মুক্তিযোদ্ধা, রাজাকার এই সময়ের সবচেয়ে আলোচিত শব্দ মনে হয়। আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করলাম। ইচ্ছে করেই অনেকগুলো নাম লিখলাম না।
সময়টা ২০০৫ সাল। কুরবানীর ঈদের ছুটিতে গ্রামের বাড়ির পথে রওনা হলাম।
মাঝ রাস্তাতেই স্কুল জীবনের বন্ধু স্বপন এর কল পেলাম। বেশি কিছু বলল না। শুধু এটুকই বলল, "আমারা বন্ধুরা মিলে কিছু একটা করতে যাচ্ছি। তোকে প্রয়োজন। আমাদের সাথে থাকিস।
" আমি সম্মতি দিলাম। ও বলল "বিকালে মাঠে আয়, সব বলব। " বিকালে শুনলাম তাদের পুরো পরিকল্পনা। গ্রামের ছেলে গুলোর পড়াশোনায় কোন মন নেই। অনেক ছেলে মেয়ে স্কুলে যায় না।
যারা যায় তারা প্রাইমারীর গন্ডি পার হয়েও নিজের নাম লিখতে পারে না, বলা চলে। শিক্ষকদের দোষ দেবার কোন উপায় নেই। কারন একই স্কুলে পড়েছি আমরা সবাই। ছাত্রছাত্রীরাই কেন জানি স্কুলে যেতে চায় না। সিদ্ধান্ত নিলাম, যে করেই হোক ওদের স্কুলে ফেরাতে হবে।
এভাবেই জন্ম হল, "অরগানাইজেশন অফ স্টুডেন্টস ওয়েলফেয়ার" নামের সংগঠনের। প্রথম বছর ঝামেলা ছাড়াই কার্যক্রম চালিয়ে গেলাম। সমস্যা দেখা দিল ২য় বছরে। আমরা প্রতি বছর কুরবানীর ঈদের ২য় দিন অনুষ্ঠান করে গ্রামের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেক শ্রেনীর ১ম স্খান অধিকারীকে পুরস্কার দিতাম। অনুষ্ঠানে থানা নির্বাহী কর্মকর্তা, তৎকালীন সংস্থাপন মন্ত্রনালয়ের উপ সচিব এবং সংসদ সদেস্যদেরও হাজির করতে পেরেছিলাম।
এটাই মনে হয় যত নষ্টের গোড়া। দৈনিক ইত্তেফাকের খবর ছাপা হওয়ার পরই গ্রামের সম্মানিত কয়েকজন ব্যাক্তি আমদের সাথে দেখা করলেন। অনেক বাহবা দিলেন আমাদের। সাথে থাকার আশ্বাস দিলেন। আর বললেন, "আমরা শুধু ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে কাজ করছি।
(ছাত্রছাত্রীদের জন্য আমরা আরো অনেক কাজ করেছি যেগুলো উল্লেখ করলেও চলে)। গ্রামের কথাও ভাবা উচিৎ। আমাদের উচিৎ অনুষ্ঠানে গ্রামের কৃতি সন্তানদেরও পরিচয় তুলে ধরা। প্রস্তাবটা আমাদের ভাল লাগল। প্রথমিক সিদ্ধান্ত নিলাম, শুরুতেই ছাত্রছাত্রীদের সাথে আমরা আমাদের গ্রামের সকল মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধণা দিব।
এখানেই আসল কাহিনী শুরু।
যেদিন থেকে মুক্তিযুদ্ধ বুঝতে শিখেছি সেদিন থেকে জানি আমাদের গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ৩ জন। তারা সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। আমার বাবার কাছে আরো একজনের নাম পেলাম। তিনি খবির নামেই পরিচিত।
যাকে মুক্তি যোদ্ধা বলা উচিৎ অথবা উচিৎ না। মুক্তিযোদ্ধার লিষ্টে তার নাম নেই। তিনি পাকিস্তান আর্মির সৈনিক ছিলেন। যুদ্ধ শুরু হবার পর পাকিস্তান থেকে পালিয়ে দেশে ফিরতে গেলে ধরা পরে যান, এবং বেইমান হিসেবে পাকিস্তানী আর্মি তাকে হত্যা করে। আমরা তার সম্পর্কে জানার জন্য গ্রামের মুরব্বীদের কাছে ধর্না দিলাম।
সবাই তার সম্পর্কে জানে, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা স্বীকার করে না। কারন সে পালাতে গিয়ে মারা পরেছে। কোন শত্রু মারতে পারে নাই। আমার বাবা গ্রামের মাঝখান দিয়ে যাওয়া একমাত্র রাস্তা তার নামে নামকরন করতে চাইলে যদিও কেউ বাধা দেয় নি। তবে আজও সেই রাস্তায় কোন নামফলক বসানো হয় নি।
তখন তথ্যের জন্য হাজির হলাম থানা মুক্তিযোদ্ধা কল্যান পরিষদের অফিসে। সব শুনে তৎকালীনে কর্মকর্তা একটা লিষ্ট বের করে দিলেন। দেখে আমরা "থ"। আমাদের গ্রামের মুক্তিযোদ্ধর সংখ্যা ৩৯ জন। সেখানে খবির চাচার নাম নেই।
আমরা লিষ্টের ফটোকপি নিয়ে হাজির হলাম গ্রামে। এখানে একটা তথ্য দেয়া প্রয়োজন। আমাদের গ্রাম বা পাশের গ্রামে কোন মিলিটারি বাহিনী আসে নাই। যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ ছিল তাই। গ্রামের মুরব্বীদের কাছে তাদের সম্পর্কে জানতে চাইলাম।
সবার এক কথা, প্রথমে উল্লেখকৃত ৩ জন ছাড়া আর সবাই পুরো যুদ্ধের সময় গ্রামেই ছিল। তবে আরো ৩ জনের বেলায় ভিন্নমত পেলাম। তারা নাকি ১০-১৪ই ডিসেম্বর (কেউ সঠিক তারিখ বলতে পারে নাই) যুদ্ধে যাবার জন্য বাড়ি ছেড়েছিল। তাদের ট্রেনিং শুরু হবার আগেই যুদ্ধ শেষ। যেহেতু যুদ্ধের উদ্দেশ্যে বাড়ি ছেড়েছিল, আমরা তাদের যোদ্ধার স্বীকৃতি দেয়া দোষের কিছু নয়।
কি আর করা? আমরা বাকি ৩৩ জনের বাড়িতে গিয়ে কথায় কথায় মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট দেখতে চাইলাম। সবার সার্টিফিকেট সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী নাসিম কর্তৃক প্রদত্ত। আমাদের চরম মেজাজ খারাপ হল। নাসিম সাহেব কি করে মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট দিলেন? তারা সবাই নাকি নাসিম সাহেবের অধীনে যুদ্ধ করেছেন। (এখানে বলার কোন প্রয়োজন আছে কি, তার সবাই আওয়ামী পাতি নেতা)।
যা সিদ্ধান্ত নেবার নিয়ে নিলাম। অনুষ্ঠানে শুধুমাত্র ৩জনকে (যারা আগে থেকেই স্বীকৃত) সংবর্ধণা দিলাম। কারন হিসাবে বললাম, বাজেট স্বল্পতা। পর্যায়ক্রমে বাকীদেরও স্বরণ করা হবে। ব্যাস, লেগে গেল ক্যাচাল।
ওদের কেন আগে দেয়া হল? বাজেট নাই, ভাল কথা। প্রথমে আমরা নই কেন? কত শত প্রশ্ন। পুরা ঝড় বয়ে গেল আমাদের উপর। আলোচনা সমালোচনায় যখন গ্রাম অস্থির, তখন আমর এক বন্ধুর বাবা যিনি পাকিস্তান আর্মিতে ছিলেন, আমাদের ডাকলেন। তার কাছে শুনলাম নতুন তথ্য।
মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি বার্তা বাহকের কাজ করতেন। তার কাজ ছিল একই এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পগুলোর মধ্যে সমন্বয় রাখা। এক ক্যাম্পের প্রগ্রেস অন্য ক্যাম্পে জানানো। এরকম আরো অনেক কিছু। কিন্তু তিনি মুক্তিযোদ্ধা নন।
কারন, তার সার্টিফিকেট নেই। তিনি জানালেন, একদিন আমাদের গ্রামের যোদ্ধারা যে ক্যাম্পে ছিল সেই ক্যাম্পে তিনি যান এবং দেখতে পান তারা প্রচুর পরিমান স্বর্ণালঙ্কার সহ ক্যাম্পে ফিরলেন। তার সন্দেহ হওয়ায় জানতে চান ঘটনা কি? যোদ্ধারা কেউ জবাব দেয় না। তিনি রাতে ক্যাম্পে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। এমন সময় তার চাচাত ভাই (মুক্তিযোদ্ধা) তাকে জানান, এটা কোন গেরিলা বাহিনীর ক্যাম্প নয়।
তারা আসলে ডাকাতি করে। প্রাণ বাচাতে আমার বন্ধুর বাবাকে তিনি পালিয়ে যেতে বলেন এবং সব রকম সহায়তা করেন।
চোখের সামনে ইতিহাস বদলাতে দেখলাম। কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যা বুঝব কিভাবে? তবে আমাদের সংবর্ধণা দেয়া একজন মুক্তিযোদ্ধার মাথায় সমস্যা দেখা দিয়েছে। মাঝে মাঝেই সে ভয়ে চিৎকার করে ওঠে।
রাতে ঘুমায় না। ঘুমের মাঝে কাদে। নিজের পাপের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায়। সে নাকি অনেক পাপ করেছে। অনেক নিরীহ লোক মেরেছে।
এই নিরীহ লোক কারা? পাক সেনা নিশ্চই নয়। তাহলে নিশ্চই নিরীহ বলত না। বলত অনেক জালিম মেরেছি। পাপ নয় পূণ্য করেছি। তবে তারা কি আসলে আমার দেশের হিন্দু পরিবারের সদস্যরা ছিল? আমি এই প্রশ্নের জবাব আজও পাই নি।
সর্বজন স্বীকৃত একজন মুক্তিযোদ্ধার কাছে একদিন জানতে চেয়েছিলাম। তিনি বললেন, "পাগলের কি মনে হয়, আর কি কয় কে জানে?"
নোট: আমারা আমাদের সংগঠন টিকিয়ে রাখতে পারি নাই। আমাদের সকল কার্যক্রম স্থগিত করতে বাধ্য করা হয়েছে। গ্রামে নতুন আরো একটা সংগঠন গড়ে উঠেছে। নাম, "বেতুয়ান ওয়েলফেয়ার এ্যাসোসিয়েশন।
" "অরগানাইজেশন অফ স্টুডেন্টস ওয়েলফেয়ার" বলতে গেলে নিষিদ্ধ। শুধু নামটাই টিকে আছে, কোন কার্যক্রম চালাতে গেলেই বাধা দেয়া হয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।