আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঝাড়খণ্ডে মাওবাদী



ঝাড়খণ্ডে মাওবাদীদের প্রধান কাজ বন্দুকের মুখে তোলা আদায় আতঙ্ক আর ভয়, মাওবাদের প্রতিশব্দ ঝাড়খণ্ডে। রাজ্যে এখন রাষ্ট্রপতি শাসন। পাশাপাশি একটি সমান্তরাল বন্দুকের শাসনও কায়েম করেছে লালগড়ের কিষেণজীর বাহিনী। রাজ্যের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলি বর্তমানে মাওবাদী উগ্রপন্থীদের তল্পিবাহকে পরিণত হয়েছে। দুর্নীতির শিকড় প্রথিত প্রশাসনের রন্ধ্রে, রন্ধ্রে।

আর এই সুযোগ ব্যবহার করছে মাওবাদীরা। রাজ্যে জাঁকিয়ে বসেছে সন্ত্রাসের আবহ। প্রভাবিত জনজীবন। বিপর্যস্ত ব্যবসা-বাণিজ্য। নয়ের দশকের শুরুতে রাঁচি দাপিয়ে বেড়াতো সুরেন্দ্র ও অনিল শর্মা নামের দুই দুষ্কৃতী।

শহর দখল করেছিলো ত্রাসের রাজত্ব। সূর্য অস্ত গেলে মানুষ বাড়ির বাইরে বেরোতে ভয় পেতো। সন্ধ্যায় থমকে যেতো শহরের হৃদ্‌স্পন্দন। ঝাড়খণ্ডে এখন মাওবাদীদের বাড়তে থাকা দৌরাত্ম্য, রাঁচির মানুষের মনে ৯০-এর দশকের সেই ত্রাসের অধ্যায়ের স্মৃতিকেই উসকে দিচ্ছে। ‘এখনকার মাওবাদী সন্ত্রাস আমাকে অনিল ও সুরেন্দ্রদের কথাই মনে করিয়ে দেয়।

তখন রাতের রাঁচি উপভোগ করতে পারতো না শহরের আম-জনতা। সন্ধ্যা ৭টা মানেই ঘরের চার দেওয়ালের নিরাপত্তা’, জানালেন ঝাড়খণ্ড ক্ষুদ্র কুটির শিল্প সঙ্ঘ (জে এস আই এ)-এর সভাপতি বিকাশ সিং। রাঁচির এই শিল্পপতি আক্ষেপ প্রকাশ করলেন রাজ্যের হালহকিকৎ নিয়েও। তিনি খেদের সঙ্গেই বললেন, সদ্যসমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনে প্রচারের সময় রাজ্যের কোন রাজনৈতিক দল মাওবাদের সমস্যার কথা একবারের জন্যও তোলেনি। বোঝাই যাচ্ছে, কোন রাজনৈতিক দলই মাওবাদী উগ্রপন্থীদের চটাতে চায় না।

এদিকে মাওবাদী সন্ত্রাসের কারণে রাজ্যের বেহাল অর্থনীতি আরো তলিয়ে যাচ্ছে। মার খাচ্ছে ছোট-বড় ব্যবসাও। সেন্ট্রাল কোলফিল্ডস লিমিটেড (সি সি এল)-এর এক উচ্চপদস্থ কর্তা জানিয়েছেন ভয়াবহ তথ্য। ২০০৮সালে মাওবাদী উগ্রপন্থার দাপটে ৮৮দিন ঝাড়খণ্ডে পণ্যবাহী ট্রাক চলাচল করেনি। এর প্রত্যক্ষ কারণে রাজ্যে বন্ধ হয়ে যায় উৎপাদনের কাজ।

ক্ষতিগ্রস্ত হয় ঝাড়খণ্ডের উদীয়মান শিল্পজগৎ। রাজ্যের সবকটি জাতীয় সড়কে ট্রাক চলাচল বাধার সম্মুখীন হয়েছে মাওবাদী সন্ত্রাসের কারণে। কেননা দক্ষিণ ভারতে যেখানে দৈনিক একটি ট্রাক গড়ে ৩৫০ কিলোমিটার থেকে ৪৫০ কিলোমিটার যাতায়াত করে, সেখানে ঝাড়খণ্ডে একটি ট্রাক ১২৫কিলোমিটার থেকে ২০০কিলোমিটারের বেশি পথ চলাচল করতে পারে না। ‘গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড এবং পাটনা-রাঁচি-জামসেদপুর ৩৩নম্বর জাতীয় সড়ক ছাড়া, রাজ্যের আর কোন রাজপথেই নির্ভয়ে ট্রাক চালানোর উপায় নেই। মাওবাদীদের ভয়ে গরিব ট্রাকচালকরা সূর্য ডোবার পর গাড়ি চালানোর বিষয়ে কোনমতেই রাজি হতে চান না ’, জানালেন ঝাড়খণ্ড ট্রাক ওনার অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য উদয়শঙ্কর ওঝা।

ঝাড়খণ্ডে রোজ ৩৫হাজার থেকে ৪০হাজার ট্রাক চলাচল করে। রাজ্য থেকে প্রতিবেশী রাজ্যে পাড়ি দেয় প্রায় ১০হাজার থেকে ১৫হাজার ট্রাক। এই ট্রাকগুলির সিংহভাগই বিভিন্ন কারখানার জন্য খনিজ আকরিক এবং কয়লা পরিবহন করে। এই ছোট্ট পরিসংখ্যান থেকেই আন্দাজ করা যায় ঝাড়খণ্ডের শিল্পজগৎ ট্রাক পরিষেবার ওপরে ঠিক কতটা নির্ভর করে। প্রসঙ্গত, রাজধানী রাঁচি থেকে অন্যরাজ্যে যাওয়ার জন্য ছ’টি জাতীয় সড়ক থাকলেও, রাঁচি-জামসেদপুর ৩৩নম্বর জাতীয় সড়ক ছাড়া অন্য কোন জাতীয় সড়কে ট্রাকচালকরা রাতে গাড়ি চালাতে ভয় পান।

সন্ধ্যে হলেই কোন ট্রাকচালক গুমলা যেতে চাননা। এই জেলা থেকেই সড়কপথে পার্শ্ববর্তী ছত্তিশগড়, মহারাষ্ট্র ও গুজরাট যাওয়া যায়। মাওবাদী উগ্রপন্থীদের ভয়ে দিনের বেলাতেই অনেক সময় ডালটনগঞ্জমুখী হতে চান না ট্রাকচালকরা। ২৪ঘণ্টার মধ্যে ১২ঘণ্টা ট্রাক পরিষেবা থমকে যায়। মাওবাদী সন্ত্রাসের পরোক্ষ কারণে প্রত্যহই নষ্ট হয় শ্রমদিবস।

বর্তমানে ঝাড়খন্ডের ২৪টি জেলার মধ্যে ১৮টি জেলাতেই নিজেদের খতমের রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত করতে সফল হয়েছে মাওবাদীরা। ছাতরা এবং লাতেহারে মাওবাদীরা কার্যত একটি সমান্তরাল প্রশাসন খাড়া করেছে। গত চার মাসে ঝাড়খণ্ডে মাওবাদীরা ১৬বার বন্‌ধের ডাক দিয়েছিলো। ভয়ে সব বন্‌ধই সফল হয়ে যায়। কেন্দ্রের একটি গোয়েন্দা সংস্থা জানিয়েছে চমকপ্রদ তথ্য।

ঝাড়খণ্ডে মাওবাদীরা রাষ্ট্রযন্ত্র ভাঙার লক্ষ্যে ‘লেভি’ নেওয়ার অছিলায় কোটি কোটি টাকা লুঠপাট করে। বিভিন্ন সময়ে রাজ্যে সন্ত্রাস-বিরোধী অভিযানের প্রাক্কালে বাজেয়াপ্ত মাওবাদী নথিপত্রে এর প্রমাণ পাওয়া গেছে। শুধুমাত্র ঠিকাদারই নয়, উগ্রপন্থার তহবিলে অর্থ যোগান বিভিন্ন জাতীয় স্তরের শিল্পপতি, খনির ও বনাঞ্চলের ঠিকাদাররা। সমাজ পরিবর্তনের নামে চলে অপহরণের অপরাধী রাজনীতি। মুক্তিপণ বাবদ মাওবাদীরা মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে।

উল্লেখ্য, ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগড়, অন্দ্রপ্রদেশ, ওড়িশা, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ এবং মহারাষ্ট্রের ‘রেড করিডোর’-কে তোলা আদায়ের এই কাজে ব্যবহার করা হয়। দেখা গেছে এই ‘রেড করিডোর’ থেকে বছরে প্রায় ১হাজার ৫০০কোটি টাকার তোলা তোলে মাওবাদীরা। রাঁচি জেলার সিলি, তামার, রাঙামাটি প্রভৃতি এলাকায় রাস্তার উন্নয়নের ঠিকাদার, ছোট ব্যবসায়ীদের থেকে লেভির নামে নিয়মিত টাকা তোলে। মাওবাদীরা সন্ত্রাসের কাজে হতদরিদ্র আদিবাসী পরিবারের অল্পবয়সী ছেলে-মেয়েদের টেনে আনে। অনেক সময় ১৪বছরের ছেলেদের হাতেও এ কে ৪৭ তুলে দেয় মাওবাদীরা।

এছাড়া ডালটনগঞ্জ, সহেবগঞ্জ, লিটিপাড়া, বোকারোসহ রাজ্যের আরো বিভিন্ন এলাকায় উগ্রপন্থার কাজে কিশোরীদেরও ব্যবহার করা হচ্ছে। মাওবাদীরা রাজ্যে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় দ্রুত চলাচল করার দক্ষতা অর্জন করেছে। অনেক সময় নিরাপত্তারক্ষীদের চোখে ফাঁকি দিতে মাওবাদীরা পার্শ্ববর্তী রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও ওড়িশার মতো রাজ্যে আশ্রয় নেয়। এই কাজে প্রতিবেশী রাজ্যগুলির প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলি মাওবাদী উগ্রপন্থীদের নিজেদের কায়েমি স্বার্থ রক্ষার করার স্বার্থেই আশ্রয় দিচ্ছে। অন্যদিকে তোলা আদায়ের টাকা থেকে মাওবাদীরা প্রচুর আধুনিক অস্ত্র কিনেছে।

এর মধ্যে একদিকে যেমন নানারকমের মাইন রয়েছে, ঠিক তেমনই সন্ত্রাসবাদীদের হাতে এসেছে বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র। রাজ্যে নিরাপত্তারক্ষীরা মাওবাদীদের ডেরায় তল্লাশি চালানোর সময় মর্টার, বিভিন্ন ক্ষমতার রাসায়নিক বিস্ফোরক, গোলাবারুদ এবং অস্ত্র তৈরির কারখানার সন্ধান পেয়েছে। একটি গোয়েন্দা রিপোর্টে জানা গেছে, মাওবাদীদের হাতে গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম-সক্ষম সর্বাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর যন্ত্রও রয়েছে। উল্লেখ্য, এই যন্ত্রটির সাহায্যে মাওবাদীরা সহজেই পুলিস এবং নিরাপত্তাবাহিনীর গতিবিধি সম্বন্ধে আগাম খবর পেতে সক্ষম হয়। নিরাপত্তারক্ষীদের চলাচলের পথে মাটির নিচে মাইন রেখে দেয় উগ্রপন্থীরা।

পুলিস ফাঁড়ি এবং থানায় মাওবাদী আক্রমণ নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। ঝাড়খন্ডে অধিকাংশ জাতীয় সড়কেই রাতে ভ্রাম্যমাণ পুলিসী টহলদারির কাজও লাটে উঠেছে। দেখা গেছে মাওবাদীরা যখন যে এলাকায় থাকে, তখন সেই এলাকায় সমাজে সংখ্যাগুরু মানুষের মধ্যে প্রচলিত নাম ও পদবি গ্রহণ করে। একইসঙ্গে সাধারণ মানুষের মধ্যে সম্ভ্রম উদ্রেক করার জন্য নিজেদের নামের পর ‘জী’ বসাতে ভোলে না। তাই দুমকার মাওবাদী মুকুলজী, লাতেহারে পরিচিত কুন্দনজী হিসাবে।

এবং পাকুড়ের মুসলিম প্রধান অঞ্চলে খ্যাত সেলিমজী নামেই। ইতোমধ্যেই ঝাড়খণ্ডে মাওবাদী হামলায় ১হাজার ৪০০জন খুন হয়েছেন। নৈরাজ্য ছড়িয়ে পড়েছে রাজ্যের আনাচে-কানাচে। রাজ্য প্রশাসন শুরু থেকেই মাওবাদী সন্ত্রাস মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েছে। ২০০০সালে বিহার থেকে পৃথক হয়ে ঝাড়খণ্ড রাজ্য গঠিত হয়েছিলো।

তারপর থেকে গত আট বছরে রাজ্যে ৬জন মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। অন্য সময় রাজ্যে জারি থেকেছে রাষ্ট্রপতি শাসন। বর্তমানেও রাজ্যে জারি রয়েছে রাষ্ট্রপতি শাসন। নতুন রাজ্য হিসাবে গঠন হওয়ার পর থেকে রাজ্যে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বলতে কিছু নেই। স্থায়ী সরকার না থাকার কারণে রাজ্যে উন্নয়নের কাজও ব্যাহত হয়েছে।

আর্থ-সামাজিক দিক থেকেও ঝাড়খণ্ড অনেক পিছিয়ে। রয়েছে জলের আকাল। কৃষিকাজ হয় বলতে নামেমাত্র। এদিকে সরকারী উন্নয়নমূলক পরিকল্পনাগুলি বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণে সমাজে অনুন্নয়নের চিহ্ন সর্বত্র। এর সঙ্গেই যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক মহলে লাগামছাড়া দুর্নীতি।

রাজ্যে যেটুকু উন্নয়নমূলক কাজ হতে পারে, তা—ও মাওবাদীরা বন্দুকের জোরে আটকে দিচ্ছে । স্কুলভবন নির্মাণ, পুকুর খনন, স্বনিযুক্তির কাজে প্রান্তিক মানুষের অংশগ্রহণ কিংবা সে হোক না সড়ক নির্মাণের কাজ। সবেতেই আপত্তি মাওবাদীদের। সমস্তরকমের পরিকাঠামো উন্নয়নের কাজ স্তব্ধ হয়ে পড়েছে মাওবাদী সন্ত্রাসের কারণে। ঝাড়খণ্ড ছেড়ে ভিন রাজ্যে পাড়ি দিচ্ছেন শিল্পপতিরা, সাধারণ শ্রমজীবী মানুষও।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।