মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তাল দিনুলোতে, অজস্র তরুণ কি অসম সাহসিকতা নিয়ে দেশমাতৃকাকে রক্ষা করেছিল!
নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও একজন আনোয়ার হোসেন
--------------------------------------------------- ডঃ রমিত আজাদ
আমি তখন খুব ছোট। ক্লাস থ্রী কি ফোর-এ পড়ি '৭৮ কি '৭৯ সাল হবে। ইতিহাস পড়ে সামান্য জেনেছি যে, আমাদের এই প্রাকৃতিকভাবে অদ্ভুত সুন্দর কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে হতদরিদ্র বাংলাদেশ এক সময় সোনার দেশ ছিলো। আর সেই সোনার লোভে সুদূর ইউরোপ থেকে এসেছিলো ইংরেজরা। বেনিয়ার ছদ্মবেশে এসে কূট ষড়যন্ত্র করে তারা আমাদের দেশ দখল করে নেয় আর নির্মমভাবে হত্যা করে আমাদের তরুণ দেশপতি নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে।
এই ইতিহাস পড়ে মনে খুব আঘাত পেয়েছিলাম। তার মানে আমাদের দেশের এতো দরিদ্র থাকার কথা ছিলোনা! টেলিভিশনে যেমন দেখি আমেরিকা বা ইংল্যান্ডকে, আমাদের তেমনই থাকার কথা ছিলো! আমার ফুপু-ফুপা এলেন লন্ডন থেকে তাদের এ্যালবামে যে ঐশ্বর্যশালী ইংল্যান্ডের ছবি দেখলাম তা সব আমাদের দেশের লুন্ঠিত টাকায় করা! আহারে, তরুণ নবাব কত কষ্টই না করেছিলেন দেশকে রক্ষা করতে গিয়ে, আর তাকে আমাদের ভূমিতেই নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো। শিশু মনের ভাবনায় ভাবতাম, যদি একটি টাইম মেশিন থাকতো আমি চলে যেতাম পলাশীর প্রান্তরে। তরবারি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তাম ইংরেজদের উপর। কচুকাটা করে সব শেষ করে নবাবকে সালাম করে বলতাম, আপনার দেশ রক্ষা পেয়েছে।
আচ্ছা, কেমন ছিলেন দেখতে আমাদের নবাব?
এর মধ্যে একদিন শুনলাম একটি জাতীয় দিবসে বিটিভিতে নবাব সিরাজউদ্দৌলা ছায়াছবিটি প্রচার করা হবে। নির্দিষ্ট দিনে সময়মতো বসে গেলাম টিভি সেটের সামনে। সেই সময়ে কম বাড়ীতে টিভি সেট ছিলো তাই অনেকেই আমাদের বাড়ীতে সিনেমাটি দেখতে এলো। অন্যান্য সিনেমার সময় যেমন লোক হয় এবার তার চাইতেও বেশী হলো। ড্রইংরুমে লোকে গিজগিজ করছে।
আমি গভীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে দেখার জন্য। সিনেমা শুরু হলো, পর্দায় আবির্ভুত হলেন, তরুণ নবাব।
একটি খোলা জায়গায় একজন ইংরেজ এক প্রজাকে চাবুক দিয়ে অত্যাচার করছে। ছদ্মবেশে নবাব সিরাজ সেটা অবলোকন করছিলেন। অসহায় লোকটি সিরাজের কাছে সাহায্যের জন্যে এলে সিরাজ ইংরেজকে সাবধান করার চেষ্টা করেন।
তখন ইংরেজটি উল্টো সিরাজকে হত্যা করতে উদ্যত হয়। সিরাজ তখন তাকে হত্যা করেন। নির্যাতিত সেই প্রজা যখন বিস্মিত হয়ে সিরাজকে বলেন, ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলার দেশে কোন লোককে হত্যার অধিকার কারোর নেই’। উত্তরে সিরাজ বলেন "অত্যাচার যদি সহ্যের সীমা পার হয়ে যায় তাহলে হত্যার অধিকার আছে। এই হত্যা সম্মন্ধে কেউ প্রশ্ন করলে বলে দিও নবাব সিরাজউদ্দৌলা নিজ হাতে এই ইংরেজকে হত্যা করেছে।
" লোকটি বিস্মিত হয়ে বললো, "নবাব সিরাজউদ্দৌলা!" এরপর নবাব ঘোড়ায় চড়ে দ্রুত ছুটে গেলেন। রূপালী পর্দায় ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের সাথে ঘোড় সওয়ার নবাবের এই ছুটে চলা অনেকক্ষণ দেখানো হলো। যেন বাংলার এই সবুজ-সুন্দর পথে-প্রান্তরে নবাবের এই ছুটে চলা অবিরাম, চলছেন আর সতর্ক নজর রাখছেন পুরো দেশটির উপর, যেন বুক দিয়ে আগলে রাখছেন তার প্রিয় জন্মভূমিকে।
একটু পরে তিনি হাজির হলেন তার জাঁকজমকপূর্ণ প্রাসাদ রাজধানী মুর্শিদাবাদের হিরাঝিলে। তার মরহূম নানা বাংলার মহান সুশাসক আলিবর্দি খানের স্মৃতি ও প্রতীক তার সিংহাসনের সামনে নতজানু হয়ে সেই বিখ্যাত সংলাপ বলছেন।
যে সংলাপ সেই সময়ে মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত ছিলো- ‘বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার মহান অধিপতি, তোমার শেষ উপদেশ আমি ভুলিনি জনাব। তুমি বলেছিলে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীদের প্রশ্রয় দিওনা, তুমি বলেছিলে সুযোগ পেলেই তারা এদেশ কেড়ে নেবে, আমি তাদের প্রশ্রয় দেবো না’। এই সংলাপ শোনার পর আমার রক্ত টগবগ করে ফুটে উঠে। কি বলিষ্ঠ মুখভঙ্গী! কি দৃঢ় কন্ঠ! কি তীব্র চেতনা! কি প্রগাঢ় দেশপ্রেম! হ্যাঁ এই তো আমাদের প্রিয় নবাব!
এরপর একের পর এক ঘটনার মধ্যে দিয়ে আসে নবাবের ঘটনাবহুল জীবন, বাংলার মসনদ দখলের জন্য ইংরেজদের ষড়যন্ত্র। প্রাসাদের অন্দরে এবং বাইরে দুই জায়গাতেই একদিকে ইংরেজ অন্যদিকে বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর, উমিচাদ, রাজবল্লভ, রায়দুর্লভ ও জগতশেঠেরা কীভাবে নবাবকে অস্থির আর অসহায় করে তুলছে।
কী অসাধারণ সংলাপের মধ্যে দিয়ে পরিচালক খান আতাউর রহমান ১৭৫৭ সালে ঘটে যাওয়া ঐতিহাসিক পলাশীর যুদ্ধকে বর্তমান সময়ে নিয়ে আসেন। যেন আমাদের চোখের সামনেই ঘটে চলছে সবকিছু।
ছবির শেষ দৃশ্যে নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত ধুর্ত ও শঠ ইংরেজদের প্ররোচনায় নির্মমভাবে নবাবকে হত্যা করে, তারই সাথে এক থালায় ভাত খাওয়া মোহম্মদী বেগ। বেঈমান আর কাকে বলে! একদিকে বিদেশী বেঈমান আরেকদিকে দেশী বেঈমান, এই দুইয়ের চাপে ছুরিকাহত ভুলুন্ঠিত নবাব তার শেষ কথা বলেছিলেন, "হায়রে অভাগা দেশ!"
ছবি শেষ হয়ে যাওয়ার পরও আমরা অনেকক্ষণ স্থবির হয়ে বসেছিলাম। চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বারবার কানে বাজছিলো, "হায়রে অভাগা দেশ!"
কিছুক্ষণ পর যখন সম্বিৎ ফিরে পেলাম, তখন ১৭৫৭ থেকে ১৯৭৮-এ ফিরে এলাম।
বুঝতে পারলাম নিহত নবাব সিরাজউদ্দৌলা এই মাটির কোলে ঘুমিয়ে পড়েছেন ২২০ বছর আগে। আর তাকে রূপালী পর্দায় তুলে এনে অবিকল বাস্তবের মত যিনি রূপ দিয়েছেন তিনি হলেন অসাধারণ অভিনেতা আনোয়ার হোসেন। এই একটা ছবির জন্যই চির অমর হয়ে থাকবেন তিনি। এই ছবিটি দেখে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেছিলো লক্ষ লক্ষ তরুণ।
ইতিহাস পড়ে যতদূর জেনেছি, দেশ ইংরেজদের হাতে চলে গিয়েছে, এবং আমরা পরাধীনতার গ্লানি বয়ে চলছি এটা বুঝতে বুঝতেও কিছু সময় লেগে গিয়েছিলো আমাদের।
তারপর প্রশ্ন জাগলো, কেন নবাবের হত্যা নীরবে অবলোকন করলো লক্ষ লক্ষ সৈনিক? কেন তারা কয়েকদিন পরেই ইংরেজদের তাবেদার সরকার মীরজাফরের আনুগত্য মেনে নিলো। উত্তর একটাই, যে জাতীয়তাবাদি চেতনাকে ভিত্তি করে ইংরেজরা আমাদের দেশ দখল করেছে সেই জাতীয়তাবাদি চেতনার অভাবে আমরা বাংলার মানুষরা তাদের প্রতিহত করিনি। এই সত্য অনুধাবন করার পরপরই শুরু হলো জাতীয়তাবাদ গঠনের সাংস্কৃতিক সংগ্রাম। রচিত হলো নাটক/যাত্রা 'নবাব সিরাজউদ্দৌলা'। গ্রামে গ্রামে দেশপ্রেমিক অভিনেতারা মঞ্চস্থ করতে লাগলেন এই নাটক/যাত্রা।
রক্তে আগুন ধরিয়ে দিলেন কোটি বাঙালীর শিরায় শিরায়।
এরপর যখন এলো রুপালী পর্দার জগৎ, খ্যাতিমান পরিচালক খান আতাউর রহমান কাঁধে তুলে নিলেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা নাটকের চিত্ররূপ দেয়ার। তার পাশে এসে দাঁড়ালেন শক্তিমান অভিনেতা আনোয়ার হোসেন। সোনায়-সোহাগা হলো। বাস্তব রূপ পেলো বড় পর্দার ছবি।
আমাদের জাতীয়তাবাদের শক্ত ভিত গঠন করার জন্য নবাব সিরাজউদ্দৌলা চেতনাকে চিরজাগ্রত রাখা প্রয়োজন। সেই ক্ষেত্রে এই ফিল্মটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এবং রাখতেই থাকবে।
আমি বিদেশে থাকাকালীন সময়ে এক ২১শে ফেব্রুয়ারী বড় পর্দায় 'নবাব সিরাজউদ্দৌলা' ছবিটি দেখানোর ব্যবস্থা করি। আমাকে একজন বললেন, "রঙিন নবাব সিরাজউদ্দৌলা ছবি তৈরী হয়েছে, ওটা দেখান। " আমি বললাম, "দরকার নাই, আনোয়ার হোসেনের নবাব সিরাজউদ্দৌলাই দেখাবো।
" সকলেই আমার সাথে একমত হলো।
আমার একজন আফ্রিকান (মালি দেশের) বন্ধু খুব মনযোগ দিয়ে ছবিটি দেখেছিলেন। ছবির এক পর্যায়ে ইংরেজ কর্তৃক অপমানিত এক বাঙালী ক্রদ্ধ হয়ে ধাওয়া করে সেই ইংরেজকে। আমার বন্ধুটি উল্লসিত হয়ে বলতে শুরু করে, "সাবাস সাবাস বাঙালী, এইভাবেই ইংরেজদের শিক্ষা দেয়া দরকার। "
ভালো অভিনেতা বলতে আমরা তখন অল্প যে কয়েকজনকে জানতাম আনোয়ার হোসেন তাদের মধ্যে একজন।
আমার এক স্কুল বন্ধু খুব ভালো অভিনয় করতো, স্যার ওকে উৎসাহ দেয়ার জন্য বলেছিলেন, "তুমি তো ভবিষ্যৎের আনোয়ার হোসেন।
বাংলার মুকুটহীন নবাব আনোয়ার হোসেন আজ ভীষণ অসুস্থ। নবাব সিরাজউদ্দৌলা সিনেমা করে ব্যপক পরিচয় পেলেও অনেক জনপ্রিয় সিনেমাই করেছেন আনোয়ার হোসেন। পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলনের সাংস্কৃতিক প্রকাশ অনেক ছবিই আনোয়ার হোসেন অভিনিত, 'জীবন থেকে নেয়া' অন্যতম'। একসময় মনে হতো আনোয়ার হোসেনদের মত অভিনেতারা যে দেশে আছেন সেই দেশের চলচিত্রের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।
অথচ দুঃখজনকভাবে অবলোকন করতে হয় আজকের চলচিত্র অঙ্গনের দৈন্য দশা। গুনির কদর করতে না জানলে দেশে গুনি লোক তৈরী হবেনা। আজও পত্রিকায় পড়েছি উনার অবস্থা এখনোও খারাপ। পত্রিকা মারফৎ জানলাম উনাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো হবে। সরকার এই পদক্ষেপ নিয়ে থাকলে সাধুবাদ জানাই।
অন্যান্যদেরও অনুরোধ করবো এগিয়ে আসতে। আমার সামর্থ্য নেই তাই এই ক্ষুদ্র লেখার মাধ্যমে উনার কথা বলার চেষ্টা করেছি। উনার ঋণ শোধের জন্য নয় ঋণ স্বীকারের জন্যে।
আগামী ১৯ শে সেপ্টেম্বর নবাব সিরাজউদ্দৌলার ২৮৬ তম জন্মবার্ষিকি। দোয়া করি তার আগেই যেন কিংবদন্তির অভিনেতা আনোয়ার হোসেনের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।