী খানিকটা বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘আমি আর থাকতে পারবো না, যেতে হবে.. টাকা দেন। ’ বাবু ভাই আসতে এত দেরী করছে কেন কে জানে। পাশের নির্মানাধীন বাড়ীর কন্ট্রাকটারের কাছ থেকে ধার করে পরীকে অগ্রীম দু’হাজার টাকা দিয়েছে কালু। ফোনও তো ধরছেনা বাবু ভাই। চিন্তিত কালু দরজা খুলে বাইরে বের হয়ে এল।
চোখের সামনে হঠাৎ উদয় হওয়া চওড়া একজোড়া গোঁফ দেখে তার বুকটা কেঁপে উঠল আচমকা। সামনে গোফরান সাহেব দাঁড়িয়ে। কালু মুখে হাসি এঁটে, ‘কোঁৎ’ করে একটা ঢোক গিলল। পরী ভিতর থেকে বের হয়ে আসতে আসতে বলল, ‘বাকি টাকাটা দেন, বিদায় হই। ’ গোফরান সাহেবকে দেখে পরী লাস্যময়ী হাসি দিয়ে বলল, ‘আমার কিন্তু সময় শেষ ভাই.. এখন আর কিছু হবে না।
’ গোফরান সাহেব পরীর কাছ থেকে চোখ সরিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে কালুকে বললেন, ‘চাবিটা দে?’ কালুর মুখে ফ্যাকাসে হাসিটা লেগেই আছে। পা দু’টো প্রচন্ড ভারী ভারী ঠেকছে। পরী কোমরে শাড়ী গুঁজতে গুঁজতে গোফরান সাহেবকে ঝাম্টে উঠল, ‘বললাম না সময় শেষ। ’ কালুর দিকে ফিরে বলল, ‘এই বুইরা টেকা দে। ’ বিদঘুটে সংক্ষিপ্ত একটি রিং টোনের শব্দ কালুকে কিছু সময়ের জন্য রেহাই দিল বুঝি।
গোফরান সাহেব রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, ‘কলটা ধর্ হারামজাদা। ’ কালু পরীর দিকে তাকাল। পরী বলল, ‘ফোনটা ধর্ ব্যাটা। ’ কালু মিনমিন করে বলল, ‘এটা কল না। ’ সে দেখল বাবুর পাঠানো ছোট্ট ম্যাসেজে লেখা রয়েছে, ‘Bhaijaner bisram kemon holo janaben.’
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।