আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নাইজারের বাঁক থেকে-২

...ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাচিয়া,সদাই ভাবনা, যা কিছু পায়, হারায়ে যায়, না মানে স্বান্তনা...
সকাল থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে। নাইজেরিয়ার বৃষ্টি মানে ভয়াবহ বৃষ্টি। ঘন্টার পর ঘন্টা মুষলধারে বৃষ্টি। এক হাত দূরের জিনিসও দেখা যায় না এমন বৃষ্টি। উইক এন্ডের প্রথমদিন।

গত দুই উইক এন্ডই অফিস করেছি। টানা পনেরো দিন অফিস করে তাই বেশ ক্লান্ত। যত কাজই থাকুক এই উইক এন্ডে আর বের হবো না সেটাই ঠিক করেছি। আর বৃষ্টি টা তাই হোটেলে আমার একাকী উইক এন্ড কাটানোর মজাটাকে অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। এখানে আমার সাথে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা সহকর্মীদের সাথে বেশ ভালো একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে।

তাদের সাথেই সারা দিন। কলিগ বলি, বা বন্ধু সবই তারা। একঘেয়ে জীবনে প্রতিদিন এই মানুষগুলোর সাথে গল্প করাটাই তাই সবচেয়ে বড় আনন্দ। তাদের নিজেদের কথা শুনি,তাদের দেশের কথা শুনি,সমস্যার কথা শুনি। মাঝে মাঝে একজন দু’জন দেশে চলে যায়।

যাওয়ার সময় তাদের চোখে যে আনন্দ দেখি, সেটা ঠিক বলে বুঝানো যাবে না। আর আমাদের যাদের আপাতত থেকে যেতে হচ্ছে, তারা হিংসাতুর চোখে তাদের আনন্দ দেখি আর দিন গুনি কবে আমরাও তাদের দলে ভিড়বো। এই গত পরশু দিন গেলেন উমা ভাই। তিনি ও আমাদের মতো বাংলাদেশ থেকে এসেছেন। এখানে আসার পর আমি তাকে বড় ভাই য়ের মতো পেয়েছি।

যে কোন সমস্যা, কি করতে হবে চিন্তা না করে সোজা উমা ভাইকে জিজ্ঞেস করলেই হলো। এমনকি কাজের ক্ষেত্রেও, কোন একটা কিছু বুঝছি না, সোজা চলে যেতাম তার কাছে। তিনি তার হাজার সমস্যার মাঝেও ঠিকই সমাধান বের হরে দিতেন। তিনি দেশে যাওয়ার পর তাই কেমন যেন অভিভাবকহীন মনে হচ্ছে। গতকাল দেশে গেলেন নাদিম ভাই।

পাকিস্তান থেকে এসেছিলেন। তার সাথে আগেই কাজ করেছি দেশে থাকতে। তবে এতো কাছ থেকে তার সাথে কাজ করা হয় নি। খু্বই হোম সিক মানুষ। এখানে আসার পরই দেখেছি তিনি কেবল তার ছোট দু’টো মেয়েকে মিস করতেন।

তিনি খুব একটা বের হতেন না হোটেলের রুম থেকে। আমাকে প্রায়ই বলতেন খবরদার গাড়ি ছাড়া বের হবে না। একদমই না। যদিও তার কথা খুব একটা পাত্তা না দিয়ে সবসময়ই বের হই। একবার তো এমন হলো অফিস থেকে বের হয়েছি।

তিনি তখনো অফিসে। বার বার বলে দিলেন খবরদার গাড়ি ছাড়া কোথাও যাবে না। আমি আর আমার বন্ধু রনি বের হয়ে দেখি গাড়ি নেই। অনেকক্ষন দাড়িয়ে থেকে শেষে হাটা দিলাম। খুব ভয়ে ভয়ে।

নাইজেরিয়ানরা সবাই খুব লম্বা চওড়া। আর ইয়া কালো। যাকেই দেখি মনে বুঝি আমাদের এখনই কিডন্যাপ করে নিয়ে যাবে বা এসে হাইজ্যাক করবে। আসলে নাইজেরিয়ার অবস্থা এতোদিন যা দেখলাম এমন ভয়ের কিছু দেখি নি। তবে আমাদের মনে এই ভয়টা সবাই ঢুকিয়ে দিয়েছে যে এখানে বিদেশী দেখলেই কিডন্যাপ করে নিয়ে যায়।

তাই ফেরার পথে যাকেই দেখি মনে হয় আমাদের কিডন্যাপ করতে এসেছে। অনেক ভয়ে ভয়ে হোটেলে ফিরলাম। নাদিম ভাই জানলে হয়তো তখনই ভয়ে হার্টফেল করতেন। ছবি: উকাডা, এই মোটর সাইকেল হলো লাগোসের প্রধান পাবলিক ট্রান্সপোর্ট এই সপ্তাহেই চলে যাবে সেম্পা। পুরো নাম সেম্পা বাকুজা এডওয়ার্ড।

উগান্ডা থেকে এসেছে। দেশের বাইরে আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ। অসাধারন এক মানুষ। ভয়াবহ কাজ পাগল। সারাক্ষন কাজ নিয়ে পড়ে থাকে।

যার যে সমস্যা শুধু গিয়ে সেম্পাকে বললেই হলো। সে তখন সেই সমস্যা নিয়ে ঝাপিয়ে পড়বে। কাজের ব্যাপারে যে কোন সমস্যা, সেম্পা থাকলেই হলো। বেচারা সোজা দেশে যেতে পারছে না। এখান থেকে সাইপ্রাস চলে যাবে।

তাই তার খুব মন খারাপ। সম্ভবত বেচারা তার গার্লফ্রেন্ডকে মিস করছে। ওয়ারিদ সেট আপের সময় সে বাংলাদেশে ছিলো অনেকদিন। তার একটা মজার অভ্যাস হলো সে একটু পর পরই অবাক হয়ে যায়, বাংলাদেশ এতো ছোট। আর সেখানে ১৫ কোটি মানুষ থাকে কিভাবে।

প্রায়ই সে উইকি পিডিয়াতে ঢুকে আর উগান্ডার জনসংখ্যা দেখে আর বাংলাদেশের জনসংখ্যা দেখে। আর বলে হায় এতো মানুষ কিভাবে থাকে বাংলাদেশে। কিছু দিন আগে আমি তাকে গুগল ম্যাপের সন্ধান দিলাম। সে খুঁজে খুঁজে বাংলাদেশের যে হোটেলে সে ছিলো সেটা বের করলো। তারপর আমি তাকে বললাম তার বাড়ি দেখাতে।

সে অনেক খুঁজে সেটা দেখিয়ে দিলো। তবে সে যে মনে মনে তার গার্ল ফ্রেন্ডের বাড়িটাই খুজছিলো সেটা আমরা সবাই বুঝে গেলাম। কয়েকদিন আগে সে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানতে চাইলো। নিজের দেশের কথা বলতে কার না ভালো লাগে। আমিও খুব আগ্রহ নিয়ে তাকে আমাদের ইতিহাস বলা শুরু করলাম।

এসে থেমে গেলাম পচাত্তরে যখন সে প্রশ্ন করলো মুজিবুর রহমানের মতো একজন নেতা, যে কিনা তোমোদের দেশের জনক, তাকে কি করে তোমরা মেরে ফেললে। আমার আসলেই উত্তর দেয়ার কিছু ছিলো না। আমরা দেশে থেকে জানি না, দেশের বাইরে এমনকি নাইজেরিয়া বা উগান্ডাতেও শেখ মুজিবুর রহমান একজন শ্রেষ্ঠতম নেতার নাম। সারা দুনিয়া তাকে চিনে একটা জাতির জনক হিসেবে। কেবল আমরাই তাকে নিয়ে তর্ক করি আর রাজনীতি করি।

আমি সেম্পাকে বলেছি সে যখন বিয়ে করবে যেন বাংলাদেশে ঘুরতে আসে। আমার ইচ্ছা এই অসাধারন মানুষটাকে আমি আমার দেশটা ঘুরিয়ে দেখাবো। ছবি: ট্রাফিক জ্যাম, লাগোসের ট্রাফিক জ্যাম ঢাকার চেয়ে কম না। আমার সাথে বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়েছে কুয়েত থেকে আসা রামি’র। আমার বয়েসীই।

তার ধারনা ছিলো সে একমাসের মধ্যেই দেশে ফিরে যেতে পারবে। কিন্ত এখন বুঝতে পারছে তাকে কমপক্ষে তিন মাস থাকতে হবে। প্রতি সপ্তাহেই সে প্লান করে সী বীচে ঘুরতে যাবে। কিন্ত গাড়ির ব্যাবস্থা করতে পারে না বলে যাওয়া হয় না। গতকাল ও আমাকে বললো আমরা এই উইকএন্ডে সী বীচে যাবো তুমি যাবে কিনা।

আমিও প্রতি সপ্তাহেই রাজী হই। জানি না সে আসলেই ব্যাপারটা ম্যানেজ করতে পারবে কিনা। অফিস থেকে আসার পরও তার সাথে অনেক গল্প হয় নেটে। বেচারা নাইজেরিয়াতে হাপিয়ে উঠেছে। ছবি: এই ব্রীজটা লাগোস কে দুই ভাগে ভাগ করেছে।

মেইন ল্যান্ড আর আইল্যান্ড। আমার নাইজেরিয়ান সহকর্মী রাশীদ জিমোহ। সেদিন সে দুপুরে লাঞ্চে যাবার সময় আমাকে বিস্কুট কিনতে দেখে বললো তার সাথে গিয়ে নাইজেরিয়ান খাবার পরীক্ষা করে দেখতে। সাহস করে আমি আর আমার বন্ধু রনি রওনা দিলাম তার সাথে। অনেক গলি ঘুপচি পেরিয়ে আমাদের দেশের ছাপড়া দোকান মতো একটা জায়গায় নিয়ে গেলো।

নাইজেরিয়ান একটা বিখ্যাত খাবার হলো এ্যাবা। জিনিসটা স্বাদহীন। সুজি টাইপের। তার সাথে একচা স্যুপ দেয়া হয়। গরুর মাংসের সাথে শুঁটকী মাছের ঝোল।

খেতে খারাপ না। তবে মাছের গন্ধের কারনে খেতে পারলাম না। রাশীদের খুব ইচ্ছা বাংলাদেশ দেখার। ইন্ডিয়ান ফুড তার খুব প্রিয়। আমার ইচ্ছা আছে তাকে আমার দেশে খাবার একবার খাওয়ানোর।

এখানে প্রায়ই একটা রেষ্টুরেন্টে গিয়ে খাই। নাম ট্যান্টা লাইজার। চিকেন ছাড়া আর কিছু খেতে পারি না। বিশাল বিশাল চিকেন। আমি আর রনি নাম দিয়েছি জংলী মুরগী।

আসলেই মুরগীটা কত বড় আমাদের দেখার খুব ইচ্ছা। আর একটা খাবার আছে নাম হলো ফ্রাইড প্লানেটাইন। জিনিস টা হলো পাঁকা কলা স্লাইস করে কেটে ভাঁজি করা হয়। নাইজেরিয়ানরা এই জিনিস খুব পছন্দ করে। একপ্রকার আলু আছে সেদ্ধকরে পেঁয়াজ দিয়ে পরিবেশন করা হয়।

প্রচন্ড ঝাঁঝ। আমরা নাম দিয়েছি জংলী আলু। আরো কত নানা রকম রকমারী খাবার। কিন্তু তার পরও আমার আর রনির চোখ খুজে বেড়ায় একটু দেশী ভাত আর আলু ভর্তা। এখানে আসা ইরাকের মোহাম্মদ আলী, ভারতের আনীষ, আনসাল,আমোল,আইভরী কোষ্টের বালো,সুদানের সাজার,লেবাননের মারিও সবার মতো আমিও তাই অপেক্ষায় আছি কবে আবার দেশ ফিরবো।

এক প্লেট সাদা ভাত আর আলু ভর্তার সাথে ডাল দিয়ে ভাত খাবো। টুনা ফিস এখানকার খুব জনপ্রিয় খাবার। খেয়ে দেখেছি। ভালোই । তবে ভরা বর্ষায় ধরা পদ্মার ইলিশের কাছে তার কোন তুলনা নেই।

আমার কাছে আফসোস হয় স্রেফ বাংলাদেশী না হওয়ার জন্য কত অসাধারন জিনিস থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এই মানুষ গুলো। ছবি: এ্যাবা, সাথে স্যুপ বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। হোটেলের রুমে বসে আমি প্রচন্ড বৃষ্টির শব্দ শুনছি। বৃষ্টি জিনিসটা আমার বরবরই প্রিয়। বৃষ্টি তো সবদেশেই সমান।

কিন্ত কেন যেন টিনের চালে রিমঝিম করে পড়া বৃষ্টির শব্দ শুনতে ইচ্ছা করছে। আর সাথে সন্ধ্যার পর ব্যাঙের ডাক। আর প্লেঁটে ধোয়া ওঠা ভাতে পদ্মার ইলিশ ভাজি। মনটা চলে যাচ্ছে হাজার মাইল দূরে, যেখানে আমার দেশ।
 


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.