ছবিটির সাথে গল্পের নামকরণের কোনো মিল নেই। তা কিন্তু নিঃসন্দেহে বলে দেয়া যায়। তবে বিশ্বাস করুন গল্পের মিল আছে। ফুটে উঠবে। আশা রাখি শেষ পর্বে ফুটে উঠবে।
----------------------------------------------------------------------------
একটি বন্দুক। তার ভিতর তিনটি বুলেট। চকচকে কালচে রঙের বন্দুক। পুরণ সেকেলে টাইপ। এই সব বন্দুক রাজার আমলে ছিল হয়তো।
জহিরদের পরিবারের কেউ রাজা বাদশা ছিল কি না তা তো আর সে জানে না। তবে বংশক্রমে তা চলে এসেছে।
এই বন্দুক অবিস্কার সে কিছুদিন আগেই করেছে। আবিস্কারের ঘটনাটা বলা যাক।
জহির তার গ্রামের বাড়ি খুব একটা যায় না।
বাবা মা পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার পর তো আরও যাওয়া হয় না। এই কিছুদিন আগে সে বেড়াতে গিয়েছিল। গ্রামে আপন বলতে তেমন কেউই নেই জাহিরের। শুধুমাত্র আছে এক চাচা। তাও সেই চাচার সাথে তাদের খুব একটা ঘনিষ্ঠতা নেই।
তারপরও শহুরে ছেলে তার বউ বাচ্চা নিয়ে গ্রামে এসেছে তাই সেই চাচার আপ্যায়নের কোনো শেষ নেই। সেই চাচাকে জহির ডাকে রবি কাকু বলে। ওনার নাম আসলে রবিউল। সেই রবিউল হয়ে গেছে রবি। যা হোক।
তো, সে চাচা একদিন জহিরকে বলছিলেন, আমাদের বংশধররা রাজা বাদশার বংশধর আছিল বুঝলা বাবা।
জহির তখন মাথা নাড়ায়। আর একটু অবাক হয়েই বলে, তাই নাকি চাচা? বাবার কাছে তো কখনও শুনিনি।
- আরে, আমরা তো আর সেই ব্যাপরটা নিয়া ঘাটাই না। বুঝলা।
আমাদের মধ্যে কেউই কিন্তু চায় না, নিজেদের রাজা বাদশার বংশধর ব্যপারটা নিয়া গৌরব করতে।
জহির আবার আবাক হয়। এ আবার কেমন কথা! রাজা-বাদশার বংশধর হওয়া তো গৌরবের ব্যাপার। মানুষকে গৌরব করে বলাও যায়। এ কথাগুলো রবি কাকুকে বলে জহির।
রবি কাকুও ধমক দিয়ে বলেন, কি যে বলো তোমরা। রাজা বাদশারা তাদের প্রজাদের উপর যে পরিমাণ অত্যাচার করতো! সেই অত্যাচারের কথা লুকুচুরি করেও ইতিহাসে দাবিয়ে রাখতে পারেনি। নিজেকে ঐ অত্যাচারি বংশের লোক মনে হলেই তো ঘিন্না করে।
জহির এরপর হেসে ওঠে। কাকু, অত্যাচার যে করেছে সে খারাপ।
তবে এ কথা তো সত্য যে মানুষই তাদের সেই ক্ষমতায় বসিয়েছে। আর মানুষতো তাদের মানতও। সুতরাং তাদের কর্মে আমরা কেনো অপরাধী হবো।
রবিউল এবার একটু চুপ যান। তিনি আসতে আসতে হাটেন আর কথা বাড়ান।
জহির এবার ঘটনাটা একটু ডিটেইলে যায়। বলে, রবি কাকু, তার আগে আমার একটা প্রশ্নের জবাব দেন। আপনি বলছেন, আমরা রাজা-বাদশার বংশধর। তাহলে রাজপ্রাসাদ কোথায়। রাজপ্রসাদ তো নেই।
তাহলে কিসের উপর ভিত্তি করে আপনি একথা বলছেন।
- কথাটা তুমি বাবা ভুল বলো নাই। তবে সত্যি কথা বলতে কি, রাজাবাদশাও আসলে বলা চলে না। বলা চলে, আমাদের পূর্বসূরিরা ছিল জমিদার। অঢেল জমির মালিক ছিল তারা।
লোকমুখে কিন্তু এখনও অনেকে এই কথা বলেন, এই গ্রামের অধিকাংশ জমি আমাদেরই ছিল। আর রাজপ্রাসাদ আসলে যে কোথায় তা আমরাও জানি না। হয়তো মানুষের অভিশাপে সমস্ত কিছু কালগর্ভে হারিয়ে গেছে। তবে এটা আমি নিশ্চিত যে আমার পূর্বসূরি রাজাবাদশা মানে জমিদার ছিল।
জহির এবার একটু ভাবনায় মগ্ন হয়।
শহুরে পরিবেশে অত্যাধুনিক পরিবারের ছেলে সে। তার বাবা একজন সরকারী কর্মকর্তা ছিলেন। নামকরা সরকারি কর্মকর্তা। সেই পরিবারের ছেলের গ্রাম বাংলার ইতিহাস তেমন একটা না জানাটাই স্বাভাবিক। যা জানে তা বই-পুস্তক থেকে।
তার বাবাও খুব একটা গ্রাম নিয়ে কথা বলতো না।
আর তাছাড়া জমিদার কিংবা রাজারা একসময় প্রজাদের উপর অত্যাচার করতো তা সকলেই জানে।
তাই জহির এবার মনে মনে ভাবে, হয়তো বাবা এই কারণেই খুব একটা গ্রাম ঘেষা ছিল না। গ্রামে আসলে হয়তো সেই অতিত তাকে তাড়িয়ে বেড়াতো। তাই হয়তো বাবা গ্রামকে এড়িয়ে চলতো।
তারপরও মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বাবা বলতো, ইস আমার গ্রাম বদরপুর। কত্ত সুন্দর সবুজে ঘেরা। গ্রামের মানুষ কত্ত আবেগী। এই আবেগী মানুষ এই স্বার্থে ঘেরা শহরে পাওয়া ভাগ্যের ব্যপার।
গ্রামের কেউ যদি কখনও তাদের বাড়ি আসতো তবেই তার বাবা ব্যস্ত হয়ে যেতো তাকে অপ্যায়ন করার কাজে।
গ্রামের অনেকেই প্রায়ই তাদের বাসায় যেতো। আর তখনই তিনি অত্যন্ত অমায়িক ব্যবহার দিয়ে তাদের সকলকে মুগ্ধ করে দিতেন। গ্রামের লোকটি যে পর্যায়েরই হোক না কেনো! হোক না সে কৃষক! তাতে কি! তার আসল পরিচয় সে বদরপুরের লোক। ব্যাপারটা অনেকটা এমনই।
এসব ভাবতে গিয়েই জহিরের মনে একটু খটকা লাগে।
সে ভাবে, যে লোকটা সব সময় গ্রাম থেকে দূরে দূরে থেকেছে সে কেন শুধু শুধু গ্রামের লোক পেলে এতো অস্থির হয়ে উঠতো।
এই উত্তেজনাটা জহির চাপিয়ে রাখতে পারলো না। সে তার রবি কাকুকে প্রশ্ন করে, কাকু, তা না হয় বুঝলাম যে আমরা জমিদার বংশের লোক। কিন্তু তারপরও একটা চিহ্ন তো থাকবে। এমন কিছুই কি অবশিষ্ট নেই?
রবিউল এবার হাসে।
রহস্যে ঘেরা একটি হাসি। জহির তার মানেও বুঝতে পারে না।
তারা তো হাটছিল। হঠাৎ রবিউল থেমে যায়। থেমে যাওয়ার পর বলে, এ জায়গাটার নাম জানো জহির?
জহির না সূচক মাথা নাড়ে।
আর তাছাড়া সে এই ব্যাপারে কোনো আগ্রহও দেখায় না। সে মগ্ন আছে তার চিন্তায়। সে মগ্ন আছে জমিদারিত্ব নিয়ে। জমিদারদের বংশধর। এতো আর ছেলেখেলা ব্যাপার নয়।
অনেক বড় একটা বিষয়। শতবছরের ইতিহাস তার বংশেই ঘটেছে! এই বিষয়টা নিয়ে সে খুবই উত্তেজিত। আগ্রহ-কৌতুহল।
রবিউল আবার তাকে বলে, কি বাবা, আগ্রহ পেলে না। তাই তো?
জহির এবার চুপ করে থাকে।
রবিউল বলে, এই জায়গাটার নাম হচ্ছে নর্তক হাট। আর নর্তক শব্দটা কোথা থেকে এসেছে বুঝেছো তো? এসেছে নর্তকী থেকে।
এইবার জহির একটু আগ্রহ পেলো। নর্তকী। জমিদারদের আয়েশের অন্যতম উপাদান নর্তকী।
এই নর্তকীদের নিয়ে ইতিহাসে অনেক গুজব আছে। আসলে গুজবও বলা যায় না। বলা যায়, ইতিহাসে তাদের সাথে রাজা কিংবা জমিদারদের সাথে অবৈধ সম্পর্কের অনেক প্রমাণও আছে।
যা হোক। রবিউলকে জহির প্রশ্ন করে, এই নর্তক নাম দেয়ার কারণ কি।
রবিউল আবার হাসে। বলে, তুমিই তো প্রমাণ চাইলে। অবশিষ্ট কিছু। এই যে। নর্তক।
এটাই তো প্রমাণ। কি মনে হয় তোমার?
জহির চুপ করে থাকে। প্রমাণ কি করে হলো। প্রশ্নও করে সে।
এরপর রবিউল তাকে ইতিহাসের পাতায় ঢোকায়।
- শোনো বাবা। এই জায়গায় নর্তকীদের বাড়ি ছিল। এই জায়গা থেকে জমিদার বাড়িতে নর্তকীদের নিয়ে যাওয়া হতো। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে, এই বাড়ির মানুষ জন্মসূত্রেই নর্তকী। তার মা নর্তকী।
তাই তো কন্যা সন্তানটাও নর্তকী। মজার ব্যাপার হচ্ছে, রাজমহলের ভিতরে অর্থাৎ জমিদারের স্ত্রীর পুত্র সন্তান হওয়া অনেকটা বাধ্যতামূলক ছিল। না হলে, দ্বিতীয় বিয়ে। ঠিক তেমনি নর্তকীদের গর্ভে কন্যা সন্তান হওয়াটা অনেকটা বাধ্যতামূলক ছিল। তা না হলে প্রাণ যাবে।
বংশক্রমে নর্তকী তৈরী করতে হবে। তা না হলে রাজা বাদশার আয়েশের উপাদান আবার জোগাড় করবে কি করে। তাদের অত্যাচারের বর্ণনা শুনলে তুমি শিউরে উঠবে। যেমন, একবার এক জমিদারের ছেলের খায়েশ হলো, মায়ের গর্ভে কি করে সন্তান থাকে তা সে নিজ চোখে দেখবে। জমিদারের পূত্র বলে কথা।
বলেছে মাত্রই তাকে দেখাতে হবে। জমিদারও নির্দেশ দিলো, গর্ভবতী মহিলাকে নিয়ে আসা হোক। পেয়াদারা লেগে গেলো পুরো গ্রামে গর্ভবতী মহিলা খোজার তালে। এক ঘন্টার মধ্যে নিয়ে আসা হলো গর্ভবতী মহিলা। জমিদারের ছেলের সামনে সেই মহিলার পেট তলোয়ার দিয়ে কাটা হলো।
কেটে দেখা হলো গর্ভাবস্থায় এক শিশুর অবস্থান কেমন হয়।
চিন্তা করতে পারো? কতটা ভয়াবহ? একটা মানুষের পেট জীবন্ত অবস্থায় কেটে ফেলা হলো। একটি নির্দোষ মানুষকে হত্যা করাতো হলোই সাথে সেই শিশুটি হত্যা হলো যে কিনা এই পৃথিবী দেখতেই পেলো না। আর সেই হত্যা কেনো হলো? এক মাত্র তাদের কৌতুহল মেটানোর জন্য। সেই রক্তের ছিটা যে তাদের গায়ে লেগেছে সেই রক্তের অভিশাপ কি আমাদের তাড়িয়ে বেড়ায় না?
রবিউল যেনো খুব ইমোশনাল হয়ে যাচ্ছে।
এই ভয়াবহ বিষয়টা বলার সময় সে রীতিমত কাঁপছিল।
যাইহোক, রবিউল আবার বলতে শুরু করলো, জমিদারদের নর্তকীদের বিষয়টা ছিল আরও ভয়াবহ। এই জমিদারদের নর্তকীদের ভোগ করতো তারাই। হয়তো, সেই নর্তকীর পেটে জমিদারেরই সন্তান। আবার সেই সন্তানকে হয়তো সে নিজেই ভোগ করছে।
বৃদ্ধ জমিদার হয়তো নিজ কন্যার সাথেই বিছানায় শুয়েছে। অথবা জমিদারের অবৈধ কন্যা সন্তান নর্তকী হয়েছে। আর জমিদারের দায়িত্ব পেয়েছে জমিদারের বৈধ ছেলে। সেই ছেলেও হয়তো নিজের বোনের সাথে অনৈতিক কাজে লিপ্ত হচ্ছে।
পাপ।
একের পর এক পাপ তারা করে বেড়িয়েছে। ভয়াবহ পাপ। সেই পাপ কি এ প্রকৃতি ভুলে গেছে ভেবেছো? না ভুলে নি। প্রকৃতি এখনও ভুলেনি। এখনও নির্যাতিত প্রজাদের কান্না বাতাসে পাওয়া যায়।
তোমাকে কি সাধেই বলেছি, অভিশাপ সব কিছু ধ্বংস করে গেছে। আর এই নর্তক হাটটা কিন্তু নর্তকীদের উত্তরসূরিদেরই করা। তারা এখন এই গ্রামের সব চাইতে প্রতিষ্ঠিত বংশ। তাদের যাতাকলেই এখন গ্রাম পিষ্ঠ। নর্তক ঘরের লোকজন শহরে- বিদেশে প্রতিষ্ঠিত।
তার মানেটা এখন বুঝতে পারছো? প্রকৃতি ওদের সম্ভ্রম দিয়েছে আর আমাদের মাটিতে মিশিয়েছে। এগুলোই হচ্ছে প্রমাণ। বুঝলা বাবা। এর চেয়ে আর বড় প্রমাণ কি চাও?
জহির এবার চুপ করে থাকে। অবাক হয়ে মুখটা হা করে উ™£ান্তের মত চিন্তায় মগ্ন হয়ে যায়।
জহির মানতে পারে না এ অত্যাচারের কথা। নির্মম ওরা। একটি মানুষের পেট কেটে দেয় একমাত্র কৌতুহল মেটানোর জন্য। কি অদ্ভদ এ পৃথিবী। কি নির্মম!!
চলবে......
[পরবর্তী পর্বই শেষ পর্ব।
কথা দিচ্ছি। বন্দুকের আসল গল্পটা শেষ পর্বেই বলবো। ]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।