আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

লিডিয়া লিতভিয়াক- ব্যাটল অফ স্ট্যালিনগ্রাদের এক বীরঙ্গনা ও ইতিহাসের প্রথম সফল মহিলা বৈমানিক

.................।
কিছুদিন আগের এক পোস্টে আমি ব্যাটল অফ স্ট্যালিনগ্রাদের এক বীর পাভলভের কাহিনী বর্ণণা করেছিলাম (২য় বিশ্বযুদ্ধ, ব্যাটল অফ স্ট্যালিনগ্রাদ- পাভলভ হাউজ এবং পাভলভ বাহিনীর বীরত্বগাথা )। ব্যাটল অফ স্ট্যালিনগ্রাদ নিয়ে পড়াশুনা করতে গিয়ে, অনেক বীরের মাঝে অন্যরকম একজনের সন্ধান পেয়েছিলাম, তখনি মনে মনে ঠিক করেছিলাম সেই অন্যরকম আরেকজনকে নিয়ে একটি পোস্ট দিব। ব্যাটল অফ স্ট্যালিনগ্রাদে লিডিয়াঃ জার্মান বিমান লুফতওয়াফের(Luftwaffe) আক্রমণে সোভিয়েত বিমান একরকম ধ্বংশ। স্ট্যালিনগ্রাদের আকাশে জার্মান স্টুকা বোম্বার বিমানের রাজত্ব, ধারাবাহিকভাবে বোমা বর্ষণ করে যাচ্ছে সোভিয়েত স্ট্রং পয়েন্টের উপর।

নিরুপায় সোভিয়েত জেনারেল চিকুভ তার রেড আর্মিকে নির্দেশ দিল, যতটা সম্ভব শত্রু জার্মান পদাতিক বাহিনীর কাছে থাকতে যেন জার্মান বিমান আক্রমণের প্রকোপ কমে। এই শত্রু বাহিনীর কাছে থাকার স্ট্রাটেজী স্ট্যালিনগ্রাদের যুদ্বকে নিয়ে গিয়েছিল রাস্তার মোড়ে মোড়ে, ভবন হতে ভবনে, এমনকি কিচেন রুম হতে ড্রইং রুমে হাতাহাতি যুদ্ব ছড়িয়ে পড়ে। দিন যায়, মাস যায় স্ট্যালিনগ্রাদের আকাশে জার্মান বিমানের একচ্ছত্র রাজত্ব। ধীরে ধীরে সোভিয়েত বিমানের আকাশে দেখা মিলে। পাল্টা আক্রমণ করে জার্মান বিমান বাহিনীকে।

এই প্রথম জার্মান পদাতিক বাহিনী সোভিয়েত বিমান বাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হয়, এতদিন যা বিপরীত হয়ে আসছিল। প্রথম দিকে সোভিয়েত বিমান কেবল রাতে মহড়া দিত, ধীরে ধীরে সোভিয়েত বিমানের তেজ বাড়তে থাকে স্ট্যালিনগ্রাদের আকাশে। যেসব সাহসি সোভিয়েত বৈমানিক, তখন পর্যন্ত দূর্জয় জার্মান লুফতওয়াফের মুখামুখি হয়েছিল তাদের মধ্য ছিল ব্লন্ড চুলে অধিকারিণী ২১ বছরের এক সুন্দরী নারী, নাম লিডিয়া লিতভিয়াক , সহবৈমানিকরা সংক্ষেপে ডাকত লিলি। লিডিয়ার বিমানের ককপিটে সাদা ফুলের ছাপ ছিল, যার কারণে পরবর্তীতে তাকে জাতীয়ভাবে "হোয়াইট রোজ অফ স্ট্যালিনগ্রাদ" হিসেবে অ্যাখায়িত করা হয়। কথিত আছে, লিডিয়া বারটি শত্রু বিমান ধ্বংস করে(মতান্তর আছে)।

তার মধ্য প্রথম একা শত্রু বিমান ধ্বংস কাহিনী একটু মজার। লিডিয়ার প্রথম সন্মিলিত জয় আসে এক জার্মান বিমান Ju 88 এর বিরুদ্বে, লিডিয়া তার রেজিমেন্টের কমান্ডারকে সাহায্য করেছিল এই বিমান ভূপাতিত করতে। তার পরের জয়টি একক প্রচেস্টায়। বিপক্ষের বৈমানিক ছিল জার্মান বিমান Bf 109 চালক ১১ বার বিমান যুদ্ব জয়ী, তিন বার জার্মানির সর্বোচ্চ সেনা পদক আয়রণ ক্রস বিজয়ী এরউইন মায়ির। লিডিয়া ভূপাতিত করে এই বিমানকে, শুধু তাই না এই জয় হল ইতিহাসে প্রথম কোন নারীর একক প্রচেস্টায় বিমান যুদ্ব জয়।

পরাজিত জার্মান বৈমানিক মায়ির প্যারাসুটের সাহায্য বিনস্ট Bf 109 থেকে নিচে অবতরণের পর সোভিয়েত বাহিনীর ধরা পড়ে। সোভিয়েত সৈন্যরা যখন মায়িরকে বলে, তুমি এক নারীর কাছে হেরেছ মায়ির সেটাকে সোভিয়েত জোকস হিসেবে ধরে নেয়। মায়ির নিজেই দেখা করতে চায়, যে তাকে পরাস্ত করেছে। যখন মায়িরকে লিডিয়ার সামনে নিয়ে যাওয়া হল তখন ও মায়িরের চোখে-মুখে অবিশ্বাসের ছাপ। লিডিয়া যখন আদ্যপান্ত দুজনের দ্বৈরথ বর্ণণা করে, তখন মায়িরকে মেনে নিতে হয় ইতিহাসে প্রথমবারের মত এক পুরুষ বৈমানিক মহিলা বৈমানিকের কাছে হার মেনেছে।

ছবিঃLawotschkin_La-5( স্ট্যালিনগ্রাদের যুদ্বে লিডিয়া এই মডেলের বিমান ব্যবহার করেছেন) ছবিঃMesserschmitt Bf 109. (জার্মান বৈমানিক মায়ির এই মডেলের বিমান ব্যবহার করেছেন) লিডিয়ার মৃত্যঃ ১৯৪৩ সালে ব্যাটল অফ কুরস্ক(ট্যাঙ্ক যুদ্ব নামে সমাধিক পরিচিত) যুদ্বে এই সোভিয়েত বীরঙ্গণার মৃত্য হয় বলে ধারণা করা হয়। তবে কিভাবে লিডিয়ার মৃত্য হয়েছে, তা একধরনের ধোয়াশার মত রয়ে গিয়েছে। কথিত আছে, একটি ফ্লাইটকে স্কর্ট করে ফিরার পথে উপর থেকে দুই জার্মান বিমান লিডিয়ার বিমানকে আক্রমণ করে। শেষ মোমেন্ট পর্যন্ত লিডিয়ার বিমানকে মেঘের নীচে যুদ্ধরত অবস্থায় দেখা গিয়েছে। অন্য এক সোভিয়েত বৈমানিক ইভান বরিশেঙ্কো সাহায্যর জন্য এগিয়ে গেলেও শেষ মূহুর্তে হারিয়ে ফেলে লিডিয়ার বিমানকে, ইভান কোন বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পায়নি, কোন প্যারাসুটেরও দেখা পায়নি।

লিডিয়ার কবরঃ লিডিয়ার অপর এক সহযোদ্বা পাস্পোর্টনিকোভা ৩৬ বছর ধরে সোভিয়েত বিমান ধ্বংস এলাকা মিডিয়া এবং জনগণের সাহায্য অণুসন্ধানের পর ১৯৭৯ সালে ডিমিট্রভকা নামক এক গ্রামে এক নামহীন মহিলা পাইলটের কবরের সন্ধান বাহির করেন। ধারণা করা হয় যে, এটাই সোভিয়েত বীরঙ্গনা লিডিয়ার কবর। তবে কিছু কিছু বিশেষজ্ব মতামত দিয়েছেন, লিডিয়া জার্মান বাহিনী কর্তৃক ধৃত হয়েছিল । এমনকি এক সহযোদ্বা দাবি করেছেন, টিভিতে সে একজন ৭০ বয়স্ক নারীকে দেখেছেন, যে নারী্র চেহাড়ায় লিডিয়ার ছাপ রয়েছে এবং সেই বৃদ্ব নারী নিজেকে ২য় বিশ্বযুদ্বের একজন বৈমানিক হিসেবে দাবি করেছেন। লিডিয়ার পরিচয়ঃ পূর্ণ নাম Lydia Vladimirovna Litvyak।

১৯২১ সালে মস্কোতে জন্ম। কৈশরেই বৈমানিক হওয়ার হাতছানি থেকে ১৪ বছর বয়সেই এরোক্লাবে যোগদান করে। ১৯৩৭ সালের শুদ্বিকরণ অভিযানের সময় তার পিতাকে সোভিয়েত সরকার গ্রেফতার এবং হত্যা করে। ১৯৪১ সালে অপারেশন বারবোসার মাধ্যমে জার্মানদের সোভিয়েতের উপর আক্রমণের পর, লিডিয়া স্বেচ্ছায় সোভিয়েত বিমান বাহিনীতে যোগদানের চেস্টা করে কিন্তু যুদ্বক্ষেত্রে পূর্ব অনভিজ্বতার কারণে ব্যর্থ হয়। পরবর্তীতে ১০০ ঘন্টা যুদ্ব পূর্ববতী যুদ্ব-বিমান চালানোর সক্ষমতা দেখিয়ে ৫৮৬ ফ্লাইট রেজিমেন্টে জয়েন্ট করে।

উল্লেখ্য ৫৮৬ রেজিমেন্ট ছিল কেবল নারীদের। ১৯৪২ সালে ব্যাটল অফ স্ট্যালিনগ্রাদের সময় লিডিয়াকে পুরুষ রেজিমেন্টে ট্রান্সফার করা হয়। লেখার সোর্সঃ ১। http://www.strategypage.com/ ২। উইকিপিডিয়া (ইংরেজি, স্লোভাক-গুগল ট্রান্সলেটর দিয়ে ইংরেজি করিয়েছি।

) ৩। http://www.militaryhistoryonline.com ৪। forum.axishistory.com ৫। ইমেজ কিছু এসেছে গুগল ইমেজ সার্চ থেকে আমাদের শিক্ষাঃ লিডিয়ার পিতা সোভিয়েত সরকার কর্তৃক মারা গিয়েছিল, অথচ দেশ যখন আক্রান্ত হল লিডিয়া স্বেচ্ছায় সরকারি বাহিনীতে যোগদান করেছিল। ইচ্ছে করলেই লিডিয়া চুপ করে থাকতে পারত অথবা জার্মান কতৃক গঠিত "হোয়াইট আর্মি"( রাশিয়ান বাহিনী জার্মানদের সহযোগি হিসেবে কাজ করেছিল) তে যোগদান করতে পারত।

লিডিয়ার রক্তে প্রবাহিত ছিল আমাদের মীরমদন- মোহনলালের আগুন। সব কিছু থেকে দেশ বড়, এই আহবান লিডিয়া উপেক্ষা করতে পারে নাই। যুগে যুগে দেশে দেশে মীরমদন মোহনলালরা ফিরে আসে, ফিরে আসবে, আসতে হবেই। ৭১ আমাদের দেশে ছিল মীরজাফর, ইয়ারলতিফ,রাজভল্লবের দল, আজও আছে। সেই সাথে আছে এবং থাকবে মীরমদন মোহনলালরা, যারা শতাব্দী থেকে শতাব্দী দেশমাতৃকার জন্য নিজেদের উৎসগ করে দিয়ে যাবে।

মীরমদন, মোহনলাল এবং লিডিয়ার মত দেশপ্রেমিকরা অক্ষয়, অমর।
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।