বড়াইগ্রাম(নাটোর) উপজেলার সমস্যা সম্ভাবনা নিয়ে এই ব্লগে আলোচনা করা হবে। বেশী করে নিমগাছ লাগান, আপনার পরিবেশ ভাল থাকবে।
মুক্তিযুদ্ধ ও বড়াইগ্রামে ৯ মাস
ড. আব্দুস সাত্তার
১৯৭১ আমার শিাজীবনের শেষ বছর। চূড়ান্ত পরীার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন। পরীার দিনণও ঘোষণা করা হয়েছে।
চোখজুড়ে রঙিন স্বপ্ন। পরীা শেষে চাকরি হবে। সুন্দর সংসার হবে। নতুন জীবনে প্রবেশ করব। স্ত্রী সন্তানদের ঢাকায় আনব।
এহেন ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও আশার যেন শেষ নেই। কারণ পাকিস্তানের শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে চলছে গণআন্দোলন। আন্দোলনে উত্তাল ঢাকা। পাক শাসকদের সাথে চলছে বৈঠকের পর বৈঠক। আশা, বঙ্গন্ধু শেখ মুজিবই হবেন রাষ্ট্রপ্রধান।
দেশ হবে শান্ত। বুকভরা এমনই আশা নিয়ে পরীার আগে পরিবারের সাবার সাথে মিলিত হতে দিন কয়েকের জন্য গ্রামের বাড়ি চকবড়াইগ্রামে (নাটোর জেলা) গেলাম। কিন্তু সবার সাথে সাাৎ শেষে ঢাকা ফেরার প্রস্তুতি নিয়েও ফিরতে পারলাম না। কারণ, পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী ২৫ মার্চের রাতে ঢাকার ঘুমন্ত মানুষের ওপর মারণাস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং নির্বচারে সব বয়সের অগণিত মানুষকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে ইতিহাসের জঘন্যতম অপরাধ সংঘটিত করে। ঢাকায় ব্যাপক হত্যাকান্ড সংঘটনের পর সমগ্র দেশে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করতে থাকে।
উত্তরবঙ্গে প্রবেশকালে পথ হারিয়ে পাক সেনাদের কয়েকজন সদস্য গোপালপুর ও ওয়ালিয়ায় আটকা পড়ে। খবর পেয়ে অন্যান্য এলাকার মতো বড়াইগ্রাম থানার বিভিন্ন এলাকা থেকে শত শত মানুষ গোপালপুর ওয়ালিয়ার দিকে ছুটে যায়। লাঠিসোটা, তীর ধনুক, বন্দুকসহ যার যা ছিল তাই নিয়ে চলে যায় ঘটনাস্থলে। সর্বস্তরের জনতার আক্রমণে পাকিস্তানের প্রশিতি জওয়ানরা পরাজিত ও নিহত হয়। নিহত জওয়ানদের পায়ের বুট এবং মাথার হেলমেট হাতে সে দিন অনেককেই লীকোল বাজারে বিজয়ী বেশে ফিতে দেখা গেছে।
বড়াইগ্রাম থানাবাসীর এটিই প্রথম যুদ্ধ। প্রথম বিজয়। এখান থেকেই বড়াইগ্রামের স্বাধীনতাকামী মানুষের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। মুক্তিযদ্ধের নয় মাস বড়াইগ্রামের মানুষের অশান্ত পরিবেশে নির্ঘুম বসবাস। প্রতি মূহুর্তে হানাদার বাহিনীর আক্রমণের আশঙ্কায় শঙ্কিত মানুষের নিঃশব্দ পদচারণা।
কারণ, ওয়ালিয়ায় পাক সেনা নিহত হওয়ার দিন কয়েক পর চরম প্রতিশোধ নিয়েছিল হানাদার বাহিনী। উত্তরবঙ্গ চিনিকলের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ এলাকার অসংখ্যা মানুষকে হত্যা করেছিল তারা। তাদের ত্রাসের রাজত্ব কায়েমের কারণেই বড়াইগ্রামবাসী আতঙ্কের মাঝে দিন যাপন করতেন। এই বুঝি পাক সেনারা এসে পড়ে।
একদিন সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে খবর এলো পাক সেনারা আসছে।
রাস্তার দু’পাশের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে গুলি করে মানুষ মারতে মারতে তারা আসছে। সে দিন ছিল লীকোলের বাজারের দিন। মানুষে মানুষে পূর্ণ বাজার। মূহুর্তে খবর ছড়িয়ে পড়ল সর্বত্র। সবার চেহারায় আতঙ্কের ছাপ।
বাজার শূণ্য হয়ে গেল। আমি বাড়ি ফিরলাম বাজার থেকে। বাড়িতে থাকা নিরাপদ নয় ভেবে আমাদের কচুগাড়ীর বাড়িতে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। কচুগাড়ী বড়াইগ্রাম থানা থেকে বেশ খানিকটা দূরে। বিল অঞ্চল।
সহজে যাতায়াত করা যায় না। গরুর গাড়িতে রওনা দিলো সবাই। আমি রওনা দিলাম হেঁটে। হাতে আমার প্রিয় এয়ারগান। দিন শেষে সন্ধ্যা নেমে এলো।
টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছে। রাস্তা কর্দমাক্ত। দ্রুতগতিতে হাঁটছি। কিন্তু এগোনো যায় না। পিচ্ছিল রাস্তা।
অবর্ণনীয় দুর্ভোগ শেষে এক সময় ভেজা কাকের মতো জবুথবু বেশে বাড়ি পৌছলাম। বাড়ির পরিবেশ ভালো নয়। কারণ আমরা এ বাড়িতে থাকি না। এটা খামার বাড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। টিনের চালা।
বৃষ্টির ঝম ঝম শব্দ। কান্ত অবসন্ন দেহ। দেশের ভবিষ্যৎ চিন্তায় ভারাক্রান্ত মন। সব মিলে অস্বাভাবিক পরিবেশ। এমনি পরিবেশে কান্ত দেহে বিছানায় শুয়ে রেডিও ছেড়ে দিলাম।
রেডিও ছাড়তেই কয়েকটি গানের কলি ভেসে এলো।
বিশ্ব কবির সোনার বাংলা
নজরুলের বাংলাদেশ
জীবনানন্দের রূপসী বাংলা
রূপের যে তার নেইকো শেষ
বাংলাদেশ।
কবি লেখকদের সোনার বাংলা, রূপসী বাংলা তথা সবার প্রিয় বাংলাদেশকে যে পাক সেনারা ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছে, তাদের নির্বিচার হত্যাযজ্ঞের কারণে যে মানুষ প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে, মানুষ অবর্ণনীয় দুখ-দুর্দশা ভোগ করছে, এ কথা যখন ভাবছি তখন চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিল। বাংলাদেশকে যারা ভালোবাসতেন তারা কেউই চোখের পানি সংবরণ করতে পারেনি সে সময়। দেশের ভবিষ্যৎ চিন্তায় সবাই ছিলেন উদ্বিগ্ন।
উদ্বিগ্ন হৃদয়ে অশান্ত ও অস্বাভাবিক পরিবেশে দিন কয়েক কাটিয়ে আবার ফিরি বড়াইগ্রামের নিজস্ব পরিবেশে। চেনাজানা সবার কাছে। কিন্তু পাক সেনাদের ভয়ে পালিয়ে বেড়ানোর বিষয়টি অব্যাহতই থাকল।
লীকোল বাজার আমাদের এলাকার ব্যবসার প্রধান কেন্দ্র। বাজার এবং বাজারকে ঘিরে গড়ে উঠেছে সংখ্যালঘু স¤প্রদায়ের আবাসস্থল।
শ্মশান, পূজামন্ডপ, বিদ্যালয়, মসজিদ, চিকিৎসালয়সহ সব কিছুই বাজারকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। পাকা সড়কটিও বাজারের মধ্য দিয়েই নির্মিত হয়েছে। ফলে পাক সেনাদের যাতায়াত কালে বাজারে অবস্থানরত সবাই বিশেষ করে হিন্দু স¤প্রদায়ের লোকেরা নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করতেন। অসহায় হয়ে পড়তেন। এ কারণে পাক সেনাদের আগমণ ঘটলে তারা পার্শ্ববর্তী দুর্গম এলাকায় চলে যেতেন।
হিন্দু সহপাঠী বন্ধুরা আমাদের বাড়িতে চলে আসত। তাদেরসহ আমরাও নদী পেরিয়ে ভরতপুর কিংবা মহানন্দগাছায় চলে যেতাম। আবার ফিরতাম পাক সেনারা চলে গেলে। বিকেলে আড্ডা জমত বাজারে। কোথায় কি হচ্ছে, পাক সেনারা কোথায় কী তি করল ইত্যাকার বিষয়ে খোঁজখবর নেয়া হতো বাজারে আগত মানুষদের কাছ থেকে।
ভয়ে অনেকে বাজারে অবস্থান করতে সাহস পেতেন না। দূরে দূরেই থাকতেন তারা। অনেকেই আমাদের বাড়িতে ঘুমাতেন। আমাদের স্কুলের শিক ঈমান আলী বাজারের বাসা ছেড়ে অনেক দিন আমাদের বাড়িতে ঘুমিয়েছেন। এই ঈমান আলী স্যারের আপন তিন ভাই মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধে স্নেহের তিন ভাইকে হারিয়ে ঈমান আলী স্যার প্রচন্ড মানসিক কষ্টে ছিলেন। কষ্ট লাঘবের জন্য তিনি তার ছাত্রদের মাঝে মধ্যে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে বলতেন। ছাত্রের গাওয়া গান শুনতে শুনতে তিনি আনমনা হয়ে যেতেন। শহীদ ভাইদের কথা স্মরণ করে কেঁদে চোখের পানিতে বুক ভাসাতেন। কিন্তু ব্যাথিত হৃদয় নিয়েও তিনি এবং তার ছোট ভাই মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান নির্মমভাবে নিহত হলেন লীকোল বাজারের বাসায়।
ঈমান আলী স্যারের পরিবারের প্রায় সবাই জীবন দিলেন স্বাধীনতার জন্য। আত্মদানকারী এমন পরিবারের সংখ্যা ক’টি আছে বাংলাদেশে? হয়তো আছে। হয়তো নেই। কিন্তু আত্মদানকারী এই পরিবার স্বাধীনতা এনে দেয়ার বিনিময়ে কী পেয়েছে! ঈমান আলীর স্ত্রী সন্তানরা কী করছেন, কেমন আছেন বাংলাদেশের কোন সরকারের কেউ কী কোনো দিন কোনো খবর নিয়েছেন? কী পেয়েছেন বড়াইগ্রামের মুক্তিযোদ্ধারা, যারা এখনো বেঁচে আছেন? পেয়েছেন অবহেলা আর বঞ্চনা। সেই মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে তাদের টগবগে চেহারায় সে উন্মাদনা দেখেছি, যে চাঞ্চল্য দেখেছি এখন তাদের মাঝে সেই উন্মাদনা, সেই চাঞ্চল্য নেই।
এখন যেন তারা নি®প্রাণ। সেই মুক্তিযোদ্ধাদের, মুক্তিযুদ্ধে প্রাণদানকারী পরিবারের সদস্যদের এখন তো আরো শক্তিশালী , সবল এবং প্রাণোচ্ছল থাকার কথা। দেশ গড়ার কাজে, সমাজকে সুন্দর করার কাজে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করার কথা। কিন্তু কোথায় তারা? এখন স্বার্থপর শহরের কিছু অমুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধা সেজে বিশেষ বিশেষ দলে ভিড়ে ফায়দা লোটায় মত্ত। সরকারও তাদের নিয়েই মহাব্যস্ত! গ্রামের প্রাণদানকারী, জীবনবাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের খবর রাখার কিংবা মর্যাদা দেয়ার কেউ আছে বলে মনেই হয়না।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস বড়াইগ্রামে অবস্থান করলেও বিভিন্ন এলাকায় সঙ্গত কারণেই যেতে হয়েছে। গিয়েছি ভাঙ্গুরা। চারদিকে বর্ষা আর বন্যার পানি। ঘরবাড়ি যেন পানিতে ভাসছে। চারপাশ পানিতে ঘেরা এমনই একটি স্বচ্ছল ব্যক্তির বাড়িতে গিয়ে উঠলাম।
দুপুরে খাসি মেরে খাবার ব্যবস্থা করা হয়েছে এলাকার একদল যুবক মুক্তিযোদ্ধার জন্য। মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে খাবার পর কথাবার্তা বলে সন্ধ্যায় বড়াল ব্রিজের পাশের এক বাড়িতে উঠলম। বাড়িটি একজন এলএমএফ ডাক্তারের। তিনি আমাদের বাড়িতে থাকতেন আর দাতব্য চিকিৎসালয়ে চাকরি করতেন। যে বাড়িতে দুপুরে উঠেছিলাম সেটি ডাক্তারের শ্বশুরবাড়ি।
যে রাতে ডাক্তারের বাড়িতে রাত যাপন করেছি, সেই রাতেই মুক্তিযোদ্ধারা বড়াল ব্রিজে অপারেশন চালায়। ফলে পরদিন বোট নৌকাযোগে পাক সেনাদের ব্যাপক আগমন ঘটল। ব্রিজের আশপাশে টহল দিচ্ছিল তারা। আমরা তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে নৌকাযোগে এলাকা ছাড়লাম। ফিরলাম বড়াইগ্রামে।
বড়াল ব্রিজের মতো বড়াইগ্রামে কোন অপারেশন বা যুদ্ধ করতে না হলেও বড়াইগ্রামের মুক্তিযোদ্ধারা চারঘাট, সারদা, হান্ডিয়াল, চাটমোহর, গফুরাবাদ, গারফা প্রভৃতি স্থানে সম্মুখযুদ্ধে ৩৬ পাক সেনাকে হত্যা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের এলাকার যেসব গ্রামের ছাত্র, যুবক ও জনতা অংশগ্রহণ করেছেন সেসব গ্রামের মধ্যে লীকোল, পারকোল, মৌখাড়া, খোকসা, মেরীগাছা, সরিষাহাট, চামটা, শ্রীরামপুর, দোগাছী, কুজাইল ও মাড়িয়ার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসব গ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে দেশ যখন স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে, তখন এক পড়ন্ত বিকেলে লীকোল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠ সংলগ্ন বড়াল নদীর পাড়ে আমরা ক’জন বসে আছি। এমন সময় মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া এক বিমান থেকে প্যারাসুট নিয়ে নেমে এলো ভারতীয় এক ছত্রীসেনা। অজ পাড়াগাঁয়ে প্যারাসুট নিয়ে ছত্রীসেনা নামতে দেখে সবাই হতবাক! হয়তো ঢাকার আশপাশে নামতে দিয়ে কোনো বিলম্ব হওয়ায় শেষ পর্যন্ত ভরতপুরেই নেমে পড়েছেন।
ডুবন্ত সূর্যের শেষ রশ্মিটুকুও আকাশ থেকে মুছে গিয়েছে। অন্ধকার ক্রমান্বয়ে তার প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছে। এমনি সময় ঘটনাটি ঘটল। উৎসুক জনতা সন্ধ্যার অন্ধকারে তাকে রেখে আসেন মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে। এ ঘটনার দিন কয়েক পরই চূড়ান্ত বিজয় ঘোষিত হলো।
আমরা পেলাম কাঙ্খিত স্বাধীনতা। ২০০৯ সালের ২৬ মার্চে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী, আত্মদানকারী, সহযোগিতা দানকারী সবাইকে সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করি। বাংলাদেশের ‘স্বর্ণসন্তান’ তোমাদের লাখো সালাম।
চেয়ারম্যান,
প্রাচ্যকলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।