আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প: তালাক

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ

ভাইজান, রেহানায় শহীদুল ভাইয়ের কাছ থেইকা তালাক চায়, আপনি না করেন ক্যান? আপনি না মুক্তিযুদ্ধ করছেন? আসমার তীক্ষ্ম প্রশ্নে থমকে যায় শামশের আলী; ছোট বোনের দিকে অবাক চোখে তাকায় আটান্ন বছরের প্রৌঢ়। শ্যামলা মতন সাদামাটা চেহারা আসমার; মাথায় ঘোমটা, লাল পার সবুজ শাড়ি পরে আছে, রোদের আলোয় ঝিকিয়ে উঠছে নাকের নথ । আপনি না মুক্তিযুদ্ধ করছেন? আসমার এই প্রশ্নে অনেকটা বছর পিছিয়ে যায় শামশের আলী ... সত্যিই তো এই দেশে একটা যুদ্ধ হয়েছিল-মুক্তিযুদ্ধ: তো, সেই যুদ্ধটায় কাউলতিয়ার ভূঁইয়াবাড়ির বড় ছেলে পঁচিশ বছর বয়েসী শামশের আলী ভূঁইয়া ঝাঁপিয়ে পড়েছিল; কেননা, পাকিস্তানি সৈন্যরা ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাস থেকেই একে একে গাজীপুর সদর, কোনাবাড়ী, বাড়ীয়া, কাউলতিয়া, কাশিমপুর তছনছ করছিল।

আক্রান্ত জনপদের তরুণরা এই রকম দুঃসময়ে কি করে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারে? গাজীপুরের ইব্রাহীম শেখ, কোনাবাড়ীর জয়ন্ত সান্যাল, বাড়ীয়ার ইকবাল হোসেন, কাশিমপুরের মুক্তি ডাক্তার আর কাউলতিয়ার শামশের আলী ভূঁইয়ার নেতৃত্বে পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে প্রায় খালি হাতেই গড়ে উঠেছিল তীব্র প্রতিরোধ; ... মাঝেমাধ্যেই দু-পক্ষের সংঘাত বাধত; সংঘাত বাধত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অনুগত ঘৃন্য রাজাকারদের সঙ্গেও। সেই যুদ্ধের বছরটায় গাজীপুরে মোছলেম রাজাকারের প্রবল দাপট; সশস্ত্র লোকজন নিয়ে চলা ফেরা করত লোকটা। গাজীপুরের কম পক্ষে চল্লিশ হাজার নিরীহ ও নিরস্ত্র নারীপুরুষশিশু হত্যায় প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল মোসলেম রাজাকার। নিরীহ নারীপুরুষশিশুদের মোছলেম রাজাকারের লোকেরা জোর করে অস্ত্রের মুখে ট্রাকে তুলে দিত। তারপর ট্রাকটা থামত ধিরাসরাম রেল ইস্টিশনের পাশে শালবনের ধারে।

সেখানে সশস্ত্র পাকিস্তানি সৈন্যরা অপেক্ষা করত। যাদের একটু পরেই গুলি করে মারা হবে-সে রকম বন্দি লোকদের দিয়েই বড় করে গর্ত খুঁড়িয়ে নিয়ে নিত পাকিস্তানি সৈন্যরা। তারপর সবাইকে খাদের কিনারে দাড়াতে নির্দেশ দিত। তারপর মেশিনগানের গানের গুলিতে মানুষগুলি পাখির মতন লুটিয়ে পড়ত খাদে। সব শেষ হয়ে গেলে তারা মাটি চাপা দিয়ে চলে যেত ... রাতের পর রাত দিনের পর দিন এভাবে বাংলার নিরীহ মানুষ হত্যা করেছে তারা ... রাতের পর রাত দিনের পর দিন ... পরবর্তীতে কেন্দ্র থেকে বুলেট বাঁচানো নির্দেশ এল; তখন প্রথমে বেয়োনেট -পরে গনহত্যায় দা-বটি ব্যবহার করতে শুরু করে রাজাকাররা।

অক্টোবর মাসের শেষের দিকে শামশের আলীরা মোছলেম রাজাকারকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৭১ সালের নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহের এক মধ্যরাত্রি: মোছলেম রাজাকারের গাজীপুর সদরের বাড়িটা আক্রমন করে শামশের আলীরা । কাজটা সহজ হয়নি- মোছলেম রাজাকারের অনুগত লোকেরা চোরাগোপ্তা আক্রমন করে প্রতিরোধ করেছিল। সে রাতেই অতর্কিতে বুলেটের আঘাতে কোনাবাড়ীর জয়ন্ত সান্যাল ও কাশিমপুরের মুক্তি ডাক্তার শহীদ হয়। শামশের আলীর কোলেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিল কাশিমপুরের মুক্তি ডাক্তার ।

বড় ভালো মানুষ ছিল কাশিমপুরের মুক্তি ডাক্তার ...হ্যাঁ। মুক্তিযুদ্ধ করেছে শামশের আলী । দেশ স্বাধীন করছে; পূর্ব বাংলার তরফ থেকে পাকিস্তানের প্রতি তালাক কার্যকর করেছে। এখন শামশের আলীর ছোট ভাই শহীদুলের বউ রেহানাও তালাক চায়। কিন্তু, তা কি করে সম্ভব? কাউলতিয়ার ভূঁইয়াবাড়ির ইজ্জত আছে না? অথচ ...অথচ, রেহানা কাশিমপুরের মুক্তি ডাক্তারের আপন বোনের মেয়ে ... কাশিমপুরের মুক্তি ডাক্তারের সম্মান আর রাখা যাচ্ছে না।

সময় কী ভাবে যে বদলায়া যায়? শামশের আলী দীর্ঘশ্বাস ফেলে। একতলা কোঠাবাড়ির লাল সিমেন্টের মেঝের রোদ ঝলমলে বারান্দার কাঠের একটা পুরনো বেঞ্চের ওপর বসে ছিল শামশের আলী। তার মাঝারি উচ্চতা, মোটা, কালো। ছোট ছোট কোঁকড়া চুল। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা পরা।

পরনে কালো প্যান্ট আর ধবধবে সাদা শার্ট । সকাল এখন দশটার মতন বাজে। একটু পর সে মোটর সাইকেলে করে গাজীপুর সদরে যাবে-শামশের আলীর ধান চালের আড়তটা ওখানেই। উঠানে জৈষ্টি মাসের ঝাঁ ঝাঁ রোদ। শামশের আলী চা খাচ্ছিল।

তখনই আসমা এল। এসেই সেই মারাত্বক প্রশ্নটা করল। আসমা দরজার চৌকাট ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখের ওপর তীর্যকভাবে রোদ পড়েছে। মুখটা ঘেমে আছে।

গতকালও আসমার একটা কথায় দারুন চমকে উঠেছিল শামশের আলী। তার কারণ আছে। শামশের আলীরা ছয় ভাই। ছয় ভাইয়ের একমাত্র বোন আসমা। শামশের আলী আর রেহানার স্বামী শহীদুলের মাঝখানে চার চারজন ভাই।

চার ভাইই বিদেশে থাকে। একজন ইটালি, দুই জন জাপান আর একজন থাকে কুয়েত । তাদের আয়রুজি ভালোই। ভাইদের মধ্যে শহীদুলই সবচে ছোট। সে গাজীপুরেই ব্যাবসাবানিজ্য করে।

মাঝখানে বছর দুই মালয়েশিয়া ছিল; পোষায়নি-চলে এসেছে। তারপরই রেহেনাকে বিয়ে করল। আসমার শ্বশুড়বাড়ি কোনাবাড়ী। শ্বশুড়বাড়ির অবস্থা ভালো; বাসের ব্যবসা। ঢাকা-সাভার-কাশিমপুর-কোনাবাড়ী -কালিয়াকৈর রুটে মিনিবাস আছে।

আগে আসমার স্বামী কামরুল ইসলাম মিনিবাস কাউন্টারে বসত। মাসে মাসে একটা টাকা পেত। গতবছর কী এক জ্বরে পড়ল আসমার স্বামী - তারপর থেকে কামরুল ইসলামের শরীরের দূর্বলতা আর কাটে না। অল্প হাঁটলেই হাঁপিয়ে ওঠে হিসাব এলোমেলো করে। মিনিবাসের কাউন্টারে বসতে পারে না।

আসমার শ্বশুড় বেঁচে; শ্বশুড়বাড়ির অবস্থা ভালো বলেই ভাতকাপড়ের অভাব হয় না ঠিকই -তবে শ্বশুড়ের কাছে তো এটা-ওটার জন্য হাত পাতা যায় না- কামরুল ইসলামরা আট ভাই তিন বোন। শ্বশুড় বড্ড হিসাবী-কখনও কখনও মাসিক টাকাটা দিতে ভুলে যান। এদিকে আসমার তিন ছেলেমেয়ে; তাদের পড়ালেখার খরচ আছে, অন্যান্য খরচও আছে। আসমা এখন অনেকটা মরিয়া হয়েই বাপের বাড়ির সম্পত্তির হিস্যা নিতে এসেছে। আজ বিকেলেই চলে যাবে কোনাবাড়ী।

ভাগাভাগির কথাটা বড় ভাইয়ের কাছে কাল রাতেই তুলেছিল আসমা; শামশের আলী ভূঁইয়া গম্ভীর কন্ঠে বলে, তর বিয়ার সময় বিস্তর খরচ হইছে, এখন আবার ভাগ চাস ক্যান? আসমা ফস করে বলে, বিয়ায় খরচ হইছে বইলা ধর্মমতে ন্যয্য পাওনা দিবেন না ভাইজান? কথা সত্য। ধর্মানুযায়ী শামশের আলী চুপ করে থাকে। অনেক ক্ষণ ভেবে বলল, ঠিক আছে, তর ভাইয়েরা আইলে তারপর কথা তুলব। আমি একা তো দিতে পারি না। আসমা এবার নিভে যায়।

মিনমিন করে বলে, ভাইরা কবে না কবে আসে। তার আমি কী জানি। বলে শামশের আলী উঠানের দিকে তাকায়। উঠান ভরতি টকটকে রোদ। মর্জিনা, এ বাড়ির ঝি, দড়ির ওপর কাপড় মেলে দিচ্ছে।

আর এক দঙ্গল কাক মিললা ম্যালা চিল্লামিল্লা লাগাইছে। ওপাশে গোয়াল ঘর। পুস্করিনী। গরু নিয়ে শামসু মোল্লা মাঠের দিকে যাচ্ছে। কাচারি বাড়ির দিকে ইয়াসিনরে দেখা গেল।

পেঁপে গাছের নীচে দাঁড়িয়ে রাসেল দাঁত মাজতেছে। খালি গা, লুঙ্গি পরা। আর একটু পর সে পুকুরের দিকে যাবে ... রাসেল শামশের আলীর মেজ ছেলে। বড় ছেলে ঢাকায় থাকে, চাকরি করে; বউবাচ্চা নিয়ে মাঝেসাজে আসে। রাসেল সারাদির ঘুইরা বেড়ায়।

তিনবার ইন্টার ফেল করছে। এইবার পাস করতে না পারলে পোলাটারে আড়তে বসায়া দিব ... শামশের আলী বোনের দিকে তাকায়। আজকাল মেয়েদের দিকে তাকালে তার অস্বস্তি হয়। কেন কে জানে। রেহানা -রাবেয়া- আসমা।

এদের সঙ্গে কথা বললেই কেমন অস্বস্তি লাগে। মেয়েটার সঙ্গে কথা বলে একমাত্র যা শান্তি জুটে। তো, শ্যামলীর বিয়ে হয়েছে সাত মাস হইল। শ্যামীল যদ্দিন এ সংসারে ছিল- শামশের আলীর মনে সুখশান্তি ছিল। এখন আর শামশের আলীর মনে সুখশান্তি নাই।

কোনাবাড়ী থেকে ছোট বোনটা এলে তার ভীষন অস্বস্তি হয়। তবে আসমা যে এ বাড়িতে খুব আসে তাও না। শেষ বার এসেছিল শহীদুলের বিয়ের সময়। কন্যা কাশিমপুরের মরহুম ছাদেক মুনশীর ছোট মেয়ে রেহানা । আসমা আর বড় ভাবী রাবেয়া মেয়ে পছন্দ করল।

কাউলতিয়ার ভূঁইয়াবাড়ির মেয়েমানুষ আর কই? সঙ্গে অবশ্য রাসেল আর শ্যামলীও ছিল। কথা কম বলা কালো মতন মেয়ে রেহানা-আসমার দেখেই পছন্দ হইছিল। ছাদেক মুনশীর কাশিমপুর বাজারে কাপড়ের দোকান ছিল। সে যখন হঠাৎ মারা গেল-তার ছেলেমেয়েরা সব ছোট ছোট । অন্যান্য ভাইবোনদের মতোই রেহানা মামার কাছে মানুষ; মামা টুকু মন্ডল সম্পন্ন গৃহস্থ।

বছর ভর গরু পালে; কুরবানীর ঈদ এলে সে গরু গাজীপুর সদরে নিয়ে ট্রাকে তুলে দেয়। গরুর ব্যবসা ছাড়াও দুই বিঘা মরিচ ক্ষেত আছে টুকু মন্ডলের। তো, গতকাল এ বাড়িতে পা দিয়েই আসমা টের পেয়েছিল রেহানার দিনকাল ভালো যাচ্ছে না। পাঁচ মাসের পোয়াতি রেহানা। তার হইল কি? রেহানার কালো মুখ দেখে বড় ভাবীকে জিজ্ঞেস করে আসমা।

বড় ভাবী চুপ করে থাকে। শেষে আসমাই রেহানাকে জিজ্ঞেস করে, কী হইছে খুইলা কও? কী বলবে রেহানা? রেহানা চুপ করে থাকে। ভূঁইয়া বাড়ির ছোট ছেলে শহীদুলের সঙ্গে রেহানার বিয়ে হয়েছে এক বছরও হয়নি-বিয়ের পর থেকেই শহীদুল প্রায় অচেনা হয়েই আছে রেহানার কাছে। প্রথম কথা- শহীদুল রেহানাকে খেয়াল করে না; শহীদুল কেবল তার প্রয়োজন মিটায়; আদরসোহাগ তো দূরের কথা, রেহানার সঙ্গে অতিরিক্ত একটা কথাও বলে না শহীদুল। সারাক্ষণ নিজের ভাবনায় আচ্ছন্ন।

রেহানা যেন শহীদুলের খাস বাঁদী । (কথাটা বলে বড় ভাসুর। রেহানার কানে এসেছে ঝি মর্জিনা মারফত। ) তাছাড়া খুঁটিনাটি ব্যাপারে শহীদুল রাগ করে। যেন রাগ না-থাকলে ব্যাপারটা জমে না।

তারপর যা হয় তা কখনও কখনও ধর্ষনের পর্যায়েই পড়ে। এতসব রেহানা মেনে নিয়েছে। তাছাড়া শহীদুল বিদেশে ছিল। বউকে সে যেভাবে চায়-তাতে রেহানার ঘেন্না করে। ...কাজেই আসমা যখন রেহানাকে জিজ্ঞেস করে, কী হইছে খুইলা কও? তখন কী বলবে রেহানা? রেহানা চুপ করে থাকে।

কত কথা মনে পড়ে ওর। বিয়েটা রেহানার অনেকটা জোর করেই দেওয়া হয়েছিল। বিয়ের আগে রেহানা ভালোবাসত কালিয়াকৈর-এর ছালাম ভাইকে । তো, সেই লোক তো ... সে যাক। রেহানা তো আসমাকে বলতে পারে না যে ও শহীদুলের অনেক আচরণ মেনে নিলেও শহীদুলের ইদানীং কিছু আচরন মেনে নিতে পারছে না ... আসমা শুনেছে মোছলেম রাজাকারের সঙ্গে নাকি শহীদুল ব্যবসা করবে;- ঢাকা-গাজীপুর মিনি বাস নামাবে।

ছিঃ! রেহানার বড় মামা কাশিমপুরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মুক্তি ডাক্তার । রেহানা ওর মায়ের মুখে মেয়েবেলা থেকেই রাজাকারদের নিষ্ঠুর কীর্তিকলাপ শুনে আসছে ...পাকিস্তানী সৈন্যরা ক্যাম্প করত স্কুলেঘরে। রাজাকাররা মেয়েদের নানাবয়েসি পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে তুলে দিত। ষাট বছরের বৃদ্ধা থেকে সাত বছরের মেয়েও নাকি ছিল। গাজীপুর অঞ্চলে মোছলেম রাজাকার বাড়ীয়া কাউলতিয়া কাশিমপুর কোনাবাড়ী গাজীপুর সদর থেকে নানাবয়েসী মেয়েদের জোর করে ধরে এনে স্কুলঘরে পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে তুলে দিত।

সৈন্যরা মেয়েদের ওপর অত্যাচার করত। বেইজ্জতি করত। অত্যাচার করতে করতে মেরে ফেলত। কত লাশ ভেসে গেছে নদীতে বালু নদী তুরাগ নদী কালেশ্বর বিল আর ডনকা বিলে ...রেহানা ওর মায়ের মুখে শুনেছে ... টঙ্গী খালেও লাশ আর লাশ ভেসে গেছে ... ধিরাসরাম রেল ইস্টিশনের পাশে গর্ত খুঁইড়া মানুষদের গুলি করে মারত। মায়ের সামনে ছোট মেয়েকে বেইজ্জতি করত ...ছোট ছোট ছেলে মেয়েকে বেনোট দিয়া খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারত ।

ছোট ছোট শিশুকে শূন্যে ছুঁড়ে নিচে বেয়োনেট ধরত খুনি সৈন্যরা... এসবই কেমন করে ভুলে গেল শহীদুল? কাউলতিয়ার ভূঁইয়াবাড়ির সবাই আওয়ামী লীগ করে। শহীদুলই কেবল বিএন পি করে। রেহানা আওয়ামী লীগ -বিএন পির খানিকটা বোঝে; রেহানার মামা টুকু মন্ডলের জমির ওপর ১৯৭৩ সালের এপ্রিল মাসে রক্ষীবাহিনী ক্যাম্প করেছিল বলে টুকু মন্ডল ১৯৭৫ সাল থেকেই বিএনপি করে; মামার কাছে বিএনপি সম্পর্কে ভালো ভালো কথা শুনেছে রেহানা; রেহানা বিশ্বাস করে-বিএনপি দেশের মানুষের ভালোই চায়। কেবল মোছলেম রাজাকারের সঙ্গে শহীদুলের ঘনিষ্টতা রেহানা মেনে নিতে পারছে না। বাধা দিয়েছে।

বলে, আপনি খারাপ লোকের সঙ্গে যান ক্যান? শহীদুল হেসে বলে, ক্যান? বড় ভাইজানে আওয়ামী লীগ করে। সে মোছলেম রাজাকারের মেয়ের বিয়ায় যায় নাই? মোছলেম রাজাকারের এই বাড়িতে আইসা দাওয়াত দিয়া গেছিল। গাজীপুর সদরে মোছলেম রাজাকারের সঙ্গে বড় ভাইজানের দেখা হইলে দুইজনে একত্রে হোটেলে বইসা চা খায় না? রেহানা অসহায় ভাবে বলে, যুদ্ধের সময় কত মানুষ মারছে মোছলেম রাজাকারে। গাজীপুরের সবাই জানে তাগো কাহিনী। ধুরও।

কাহিনী দিয়া কী হয়- বলে শহীদুল হেসে উড়িয়ে দেয়। কী বলবে রেহানা? ও ছটফট করে। এমন বিপদে মানুষ পড়ে? স্বামী খুনি আর নষ্ট মানুষের সঙ্গে ব্যবসা করবে। রেহানা এসব ভেবে ভেবে অতিষ্ট। কারও সঙ্গে কথা বলে যে মনের ভার নামাবে সে উপায় নেই।

বড় ভাবী তো কথা কম বলা পাথরের মূর্তি। শ্যামলীর তো বিয়ে হয়ে গেছে। শ্যামলী থাকলে কথা বলা যেত। ...বিয়ের পর থেকেই শহীদুলের আচরণ কেমন সন্দেহজনক । রাত করে বাড়ি আসে।

প্রতিদিন ইস্ত্রীরি করা পাঞ্জাবি পরে। গুনগুন করে গান গায়। আদর করার সময় মুখে অষুধের গন্ধ পায় রেহানা। শহীদুলের মামাতো বোন আঞ্জু কে সন্দেহ করে রেহানা । সন্দেহটা একেবারেই অমূলক না; শ্যামলীও ইঙ্গিতে কিছু তথ্য দিয়ে রেহানার সন্দেহ আরও উশকে দিয়েছে ... কোনাবাড়ীর ইউসুফ কনট্রাকটরের বউ আঞ্জু দুই বাচ্চার মা; ভীষন ঢলানী, থলথলে ফরসা।

পান খায়, কটা চোখ, বাদামী কোঁকড়া চুল। মাঝে মাঝে বাচ্চাদের নিয়ে কাউলতিয়ায় আসে আঞ্জু। দুই-একদিন বেড়িয়ে যায়। যা বোঝার বোঝে রেহানা। শহীদুলও মাঝেসাজে কোনাবাড়ী যায়।

রাত্রে থাকে। ইউসুফ কনট্রাকটরের সঙ্গে তার নাকি ব্যবসায়িক লেনদেন আছে। আসলে লেনদেনটা আঞ্জুর সঙ্গেই। রেহানা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। রেহানারও তো বিয়ের আগে পিরিতি ছিল কালিয়াকৈর-এর ছালাম ভাইয়ের সঙ্গে।

ছালাম ভাইয়ে কী সুন্দর গানের গলা ছিল। ছালাম ভাই গাইত- তুই যদি আমার হইতে রে বন্ধু আমি হইতাম তোর; (এই তোরের ওপর কী টানটাই না দিত কালিয়াকৈর শ্রীফলতলীর ছালাম ভাই) কোলে তো বসাইয়া তোরে কোলে তো বসাইয়া তোরে করিতাম আদর রে ... আঞ্জুকে শহীদুল কেবল কোলেই বসায় না, আরও অনেক কিছুই করে। আঞ্জুই একবার জোর করে রেহানাকে কোনাবাড়ী নিয়ে গেল; ইউসুফ কনট্রাকটরে তখন বাড়ি ছিল না। শহীদুলও সঙ্গে ছিল। শহীদুল কোনাবাড়ী গেলে নাকি ইউসুফ কনট্রাকটরে বাড়ি থাকে না।

ইউসুফ কনট্রাকটরের টাকার নাকি ভীষন লোভ। তো, সেবার কোনাবাড়ী যাওয়ার পর শখ করে কত পদ যে রাঁধল আঞ্জু। রেহানা আইর মাছ খেতে ভালোবাসে। আঞ্জু কপি,টমাটো, মটরশুঁটি আর আলু দিয়ে আইর মাছ রাঁধল। এসব ঠিকই আছে ...তবে মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেছিল রেহানার ... তারপর উঠে বাতি জ্বলতে থাকা পাশের ঘরে যা দেখল তাতেই প্রথম রেহানা তালাকের কথা ভেবেছিল।

পেটের ভিতরের চার মাসের শিশুটিরর কথা ভেবে তালাকের সিদ্ধান্তটি প্রত্যাহার করেছিল। গত মাসে মোছলেম রাজাকারের সঙ্গে শহীদুলের ব্যবসা করার কথাটা কানে যাওয়ার পরই শহীদুলকে তালাকের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেহানা। কথাটা শ্যামলীর মুখেই প্রথম শুনেছিল রেহানা । জামাইয়ের সঙ্গে গত মাসে শ্যামলী বাপের বাড়ী এসেছিল। রান্না ঘরে বসে শ্যামলীর জামাইয়ের জন্য রেহানা আপেল কাটছিল।

শ্যামলী এসে উবু হয়ে বসল। তারপর বলল, ছোট চাচায় নাকি মোছলেম রাজাকারের সঙ্গে ব্যবসা করব। রেহানার হাত থমকে যায়। এ কী কথা বলল শ্যামলী! মোছলেম রাজাকারের সঙ্গে ব্যবসা করবে! মোছলেম রাজাকার তো বড়মামার খুনি! মায়ের মুখে শুনেছে রেহানা ...যুদ্ধের বছর ...নভেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ ... মোছলেম রাজাকারের বাড়ি আক্রমন করে বড় মামারা । মোছলেম রাজাকারের লোকেরাও ছাড়ে নাই।

তারা গুলি করছিল। শেষ রাইতের দিকে বড় মামা মারা যায়। গাজীপুরের লোকে জানে -বড় মামা শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মুক্তি ডাক্তার বড় ভালো মানুষ ছিল । মাওলানা ভাসানীর ভক্ত ছিল। মাওলানা নাকি বড় মামারে বলছিল, ...তুমি পাস করছ মুক্তি, বাবা ইবার তুমি গ্রামের ফিরা যাও।

পূর্ব পাকিস্তানের গ্রামের মানুষ ভীষন গরীব আর অসহায়। ওগো দেখনের কেউ নাই। বলে বড় মামারে জড়ায় ধরে মাওলানা ভাসানীর কি কান্দন ...রেহানা ওর মায়ের মুখে শুনেছে ...ডাক্তরী পাশ কইরা তর মামায় গ্রামে ফির‌্যা আসল। হারাদিন চাষাভূসা গো লগে মিশত বড় ভাইয়ে। হিন্দুমুসলিমবিহারী বইলা কোনও কথা নাই ... ঘরে ঘরে অসুখবিসুখের খোঁজ খবর লইত।

। যুদ্ধের পাঁচ বৎসর আগের কথা। গাজীপুর সদরে সেই সময় কয়েক ঘর বিহারী থাকত। তো, তর মামায় কার্তিক মাসের এক সন্ধ্যায় এক বিহারী বাড়িতে গেছে- কোন্ বুড়ার অসুখের কথা শুনছে। সেই বিহারীঘরে গিয়া দেখে এক যুবতী মেয়ে।

... কার কথা কও মা? আরে ওই তো তর শামশাদ মামী। তো সেই যুবতী বিহারী মাইয়ারে দেইখা তর মামার মাথা খারাপ ...বিয়া হয় নাই শুইনা বিয়া করব ...। মাওলানা ভাসানী গ্রামে গিয়া গরীবদের সেবা করতে বলেছেন-বিয়া করতে তো নিষেধ করে নাই ...বাবারে আইসা তর বড় মামায় সেই যুবতী বিহারী মাইয়ার কথা কইল। বাবা বিয়াতে রাজী না। বাবার অমতে তারপর বড় ভাই সেই যুবতী বিহারী মাইয়ারে বিয়া কইরা আলেদা হইয়া গেল ... এই সবই মেয়েবেলা থেকে মায়ের মুখে শুনেছে রেহানা।

... যেন সেই দিকে কথা বড় ভাইকে নিয়ে মায়ের কী অহঙ্কার ... কাশিমপুরে রেহানার নানার বাড়ীতে সৈন্যরা আসছিল। নানার বাড়ি ক্যান? বড় মামা না আলেদা হইয়া গেল ... আরে ...কথা শোন না আগে ...আব্বায় পরে শামশাদ ভাবীর আচার আচরনে মুগ্ধ হইয়া নিজেই যুদ্ধের দুইবৎসর আগে নিনয়া আসলেন। আমার মনে আছে-বুধবার-আছর নামাজের পর ... মায়ে পিঠা বানায়ছিল। লেকিন চাচয় আসছিল। লেকিন চাচা কে? শামশাদ ভাবীর আব্বা।

কথায় কথায় লেকিন লেকিন করত বইলা ঐ নাম। লেকিন মানে কি আম্মা? অয় তুই আমার ভাইয়ের কী হইল তা শুনবি না ... না না তুমি কও তুমি কও সৈন্যরা তর নানাবাড়ি আসনের আগেই আমরা সবাই কালিয়াকৈর সোবান মাষ্টরের বাইত পালায় গেলাম। তর শামশাদ মামী পালায় নাই ... তর মামা মাঝেমাঝে রাত্রে বেলা আসত বইলা। মামী যতœ কইরা খাওয়াইত। কত জনে যে আসত ... গাজীপুরের ইব্রাহীম শেখ, কোনাবাড়ীর জয়ন্ত সান্যাল, বাড়ীয়ার ইকবাল হোসেন, কাশিমপুরের মুক্তি ডাক্তার আর কাউলতিয়ার শামশের আলী ভূঁইয়া তারপর? তারপর সৈন্যরা শামশাদ মামী তুলে নিয়ে যায়।

বিহারী বইলা ছাড়ে নাই। নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে গাজীপুর সদরে মোছলেম রাজাকারের ভিটা জ্বালিয়ে দিছিল তর বড় মামারা । মোছলেম রাজাকার পাকিস্তানিদের প্রিয়পাত্র ছিল। সেই রাগ ...তারা জানে কারা এই কাজ করছে ... ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তানি সৈন্যরা তর শামশাদ মামী তুলে নিয়ে যায় ... বড় মামীরে তারা কই নিয়া গেছিল মা? কাশিমপুর মাদ্রাসায়। ঐখানে মেয়েদের নিয়া মারত।

তোর বড় চাচারা পরে গেছিল কাশিমপুর মাদ্রাসায়... বড় ভাসুরের মুখে শুনছি ...তারা তর শামশাদ মামীরে ব্লেলেড দিয়া ফালা ফালা কইরা কাটছে । মুক্তি ডাক্তারের স্ত্রী বইলা...পেটে পাঁচ মাসের বাচ্চা ছিল ...পেট থন বাইর কইরা আছাড় দিয়া মারছে ... মায়ের কথা শুনতে শুনতে রেহানা শিউড়ে উঠেছিল। প্লেট থেকে এক কোয়া আপেলতুলে নিয়ে শ্যামলী বলে, ছোট চাচা নাকি বাস নামাইব, মিনি বাস। আমরা মাগনা চরুম গো চাচি। রেহানার বুক ধড়ফর করে বলে তুই কই হুনলি? তোমাগো জামাই কইছে।

কস কি! মোছলেম রাজাকারে ভালো লোক না। যুদ্ধের পর পলায় গেছিল পাকিস্তান। আবার তাগো টাইম আইলে ফিরা আসল। এই দেশের মাানুষের কিছু মনে থাকে না। মোছলেম রাজাকারে যে মানুষ ভালো না -লোক মরে রাখছে না।

রেহানা ঘৃনাভরে বলে। শ্যামলী উদাসী কন্ঠে বলে, এই টাইমে কে ভালো আর কে খারাপ তুমিও কও চাচী। অপরাধ করলে রাজাকারেরা ঘুইরা বেড়ায় কেমনে? দেশে আইনকানুন নাই? শোন না চাচী, কী হইছে। আমার এক চাচত দেওর জামাত করে। আমার শ্বশুড় আবার দুইবার হজ করলেও দুইচোখে জামাত দেখতে পারে না।

আমার শ্বশুড়ে আমার সেই চাচত দেওররে দুই বার কানে ধইরা উঠানে নিয়া সবার সামনে জুতাপিটা করছিল একবার হজে যাওয়ার আগে আরেকবার হজ থেকে আসনের পর। তারপরও আমার সেই চাচাতো দেওরে আমার শ্বশুড়বাড়ি আসে-এমন লেছড়ার লেছড়া... আমারে কয় কী জান, আমারে কয়, ভাবী ছাব বুরকা পড়েন না ক্যান? আমি কই, ক্যান-আমি বুরকা পড়–ন ক্যান? আমার হেই দেওরে কয়, নারীজাতির চুল দেখলে বদন দেখলে পুরুষের শরীর নাকি চিনচিন করে। আমি কই মেয়েদের দেখলে যাগো মাথায় মাল ওঠে তাগো কন চোখে ঠুলি পইরা থাকতে। বলে শ্যামলী হেসে গড়িয়ে পড়ে। অন্য সময় হলে হাসত রেহানা।

এখন ওর শরীর কাঠ হয়ে গেছে। আশ্চর্য! শহীদুলের এত বড় পাপ। বড় ভাসুরও চুপ। তিনি না রেজাকারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছেন ...রেহানার খালি দীর্ঘশ্বাস পড়ে। রেহানা জানে-বড় ভাসুর শহীদুলকে হাতে রাখতে চায়।

বিদেশ থেকে ভাইরা সব আসতেছে ... সম্পত্তির ভাগ বাঁটোয়ারা হবে। শহীদুলের শরীরে যুয়ান বয়েসের গরম রক্ত-ভীষন রগচটা । ছোট ভাইয়ের রাগ দেখাইয়া ভালো ভালো জমিগুলি সব রেহানার বড় ভাসুর শামশের আলী নিজের কবজায় রেখে দেবে। এইসব ভেবে ভেবে রেহানার জীবন আজ অতিষ্ট। রেহানার একটাই শান্ত্বনা- বাঁশি।

কে যেন অনেক রাত্রে অনেক রাত্রে বাঁশী বাজায় । বাঁশীর টানা টানা সুরে রেহানার বুকখানি চলকে ওঠে। কালিয়াকৈরের ছালাম ভাই বাঁশি বাজাইত। সে না তো? কাউলতিয়া জায়গাটা সুন্দর। পুবে বালু নদী অবধি বিস্তীর্ণ মাঠ-এ অঞ্চলের লোকে বলে তেপান্তরের মাঠ ।

তেপান্তরের মাঠজুড়ে তালতমালের বন, মাঝে মাঝে পদ্মদীঘি। তারপর আবার ঘাসের মাঠ। সেই মাঠে আপন মনে ঘাস খাওয়া নানা বর্নের গরু চড়ে বেড়ায়। বালু নদীর পানি ঘোলা হলে ও রোদ পড়ে চিকচিক করে। ওপারে তালতমালের বন।

এপাড়ে অনেক প্রচীন বটবৃক্ষ। সেই বটবৃক্ষের ডালে কত যে পাখপাখালির বাস। বটবৃক্ষের নিচে দিনের বেলায় গভীর ছায়া। সে ছায়ায় বসে রাখাল বাঁশী বাজায়। কিন্তু, বাঁশী মাঝ রাইতে কে বাজায়? কালিয়াকৈরের ছালাম ভাই? কালিয়াকৈরের ছালাম ভাইয়ের সঙ্গেই বিয়ে হয়েই যেত রেহানার-রেহানার মামাতো বোন রীনা আপারও সে রকমই ইচ্ছা ছিল ।

সম্পর্কে ছালাম ভাই রীনা আপার দেওর; বাড়ি কালিয়াকৈর শ্রীফলতলী (রীনার শ্বশুড়বাড়ি সেখানেই)। ছালাম ভাই কাম কাজ করে না- বউরে কী খাওয়াবে? খালি ঘুইরা বেড়ায়। ঘুইরা বেড়ায় আর বাঁশী বাজায়। আর, বাউলা গান গায়। প্রেম করা যে স্বর্গের খেলা দারুন বিচ্ছেদের জ্বালা।

লম্বা ফরসা আর ঝাঁকড়া চুলের এরকম সুঠাম সুপুরুষকে রেহেনার ভালো লাগতেই পারে। তো, রেহানার মামা বিয়েতে রাজী হবে কেন? বোনের মেয়েরা এতিম হওয়ার পর দায়িত্ব নিয়েছে। ছালাম আগাগোড়া বাদাইমা। বাদাইমা পোলার হাতে টুকু মন্ডল রেহানাকে তুলে দিবে কেন? তবে রীনা আপার ইচ্ছা ছিল রেহানার সঙ্গে ছালামের বিয়ে দিতে। গাল টিপে বলত, তুই হবি আমার সতীন লো সতীন।

বলে রেহনার গালে চুমু খেত। কালিয়াকৈরের বাড়িতে ছালাম ভাইয়ের ঘরে রেহানাকে রীনা আপাই ঠেলে দিত । তখনই কয়েকবার রেহানাকে কোলে নিছিল ছালাম ভাই ...না, প্রেমেও মন নাই মানুষটার। খালি কথা কয়। একবার ট্রেনে নাকি এক বাউলানীর সঙ্গে দেখা হইছিল ছালাম ভাইয়ের ...সেই বাউলানী নাকি বলছিল- কুষ্ঠিয়া নাকি বাংলাদেশের মক্কা।

এইসব আবঝাব বলে আর বাঁশি বাজায়। কালিয়াকৈরের ছালাম ভাইই কি মাইঝরাইতে বাঁশী বাজায়? এই কথাটা রেহানার মাথার মধ্যে গেঁথে যাওয়ার পর থেকেই তালাকের কথাটা গভীর ভাবে ভেবেছে। গাজীপুর অঞ্চলের গাঁ-গেরামের স্বচ্ছল পুরুষেরা কথায় কথায় তালাক দেয়-এইবার রেহানা দিবে। পারে না। শামশের আলী ভূঁইয়া কাউলতিয়ার সম্ভ্রান্ত পরিবার ।

তার মান ইজ্জতের ব্যাপার আছে। তার ওপর রেহানা তো শহীদুলের খাস বাঁদী। রেহানা চলে গেলে শহীদুলের আরাম আয়েস কে দেখবে? ছোট ভাইয়ের ভালোমন্দ দেখা তো বড় ভাইয়ের কর্তব্য। কাজেই রেহানা বাঁদিগিরি না করে তালাক দিয়ে চলে যেতে চাইলে বড় ভাই শামশের আলী রেহানাকে চোখ রাঙানি দিতেই পারে। হোক সে কাশিমপুরের মুক্তি ডাক্তারের আপন বোনের মেয়ে রেহানা ... নাঃ, কাশিমপুরের মুক্তি ডাক্তারের সম্মান আর রাখা যাচ্ছে না।

মুক্তিযুদ্ধটা অনেক দিনের ব্যাপার ... রেহানাকে আসমা জিজ্ঞেস করে, বুঝলাম তালাক চাও, কিন্তু তুমি যাইবা কই? রেহানা চুপ করে থাকে। মামার বাড়িতে ফিরা যাইবা? এত কষ্ট কইরা মামায় বিয়া দিল- রেহানা চুপ করে থাকে। লও, তুমি আমার লগে চল, কিছুদিন কোনাবাড়ী বেড়াইয়া আসবা। রেহানা চুপ করে থাকে। তুমি না পাঁচ মাসের পোয়াতি? রেহানা চুপ করে থাকে।

বলে, ভালো থাকমু বইলা চইলা যাইতেছি না-আমার মত কইরা থাকুম বইলাই আমার স্বামীরে আমি তালাক দিমু। কিন্তু, যাইবা কই? দেশটা শুনছি অনেক বড়। ফিসফিস করে বলে রেহানা। আসমার বুকের ভিতরে কেমন করে। আসমা ক্ষাণিকক্ষণ রেহানার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

তারপর বলে, আচ্ছা, বুঝছি। আচ্ছা, তুমি তালাক দিয়া যাও গিয়া। ভাইজান কিছু কইলে আমি আছি ...আমারে ...আমারে সম্পত্তির ভাগ দিতে চায় না। সব ভাইরা মিল্লা আমারে ঠকাইতে চায়। তারপরই ঘর থেকে বেরিয়ে আসমা বারান্দায় এসে বলে, ভাইজান, রেহানায় তালাক নিয়া চইলা যাইতে চায়।

গেলে যাউক। আপনি না করেন ক্যান? রেহানায় মনের দুঃখে গলায় ফাঁস দিলে আপনে তখন কোটকাচারি করবেন? ছোট বোনের তীক্ষ্ম প্রশ্নে চমকে ওঠে শামশের আলী । তার কালো চৌকো মুখটা থমথমে দেখায়। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠতে থাকে। কত কত বছর আগে নিপীড়ক পাকিস্তানের কাছ থেকে বিচ্ছেদপ্রত্যাশী বাংলাদেশ স্বাধীন করেছে শমশের আলী; পূর্ব বাংলার তরফ থেকে পাকিস্তানের প্রতি ন্যয্য তালাক কার্যকর করেছে।

এখন রেহানাও তালাক চায়। কারনটাও জানে, মোসলেম রাজাকার। মুক্তি ডাক্তারের খুনি ...কী করা যায় এখন? ভীষনই অস্থির লাগে শামশের আলীর। ঝট করে উঠে দাঁড়ায় সে; তারপর ছাতাটা তুলে নিয়ে হন হন করে উঠানের রোদের ভিতরে নেমে যায়। ২ আসমা সেদিন বিকেলেই চলে গিয়েছিল কোনাবাড়ী।

৩ তারপর একসময় ভূঁইয়াবাড়ির উঠানে নেমে এসেছিল রেহানা । তখন হয়তো উঠানে রোদ ছিল। খড়ের গন্ধ ছিল। ছিল কাকের ডাক। দিনটা শেষ হলে পর নেমেছিল রাত।

মাইঝ রাইতে তেপান্তরের মাঠে কে যেন বাঁশী বাজায়; বাঁশী যেই বাজাক না কেন-রেহানা তার খোঁজেই পথে নেমেছিল ...

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.