ডুবোজ্বর
আমাদের জন্ম এক অর্ধমিথ্যা কুসুমকুমারের ঘুমহীন মাথার ভিতর। আমাদের জ্যামিতির একটি স্যার আছে। আমাদের বুড়োর বাগান আছে। আমাদের আম, জাম, লিচু, পেয়ারা, কমলা, নাশপাতি, কলা, কদুলিবন ইত্যাদি আছে। আমাদের সে আছে সুতোচুর থালাবাসন, মলিন রেকাব।
আমরা চপল এবং হিরণ্ময় দ্যুতি নিয়ে ঘুরে বেড়াই। আমাদের পরনে ইশকুলের শাদা জামাজোড়া ভাঁজতোলা। শাদাজামায় জামের রস। দুইজায়গায় দাগ। আর আমাদের কুসুমকুমার নির্ঘুম আনন্দগান।
আমাদের নতুন জ্যামিতি স্যার এলো শ্রেণিঘরে। আমরা মাঝে মাঝে ভুল করে লিখি নবমশ্র্রোণি। স্যার চিল্লায়, শ্রোণি মানে কী জানো?
আমরা ফিক করে হেসে ফেলি, কী স্যার?
স্যার হাদার মতো তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে, জ্যামিতি বইয়ের নবমপৃষ্ঠা খোলো।
আমরা একে একে গিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডে একটা করে ত্রিভুজ এঁকে দিয়ে বেরিয়ে যাই।
ক্লাসে স্যার দাঁড়াতে দাঁড়াতে বসে যায়।
স্যার জ্যামিতিতে কাঁচা।
আমরা বুড়োর বাগানে ঢুকে পড়ি।
কে লো?
তুমি এখনো মরো নাই বুড়ো?
মুই মলে তো তোরা সব লুতেপুতে খাবি লে ছালি...
বুড়ো ছড়িহাতে আমগাছের ডালে বসে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। আমরা বাগানের আম, জাম, কলা, কলাপাতা ইত্যাদি খেয়ে বেরিয়ে পড়ি।
আমরা ভূতে বিশ্বাস করি না।
বাজারে দুইটা ঢেউটিনের বাগান আছে। আমরা বাজারে গিয়ে টিনের বাগান তছনছ করি। দুইহাতে বাজাই আর আটহাতে টিন কাটি। টিনবাগানের পাশেই কাচের আড়ত।
আমরা আড়তে ঢুকি। আমাদের প্রত্যেকের আঙুলই তখন হিরের ক্ষুর। তারপর আমরা অফিস, বাড়ি, জাদুঘর সবখানে ঢুকে জানলার কাচগুলি ফালি ফালি করে কেটে দিই। আমাদের আনন্দ হয়।
আমরা জানতাম একটা কাচকাটা ক্ষুরের দাম একশোবাষট্টি টাকা নব্বইপয়সা।
আমরা একটা কালীমন্দিরে ঢুকে পড়ি। মায়ের পাথরের লকলকে জিব ধরে টানাটানি করি। নরমুণ্ডে আদর বুলাই, বুকে চেপে ধরি। আমাদের বুক ক্রমশ স্ফীত হয়। টনটন করে।
মা হাসে। তার হাসিতে নৈঃশব্দ্য ছাড়া কিছুই ঝরে না। আমরা এদিক-ওদিক তাকাই। রাস্তায় পাড়ায় কাউকে চোখে লাগে না। আমরা সর্ন্তপনে দরজা লাগাই।
জানলা লাগাই। সব মোমবাতিগুলি সব জ্বালিয়ে দিই। পিলসুজের নিচে ভয়ানক অ›ধকার জ্বলতে থাকে। আমরা ডরাই না।
আমাদের সাথে সে আছে।
মোমের আলোয় তার কাঁধের দিকে আমাদের সকলের চোখ যায়। কাঁধে তার জ্বলজ্বল করছে কাঁচুলির ফিতা। আমার মজা পাই। সে বুঝতে পারে। কেমন করে তাকায়।
আমরা তার জামা ধরে টানা-টানি করি। একে একে তার সব জামা ছিঁড়ে ফেলি মহান উল্লাসে। সে দুহাতে তার চিহ্ন আড়াল করে নতমুখে বসে থাকে। তার বুক থেকে গড়িয়ে পড়ে একজোড়া কমলা। আমরা অবাক হই না।
আমরা প্রত্যেকে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হিহিহিহিহিহি করে হাসি। কমলা দুইটা খুলে খেতে খেতে বেরিয়ে আসি।
ইশকুলের ক্লাসে সে আর আমাদের সাথে বসে না। আমাদের সে ছেলেদের সাথে বসে। মৌলবি স্যারের ক্লাসে মাথায় টুপি পরে বসে থাকে।
মৌলবি স্যার বলে, তুই কি নতুন আইছস? নাকি কেলাস করস নাই।
সে নতমুখে কাঁপতে থাকে। কিছু বলে না।
হিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহি আমরা হাসি। মৌলবি স্যার আমাদের দাঁড় করায়।
আমরা দাঁড়িয়ে বলি, হুজুরে কি দাড়িতে মেহেন্দি দিছেন? সোন্দর লাগে হিহিহিহিহিহিহিহি...
মৌলবি স্যার রাগে কাঁপতে থাকে কিছু বলে না, ইশারায় আমাদের বেঞ্চে দাঁড়াতে বলে। আমরা দাঁড়াই আর কিছু বলি না তবে আমাদের হাসি বাড়তে থাকে হিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহি...
মৌলবি স্যার আমাদের হাই বেঞ্চে দাঁড় করায়
হিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহি...
পাঁচ কলমা ক
হিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহি...
তিনি আমাদের পিঠে দুইটা বেত ভাঙেন। আমাদের হাসি বাড়তে থাকে। তিনি দৌড়ে অফিসে গিয়ে আরো পাঁচটা বেত নিয়ে আসেন।
হিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহিহি...
তিনি পাঁচটা বেত আমাদের পিঠে ভাঙেন।
আমাদের শাদাপিঠ লালপদ্ম হয়ে ফোটে। আমরা হাসতে থাকি।
ঢং ঢং ঢং ঘণ্টা পড়ে। তিনি রাগে কাঁপতে কাঁপতে হিস্টিরিয়াগ্রস্থের মতো বেরিয়ে যান। আমরা হাসতে হাসতে দেখি-- আমাদের সে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
তার চোখে পৃথিবীর সমস্ত বর্ষা এসে ছাপিয়ে পড়ছে। আমরা অবাক হই। আমাদের হাসি থেমে যায়।
আমাদের শহরতলিতে একপাল জানোয়ার নেমে আসে। বুড়োর বাগানের আনারস সব করাত দিয়ে কাটে।
ভূতটাকে একটা বোতলে ভরে এগারোহাত মাটির তলায় পুতে ফেলে। আমাদের ইশকুলে ঢুকে পড়ে। বাথরুম নোংরা করে। লাইব্রেরিতে ঢুকে বইপত্র ছিঁড়ে ফেলে। আমাদের মৌলবি স্যার আর জ্যামিতি স্যারকে ধরে নিয়ে যায়।
দুইদিন আটকে রাখে। তারপর খোজা বানিয়ে ঝুলিয়ে রাখে। তারপর এক বিষুদবারের হাটে কেজি দরে বিক্রি করে দেয়।
আমরা হাসতে গিয়ে মনখারাপ করে বাড়ি ফিরি।
আমরা পলাশবনে, অশোকবনে, কৃষ্ণচূড়ার বনে, শিমুল আর পারিজাতের বনে গাছের মাথায় আগুন ধরিয়ে দিই।
জানোয়ারগুলি মনে করে বুঝি বসন্ত। তারা বনের দিকে ছুটে যায়। গাছে চড়ে ফুল পাড়তে গেলে তাদের নখ আর লোম পুড়ে যায়। তাদের চোখে ছানি পড়ে। তারা জান্তব চিৎকার করে গাছ থেকে খসে পড়ে।
এবং আমাদের পাড়ার দিকে আসতে থাকে। আমরা তাকিয়ে থাকি। কিন্তু আমরা ডরাই না।
জানোয়ারগুলি আমাদের পাড়ায় ঢুকে পড়ে। আর যখন আমাদের ফুফু এবং খালাদের পা ধরে টানে আমাদের মাথায় রক্ত উঠে যায়।
আমরা ইশকুলের ধারের রক্তজবার ঝাড়ে লুকিয়ে পড়ি। এবং গুলতি দিয়ে জানোয়ারগুলির চোখে ধুতুরার বিষমাখা মার্বেল ছুঁড়ে মারি। অচিরেই জানোয়ারগুলি চোখ হারায়। আমরা জানোয়ারগুলিকে নিয়ে খেলি। খেজুরের কাঁটা দিয়ে চারপাশ থেকে খোঁচাই।
বেতের কাঁটা দিয়ে করাতের মতো কাটি। জানোয়ারগুলি আক্রোশে তড়পায়। আমাদের দেখতে পায় না বলে কিছু করতে পারে না। আমরা ঘর থেকে বটি নিয়ে আসি। জানোয়ারগুলির সামনের লেজসমস্ত কেটে দিই।
তারপর পিটিয়ে মেরে ফেলি। এবং ফালি ফালি করে কাটি। কেটে রান্না করি। ভোজসভা চলে দুইদিন ধরে। শহরতলির লোকজন বাসমতি চালের রুটি দিয়ে সেই মাংস মহা আনন্দে কব্জি ডুবিয়ে খায়।
আমরা হাসি। আমাদের সে আমাদের পাশে এসে দাঁড়ায়। সেও হাসে হা হা হা হা হাহাহাহাহা...
আমরা সব একসাথে থাকি। একই শয্যাবাস। পরস্পরের চুল বেঁধে দিই।
নখ কেটে দিই। খাইয়ে দিই। কাপড় কেচে দিই। ত্বকে হলুদ লাগিয়ে দিই। চুলে আমলকি, মেথি ও মেহেদি লাগিয়ে দিই।
চোখে কাজল টেনে দিই ইত্যাদি। আমরা পরস্পরকে রক্তের ভিতর টের পাই। আর রক্তের ভিতর টের পাই আমাদের তাকে।
আমাদের সে আমাদের সাথে থাকে না। তবে সে আসে কোনো কোনো দিন বৃষ্টির ভিতর।
আমরা তাকে দিই এলাচির বন। সে এলাচির বোঁটায় মুখ রেখে পাগল হয়ে যায়। ঘ্রাণের উৎস খুঁজে বেড়ায় উন্মাতাল। আমরা তাকে আমাদের সমুদ্রে নিয়ে যাই। আমরা তাকে আমাদের নদীতে নিয়ে যাই।
সে নুনের ঘ্রাণ শুকে পাগল, সে পলিমাটির নির্যাসে পাগল। সে তরলমেঘের আস্বাদে পাগল। আমরা তাকে মুঠোর ভিতর দিই মখমল মেঘ। সে মুঠো খুলে পাগলের মতো মুখে নেয়। আমরা তাকে আঙুলের ফাঁকে গুজে দিই শঙ্খের রাত।
দুআঙুলে তুলে সে তা ওষ্ঠাধরে নেয়। আমাদের শঙ্খ ক্রমে সূর্যকে ম্লান করে দেয়। আমরা তাকে দিই ঝিনুকপাখি। সে দংশনে তাকে মুক্তো বানায়।
একদিন আমারা দ্বিগুণ হয়ে উঠি।
বছরের পর বছর কেটে যায়। আমরা রক্তজবার ঝাড়ে মিনার হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। আমাদের তারা ইশকুলে যায়। জ্যামিতির নতুন স্যার আসে। আমাদের জানতে ইচ্ছে করে-- আমাদের তারা জ্যামিতির ক্লাসে কী করে।
আমরা চুপিচাপ প্রজাপতি হয়ে উড়ে ক্লাসে ঢুকে পড়ি, আমাদের তাদের জ্যামিতি বইয়ের নবমপৃষ্ঠায় ঢুকে ত্রিভূজ আর ট্রাপিজিয়াম হয়ে যাই। পৃষ্ঠা ফাঁক করে স্যারের দিকে তাকাই। জ্যামিতি স্যারকে দেখে অবাক-বিস্ময়ে মাছ হয়ে যাই।
আমাদের তারা আমাদের মতোই যথারীতি হিহি করে। খাতাতে লিখে রাখে নবমশ্রোণি।
জ্যামিতি স্যার খেয়াল করে। তাদের দাঁড় করায়।
কী লিখেছো? দেখাও।
তারা খাতা এগিয়ে দেয়।
শ্রোণি মানে কী জানো?
আমাদের তারা হিহি করে হাসে, কী স্যার?
জ্যামিতি স্যার শ্রোণি কী, কী কাজ বিস্তারিত বলতে থাকে তাদের চোখের ভিতর তাকিয়ে।
তারা লজ্জায় চোখ নামায়।
জ্যামিতি স্যার বলে, আসো এইবার একটা করে ত্রিভূজ আঁকো।
জ্যামিতি স্যার দাঁড়িয়ে থাকেন। দাঁড়িয়েই থাকেন। ঘণ্টা পড়ে।
তিনি দাঁড়িয়ে...
আমাদের তারা স্যারের দিকে তাকিয়ে পাথর হয়ে যায়।
ঘোর কেটে গেলে আমরা সমুখে আমাদের সেই অর্ধমিথ্যা কুসুমকুমারকে দেখি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।