করমজান বিবিকে গ্রামের কে না চিনে? তবে করমজান বিবি নামে না- চিনে দছক বলে। দছক বললে শুধু এই গ্রাম না আশ-পাশের তিন গ্রামের লোকে চিনে। সলিমের বাপ তাকে মোমেনশাহী থেকে নিকাহ করে আনে। বুড়া বউ মরার বছর না পেরুতেই এই কান্ড ঘটাবে গ্রামের কোনো লোকেরই মালুম ছিলো না। সবাইকে অবাক করেই সে নিকাহ করে।
তার এই নিকাহ ছেলে সলিম মেনে নিতে পারলো না। কেনই বা নেবে এখন যার নাতনী বিয়া দেয়ার সময় সেই বুড়া বাপ কিনা নিকাহ করলো। রাগে বাপের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। জুদা রান্না করে। গ্রামের মানুষ বলে,
-সলিম ঠিকই করেছে।
বুইড়া বোঝুক নিকাহ করার মজা কতো!
গ্রামের সবাই বুড়ার এই নতুন বউকে নিয়ে ঠাট্টা করে। করমজান বিবিও এই ঠাট্টায় যোগ দেয়। শতহলেও গ্রামের ছাওয়াল পাওয়াল তার নাতী নাতনী। যুবতি নাতনীরা যখন মশকরা করে তার গায়ের ওপর এলিয়ে পড়ে তখন করমজান বিবিও গালে চিমটি কেটে বলে,
-দেখো মাগিরা রঙে বাচে না! আমার লগে দছক করে!
যুবতিদের কাছে এই নতুন শব্দটি খুব ভালো লাগে। মশকরা করে নতুন নানী যখন বলে,
-দছক করে।
রঙে বাচে না!
তারা শব্দটি লুফে নেয়। আর এক একজন করে শব্দটি চালান করে দেয় সারা গ্রাম। তখন করমজান বিবি আর করমজান বিবি থাকে না, নানী থাকে না, দাদী থাকে না; দছক হিশেবেই পরিচিত হতে থাকে। গ্রামের আন্ডা-বাচ্চা থেকে শুরু করে আবাল-বৃদ্ধ পর্যন্ত তাকে দছক বলে ডাকে। করমজান বিবিও এক সময় অভস্ত হয়ে পড়ে আর দছক নামটি শুনতে শুনতে নিজের নামটি ভুলে গিয়ে দছক নামটি নিজের নাম বলে ভাবতে শুরু করে।
দছকের নাম যে করমজান বিবি ছিলো তা আজ আর মনে করে ওঠতে পারে না। ন্যাশনাল আইডি কার্ডের তথ্য সংগ্রহ করতে আসা মাস্টার তার নাম জিজ্ঞেস করলে করমজান বিবি শরমে মাটিতে মিশে যায়। তারপর আবার মাস্টার জিজ্ঞাস করলে ছোট্ট করে একটি শব্দ করে,
-দছক।
দছক কথাটি শোনা মাত্র ঘরের মধ্যে যুবতিদের একটি হাসির ঢেউ খেলে যায়। মাস্টার না শোনার ভান করে আবার জিজ্ঞাসা করে,
-নানী আপনের নাম কি?
অন্ধপ্রায় ঘোলা চোখ দুটি তুলে করমজান বিবি মাস্টারের দিকে তাকায়।
চিন্তার একটি রেখা কপালে তুলে মনে করার চেষ্টা করে তার নাম। তার যে আর একটা নাম ছিলো সে কথা আজ ভুলেই গেছে। সে যেনো মনেই করতে পারে না তার নামটি কি ছিলো। বা মনে করে আর কি লাভ এই বয়সে এসে এমননি একটি শান্তনা বুকে পুষে বলে,
-আমার নাম দছক।
নামটি বলেই সে এবার মাস্টকেই প্রশ্ন করে,
-মাস্টর এই যে এতো কিছু জানতে চাও এইগুলা জাইনা কি লাভ?
মাস্টার ন্যাশনাল আইডি কার্ডের মাহাত্ব বর্ণনা করে।
বর্ণনা শেষে বিস্তর একটা সোয়াবের কাজ করেছে বলে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে। কিন্তু করমজান বিবি মাস্টরের সেই কথায় মনোযোগ না দিয়ে আবার জিজ্ঞাস করে
Ñশুনছি ততবাদর সরকার আইছে? হেয় নাকি দেশ চালাইতে পারেন না। হের লাইগাইগা নাকি চাইলের দাম বাড়ছে? জিনিসপাতির দাম বাড়ছে?
মাস্টার বুড়ির কাছে এমন একটি কথা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলো না। প্রশ্নটা শুনে একটু হকচকিয়ে যায়। মাস্টার এইসব জানে।
নিজেরও সংসার চালাতে কষ্ট হয় কিন্তু সরকারী চাকরী করে, তার কাছে রাজনীতি পরের ঘরে ধন। পরের ঘরের ধন নিয়ে কথা না বলে সরকার যেমন রাখে তেমন থাকতে হয়। না হইলে চাকরী থাকে না। সে বিরক্তি বোধ করে আর মনে মনে কয়,
-আইডি কার্ডের তথ্য সংগ্রহ করতে আসছি। রাজনীতির কথা কইতে আসি নাই।
বুড়ি আবার জিজ্ঞাসা করে
-মাস্টর চাইলের দাম এহন কতো?
বিরক্তি তার চরমে উঠে কিন্তু কিছু বলতে পারে না। পাবলিক ফাংশন; কি হতে কি হয়। কিন্তু মনে মনে বুড়কে বকা দেয়,
-সৎ ছেলের ওপর বইসা বইসা খায় সে আবার চাইলের দাম জিগায়। আরে ঐ বুড়ি তুইতো চাইল কিনোছ না; খামাখা চাইলের দাম জিগানের দরকার কি?
চিন্তার সেই গালমন্দ থেকে মাস্টার বাস্তবে ফিরলে, শুনতে পায় বুড়ির বকবকানি। বুড়ি যে তার উত্তরে আশায় থাকে না।
নিজের প্রশ্নের উত্তর নিজেই দিতে থাকে,
-দেশে ততবাদর সরকার আইছে না? এইটা সরকার না গজব! গজব আইছে! এহন মাইনষে মাইনষেরে গিল্লা খাইবো। কেউ আর মানুষ থাকবো না। খাওন না পাইয়া সব জানোয়ার হইয়া জাইবো। মানুষ অইলে আল্লায় এই গজব দিতো না। দেহো না বৈশাখ মাস আইছে আকাশে মেঘ নাই; বিষ্টি নাই।
আকাশ থেইক্কা আগুন পড়তাছে। হেই আগুনে জ্বইলা যাইতাছে েেতর ফসল। জ্বইলা যাইতাছে সারা দুইন্নাই। এই সরকাররে নামাইতে পাড়লেই আকাশ থেইক্কা বিষ্টি নামবো।
বুড়ির বকবকানি আর পছন্দ হয় না মাস্টারের।
সে জটপট তথ্য সংগ্রহ করে বুড়ির বকবকানি থেকে দূরে যেতে চায়। কারণ এই কথাতো তার কথা এই চিন্তাতো তার চিন্তা। বুড়ি কইতে পারে সে কইতে পারে না।
দেশে এই প্রথম পরপর দুইবার বন্যায় ফসলি জমি তলিয়ে গেলো। কৃষকের অবলম্বন আর কিছুই রইলো না।
তারপরও সৃষ্টিশীল কৃষক আবার নেমে পরে ফসল ফলানোর আশায়। বীজ ফালায়; জেগে ওঠে নতুন পাতা। কৃষকের মন ভরে উঠে নতুন শিশু জন্ম দেয়ার আনন্দে। সলিমেরও এবার ফসল ভালো। গত দুই বন্যার তি যেনো পুষিয়ে উঠতে পারবে।
সলিম সৎ মায়ের কাছে যায়। মায়ের কাছে গল্প করে। নতুন চারা গাছ কেমন নাদুস নুদস হয়েছে ঠিক যেনো তার ছেলে জফিল। করমজান বিবি শুনে হাসে।
-বড়ই বেচইন ছেলে।
কতো আশা স্বপ্নের ছাওয়াল। এরকম তার বাপেও ছিলো। কোনো কিছুতেই হার মানতো না। বউ মইরা গেছে কিন্তু হেয় বউ ছাড়া থাকলো না। নিকাহ করলো আমারে।
জীবনে হারতে নারাজ। শেষ দিনটি পর্যন্ত কেমন বিশ্বাস নিয়া লোকটা ইন্তেকাল করলো।
সেই কথাই আজ বারবার করমজান বিবির মনে পড়ে ছেলের কথায়। সৎ ছেলে হলেও আজ মা হারানোর ব্যথা ভুলতে চায় করমজান বিবির কোলে মাথা রেখে।
দিন যায়; রাত আসে।
রাত যায়; দিন আসে। এক সময় ধানের গলা মোটা হয়, ছড়া ফেলবে। পোয়াতী গাছের এসময় একটু যত্নআত্তি প্রয়োজন। পোয়াতী সময় মেয়ে ছাওয়ালের যেমন বেশি বেশি খাওয়ান লাগে তেমনি পোয়াতী ধানগাছও পানি না দিলে তরতাজা লম্বা লম্বা ছড়ি ফেলবে না। কিন্তু পানি নাই চারদিকে।
উজানের পানি নাই। পানির অভাব। ডিপকল চালানের বিদ্যুৎ নাই। আকাশ জুড়েও মেঘ নাই। মেঘ না হলে পানির অভাবে পোয়াতি ধানগুলো চিটা হয়ে যাবে।
দিশেহারা কৃষক। বৈশাখের রুদ্র তাপ যেনো সাপের নিশ্বাসের মতো জমিনে অনবরত নিশ্বাস ফেলছে। পোয়াতি ধান গাছগুলোরে গিলে খাবে। জফিল বাপের কথাগুলো বলে দাদীকে বলে। তার বাপ পানির জন্য কেমন পাগল হইয়া যাইতাছে।
বাপের কষ্টগুলো যেনো তার ভেতরে কষ্টের দানা বাধে। সে দাদীকে প্রশ্ন করে
-দাদী বিষ্টি হয় না ক্যা। বিষ্টি না হইলে নাকি ধান হইবো না। ধান না হলে আমরা কি খাবো। আমরা কি না নাইয়া থাকমু।
ও দাদী কথা কও না ক্যা।
করমজান বিবি উত্তর করে না। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। যেনো তাবৎ আকাশে খুঁজছে এক ফোঁটা পানি আনতে চায় তার ঘোলা চোখ দুটি।
রোদের তাপে যখন ফসলি জমি পুড়ে ছাই হতে থাকে তখন করমজান বিবিকে জফিল টানতে থাকে তাদের ঘরে যাওয়ার জন্য।
করমজান বিবি নাতীকে জিজ্ঞাসা করে,
-কি অইছে ক দেহি। টানতাছস ক্যা।
জফিল উত্তর করে না। টানতে টানতে নিজেদের ঘরে নিয়ে যায়। করমজান বিবি ঘরে ঢুকে আন্দাজ করে।
সলিম কান্না করছে। সে এই প্রথম দেখলো ছেলের কান্না। তারে নিকাহ করে আনলে ছেলে রাগ করেছে বটে কিন্তু কান্না করে নাই আজ ছেলে কাঁদছে। আজ কতো বছর হলো এই বাড়িতে আসছে কিন্তু কোনো দিন ছেলের কান্না দেখে নাই। দেখবোই বা ক্য এতো বড় ছেলে কান্দে নাকি? এই শেষ বয়সে ছেলের কান্না শোনতে হচ্ছে।
ছেলেকে শান্তনা দিতে পারে না। নিজের অজান্তে বলতে থাকে,
-এই খরা থাকবো না বাপ। থাকবো না এই গজবী সরকার। দেখবি। দেখবি বাপ এই সরকার উল্টা যাইবো।
যেমনে আমগো রইস ঘরটা গেলোবার ঝড়ে উল্টা গেছে তেমনি উল্টা যাইবো। তহন আকাশ ফাইটা বিষ্টি পড়বো। এক টাকা কয়েনে মতো বিষ্টি। পাঁচ টাকা কয়েনের মতো বিষ্টি পড়বো। আমরা হেই বিষ্টি টোকাইয়া ঘরে তুলুম।
আমগো গোলাগুলি ভইরা যাইবো ধানে।
বুড়ি আর কিছুই বলতে পারে না। বকবক করতে করতে তার গলা ধরে আসে। নিজের কান্না পায়। সেই কান্না ছেলের কান্নার সাথে মিশে একারকার হয়ে যায়।
আজ শুক্রবার। বিকাল থেকেই আকাশটা করমজান বিবির কেমন কেমন মনে হয়। মনে হয় বিষ্টি হইবো। সে নাতিকে ডাকে
-জফিল, ও জফিল একটু শোন দাদা। আমার জানি আজকা কেমন মনে হইতাছে।
ভালা ঠেকতাছে না আকাশটা। মনটা কেমন উতলা অইতাছে। জফিল; ও জফিল শোন দাদা। মজা দিমুনে।
জফিল বুড়ির দিকে মন দেয় না।
সে জমিরের সাথে খেলায় মন দেয়। করমজান বিবি গালমন্দ করে ঘরে ঢুকে মাগরিবের নামাজ পড়ে। নামাজ শেষে জায়নামাজ থেকে আজ আর ওঠে না। আজ কেনো যোনো ভালো লাগছে না তার। নামাজের বিছানায় বসেই তসবি টিপতে থাকে।
সন্ধা নেমে আসে। আকাশে মেঘ হয়। বিদ্যুৎ চমকায়; গর্জন করে। এমন সময় জফিল ঘরে ঢুকে ডাকে,
-দাদী; ও দাদী তারা তারি আহো টিভিতে জানি কি কইতাছে। দেশে নাকি কি অইছে? তারা তারি হুইনা যাও।
নাতির টানাটানিতে করমজান বিবি বাইরে আসে। বাইরে আসতে আকাশের মেঘের গর্জন বৃদ্ধি পায়। আকাশ গইলা এখুনি বিষ্টি নামবো। বিষ্টির এক একটা ফোঁটা এক একটা কয়েন। এক টাকার কয়েন, পাঁচ টাকার কয়েন।
সেই কয়েন টোকাতেই নাতি তাকে হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।