আদর্শটাকে আপাতত তালাবন্ধ করে রেখেছি
প্রত্যেক মানুষের কাছেই নিজের জন্মস্থানকে অনুপম মনে হয়; আমার এই বোধ কিছুটা কম। তবে জন্মস্থানকে অনুপম মনে না হলেও এর কিছু কিছু দিক আমাকে বিহ্বল করে তোলে প্রায়ই। এর একটি লোককথা। হাওর-বাওর-নদী-খাল-বিলবেষ্টিত এবং অসংখ্য পুকুরশোভিত একটি উপজেলার নাম মোহনগঞ্জ, নেত্রকোনা জেলার একটি অংশ। এখানেই আমার বেড়ে উঠা।
কৈশোরের বয়ঃসন্ধি যখন আমাকে প্রায়ই বিভিন্ন বিষয়ে প্রবলভাবে দ্বিধায় ফেলে দিতো, ঠিক সে সময়টাতেই মোহনগঞ্জকে ছেড়ে চলে আসি এই নগররাজ ঢাকায়। ফলে সে সময় থেকে আমার অস্তিত্বে মিশে যাওয়া লোককথাগুলো আস্তে আস্তে নিস্পৃহ হতে থাকে।
অনেককাল আগে মোহনগঞ্জের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে একটি বই বেরিয়েছিলো- সেটি এখন বিলুপ্ত। একদল উদ্যোগী তরুণ আবার নতুন করে সেই কাজ শুরু করলেও আর্থিক সীমাবদ্ধতা এবং স্বার্থকেন্দ্রিক ব্যস্ততা সবাইকে আবার নিজ নিজ ঘরে ফেরত নিয়েছে। আমার দায়িত্ব ছিলো লেখাগুলোকে সাজানো, প্রুফ দেখা এবং পেজ মেকাপ করা।
সেই কাজ করতে গিয়েই চেপে রাখা বাতাসের মতো লোককথাগুলো সজোরে হানা দেয় আমার সমগ্র অস্তিত্বকে। আমি এই ভেবে স্বস্তিবোধ করি যে- নগরজীবন আমার শিকড় ধরে টান দিয়েছে, কিন্তু আমার অগোচরে কিছু কিছু খণ্ডিত শিকড় নগরজীবনকে ফাঁকি দিয়ে লম্বা এক শীতঘুম দিয়েছিলো আমারই ভেতর।
এই সিরিজের জন্য আমি ঋণী মোহনগঞ্জের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে যারা কাজ করেছেন তাদের প্রতি। এখানে আমি নিজের মতো করে লোককথাগুলো সংগ্রহ ও ব্যাখ্যা করেছি, বিশেষ করে নির্ভর করেছি আমার স্মৃতির ওপর। ছোটবেলায় যে ছড়াগুলো পড়তাম, বলতাম, খেলতাম- সেগুলো তো এসেছেই; তাছাড়া যে লোককথাগুলো সম্পর্কে আমি একেবারেই অবগত ছিলাম না সেগুলোর কিছু ধার নিয়েছি আমাদের মোহনগঞ্জ বইটি থেকে।
কিছু কিছু ছড়া-ধাঁধা-হেঁয়ালি বইতে একরকমভাবে রয়েছে, স্থানীয় মানুষজন ও আমি জানি আরেকরকমভাবে। সেগুলোর ক্ষেত্রে বইয়ের বদলে আমার স্মৃতি ও মানুষের মুখে শোনার ধরনটিকেই আমি গুরুত্ব দিয়েছি বেশি। তবে ব্যাখ্যা-টীকা পুরোপুরি আমার ব্যক্তিগত জানাশোনা, দৃষ্টিকোণ ও উপলব্ধি থেকে দেওয়া। এখানে আরেকটি কথা বলা দরকার। এই সিরিজে হয়তো এমনসব ছড়া-ধাঁধা বা হেঁয়ালির সন্ধান মিলবে যেগুলো হয়তো অন্য এলাকাতেও প্রচলিত।
থাকুক প্রচলিত, কোনো বাছবিছার ছাড়াই আমি মোহনগঞ্জে প্রচলিত সবগুলোকে তুলে আনতে চাই এই সিরিজে
আইলাম্বর আইলাম্বর
আইলাম্বর আইলাম্বর
আইলাম রে মোড়লের বাড়ি
পথ পাইলাম কলার ছড়ি
কলার ছড়ি লড়বড়
ও মোড়ল চোর ধর
চোর ধরতে টেহা পড়ে
ঝনঝনাইয়্যা টেহা পড়ে
উগলা টেহা পাইলাম গো
বাইন্যা বাড়িত গেলাম গো
বাইন্যা তর রূপার মালা
তর ঘরডা দেখতে বালা
ঘর বালা ঘর বালা
ঘর বালা গাড়ুনি
গিত্যাইন বালা রাঁধুনি
ও গিত্যাইন লড়চড়
আমায় দিবা কত ধন
আমি তো মাইগ্যা খাই
বাঘের নামে শিরনি চাই
বাঘ গেল নাগাইরপুর
কিইন্যা আনল চাম্পাফুল
চাম্পা গায়া পোলাইন রে
কী কী ধান নিছ রে
আপন ধান মাইগ্যা খাই
বাঘের নামে শিরনি চাই।
এছাড়া অনেকে বাইন্যা বাড়িত গেলাম গো-এর পরে বাকি লাইনগুলো না বলে নিচের লাইনগুলো বলে থাকে:
বাইন্যা বাড়িত টকইর বাসা
টকই টকই নলভাসা।
শব্দের অর্থ
১. আইলাম্বর = শব্দের অর্থ জানা নেই; সম্ভবত আসার ঘোষণা
২. আইলাম = এলাম
৩. লড়বড় = নড়বড়ে অবস্থা
৪. টেহা = টাকা
৫. উগলা = একটা
৬. বাইন্যা = ব্যবসায়ী
৭. বালা = ভালো
৮. গাড়ুনি = শব্দের অর্থ জানা নেই
৯. গিত্যাইন = একজনের নাম; গীতাকে এভাবে ডাকা হয় (নজমুল আলবাবের মতে গৃহিণী)
১০. মাইগ্যা= চেয়ে, ভিক্ষা করে
১১. নাগাইরপুর = নাগরপুর (টাঙ্গাইলের নাগরপুর কি?)
১২. কিইন্যা = কিনে
১৩. চাম্পাফুল = চম্পাফুল
১৪. গায়া = গ্রাম
১৫. টকইর = টুনটুনি পাখি
১৬. নলভাসা = যা জলে ভাসে
ব্যাখ্যা
লোককথা অনুসারে, মোহনগঞ্জ একসময় একদিকে সমুদ্র, একদিকে হাওর ও অন্যদিকে বনঘেরা একটি অঞ্চল ছিলো। বনে বিভিন্ন হিংস্র জীবজন্তু বাস করলেও সেগুলোর মধ্যে বাঘের আতঙ্ক ছিলো সবচাইতে বেশি। বর্তমানে সমুদ্র ও বন না থাকলেও হাওর আছে।
শুকনো মওসুমে এসব হাওরে রাখালরা গরু-ছাগল চড়াত, কিন্তু প্রায়ই বাঘের অত্যাচারে অনেক গরু-ছাগল মারা পড়তো। বাঘের উপদ্রব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রতি বছর ধান উঠার পর রাখালরা ‘বাঘাই শিরনি’র আয়োজন করে বাঘকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করতো যাতে বাঘের হাত থেকে গরু-ছাগল রক্ষা করা যায়। এই বাঘাই শিরনির উপকরণ সংগ্রহ করার সময় রাখালরা সুর করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে এই ছড়াটি পাঠ করতো।
সত্যিকার অর্থে এই ছড়াটির উৎপত্তি কীভাবে এবং এই ছড়ার পেছনের কাহিনীর মূলসূত্র বর্ষীয়ান অনেকের সাথে কথা বলেও জানা যায় নি। এই ছড়ার সাথে বাঘ তাড়ানোর সম্পর্ক কী- তাও বের করা সম্ভব হয় নি।
তবে মনে করা যায়- শিরনির উপাদান সংগ্রহ শুরু হতো মোড়লের বাড়ি থেকে এবং তারপর ব্যবসায়ীর বাড়ি হয়ে অন্যান্যদের কাছে যাওয়া হতো। ছড়ায় মোড়ল, ব্যবসায়ী ও অন্যান্য মানুষ- যার যার কাজের প্রকৃতি অনুসারে তাদের বাড়ি বা কাজের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া শিরনির জন্য মূলত ধান সংগ্রহ করতে গেলেও অনেকেই ধানের বদলে অন্য কিছু বা টাকাপয়সা দিতো। সেগুলো আবার বিনিময় করে রাখালরা শিরনির জন্য কেবল ধান, মশলা, পান ইত্যাদি সংগ্রহ করতো।
(প্রতি পর্বে এরকম কোনো ছড়া বা ধাঁধা বা হেঁয়ালি থাকবে।
তবে আগামী পর্ব থেকে ভূমিকাটুকু থাকছে না। )
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।