পরাজিত হতে হতে আমি উঠে দাড়িয়েছি এবার ফিরে যাবো না খালি হাতে, স্তব্ধতা আর সৌন্দর্যের পায়ে পায়ে এগিয়ে যাই যে কবি সে কখনো খালি হাতে ফিরে যেতে পারে না ।
একাত্তরের ঘাতক দালালরা আর রাজাকারি চেতনাধারিরা গত ৩৮ বছর ধরে প্রচার করে আসছে -পাকিরা নাকি ভারতের কাছে সারেন্ডার করেছে , ভারতই ষড়যন্ত্র করে এমন করিয়েছে , মুক্তিবাহিনীর সিএনসি ওসমানিকে সারেন্ডার অনুষ্ঠানে থাকতে দেয়া হয়নি -ইত্যাদি ইত্যাদি ।
আসুন দেখা যাক , কেন ওসমানি অনুপস্থিত ছিলেন ?কেনই বা পাকিরা মিত্রবাহিনীর অরোরার কাছে সেরান্ডার করলেন ? এবং তা’ আদৌ ভারতের ষড়যন্ত্র কিনা ?
আসলে পাকিরা ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বতমানে সোরওয়ার্দি উদ্যানে ) আত্মসমর্পন করেছিল যৌথকমান্ডের অন্যতম অধিনায়ক জেনারেল অরোরার কাছে । দেখুন দলিল -
২। বাংলাদেশের পক্ষে এই অনুষ্ঠানে প্রতিনিধিত্ব করেন মুক্তিবাহিনীর উপপ্রধান গ্রুপ ক্যাপ্টেন (এয়ার ভাইস মার্শাল) একে খন্দকার।
আরো উপস্থিত ছিলেন ২ নং সেক্টর (ঢাকা) কমান্ডার এ টি এম হায়দার । নিচের ছবিতে দেখুন জেনারেল অরোরা আর নিয়াজির সাথে অপুর্ব ভঙ্গীতে কাঁধে চাইনিজ এসএমজি নিয়ে পাকবাহিনীর আত্মসমর্পন টেবিলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন মেজর হায়দার ।
৩। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে জেনারেল এমএজি ওসমানীর অনুপস্থিতি নিয়ে আজও কুতর্ক তুলছে বিএনপি-জামাত । বস্তুত আত্মসমর্পণ সিদ্ধান্তের আগেই ওসমানী সিলেট চলে গিয়েছিলেন ।
ড. এ আর মল্লিক এর ষ্মৃতিচারণ-"তাজউদ্দিন আহমদ এর সঙ্গে আমার কথা হচ্ছিলো । তাজউদ্দিন আহমদ আমাকে বললেন , দেখুন তো পাকিস্তান আর্মী সেরান্ডার করবে , প্লেন যাবে অথচ ওসমানি সাহেবকে পাওয়া যাচ্ছে না । তিনি মনে হয় খুব রিলাকটেন্ট । এর কারণ কিতা বুঝা গেলনা । তিনি আমাকে বললেন , একটু খুজে দেখতে হবে ।
খোজাখুজি আমিও করলাম । কিন্তু পেলাম না । পরে শুনলাম যে তিনি এয়ারপোর্টে গিয়ে একটি হেলিকপ্টার নিয়ে সিলেট চলে গেছেন কাউকে না জানিয়ে । " ( দ্র. আমার জীবন কথা ও বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম, আগামী প্রকাশনী , ১৯৯৫ , পৃষ্ঠা ১১৫) বস্তুত, ওসমানী ১১ ডিসেম্বর থেকে রণাঙ্গন সফরে বেরিয়েছিলেন। (দ্র. মাইদুল হাসান, মুলধারা '৭১)
তার এই অনুপস্থিতিতে নানা গুজব রটনা তখন ছড়ানো হয় ।
এ নিয়ে পরেও যে বিতর্ক হবে এমন আশংকা তখনই প্রকাশ করেছিলেন এম এ মোহাইমেন।
৪। জেনারেল জেকবের বক্তব্য - Why was the Commander in Chief of the Bangladesh Army, General MAG Osmani, absent at the ceremony?
Jacob: There is a lot of propaganda about it. The fact is, he was in Sylhet. He was in a helicopter that was shot at by the Pakistan army. I had ordered everyone on the Bangladesh side to stay in Kolkata. But he rode the chopper, got shot and couldn’t attend the ceremony. It’s not our fault. He should have been there. We wanted him there. Khondkar attended in his absence.
৫ । "জেনারেল ইয়াহিয়া জেনারেল মানেকশ’র নিকট একটি আবেদনে জানালেন যে, পাকবাহিনী আত্মসমর্পনে প্রস্তুত তবে তাদের শুধু একটি প্রার্থনা যে আত্মসমর্পন গ্রহন করবে ভারতীয় সেনানায়কেরা । কারণ ভারত জেনেভা কনভেনশন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ।
কিন্তু বাংলাদেশ যেহেতু জেনেভা কনভেনশনে সই করেনি তাই বাংলাদেশের জেনেরেলের নিকট আত্মসমর্পন করা সম্ভব নয় । কারণ মুক্তিবাহিনী যদি প্রতিশোধমূলক হত্যা চালায় তবে আন্তর্জাতিক আইন বা জেনেভা কনভেনশন তাদের রক্ষা করতে পারবে না । " ( দেখুন, স্বাধীন বাংলার অভ্যুদয় এবং অতঃপর ,কামরুদ্দীন আহমদ , নওরোজ কিতাবিস্তান , ঢাকা, ১৯৮২, পৃষ্ঠা ১৩১)
৬। ১৮ তারিখে ওসমানী সদর দপ্তরে ফিরে আসেন । তাকে নিয়ে নানা গুজব শুনে ভীষণ ক্ষুব্ধ হন তিনি।
এ নিয়ে সামুতে পিয়াল ভাই লিখেছিলেন । তার ব্লগ থেকেই ওসমানীকে কোট করছি--''দেখুন আমরা স্বাধীনতা অর্জন করতে যাচ্ছি। কিন্তু দুঃখ হলো স্বাধীন জাতি হিসেবে আমাদের মধ্যে আত্মমর্যাদাবোধ সম্পর্কে কোনো চেতনা এখনও জন্ম হয়নি। আমাকে নিয়ে রিউমার ছড়ানোর সুযোগটা কোথায়? কোনো সুযোগ নেই। তার অনেক কারণ রয়েছে।
নাম্বার ওয়ান- পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কবে আত্মসমর্পণ করবে আমি জানতাম না। আমি কলকাতা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর তাদের আত্মসমর্পণের প্রস্তাব এসেছে।
নাম্বার টু- ঢাকায় আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে আমার যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ এই সশস্ত্র যুদ্ধ ভারত-বাংলাদেশের যৌথ কমান্ডের অধীনে হলেও যুদ্ধের অপারেটিং পার্টের পুরো কমান্ডে ছিলেন ভারতীয় সেনাপ্রধান লেফট্যানেন্ট জেনারেল স্যাম মানেকশ। সত্যি কথা হচ্ছে আমি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কোনো নিয়মিত সেনাবাহিনীর সেনাপ্রধানও নই।
আন্তর্জাতিক রীতিনীতি অনুযায়ী পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমার কাছে আত্মসমর্পণ করতে পারে না। কারণ বাংলাদেশ জেনেভা কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী কোনো দেশ নয়।
আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে জেনারেল মানেকশকে রিপ্রেজেন্ট করবেন লে.জে অরোরা। জেনারেল মানেকশ গেলে তার সঙ্গে যাওয়ার প্রশ্ন উঠতো। সার্বভৌম সমতার ভিত্তিতে আমার অবস্থান জেনারেল মানেকশর সমান।
সেখানে তার অধীনস্থ আঞ্চলিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল অরোরার সফরসঙ্গী আমি হতে পারি না। এটা দেমাগের কথা নয়। এটা প্রটোকলের ব্যাপার। আমি দুঃখিত, আমাকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। আমাদের মধ্যে আত্মমর্যাদাবোধের বড় অভাব।
ঢাকায় ভারতীয় বাহিনী আমার কমান্ডে নয়। জেনারেল মানেকশর পক্ষে জেনারেল অরোরার কমান্ডের অধীন। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করবে যৌথ কমান্ডের ভারতীয় বাহিনীর কাছে। আমি সেখানে (ঢাকায়) যাবো কি জেনারেল অরোরার পাশে দাড়িয়ে তামাশা দেখার জন্য? হাও ক্যান আই!
আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করবেন জেনারেল মানেকশর পক্ষে জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা আর পাকিস্তানী বাহিনীর পক্ষে জেনারেল নিয়াজী। এখানে আমার ভূমিকা কি? খামোখা আমাকে নিয়ে টানা হ্যাচড়া করা হচ্ছে।
পাশাপাশি কেনো মুক্তিবাহিনীর কাছে পাকিস্তানীরা আত্মসমর্পণ করেনি এটার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন ওসমানী সংক্ষেপে ব্যাপারটা এমন যে যুদ্ধবন্দীদের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক নীতিমালা আছে যার অন্যনাম জেনেভা কনভেনশন। বাংলাদেশ এই কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ নয় বলেই সেই নীতিমালা মানতে মুক্তিবাহিনী বাধ্য ছিলো না। তাই তাদের হত্যা করলে বা তাদের উপর অত্যাচার করলে বলার থাকতো না কিছু। পাকিস্তানীরা জেনেশুনে সে ঝুকি নেয়নি। তাছাড়া ৯০ হাজার যুদ্ধবন্দীকে খাওয়ানো পড়ানো তদারক করার ক্ষমতাও যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের ছিলো না।
তখনও নিজের খাওয়াটাই যে জোটে না!” (দ্র. একাত্তরের রণাঙ্গন অকথিত কিছু কথা, নজরুল ইসলাম, অনুপম প্রকাশনী ১৯৯৯ )
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।