আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সিরাজউদ্দৌলা- বাঙলার স্বাধীনতার ইতিহাসে বিস্মৃতপ্রায় এক হতভাগ্য নবাব।

সত্য সমাগত, মিথ্যা অপসৃত...............।

কতই বা বয়স তখন তাঁর? চব্বিশ, বড়জোর পঁচিশ। এ বয়সে আজকাল আমাদের অনেকেরই ছাত্রজীবন শেষ হয় না! জীবনযুদ্ধে নামি আরো দু'তিন বছর পরে। আর সে বয়সেই তৎকালীন বিশ্বের সবচাইতে লোভী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সাথে মরণপণ স্বাধীনতা সংগ্রামে নেমেছিল সে যুবক। অর্থ-বিত্ত-ক্ষমতার লোভে সকলেই যখন তাঁকে ছেড়ে গিয়েছিলো তখনো হার না মেনে মৃত্যুকেই মেনে নিয়েছিল সে।

সিরাজ- বাঙলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা। যৌবনের শুরুতেই যাঁর জীবনাবসান ঘটেছে। কিন্তু আপন রক্ত-বারুদে মুক্তিকামী মানুষের মনে যে চেতনাকে সিরাজ জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন তার অবসান ঘটে নি। মহান নবাব আলীবর্দী খানের অতীব স্নেহের দৌহিত্র। অকর্মণ্য নবাব সরফরাজ খানকে সরিয়ে আলীবর্দী ক্ষমতায় আরোহন করলেও সুখবিলাস তাঁর কপালে জোটেনি।

পুরো শাসনামল জুড়ে বর্গীদের অব্যাহত হানা, ইংরেজ বনিকদের ক্ষমতালিপ্সা আর নিকটাত্মীয়দের প্রাসাদ ষড়যন্ত্র তাঁকে ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছিল। এমন কঠিন পরিস্থিতিতেও পুত্রহীন আলীবর্দীর পাশে সর্বক্ষন উপস্থিত ছিলেন তরুণ সিরাজ। বর্গী প্রতিরোধে মাতামহের পাশে থেকে ঘোড়া দাবড়িয়েছেন বাঙলার শেষ সীমানা পর্যন্ত। (এরা সেই মারাঠা বর্গী যাদের অত্যাচারে বাঙলার ঘরে ঘরে মাতম উঠেছিল। মানুষ গেয়ে বেড়াত- "খোকা ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো/ বর্গী এলো দেশে") জীবদ্দশায় তাই আলীবর্দী উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যান তাঁর এই প্রিয় দৌহিত্রকে।

মৃত্যুশয্যায় মাতামহকে দেয়া সিরাজের ওয়াদা ছিল মদ্য স্পর্শ না করা আর বাঙলার বুকে ইংরেজদের প্রভাব বাড়তে না দেয়া। আমৃত্যু সে ওয়াদা তিনি পালন করেছিলেন। ১৭৫৬ সালে ক্ষমতায় আরোহন করে পরবর্তী চৌদ্দ মাসে একের পর এক ষড়যন্ত্র জালের মত এ তরুণ নবাবকে জড়িয়ে ধরেছে। এক মুহুর্তের জন্যও কি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পেরেছিলেন তিনি? কোলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম দূর্গ অভিযান, শওকাতজঙের বিদ্রোহ দমন, খালা ঘসেটি বেগমের ষড়যন্ত্র উদ্‌ঘাটন এবং সবশেষে পলাশী যুদ্ধ। অর্ধলক্ষ সুশিক্ষিত সৈন্য নিয়ে কোন বাহিনী মাত্র তিন সহস্র আগ্রাসনকারীর কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছে- এমন নজির পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।

অথচ, ১৭৫৭ সালের এই দিনে (২৩ শে জুন) তাই ঘটেছিল পলাশীতে। পারিষদ-আমত্য-সেনাপতিদের প্রায় সকলেই যখন বিস্বাশঘাতকতা করে তখন বিশাল সেনাবাহিনী কী কাজে আসে! পলাশীর প্রহসনের পালা শেষ হলে সিরাজ পালিয়ে গেলেন পাটনার দিকে। আশা আবার শক্তি সংগ্রহ করে পুনরুদ্ধার করবেন বাঙলার স্বাধীনতা। না, পারেন নি তিনি। আবার বিশ্বাসঘাতকতা! বন্দী হয়ে নীত হলেন রাজধানী মুর্শিদাবাদে।

সেখানে তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে ক্ষত-বিক্ষত মৃতদেহকে চরম অসম্মানের সাথে হাতির পিঠে নগর প্রদক্ষিন করিয়ে ফেলে রাখা হল। জীবনে যখন কোন ওফাদার (বিশ্বাসী) জুটে নি, তখন মরণের পর নিয়তি তার নির্মম খেল দেখাল। বিশ্বাসী এক খাদেম রাতের আঁধারে এই মৃতদেহকে সসম্মানে সমাহিত করলো মাতামহ আলীবর্দীর পাশেই। আদরের দৌহিত্রকে বুকে জড়িয়ে মাতামহ এবার যেন শান্তিতে ঘুমাবার সুযোগ পেলেন! "আলিবর্দীর কবরের ছায়া সূর্যাস্তের সনে, ধীরে ধীরে পড়ে সিরাজের গোরে। দেখি ভাবি মনে আজো বুঝি দাদু ভোলে নাই তারি স্নেহের দুলালটিরে, আজো বুঝি তারে দুটি বাহু দিয়ে রেখেছে সোহাগে ঘিরে।

" স্বাধীনতার সংগ্রামের শহীদ হিসেবে স্বীকৃতি পেতে সিরাজউদ্দৌলার আর কীবা করার ছিল। কিন্তু, হতভাগ্য এই তরুণ নবাবের জন্য আরো অপমান বাকী ছিল। ইংরেজ আমলে তাঁকে চিত্রিত করা হল- ইন্দ্রিয়াসক্ত উচ্ছৃংখল এক অত্যাচারী যুবকের প্রতিকৃতিতে; বিলাসব্যসন আর ইন্দ্রিয় সুখ ছাড়া যার জীবনে কোন অভিলক্ষ্যই ছিল না! এ অন্যায় অপবাদ রটনায় ইংরেজ ঐতিহাসিকেরা মুখ্য ভূমিকা পালন করলেও সিরাজের স্বদেশী বাঙালীরাও এ ক্ষেত্রে বেশী পিছিয়ে ছিল না। বরং বলাযায়, ক্ষেত্রবিশেষে এগিয়ে ও ছিল। অবশ্য, আবহমান কাল হতেই জাতিগতভাবে বাঙালী নিজের ভালো দেরীতে বুঝলেও অপরের কুৎসা রটনায় কখনোই দেরী করে নি! আলীবর্দী খান যখন বাঙলার মসনদে আরোহন করেন তখন সিরাজের বয়স সাত।

এর ক'বছর পরেই দেশে বর্গী হানা দেয়। মাতামহের সাথে যুদ্ধে নেমে পড়ে দৌহিত্র ও। ১৭৫২ সালে যুবরাজ পদে অধিষ্ঠীত হবার চার বছরের মাথায় নবাব আর পরের বছরেই মৃত্যু। কতটা সময় হাতে ছিল তাঁর। বিলাসব্যসনে গা ভাসাতে চাইলে এ করুণ মৃত্যু তাঁর জন্য অপেক্ষা করে থাকতো না।

পরবর্তী নবাব মীরজাফর, মীর কাশেমদের মত ইংরেজদের সাথে আঁতাত করে স্বাচ্ছন্দেই কেটে যেত সিরাজের জীবন। পলাশীর যুদ্ধের এই ২৫২ বছর পরে আজ তাই প্রতিটি মুক্তি সংগ্রামে- সাম্রাজ্যবাদী- আধিপত্যবিরোধী প্রতিটি আয়োজনে সিরাজের নাম আসে সবার আগে। সিরাজ তোমাকে সালাম। আর সকলের মতই সামহোয়ারইন কর্তৃপক্ষ ও ব্লগারেরা আজ বোধহয় ভুলে গেছে সিরাজের নাম। এখানে একটি লেখা আছে উইকি পিডিয়ার লিঙ্ক বাংলার স্বাধীনতা সাহিত্য


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।