‘বাঁশি শুনে আর কাজ নাই, সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি’- মীরা দেব বর্মনের লেখা এই গানটি এক সময় জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করেছিল। আজো সেই গানের আবেদন একটুও কমেনি। কিংবা ‘তুমি যে গিয়েছ বকুল ঝরানো পথে, নিয়ে গেছ হায় একটি কুসুম আমারো কবরী হতে’- এরকম অসংখ্য গানের সুরকার ও শিল্পী শচীন দেব বর্মন আজ সঙ্গীত ইতিহাসেরই একটি বিরাট অধ্যায়। সে অধ্যায়ের সুচনা পর্বের সঙ্গে যে স্থানের নাম অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত সে হল প্রাচীন ত্রিপুরা বা আজকের কুমিল্লা।
কুমিল্লা গর্ব শচীন দেব বর্মনের স্মৃতি বিজড়িত বাসভবনটি শহরের চর্থা এলাকায় অবস্থিত।
সে স্থানে শচীন দেবের সঙ্গীত চর্চার চিহ্ন আর নেই। আছে একটি মুরগীর খামার। নতুন প্রজন্ম জায়গাটিকে চিনে সরকারি মুরগীর খামার হিসেবে। শচীন দেবের কথা কেউ তাদের মনে করিয়ে দেয়া না।
১৯০৬ সালে ১ অক্টোবর কুমিল্লা শহরের চর্থা এলাকায় রাজবাড়ীতে জন্মগ্রহণ করেন শচীন দেব।
জীবদ্দশায় প্রায় শতাধিক বাংলা ও হিন্দি ছবির গানে সুর রচনা করেছেন তিনি। ১৯৩৫ সালে ‘সাঁঝের প্রদীপ’ ছবির মাধ্যমে সুরকার হিসেবে তার প্রকৃত অভিষেক হয়। ১৯৪৪ সালে তিনি স্ব-পরিবারে মুম্বাই যাত্রা করেন। সূত্রপাত ঘটে তাঁর বলিউডে সঙ্গীত পরিচালনার। ১৯৪৬ সালে হিন্দী ভাষায় নির্মিত ‘শিকারী’ ছবিতে প্রথম সুর করেন।
বর্তমানে পরিত্যক্ত, ভগ্ন প্রায় শচীন দেব বর্মনের বাড়িটি কালের নিরব স্বাী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও প্রশাসনের কোন খেয়াল নেই এটি সংরণের কিংবা সংস্কারের। নয়তো চরম অবহেলায় কালের স্বাী এ বাড়িটিকে বর্তমানে এভাবে ফেলে রাখা হতো না। বর্তমানে ভগ্ন প্রায় এ বাড়িটির বহির্দেয়ালে একটি শ্বেতপাথরের খোদাই করা স্মৃতি ফলক লাগানো আছে, যা থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম শচীন দেবের এ বাড়িটিতে একবার অতিথি হয়ে এসেছিলেন।
কুমিল্লার নজরুল পরিষদ শচীন দেবের ভগ্নপ্রায় এ বাড়িতে এ ফলকটি স্থাপন করেছিল। কুমিল্লার ঐতিহাসিক অভয় আশ্রমের তত্ত্বাবধায়ক সংগীত প্রাণ প্রায়াত শ্রী পরিমল দত্তের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, শহরের চর্থা এলাকার গোল পুকুরের দণি পাড়ের এই বাড়িটি ছিল তৎকালীণ ভারত বর্ষের ত্রিপুরা রাজ্যের মহারাজা বীরচন্দ্র মানিক্য বাহাদুরের সৎভাই মহারাজ নবদ্বীপ কুমার দেব বর্মন বাহাদুরের।
ত্রিপুরার এই মহারাজার স্ত্রী ছিলেন বেশ কয়েকজন। তার মধ্যে পাটরাণী পুত্র মহারাজা নবদ্বীপ কুমার দেব বর্মন বাহাদুরকে আরেক রাণীর পুত্র বীরচন্দ্র মানিক্য বাহাদুর হত্যা করতে উঠে পড়ে লাগলে উপায়ান্তর না দেখে মহারাজ নবদ্বীপ রাজ বাড়ির কর্মকর্তা শ্রী কৈলাস সিংহের পরামর্শে সপরিবারে কুমিল্লায় চলে আসেন।
জানা যায়, বিখ্যাত ‘রাজমালা’ গ্রন্থটি কৈলাশ সিংহ রচনা করেছিলেন। কৈলাস সিংহের পরামর্শে মহারাজ নবদ্বীপ সিংহাসনের দাবীও এ সময় ছেড়ে দিয়েছিলেন। কুমিল্লা শহরের পূর্ব চর্থায় অবস্থিত এ বাড়িটি তৎসময়ে নির্মিত হয়েছিল।
বাড়িটি দেখতে কুমিল্লা শহরের ব্রিটিশ আমলে তৈরী বাড়িগুলোর মতোই মনে হয়। কোন রাজ প্রসাদের মত দেখতে এ বাড়িটি নয়। এই কুমার দেব বর্মন বাহাদুরের পুত্রই হলেন শচীন দেব বর্মন। তিনি ভারত বিভক্তির বহু পূর্বেই উপমহাদেশের সংগীত জগতে গায়ক ও সুরের সৃষ্টিকর্তা হিসেবে প্রচুর খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। এ সময় সংগীত সাধনে উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করলেও সময় সুযোগ পেলে তিনি তার স্মৃতি বিজড়িত বাসভবনে এসেছেন।
মিলিত হয়েছেন তার কৈশোরের বন্ধুদের সাথে। সুরেন দাস, কুলেন্দু দাস, সুখেন্দু চক্রবর্তী, মর্তুজ মিয়া প্রমুখের সাথে ছিল তাঁর ঘনিষ্ঠতা।
শহরের চর্থা এলাকার শচীন দেব বর্মনের বাড়ির উল্টো দিকে অবস্থিত মুন্সি বাড়ির ইতিহাস থেকে জানা যায়, বাড়ির জমিদার সালাহউদ্দিন আহম্মেদ প্রকাশ মর্তুজ মিয়ার বন্ধু ছিলেন শচীন দেব বর্মন। মর্তুজ মিয়ার পরিবারিক ইতিহাস থেকে শচীন দেবের গায়ক হওয়ার পিছনের চমকপ্রদ তথ্য জানা যায়।
জানা যায়, কৈশোরে একদিন শচীন দেব বর্মন ও মর্তুজ মিয়া যখন মুন্সি বাড়ির সামনের রাস্তায় রাতের বেলায় পায়চারী করছিলেন তখন শচীন দেব গুণগুন করে গান গাইছিলেন।
এ সময় বাড়ির সামনে বসা জমিদার নাবালক মিয়া বাড়ির চাকর সফর আলীকে রাস্তায় গান গাওয়া ছেলেটাকে ডেকে আনতে বললেন। সফর গিয়ে শচীন দেবকে বললেন, শচীন কর্তা আপনাকে হুজুর ডেকেছে। তখন শচীন দেব ভয় পেয়ে যায়। পরে অভয় দিয়ে তাকে ডেকে এনে নাবালক মিয়া জিজ্ঞাসা করেন, তোর তো গলা ভালো, কোন বাদ্য যন্ত্র আছে কিনা? তখন শচীন না সূচক উত্তর দিলে জমিদার নাবালক মিয়া পিয়ানো, হারমোনিয়াম, তবলাসহ সংগীতের বিভিন্ন সরঞ্জামাদি কিনে তার নিজ গৃহের একটি কে সংগীত সাধনের ব্যবস্থা করে দেন। কানাকেষ্ট নামের এক তবলচি রেখে দেন।
সে থেকে সংগীতে শচীনের উত্থান ঘটে।
শচীন দেবের ছেলে ভারতের আধুনিক ও পাশ্চাত্য সংগীতের অগ্রদূত রাহুল দেব বর্মন। পিতার জন্ম স্থান কুমিল্লার চর্থার এ বাড়িতে তিনি কখনো আসেনি। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর কালের স্বাী এই ঐতিহাসিক শচীন দেবের বাস ভবনটি প্রথমে সামরিক গুদাম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তারপর ১৯৫৮ সালে পশু চিকিৎসার প্রশিণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল।
বর্তমানে ভবনটির সামনে পিছনে খামারের নুতন ভবন তৈরী হওয়ায় বাড়িটি আড়ালে পড়ে গেছে। এ ভবনটির চারিদিকে প্রায় ৪ একর জমির উপর বর্তমানে খামারটির অবস্থান। ভবনটি কখনো খামারের হাঁস মুরগী পালনের কাজে ব্যবহৃত না হলেও খামার প্রতিষ্ঠার প্রথম দিকে ভবনটি প্রথমে অফিস ও পরে খামারের পরিচালককের বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
খামারের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, এই ভবনটির দখলস্বত্ব নেওয়ার পর খামার কতৃপ উল্লেখযোগ্য কোন সংস্কার না করলেও ৮৫/৮৬ সালে ভবনটিতে সামান্য রং-চুন করা হয়েছিল। তবে দীর্ঘ সময়েও এর কোন সংস্কার হয়নি।
বর্তমানেও এটার সংস্কারের কোন উদ্যোগ খামার কর্তৃপরে নেই।
চারদিক থেকেই ঘেরাও হয়ে থাকার কারণে বাহির থেকে ভবনটিকে দেখা যায় না। খামার কর্তৃপ আরও জানায়, স্থানীয় ভাবে কোন প্রভাবশালী মহল ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত শচীন দেবের চারিদিকে খামারের স্থাপনা বেষ্টিত ভবনটি দখল করার চেষ্টা করছে এমন কোন নমুনা নেই। তাছাড়া খামার কর্তৃপরে উপরেও কখনো কোন প্রভাবশালী চক্র ভবনটি দখলে নেয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করেনি। স্থানীয় সুশীল সমাজের অনেকেই মনে করেন, সংরণ করা গেলে এই বাড়িটি দুই বাংলা ইতিহাস, সংস্কৃতি, শিল্প ও সংগীত প্রিয় বাঙ্গালীদের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
তা নাহলে এক সময় হয়তো ভগ্ন প্রায় স্মৃতি বিজড়িত শচীন দেব বর্মনের বাস ভবনটি ধ্বংস হয়ে যাবে।
১৯৭৫ সালে ‘বাড় হি স্যনি স্যনি’ গানটিই ছিল সুর স্রষ্টা শচীন দেব বর্মনের সর্বশেষ সুর করা গান। এই গানটিতে কন্ঠ দিয়েছিলেন কিশোর কুমার। গানটি রেকর্ডিং হওয়ার পরপরই তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং একই সালের ৩১ অক্টোবর জন্মদিনের মাসেই মুম্বাইতে এই মহান সুর স্রষ্টার মহাপ্রয়ান ঘটে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।