জীবন বুনে স্বপ্ন বানাই মানবজমিনে অনেক চাষ চাই
আমাদের দেশটি নিঃসন্দেহে গানের দেশ। আমরা গানপাগল জাতি। গান ভালোবাসি বলেই আমাদের সিনেমায় গান থাকে। পশ্চিমের সিনেমায় গান একটি বিরল ঘটনা। অথচ ৫টি গান না থাকলে আমাদের সিনেমা পরিপূর্ণতা পায় না।
মনপুরা : গানই যার প্রাণ
মনপুরা ছবির গান ভালো লাগে নি এমন মানুষ আমি খুঁজে পাই নি। মনপুরা ছবিটি রিলিজ হওয়ার বহু আগেই ছবির গানগুলো মানুষের মন জয় করে নেয়। মনপুরার পরিচালক গিয়াস উদ্দিন সেলিম গানগুলো এজন্য আগে রিলিজ করেছিলেন। বলা যায়, তিনি গানগুলো রিলিজ করে তার ছবিটার মার্কেটিং শুরু করেছিলেন।
মনপুরা ছবির অডিও রিলিজ হওয়ার বছরখানেক পরে ছবিটি মুক্তি পায়।
এই সময়ে গানগুলো জনপ্রিয়তার শীর্ষে চলে যায়। নিধুয়া পাথারে বা যাও পাখি - গান দুটো মানুষের মুখে মুখে ফিরতে থাকে।
আমার ধারণা, গিয়াস উদ্দিন সেলিম সচেতনভাবেই এই কাজটি করেছেন। তিনি এমন কিছু গান তার সিনেমার জন্য নির্বাচন করেছেন, যেগুলোর সুর আমাদের মাটির সুর। মাটির সোঁদা গন্ধ লেগে আছে সেই গানের সুরে।
আসলে আমরা যতই শহুরে মানুষ হই না কেন আমাদের মনের মধ্যে এখনও গ্রামের মাটির সুর ঝংকার তোলে।
আমাদের সিনেমার গানের অবস্থা :
আমাদের দেশটা গানের দেশ। অথচ আমাদের সিনেমার গানের দৈন্য দশা। আমাদের বাউল, জারি, সারি গানের সম্ভার বিশাল, আছে লালন, রবীন্দ্র ও নজরুলের গান। আর অধুনা গানের ক্ষেত্রে বিরাট অবদান রেখে চলেছে ব্যান্ড মিউজিক।
অথচ আমাদের বেশির ভাগ সিনেমায় এসব গানের কোন প্রভাব দেখতে পাই না। হিন্দি গানের নকল সুর বাজে আমাদের সিনেমার গানে। কখনও কখনও হিন্দি সিনেমার গানের কথাগুলোও অনুবাদ করে দেয়া হয়। থাকে সুড়সুড়ি মার্কা কথা। থাকে অশ্লীল নাচ।
ওই গান না শোনার যোগ্য, না ভদ্রসমাজে বসে দেখার যোগ্য। আর গোঁদের উপর বিষফোঁড়ার মতো কোন কোন সিনেমা হলে গানের মাঝখানে চালানো হয় কাটপিস।
অথচ আমাদের গীতিকারের অভাব নাই, সুরকারের অভাব নাই। ইমপ্রেস টেলিফিল্ম যে সব ছবি বানাচ্ছে সেই সব ছবি অশ্লীল সিনেমার বিপরীতে ভালো ছবির জোয়ারের মতো । এসব ছবিতে ভালো ভালো গান হচ্ছে।
ভালো সুর হচ্ছে। হচ্ছে ভালো চিত্রায়ণ। তার মানে হল, আমাদের দেশের পরিচালকদের পক্ষে ভালো ছবি বানানো সম্ভব। সম্ভব ভালো সিনেমার গানও নির্মাণ।
গান যখন চুরির বিষয় :
কয়েক দিন আগে আমার পরিচিত এক লোক আমাকে ফোন করে জানাল এক করুণ কাহিনী।
এক ছেলে গান লেখে। সেই ছেলেটির এক পরিচিত লোক একটা গানের কোম্পানীতে চাকুরি করে। ছেলেটি সেই লোকটিকে তার গানগুলো দেখিয়েছিল। লোকটি ছেলেটির গানগুলো পছন্দ করে। ৩টি গান নিয়ে যায় ছেলেটির কাছ থেকে।
সেই গানগুলো খ্যাতিমান একজন সুরকারের মাধ্যমে সুর করিয়ে খ্যাতিমান এক শিল্পীর এলবাম বের করা হয়। কিন্তু সেই এলবামে গীতিকার হিসেবে গান লেখকের নাম যায় নি। অন্য কোন এক বিখ্যাত গীতিকারের নাম গেছে।
পরবর্তীতে সেই লোকটি একদিন ছেলেটির বাড়িতে এসে ছেলেটির ডায়েরি থেকে ৭০টি গান চুরি করে নিয়ে যায়। ডায়েরি পাতা ছিঁড়ে নিয়ে গেছে ওই লোক।
বর্তমানে ছেলেটির ওই গানগুলো এলবাম আকারে বেরুচ্ছে, কিন্তু গীতিকার হিসেবে চোরের নাম যাচ্ছে। গীতিকার ছেলেটি সেই লোকটির কাছে এই ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে গেলে লোকটি তাকে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছে এবং এই ঘটনা কাউকে না জানাতে বলেছে।
প্রকৃত গীতিকার এখন প্রাণভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। কেননা, ওই লোকের গুণ্ডাপাণ্ডারা তাকে হুমকি দিচ্ছে।
আমাদের দেশে নতুন গীতিকারদের এই রকম নানা ঝুট ঝামেলায় পড়তে হয়।
ফলে এক সময় সে হতাশ হয়ে গান লেখা ছেড়ে দেয়।
অন্য দিকে গীতিকারকে গান লেখার পারিশ্রমিক বাবদ এত সামান্য টাকা দেয়া হয় যে, সেটা দিয়ে জীবনধারণ সম্ভব না। কখনও কখনও টাকা পয়সা দেয়াও হয় না।
মনপুরার মার্কেটিং ও মুম্বাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির মার্কেটিং :
গিয়াসউদ্দিন সেলিমের সিনেমার মার্কেটিং পলিসির আরেকটি নতুন দিক হল, সিনেমার বিজ্ঞাপনে বিল বোর্ডের ব্যবহার। ঢাকার বড় বড় বিল্ডিং এর উপর মনপুরা ছবির বিজ্ঞাপন শোভা পেতে দেখা যায়।
এই ঘটনা বাংলা সিনেমার ইতিহাসে প্রথম। এই বিল বোর্ডগুলো কিন্তু জুঁই নারিকেল তেলের সৌজন্যে করা হয়েছিল। সুতরাং প্রযোজকের টাকা খরচ করা দরকার হয় নাই। স্পন্সরের মাধ্যমে বিজ্ঞাপন খরচ উঠিয়ে নেয়া হয়েছিল।
অন্য দিকে ছবি মুক্তি পাওয়ার আগে গান রিলিজ করার মার্কেটিং পলিসিটি মুম্বাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির পরিচালকরা সফলভাবে ব্যবহার করে।
তারা একটা সিনেমা তৈরির জন্য প্রথমেই গানের দিকে মনোযোগ দেয়। গানের কথা ও সুর এমনভাবে তৈরি করে যে, দর্শক শ্রোতারা সেই গানের সুরে পাগল হয়ে যায়। প্রথমে সিনেমার গানের অডিও রিলিজ হয়। তারও অনেক পরে কেবল গানের ভিডিও রিলিজ হয়। তারপর শুরু হয় সিনেমার শুটিং।
চলতে থাকে পত্র পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে প্রচারণা। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে প্রথমে গানের অডিও এলবামের বিজ্ঞাপন ও পরে ভিডিও এলবামের বিজ্ঞাপন প্রচার হতে থাকে। গান নির্মাণের পেছনে যে খরচ হয়, গানের অডিও ও ভিডিও বিক্রি করে সেই খরচ উঠে আসে। আর এ জন্য গানের কথা, সুর ও ভিডিও সকল কাজে খুবই পরিশ্রম করে কলাকুশলীরা। গানের এই ধরনের মার্কেটিংএর ফলে সিনেমার জন্য আর আলাদা মার্কেটিং করার দরকার হয় না।
যারা ভালোবেসে সেই সিনেমার গানের অডিও ও ভিডিও কেনে, তারা অবশ্যই সেই সিনেমা দেখে।
মনপুরার ক্ষেত্রে গিয়াসউদ্দিন সেলিম এই মার্কেটিং পলিসি খুব সফলভাবে ব্যবহার করেছেন। আমার কাছে মনে হয় আমাদের বাংলা সিনেমার পরিচালকেরা গিয়াস উদ্দিন সেলিমের এই মার্কেটিং পলিসি অনুসরণ করতে পারেন।
এক ঝলক মার্কেটিং পলিসি :
০১) দামী গীতিকারকে দিয়ে গান লেখাতে হবে। গীতিকারকে মোটা টাকা দিতে হবে।
নকল গান ব্যবহার করার বদ অভ্যাস বাদ দিতে হবে।
০২) দামী সুরকারকে গিয়ে গানগুলোর সুর করাতে হবে। সুরে প্রাধান্য দিতে হবে আমাদের মাটির সোঁদা গন্ধ লাগ সেই সব জনপ্রিয় সুর। সুরকারকে মোটা টাকা দিতে হবে। নকল সুর ব্যবহার করার লোভ সংবরণ করতে হবে।
০৩) গানগুলো ভালো শিল্পী দিয়ে গাওয়াতে হবে।
০৪) গানের অডিও ক্যাসেট ও সিডি রিলিজ করতে হবে এবং অডিও সিডির বিজ্ঞাপন দিতে হবে।
০৫) অডিও সিডি রিলিজের পর গানের শুটিং করে ভিডিও সিডি তৈরি করতে হবে।
০৬) ভিডিও সিডি রিলিজ হবে এবং সেই সিডির বিজ্ঞাপন প্রচার করতে হবে।
০৭) বিজ্ঞাপন প্রচারের ক্ষেত্রে কোন বড় কোম্পানীকে স্পন্সর হিসেবে নিতে হবে।
০৮) এবার পত্র পত্রিকা ম্যাগাজিন ও ওয়েব সাইট ইত্যাদি করে সিনেমার শুটিং সম্পর্কে প্রচারণা চালাতে হবে। প্রচারণার ক্ষেত্রে ইন্টারনেটে ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ ওয়েব সাইট ব্যবহার করতে হবে।
০৯) ছবি রিলিজের আগে বড় বড় বিলবোর্ডে বিজ্ঞাপন দিতে হবে এবং এসব বিজ্ঞাপনও স্পন্সরের মাধ্যমে করাতে হবে।
শেষ কথা :
সকাল থেকে বিভিন্ন চ্যানেলে বাংলা সিনেমা দেখছিলাম। সব সিনেমার গল্প প্রায় একই রকম।
বোঝাই যায়, বাংলা সিনেমা চরমভাবে কাহিনীর খরায় ভুগছে। ভালো কাহিনী খুঁজে পাচ্ছে না আমাদের পরিচালকরা। ফলে সিনেমা দর্শক কমে গেছে। একের পর এক সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
অথচ আমাদের দেশে কত ভালো ভালো গল্প উপন্যাস আছে যেগুলো থেকে সিনেমা নির্মাণ করলে আমাদের সিনেমা অনেক অনেক সমৃদ্ধ হতে পারত।
সকল বাণিজ্যিক উপাদান থাকার পরও যখন সিনেমা ফ্লপ হয়, তখন অবশ্যই ভাবার ব্যাপার আছে। মানুষ মূলত সিনেমা দেখে তার ভালো গল্পের জন্য। গল্প ভালো না হলে কেবল অশ্লীল নাচ-গান দেখিয়ে দর্শককে ধরে রাখা যায় না। নাচ গান ছাড়া ছবি বানিয়ে হলিউড কিন্তু কোটি কোটি ডলার কামাচ্ছে।
আর ভালো সিনেমার যে দর্শক হয়, মনপুরাই তো তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ।
কিন্তু তার জন্য দরকার ঠাণ্ডা মাথার মার্কেটিং পলিসি।
সিনেমা বিষয়ক আরেকটি পোস্ট :
আমরা কেন বাংলা সিনেমা দেখব ?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।