: শুনছ...: কেমন আছ?
: হুঁ, ভালো!
: কী করছ এখন?
: কিছু করছি না। এখানে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। একদম ভালো লাগছে না। আমাকে নিয়ে যান আপনার সাথে।
: কেন আবার কী হলো? কেউ বকেছে? কোনো সমস্যা?
: সমস্যার শেষ আছে? আমি শহরের মেয়ে।
আমাকে গ্রামের বনজঙ্গলে রেখে আপনি শহরে থাকছেন। এটা কেমন কথা।
: তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারি? কিন্তু চাকরির জন্য থাকতে হচ্ছে।
: চাকরি না অন্য কিছু। আপনি আসলে আমাকে জেনেশুনে কষ্ট দিচ্ছেন।
আমি জানি।
: বিশ্বাস রাখ। চাকরি না করলে খাব কী? তোমার জন্য এটা-সেটা কিনব কেমনে?
: কেন আমাকে যদি গ্রামেই রাখেন তবে এখানে কিছু করুন।
: তেমন সুযোগ কী আর আছে। এখন একটা উপায় আছে-গ্রামে গিয়ে চাষাবাদ করা।
তখন তোমার আত্মীয়রা বলবে, `রিতার স্বামী চাষা'। শুনতে ভালো লাগবে?
: আমি কিছু জানি না। এখানে আমার ভালো লাগছে না। আমি সবার সঙ্গে মিশতে পারছি না। আমি দম বন্ধ হয়ে মারা যাব।
: কেন আমার আম্মু-আব্বু তোমাকে আদর করে না।
: ওনাদের কোনো দোষ নেই। ওনারা ভালো। কিন্তু সমস্যাটা আমার।
: তুমি আমার জন্য কিছু দিন কষ্ট কোরো না লক্ষ্মী! দেখি কী করা যায়।
: আর কত দেখবেন। ততদিনে আমি শেষ হয়ে যাব। আমাকে নিয়ে যান শহরে। এখানে তিন বেলা ভাত খান সবাই। আপনি আমাকে বলতেন, বাসি না খেতে-এখানে সবাই বাসি তরকারি খান।
: গ্রামে কিছু বিষয়-আশয় আছে। সেখানে তরিতরকারি গরম দিয়ে রাখেন। আগে একধরনের মাটির পাত্রে রান্না হতো। কিছু তরকারি আছে বাসি হলে বেশি মজা। যেমন মুলার তরকারি।
: থাক আর ফিরিস্তি দিতে হবে না।
: সত্যি করে বলো তো, মারাত্মক কোনো সমস্যা হয়েছে?
: তেমন কিছু হয়নি। ওনাদের কথাবার্তা, আচরণ কেমন যেন ঠেকছে। দুটি খাবার টেবিল আছে কিন্তু মেয়েরা ভাত খাবেন রান্নাঘরে। কেন?
: ওনারা গ্রামের মানুষ।
খাবার টেবিলে খেতে অভ্যস্ত নন। তা ছাড়া সেখানে কাজের লোক বা বুয়া নেই। টেবিলে আনা-নেওয়ার ঝামেলা থেকে বাঁচতে রান্নাঘরে খেয়ে নেন মেয়েরা। তুমি ওনাদের সাথে খেতে অসুবিধা মনে করছ?
: রান্না ঘরে পিঁড়িতে বসে খেতে হয়। তখন উপুড় হয়ে খাওয়ার সময় আমার গলা দিয়ে ঢোকে না।
: ঠিক আছে একটি মোড়ার ওপর থালা রেখে খেতে পার। তখন আর মাথা নিচু করতে হবে না।
: আর কী সমস্যা আছে?
: স্নানঘরে কাপড় কাচার সাবান আর গায়ে মাখার সাবান একত্রে রাখে। কিছু বললে বলেন, দুটি সাবান একত্রে রাখলে কী হয়? আমি কীভাবে বোঝাই দুটিতে ক্ষারের মাত্রা এক নয়। আর ক্ষার বেশি হলে ত্বকের তি হয়।
ত্বক জ্বলে নষ্ট হয়ে যায়।
: সেটা বুঝিয়ে বললেই হয়। দরকার হলে দুটি সাবানদানি নিয়ে আসব। তখন আলাদা রাখা যাবে। তারপরও না হলে তোমার সাবান আলাদা রাখবে।
: আর কী সমস্যা?
: আপনি জানেন, বিদ্যুৎ চলে গেলে আমি ভয় পায়।
: তাতে কী হয়েছে? তুমি চার্জলাইট নিয়ে বসে থাকবে। যেই বিদ্যুৎ চলে যাবে অমনি জ্বালিয়ে দেবে। দরকার হলে আমি একটি ভালো চার্জলাইট নিয়ে আসব যেটি বিদ্যুৎ যাওয়ার সাথে সাথে জ্বলে উঠবে। কিছু দিন পর আইপিএস লাগাব।
: এখানে সবাই অন্ধকারে থাকতে অভ্যস্ত। বাতি জ্বালালে ওনাদের ঘুম আসে না। সন্ধ্যা নামলে সব বাতি নিভিয়ে দেন। তখন মনে হয় ভুতুড়ে বাড়ি। গা ছমছম করে।
: তোমার কে কম আলোর একটি লাইট আছে না। সেটা জ্বালিয়ে রাখবে।
: এখানে আমার মন টেকে না। সাবাই রাত নয়টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েন। আমার ঘুম আসে না।
এদিকে সারাদিন একা একা থাকি।
: ওনারা আগে ঘুমিয়ে পড়েন আবার ঘুম থেকে ওঠেনও সাতসকালে। এটা তো ভালো অভ্যাস। তুমি তো পড়েছ ইংরেজি প্রবাদটি-আরলি টু বেড, আরলি টু রাইজ মেইকস এ ম্যান হেলদি ওয়েলদি অ্যান্ড ওয়াইজ।
: পড়েছি , কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আমি জন্ম থেকে দেরিতে ঘুমোতে অভ্যস্ত।
তেমনি দেরিতে বিছানা ছাড়তেও।
: সেটা আমি অস্বীকার করছি না। তবে শুনেছিলাম, মানুষের অভ্যাসের দাস। মানুষের অসাধ্য কিছু নেই। তুমি চাইলে নতুন অভ্যাসটি আয়ত্তে আনতে পার।
অথবা চাইলে দেরিতে ঘুমিয়ে দেরিতে উঠতে পার। এতে ওনাদের তেমন কোনো লাভ-তি নেই। বুঝতে পেরেছ?
: হুঁ! তবে আমার যে সময় কাটে না।
: তুমি অবসর সময়টা নিজের মতো করে সাজিয়ে নিতে পার। অবসরে সেলাই করা, নকশা তৈরি ইত্যাদি হাতের কাজ চর্চা করতে পার।
প্রতিদিন একটি খবরের কাগজ নিচ্ছি সেটি পড়তে পার। টেলিভিশন দেখ। একটি ডিভিডি কিনব। অনেক গল্প-উপন্যাস আছে সেগুলো শেষ কর।
: আপনার আম্মু আমাকে নকশিকাঁথা দিয়েছে।
আমি একটু একটু করে সেলাই করেছি। কিন্তু ভালো লাগছে না। বিটিভি আমি দেখি না, ভালো লাগে না।
: ঠিক আছে ক্যাবল সংযোগ নেব। পাশের বাসায় তো আছে।
দু শ টাকা নেবে আর কি!
: তাতে সমস্যার সমাধান হবে? ওনারা যা ধার্মিক, সবার সামনে আমি হিন্দি ছবি বা সিরিয়াল দেখতে পারব?
: শোনো হিন্দি ছবি দেখা তো ফরজ নয়। তোমাদের বাসায় বিদ্যুৎ না থাকলে এসব দেখতে পার। মনে করবে এখানেও বিদ্যুৎ নেই। যে যাই হোক আসলে ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়। ওনারা ঘুমিয়ে পড়লে তুমি একা দেখবে।
কিংবা তোমাকে একটি টেলিভিশন কিনে দেব।
: এখানে একটি মাত্র মুঠোফোন আছে। তাতে আবার টাকা থাকে না অনেক সময়। আমার ইচ্ছে করলেও আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারি না। তার কী হবে?
: দেখো তোমার ছোট মামা কত বড় লোক।
ঘরভাড়া পান ২৫ হাজার টাকা। বাবার কাছ থেকে যে জায়গা পেয়েছেন তার দাম কোটি টাকা। তারপরও কিন্তু তিনি মুঠোফোন ব্যবহার করেন না। অনেক বড় বড় লেখকেরা, বিশিষ্ট লোকেরা এসব ব্যবহার করেন না। তার মানে মুঠোফোন দরকারি জিনিস, কিন্তু এটা অপচয়ের মাধ্যমও।
সে যাই হোক, তোমার ফোন করার দরকার কী? আমি দুদিন পরপর আসছি। প্রতিদিন আট-দশবার ফোন করছি।
: আমার আম্মু আর বাপ্পির সঙ্গে কথা বলতে হবে না?
: ওনারা প্রতিদিন কয়েকবার ফোন করছেন। এখানে এমন কোনো অসুবিধা হচ্ছে না যে তোমাকে ঘন ঘন ফোন করতে হবে। তা ছাড়া, তোমার আম্মু ফোন করলেই তুমি কান্নাকাটি করছ।
এতে তাঁরা মনে কষ্ট পান। তুমিও মন খারাপ কর।
: আমি নিজেকে সামলাতে পারি না। আসলে ওনাদের ছেড়ে কখনো কোথাও থাকিনি। তাঁরা কী করছেন, কেমন আছেন-এসব জানতে ইচ্ছে করে।
তাঁদের দেখতে ইচ্ছে করে।
: তুমি বুঝতে চেষ্ট কোরো। তাঁরা তোমার পছন্দের ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছেন। সাধ্যমতো অনুষ্ঠান করেছেন। টাকা খরচ করেছেন।
এখন তোমার হাসিমুখ দেখতে চান তাঁরা। তুমি যদি উল্টো মন খারাপ দেখাও, ফোনে কান্নাকটি কর তবে তাঁরা মনে কষ্ট পান। এটা কী ঠিক হচ্ছে?
: একটি বাসা নিলে হয় না? তাহলে আপনাকে প্রতিদিন দেখতে পারব, আম্মু, বাপ্পি আর রাজু ভাইয়াকে কাছে পাব।
: সময়টা এখনো আসেনি। আমরা মাত্র দুটি প্রাণী।
আমি চাকরিতে চলে গেলে তুমি বাসায় একা হয়ে পড়বে। কত ঝামেলা সইতে হবে-রান্নাবান্না, কাপড় কাচা, ঘর ঝাড়ু দেওয়া, নাশতা তৈরি, কেনাকাটা, অতিথি আপ্যায়ন। এ ছাড়া থাকবে জমিদারের ছেলের পরকীয়া প্রেম, প্রতিবেশীর উৎপাত, চুরি ডাকাতি, ডিশের বিলওয়ালা, ভিুক আর ফেরিওয়ালার হাঁকডাক কত কী!
: কাজের জন্য একটি বুয়া রাখা যাবে না?
: এটা তো আরও বিপদ। আজকাল চোরাইচক্রের সঙ্গে বুয়াদের যোগসাজশ আছে। খবরের কাগজে এমনকি টেলিভিশনের নাটকে দেখেছি।
প্রথমে বুয়ারা আপামণি আপামণি বলবে। কাজকাম সব করবে। বিশ্বাস জমিয়ে একদিন তোমার সোনার গয়না, টাকা-পয়সা নিয়ে পালিয়ে যাবে। এমনও হতে পারে তোমাকে খুন করে ফেলবে। অবশ্য ভালো বুয়াও আছে।
কিন্তু তাঁদের কপালে তো আর লেখা থাকে না। আর শহরে বিশ্বাস জিনিসটা দিন দিন উঠে যাচ্ছে।
: তারপরও অনেকে বাসায় থাকছে না?
: থাকছে। কখনো তিন-চার দিন বাসায় পানি থাকছে না। কখনো বছর ঘুরতেই ১০ শতাংশের নিয়মের বাইরে বাসাভাড়া বাড়াচ্ছে।
তখন কেউ বাসা বদলান। অলিগলিতে বাসা খোঁজেন নাওয়া-খাওয়া ভুলে। হয়তো ভাড়া পাওয়া যায় কোনো ঘিঞ্জি এলাকায়। যেখানে মাদক আর মাস্তানের সহাবস্থানে চলে দৌরাত্ম্য। আর বাসা না পেলে জমিদারের সব অত্যাচার সহ্য করতে হয় মুখ বুজে।
ইচ্ছের বিরুদ্ধে পরাধীন থাকেন মাসের পর মাস।
: তাহলে আমরা বাসা নিচ্ছি না?
: অবশ্যই নেব। আম্মু-আব্বু যে কয়দিন বেঁচে আছেন ওনাদের সঙ্গে থাকি। আয়-রোজগারও বাড়–ক। ইতিমধ্যে তুমি রান্না-বান্না শিখ।
গায়ে একটু হাওয়া লাগাও। আর কয়েকটি বছর হাট-বাজার-গ্যাস-পানি এসব সাংসারিক দুশ্চিন্তা থেকে দূরে থাক।
: আপনি আমাকে বুঝতে চেষ্টা করুন। এখানে আমার মন টিকছে না। এখানে খাওয়া-দাওয়া, আঞ্চলিক কথাবার্তা, পরিবেশ সব কিছু আমার ভালো লাগে না।
: সেটা আমি জানি। তুমি শহরের মেয়ে। তোমার গ্রাম ভালো লাগবে না-এটা সত্য। তবে আমি শুধু দেখছি ডিশের লাইন ছাড়া সবই আছে, অবশ্য সেটিও জুলাই থেকে নিচ্ছি। আর আমাদের পাকা বাড়ি।
সেখানে গ্যাস আছে, ঘরের ভেতরে তিনটি স্নানাগার আছে। এরপরও সেটি গ্রাম রইল কেমনে। আসলে...
: আসলে কী?
: কিছু মনে করবে না তো।
: না।
: তাহলে বলি?
: বলুন।
: আসলে সুখে থাকলে ভূতে কিলায়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।