বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
অনেক অনেক দিন আগেকার কথা।
সময়টা মধ্যভাদ্র। দ্বিপ্রহর।
সকাল থেকেই আকাশ ছিল মেঘশূন্য। সহসা হাওয়া হয়ে উঠল উত্তাল। উত্তাল ও শীতল। চারিদিকে বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ। ততক্ষণে মেঘ জমতে শুরু করেছে আকাশের কোণে।
দেখতে দেখতে ফুঁসে উঠল করতোয়ার জল।
টলে উঠল সপ্তডিঙা মধুকর।
মাঝিমাল্লার আর্তনাদে করুন হয়ে উঠল গাঙের বাতাস।
চাঁদ সওদাগর প্রমাদ গোনে।
কম্পমান পাটাতনের ওপর দাঁড়িয়ে উদ্বিগ্ন বোধ করে সে।
কত কত রাজ্যের কত কত ধনরাশি জমানো নৌকায়। এখন যদি ঝড় ওঠে?
ঝড় উঠল ঠিকই।
বাতাসের তান্ডবে ঠিকই ফুঁসে উঠল করতোয়ার জল।
চারিদিকে ঘনিয়ে এল অন্ধকার।
করকর শব্দে ভাঙ্গল মাস্তুল।
ছিঁড়ল পাল। কড়াৎ কড়াৎ শব্দে ফাটল নৌকার তলি।
উলটে গেল ডিঙা মধুকর।
চারিদিকে অন্ধকার। অন্ধকার আর জল।
চাঁদ সওদাগর খাবি খায় অন্ধকার করতোয়ার জলে।
নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়।
জলে তলায় একসময় চোখেমুখে অন্ধকার দেখে সে।
২
করতোয়ার দক্ষিণপাড়ে উজানীনগর।
সে নগরে বাস করত সায়বেনে।
সম্পন্ন বণিক সে। আর ছিল একনিষ্ট ধার্মিক। শিবের পরম ভক্ত সায়বেনে। করতোয়ার দক্ষিণ তীরে একটি শিবমন্দির গড়েছে সে । সেখানেই তার বাড়ি।
প্রত্যহ ভোরে ঠাকুরের পূজো শেষে নদীপাড়ে কিছুক্ষণ পায়চারী করে সায়বেনে।
তো, সেদিন ভোরবেলা নদীপাড়ে পায়চারী করার সময় কাকে যেন কাদার ওপর পড়ে থাকতে দেখে থমকে দাঁড়াল সায়বেনে। কাল ঝড় উঠেছিল। নৌকাডুবি হয়ে থাকবে। সায়বেনে জলে ডোবা শরীরের দিকে এগিয়ে যায়।
এ কী! এ যে আমাদের চাঁদবেনে। হ্যাঁ, চাঁদ সওদাগরই বটে। তা চাঁদবেনেকে ভালোই চেনে বটে সায়বেনে। পুন্ড্রবর্ধন বনিক সঙ্ঘের একজন ধনী প্রভাবশালী নেতা চাঁদ। প্রখ্যাত আর্য শ্রেষ্ঠী।
চাঁদ সওদাগরের বুকের ওপর উপুর হয়ে বুকের ধুকপুকানী শুনল কিছুক্ষণ। না, এ বেঁচে আছে। সায়বেনে স্বস্তি বোধ করে। সে মধ্যবয়েসী লোক। বিশাল বপুর অধিকারী ।
সে চাঁদ সওদাগরকে অনায়াসে কাঁধে তুলের ঘরের দিকে হাঁটতে শুরু করল।
বেলের পানা নিয়ে দাওয়ার স্বামীর জন্য অপেক্ষা করছিল অমলা।
ও কে গো? স্বামীর কাঁধে কাদা লেপ্টানো মানুষ দেখে অমলা প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে।
এ আমাদের চাঁদবেনে গো। নদী ধারে পড়েছিল।
কাল ঝড় উঠল না।
শিবই বাঁচিয়েছেন ঠাকুর। অমলা বলল।
তা ছাড়া আর কে। সায়বেনে বলল।
সায়বেনে পরিবারের যতেœ ধীরে ধীরে সেরে উঠল চাঁদবেনে।
পুরুষের আর কী। হাতে সময় থাকলে রাজনৈতিক আলাপে মেতে ওঠে।
সায়বেনে বলল, কানাঘুঁষো শুনছি। শশাঙ্ক নাকি বঙ্গের নৃপতি হচ্ছেন।
সত্যি নাকি চাঁদ?
হুঁ। তাই তো শুনলাম। দুধের বাটিতে চুমুক দিয়ে চাঁদবেনে বলল। আমি ওদিকেই গেছিলাম। মানে আমি কর্ণসুবর্ণ গিয়েছিলাম।
ওটাই নাকি শশাঙ্কের রাজধানী হচ্ছে। অমার্তরা নাকি শশাঙ্ককে নির্বাচিত করেছে।
বলছ কী। নির্বাচন?
হ্যাঁ। নির্বাচন।
সায়বেনে বলল, দিনে দিনে কত কী যে দেখব। যাক রাজ্যে এবার সুখশান্তি এলে হল। গত একশ বছরে পুন্ড্র-বঙ্গের সব পুড়ে ছাড়খার হয়ে গেল যে।
চাঁদবেনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, হ্যাঁ। গুপ্তদের পতন হল।
তারপর কত বছর অরাজকতা। বড় মাছ ছোট মাছকে গিলে খেল। এখন মহান শশাঙ্ক বঙ্গের সুখসমৃদ্ধি বজায় রাখবেন আশা করি। তবে আমি কর্ণসুবর্ণ থাকতে শুনেছি শশাঙ্ক নাকি বুদ্ধঘেঁষা। এখন আমাদের মত শিবভক্ত আর্যদের রাজ্যছাড়া না করলে হয়।
সায়বেনে আঁতকে উঠে বলল, তাই নাকি? তালে তো ভারি চিন্তার বিষয়। সাত পুরুষ হল আমরা পিতৃপুরুষের আর্ষসংস্কার মেনে রয়েছি। এখনÑ
দুধের বাটিটা নামিয়ে রেখে চাঁদ সওদাগর বলল, দেখা যাক কি হয়। এখনই ওসব নিয়ে অত ভেবে কী লাভ। যাক, এবার আমার চম্পক নগর ফেরার গতিক করতি হয় যে সায়।
সে হবিনে। সায়বেনে বলল।
দরজার ওপাশ থেকে অমলা বলল, আর কটা দিন থেকে গেলে হত না দাদা।
সে উপায় কি আছে?
কেন? কী হল?
চাঁদ সওদাগর বলল, কত দিন হল বাড়ির বাইরে। বড় উতলা বোধ করছি।
ও। দাসীর কন্ঠস্বর শুনে ওপাশে চলে গেল অমলা।
অমলা চলে যেতেই চাঁদ সওদাগর বলল, তোমার স্ত্রীটি মনে হয় সন্তানসম্ভবা সায়?
হুঁ।
বেশ, বেশ। আমার বোয়েরও যে গব্ব হয়েছে।
কী যে হৈল, সে ভেবে অস্থির হনু। যাক। তুমি আমার প্রাণ বাঁচালে-
সে তুমি হলেও বাঁচাতে চাঁদ।
হ্যাঁ। তা ঠিক।
তো, আমার মেয়ে হলে তোমার ছেলে হলে -
কথাটা শেষ হল না। সায়বেনে বলল, কিংবা ধরো আমার মেয়ে হলে তোমা ছেলে হলে আমরা বেয়াই হব। এই তো?
হ্যাঁ।
সায়বেনে হেসে উঠল।
দু’দিন পর চম্পক নগরের উদ্দেশে যাত্রা করল চাঁদ সওদাগর।
৩
করতোয়ার পূর্বপাড়ে চম্পক নগর।
সেই চম্পক নগরেই ছিল বহু পুরুষ ধরে চাঁদ সওদাগরের বাস। তার পূর্বপুরুষরা ছিল আর্য। তারাই এককালে করতোয়া পাড়ে বাঘ ও সাপের সঙ্গে যুদ্ধ করে গড়ে তুলেছিল নগর-জনপদ। তবে এতদ্বঞ্চলের স্থানীয় আদিম অধিবাসী নিষাদরাও বাস করে।
তবে সামান্য দূরে, করতোয়ার পাড় ঘেঁষে অরণ্যে। নিষাদরা দেবতা বোঙ্গার পূজা করে । তারা বিশ্বাস করে কী সব লৌকিক দেবদেবীতে। চাঁদ সওদাগর নিষাদদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে চলে। সে তার পূর্বপুরুষের মতোই শিবভক্ত।
আজও শিবের সুদৃষ্টি কামনায় যজ্ঞের আয়োজন করে চাঁদ সওদাগর।
বহুদিন বাদে বাড়ির আঙিনায় পা দিয়েই শিশুর কান্না শুনতে পেল চাঁদ সওদাগর। কর্ণসুবর্ণ যাত্রার আগেই সনকার শরীরে গর্ভের লক্ষণ ফুটে উঠেছিল। দ্রুতপায়ে ঘরে এসে সনকার কোলে এক ফুটফুটে শিশু দেখে মুগ্ধ হল চাঁদ। জলের ডুবে মরেই যাচ্ছিলাম।
এখন পুত্রের মুখ দেখছি। তার ভিতরে কে যেন গেয়ে উঠল-
শিবের লীলা বুঝবি ক্ষ্যাপা কেমন করে।
আর কে না জানে-ঝড়ের পরই আলোকময় দিনের শুরু।
গভীর আবেগে চাঁদ সওদাগর ছেলের নাম রাখলেন লখিনদর।
লখিনদর মানে কী গো? সনকা শুধোয়।
মানে কে জানে? বলে স্ত্রীর কপালে চুমু খেল চাঁদ সওদাগর।
এ ছেলেটি যেন মহাদেব টিকিয়ে রাখেন ঠাকুর। সনকার কন্ঠস্বর কান্নায় বুঁজে আসে।
হুঁ। গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন চাঁদ সওদাগর।
সনকা বলল, একে একে ছয় ছেলে হল আমার। মনসার অভিশাপে ছয় ছেলেই মরল।
মনসা না ছাই! গর্জে ওঠেন চাঁদ সওদাগর। চেঙ্গমুড়ি কাণী।
স্থানীয় নিষাদদের দেবীকে “চেঙ্গমুড়ি কাণী” বলেই তাচ্ছিল্য করে আর্যগর্বী চাঁদ সওদাগর।
সনকা সব জানে। সে চুপ করে যায়। স্বামীর স্থানীয় দেবী মনসার নাম সহ্য হয় না।
৪
কালে কালে বড় হল শিশু লখিন্দর।
আঠারো বছর গেল কেটে।
বিবাহের বয়স হল লখিনদরের।
৫
একদিন সনকা স্বামীকে বলল, ছেলের বিয়ের ব্যবস্থা করেন।
কেন? কী হয়েছে?
নন্দ দাসীর গর্ব হয়েছে। সনকা চাপাস্বরে বলল।
চাঁদ সওদাগরের মুখ কালো হয়ে যায়।
বলল, করছি।
চাঁদ সওদাগরের সায়বেনের কথা মনে পড়ল। গতবছর কর্ণসুবর্ণ নগরে সায়বেনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। একটি কন্যে হয়েছে নাকি অমলার।
তালে প্রস্তাব নিয়ে আসছি।
বলেছিল চাঁদ সওদাগর।
এসো। বলেছিল সায়বেনে।
লখিনদরের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে উজানীনগরে যাত্রা করল চাঁদ সওদাগর।
৬
বেহুলা বসেছিল পা ছড়িয়ে; দওয়ায়, বেড়ায় পিঠ ঠেকিয়ে।
সময়টা সকাল। উঠানে রোদ। সে রোদে বেহুলার আলতা-পরা পা দুটি সমুজ্জ্বল। সজনে গাছে কাক ডাকছে। শেষ বসন্তের মৃদু বাতাসে অষ্টাদশী বেহুলার চুল উড়ছিল।
ওর সামনে বসে পান্তাবুড়ি মুড়ি খাচ্ছে। পান্তাবুড়ি চম্পক নগরের উপান্তের এক শালবনে থাকে। জন্মের পর থেকেই বেহুলা দেখছে বুড়িকে। বুড়ি মাঝে মাঝে আসে। তখন গুড়মুড়ি খেতে দেয় বেহুলা।
পান্তাবুড়ি একটা মাদুলি দিয়েছে গত বছর। বলেছে, মাদুলিটা সারাক্ষণ সঙ্গে রাখিস মা। কাকপক্ষীও ক্ষতি করতে পারবি নে।
কাকপক্ষী কি ক্ষতি করবে গো বুড়ি! বেহুলা তো হেসে খুন।
করে না আবার? তুই কি জানিস।
নীলবর্ণ মড়ার খবর কাকই তো লয়ে যায়।
নীলবর্ণ মড়া আবার কী। এরকম কত যে আকথা কথা বলে বুড়ি। সেবার নিষাদ রানী মনসার কথা বলল। নিষাদ রানীর নাম হৈল গে মন্ষা।
কই থাকে গো তোমার মনছা?
কই আবার। মনসার থানে।
তা কই তোমার মনসার থান?
অত কী জানি। তয় জানি মনসার থানে আছে সাপ আর সাপ।
জানো না।
বলে হেসে অস্থির বেহুলা।
কাছেই বসেছিল অমলা । অমলাও হাসে।
পান্তাবুড়ি গম্ভীর হয়ে বলেম অত হাসিস নে লো। তোর স্বামিক সাপে কাটবিনি।
কী!
বেহুলা শিউরে ওঠে।
কী অলুক্ষুণে কথা। অমলার মুখ কালো হয়ে যায়।
৭
চাঁদ সওদাগর উজানীনগর পৌঁছল বিকেলে।
অমলা নিজেই দাওয়ায় পাটি বিছিয়ে পানের বাটি নিয়ে আসে।
চাঁদ সওদাগর গলা পরিস্কার করে বলে, কই, আমা মা লক্ষ্মিটি কই। সামনে এসে একবার দাঁড়াও দেখিনি।
বেহুলা আসে। কাঁপা কাঁপা বুকে বাবার বন্ধুর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
চাঁদবেনে হবু পুত্রবধূর রুপলাবণ্য দেখে মুগ্ধ।
সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে বন্ধুকে দেখে জড়িয়ে ধরল সায়বেনে।
বেহুলার কানে সব খবর যায়।
লখিনদরের মুখটি কল্পনা করতে থাকে ও।
৮
তো, বিয়ে ধূমধাম করেই হল। তেমনই হওয়ার কথা।
কেননা, পাত্রপাত্রীর বাবা পুন্ড্রবর্ধন বনিক সঙ্ঘের দুজন ধনী প্রভাবশালী নেতা।
তিরিশটি নৌকায় বরযাত্রীরা কনেকে নিয়ে উজানীনগর থেকে চম্পক নগরে ফিরে এল।
বাসর ঘরে প্রদীপের আলোয় স্বামীর মুখ দেখল। কী সুন্দর! কোঁকড়া চুল। গায়ের রং সাদা না কালো বোঝা যায় না।
লখিনদর গাঢ়স্বরে বলে-
কী সুন্দর তুমি।
যেন স্বপ্ন পরী।
উষ্ণ। উষ্ণ ও কোমলাঙ্গী।
নির্ঘাৎ শীর্ষসুখের আধার।
বেহুলা লজ্জ্বা পায়।
লখিনদর গাঢ়স্বরে বলে-
শিউলি ফুলের বোঁটার রং
আর গাঢ় সূর্য কিরণ;
ঠাকুর শিব গড়লেন
তোমার অরুণ বরণ।
বেহুলা লজ্জ্বা পায়।
এভাবে রাত বাড়ে।
বেহুলা যখন ভাবল: এ খালি কথা বলে, এ তো আমাকে তো এখনও ছুঁলো না।
রাত বাড়ছে। আর, আমার অঙ্গ এমন কাতর হয়ে আছে। কাতর হয়ে আছে আমার ঠোঁটের কোষ। কষ শুকিয়ে যাচ্ছে।
ঠিক তখনই বেহুলাকে চুমু খেতে ঝুঁকে পড়ল লখিনদর।
বেহুলা যথারীতি চোখ বন্ধ করে।
৯
ভোর বেলা। বাড়ির পিছনে খালপাড়ে। তলপেটে চাপ বোধ করায় লখিনদর সেখানে গেল।
অনেকক্ষণ হল লখিনদর ফিরছে না।
বেহুলা অস্থির হয়ে উঠল। ঢেকিঘরে ধুপ ধুপ আওয়াজ। আজ উজানীনগর থেকে কুটুমরা আসবে। মেয়েরা পিঠে তৈরি করছে। উঠানে হাঁসেদের প্যাক প্যাক প্যাক প্যাক ।
শ্বশুড়েরর গলা খাকারি শোনা গেল। এক্ষণি মন্দিরে যাবেন। পালঙ্ক থেকে নেমে মেঝেতে দাঁড়াল বেহুলা। ওর খালি পায়ের পাতায় ভিজের মেঝের হিম জড়ায়। সারা ঘরে ধূপের গন্ধ।
দুয়ারে দাঁড়াল বেহুলা। উঠানে শেষ ভাদ্রের পাতলা কুয়াশা। একটা কাক উড়ে গেল। বেহুলার দাঁড়ানোর ভঙ্গিমায় কী ছিল। বাড়িতে হইচই পড়ে গেল।
সবাই খালপাড়ে ছুটল।
ততক্ষণে নীলবর্ণ ধারণ করেছে লখিনদরের শরীর।
চাঁদ সওদাগর স্তম্ভিত। সে ঘরে গিয়ে দোর দিল।
সনকা মাটিতে পড়ে কাঁদল।
অনেক ক্ষণ।
বেহুলা জাম গাছের নিচে বসে থাকল। ততক্ষণে রোদ উঠে গেছে।
নিজেকে সামলে নিয়ে বেহুলাকে সব খুলে বলল সনকা। চাঁদ সওদাগরের ওপর মনসা অভিশাপ।
আগে কত করে বললাম মা মনসার পুজা দাও। তোমার শ্বশুড় বলে আমি আর্য। আশি শিক্ষিত। আমি বেদ পাঠ করি। আমি অনার্য অশিক্ষিত মাগীর পূজা করব কেন।
শোন কথা। ভক্তি বলে কথা। তার শিক্ষার কি-অশিক্ষার-ই বা কী। এর আগে আমার ছয় ছেলে হয়ে মরেছে। এখন মরল আমার লখিনদর।
এখন আমার কী হবে গো? আমার সর্বনাশ হয়ে গেল।
বেহুলা বড় শক্ত ধাতের মেয়ে। বলল, আপনি কাঁদবেন না মা। যা করার আমি করছি। শুনেছি নিষাদের রানী মনসা বিষ ঝারতে পারেন।
সাপে কাটা মানুষকে সারিয়ে তুলতে পারেন ঠাকুরের করুণায়। আমি আপনার ছেলেকে নিয়ে নিষাদে দেবীর সন্ধানে যাব।
এই কথায় সনকা শান্ত্বনা পেল। তাই যাও মা। আমিও যেতাম।
শরীরে সবইবে না। এত উদ্বেগ।
না, না। আপনার যাবার দরকার নেই। বেহুলা বলল।
খালপাড়ে কটা ভেলা ছিল। বর্ষাকালে কাজে লাগে। অন্য সময়ও।
সনকা আর বেহুলা ধরাধরি করে লখিনদরকে তারি একটা ভেলায় তুলল। তারপর বেহুলার হাতে একটি হেতাঁলের লাঠি তুলে দিয়ে সনকা বলল, এটা রাখ মা।
অজানা পথে যাচ্ছ, বিপদে কাজে আসবে।
১০
গাঙ্গুরের জলে ভেসে চলেছে বেহুলার ভেলা।
করতোয়ারই এক শাখানদী গাঙ্গুর। অনতিশীর্ন। দুপাড় নির্জন।
পাড়ে পাড়ে শালবন। দিনমানেও সেখানে ইষৎ অন্ধকার। ইষৎ অন্ধকারে ভাঙ্গা দেবদেউল। কবে কার যোগীঋষিদের থান।
গাঙ্গুরের জলে ভেসে চলেছে বেহুলার ভেলা।
জলের পাড়ের গাছগুলি দেখল শোকে স্তব্দ বেহুলমূর্তি। পাশে তার নীলবর্ণ স্বামী।
এ আমায় গত রাত্রে সুখ দিয়েছিল। এখন সে ঘোর অচেতন। জীবন এমন অনিশ্চিত কেন? চেতনা তাহলে কি? অচেতনাই-বা কি?
এই অষ্টাদশী মেয়েটি আগে যা যা ভাবেনি; সেসব আজ সে ভেলায় বসে ভাবতে থাকে।
১১
যখনকার কথা বলছি। সেকালে গোদা ও আপু নামে দুই যুবক বাস করত গাঙ্গুরের পাড়ে। জাতে ডোম ছিল তারা। তারা ঠিকই দেখল বেহুলাকে গাঙ্গুরের জলে ভেসে যেতে। গোদা ডোম বলল, কী নাম গো তোমার মেয়ে?
বেহুলা।
তো ভেলায় ওটা কে?
স্বামী। সাপে কেটেছে।
যাচ্ছ কোথায়?
মনসা থানে। স্বামীকে সারাব।
সাপে কেটেছে তো সেরে ওঠবার জো কি।
বেহুলা কী বলবে।
এবার অপু ডোম বলল, আমায় বিয়ে করবি লো?
না।
ভেবে দেখ। বলে গান ধরল অপু ডোম।
কলা পাতার বাসর হবে
মাংশ বিয়ের ভোজ;
রুপোর নথ গড়িয়ে দেব
পরবি নাকে রোজ।
না। গর্জে ওঠে বেহুলা।
গোদা ও আপু ডোম বেহুলার ক্রোধ দেখে সটকে পড়ে।
১২
কী প্রখর তেজ সূর্যর। কী প্রখন তার দহন।
আমি কীভাবে বেঁচে আছি। আমি কি বেঁচে আছি।
সে যখন মৃত। সে বলেছিল-
কী সুন্দর তুমি।
যেন স্বপ্ন পরী।
উষ্ণ। উষ্ণ কোমলাঙ্গী।
শীর্ষসুখের আধার।
সে বলেছিল-
শিউলি ফুলের বোঁটার রং
আর গাঢ় সূর্য কিরণ
ঠাকুর শিব গড়লেন
তোমার অরুণ বরণ।
আরও আরও কাব্যকলা শ্রবণসুখের আশায় বেহুলা তার স্বামীকে জীবিত পেতে চায়।
অথচ, জীবন কী নির্মম। কেননা, খালপাড়ের ঝোপে লুকিয়ে ছিল এক হিঃস্র গোক্ষুর। আর এখন? গাঙ্গুরের ওপরের আকাশে একটি চিল । চিলটি ছিল ক্ষুধার্ত। সে ভোলা লক্ষ্য করে ছোঁ মারে।
বেহুলার হাতে হেতাঁলের লাঠি। চিলটি ছোঁ মারতে মারতে শেষ মুহুর্তে গতিপথ পরিবর্তন করে।
গাঙ্গুরের পাড়ে সেকালে ছিল বাঘের আনাগোনা। বাতাসের তোড়ে ভেলাটি কখনও তীরের দিকে যাচ্ছিল। তো, বাঘে জল খেতে আসে জলের কিনারায়।
বেহুলার শরীর সেই হলদে ছোপ দেখে হিম হয়ে ওঠে। ওর তখন পান্তাবুড়ির কথা মনে পড়ে। নিষাদ রানীর নাম হৈল গে মন্ষা।
কই থাকে গো তোমার মনছা?
কই আবার। মনসার থানে।
তা কই তোমার মনসার থান?
অত কী জানি। তয় জানি মনসার থানে আছে সাপ আর সাপ।
১৩
তার পর কোন্ এক ঘাটে ভিড়েছিল বেহুলার কলার মান্দাস।
বহু পরে জেনেছিল বেহুলা ওটাই মনসার থান।
নিষাদরানী মনসা।
আসলে সে ছিল এক সাপুড়ে কন্যা। নিষাদবনে এত সাপ। সাপের বশমন্ত্র না জেনে কী উপায়।
বেহুলার ভেলাটি মনসার থানের ঘাটে ভিড়তেই সে ঘটনাটি কী ভাবে যেন রাষ্ট্র হয়ে যায়। পাতার কুটির থেকে বেরিয়ে পিলপিল করে নানা বয়েসী নিষাদেরা ঘাটে ভিড় করে ।
নিষাদরানী মনসাও এলেন। পরনে পাতার বসন। নরম শরীরে লাবণ্য ঝরে ঝরে পড়ে। মাঝবয়েসী নারী। কালো গায়ের রং ।
কালো এলো চুল। পান পাতার মতন মুখের ছাঁচ। বড় বড় উজ্জ্বল চোখ। বেহুলা অবাক হয়ে নিষাদের রানীটিরে দেখে।
নিষাদ রানীর পাশে এক বৃদ্ধ।
থুরথুরে বুড়ো। হাতে কাঠের ষষ্টি। ষষ্টিমুখটিতের কেউটের ফনা। পরে জেনেছিল বেহুলা-সেই প্রধান সাপুড়ে, নিষাদরানীর পিতা।
বেহুলা পাড়ে উঠে আসে।
সব খুলে বলে। একজন নিষাদ বলল, আমরা মাতৃতান্ত্রিক। আমরা মায়ের পূজা করি। মনসা আমাদের রানী। একে আগে প্রণাম কর।
বেহুলা মনসাকে প্রণাম করে।
রানী মনসা স্মিত হাসে।
কয়েকজন নিষাদ ধরাধরি করে লখিনদরের অর্ধমৃত দেহটি তুলে এনে রাখল ঘাসের ওপর।
প্রধান সাপুড়ে ঝুঁকে পড়ল নীলবর্ণের শরীরটির ওপর।
দূর থেকে ভেসে এল বীণের সঙ্গীত।
তারপর কী মন্ত্রবলে বুড়ো সারিয়ে তোলে লখিনদরকে বহুদিনের সঞ্চিত আরণ্যক অভিজ্ঞতায় ও জ্ঞানে।
শেষমেশ বেঁচে ওঠে নাগরিক লখিনদর। অরণ্যের কাছে সে পরে কৃতজ্ঞ বোধ করেছিল।
বেহুলাও কৃতজ্ঞ বোধ করে। অশ্র“সজল কন্ঠে বলল, আমার শ্বশুড় আপনাকে মানে না দেবী।
দেখবেন এবার ঠিকই মানবে।
মনসা স্মিত হাসে।
১৪
পরে সবই জেনেছিল চাঁদ সওদাগর। জেনে কেঁদেছিল। কেননা, লখিনদর ছিল তার নয়নের মণি।
না। চাঁদবেনে আর অনার্য মনসার ওপর রাগ করে থাকতে পারেনি। মনসাকে সে প্রণাম করেছিল ঠিকই। প্রণাম করেছিল সে বৃদ্ধ সাপুড়েকেও।
এভাবেই প্রাচীন অরণ্যের কাছে বারবার বিস্মিত ও পরাজিত হয়ে আসছে খন্ডিত নাগরিক বোধ।
সূত্র:
১/ দীনেশচন্দ্র সেন। বঙ্গভাষা ও সাহিত্য। (১ম খন্ড)
২/ বাংলাপিডিয়া।
(এই লেখাটি অনেক আগে একবার পোস্ট করেছিলাম। কিছু ভুল ছিল।
সেসব শুধরে আবার রি-পোষ্ট করলাম। )
উৎসর্গ: পল্লী বাউল ...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।