বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
আজ অফিস থেকে বেরিয়ে মারুফ দরদাম করে একটা সিএনজিতে উঠে পড়ল। ভিড় আর জ্যাম ঠেলে সিএনজিটা যখন ফরাশগঞ্জ পৌঁছল- দিনের শেষ আলো তখনও ছিল। ক’দিন ধরে বেশ গরম পড়েছে।
সন্ধ্যার মুখে এদিকটায় বুড়িগঙ্গার হাওয়ারা উতল হয়ে উঠে বলেই মারুফের ভালো লাগল। রাস্তার দু’পাশে দোকানপাটে আলো জ্বলে উঠেছে। একটা সিডির দোকানের বাইরে স্পিকারে জোরে জোরে বাজছিল ওয়ের্স্টান মিলনের গান: মাই ডিয়ার মৌরি/ তুমি তো গেছ চলে ... মারুফদের অফিসের কলিগদের মধ্যে এই অদ্ভূত গেঁয়ো সিঙ্গারটাকে নিয়ে দারুন হাসাহাসি হয়।
একটা সরু গলির মুখে একটা রডসিমেন্টের দোকান। নূপুর ট্রেডার্স ...কে এখন বসে দোকানে? গত বছর বাদল মামা স্ট্রোক করে মারা গেলেন।
বাদল মামা অবশ্য মারুফের আপন মামা ছিলেন না-মারুফের মায়ের আপন চাচাতো ভাই। এত বছরেও সম্পর্কটা একেবারেই ছিন্ন হয়ে যায়নি। রডসিমেন্টের দোকানের পাশে একটা কনফেকশনারি। কনফেকশনারিতে ঢুকে ছোট একটা মিনারেল ওয়াটারের বোতল কিনে ঢকঢক করে খেল। পেস্ট্রি আর সামোসা কিনল।
তারপর বিল মিটিয়ে কনফেকশনারি থেকে বেরিয়ে এসে সিগারেট ধরাল। গলির শেষ মাথায় পুরনো তিনতলা বাড়ি। ধীরেসুস্থ্যে তিন তলায় উঠে এল। সিঁড়িতে আলো জ্বলছে। আশ্চর্য! আজ লোডশেডিং নেই।
কলিংবেল চাপার ঠিক আগে সিগারেটের ফিল্টারটা ফেলে পায়ে পিষল। ঠিক সেই মুহূর্তে মারুফ মাগরিবের আজান শুনতে পেল। শ্যামলা মতন অল্প বয়েসি একটা মেয়ে দরজা খুলে দিল । মামী -মানে নূপুরের আম্মা বাসায় নাই?
আছে।
মামীকে গিয়ে বল যে উত্তরা থেকে মারুফ আসছে।
বলে, কেকের প্যাকেট আর সামোসার ঠোঙাটা মেয়েটির হাতে দিল। আসেন। বসেন। বলে মেয়েটি সরে যায়।
মারুফ ভিতরে ঢোকে-ঢুকতেই আগর বাতির গন্ধ পেল সে।
বসার ঘরটা ছোট। টিউব লাইট জ্বলেছিল। অনেক দিন পরে এল। সেই পুরনো সোফা, কাঠের ছোট টেবিল। একটা রংচটা শোকেস; তার ওপরে পুরনো মডেলের কালো রঙের সনি ট্রিনিটন।
টিভির ঠিক ওপরেই দেওয়ালে বাদল মামার বাঁধানো ছবি। দীর্ঘশ্বাস ফেলল মারুফ। ছেলেবেলায় বাদল মামা মারুফকে ভীষন আদর করতেন। মারুফরা তখন শ্যামপুর থাকত। লাটাই-ঘুড়ি কিনে দিতেন।
কবুতর কিনে দিতেন।
বিলকিস মামী এলেন। মারুফ রীতিমতো চমকে উঠল। এ কী চেহারা হয়েছে মামীর! শীর্ণ আর ফ্যাকাশে। অথচ
আগে থলথলে ফরসা ছিল মামী।
চুল পাতলা হয়ে এসেছে। আগে কোঁকড়া আর ঘন চুল ছিল। মারুফ উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিল।
বস, বাবা, বস। বলে সোফার ওপর বিলকিস মামী ধীরে ধীরে বসলেন।
বসতেও কষ্ট হল মনে হল। বসেই অনুযোগের সুরে বললেন, আমাদের এদিকে আসই না ।
মারুফ লজ্জ্বা পায়। কৈফিয়তের সুরে বলে, চাকরি মামী- বুঝেনই তো।
হ বুঝি।
তোমার মায়ে কেমন আছে?
আছে এক রকম। গত বছর নাসরিনের কাছ থেকে থেকে ঘুরে এল।
নাসরিনে আম্রিকায় থাকে না?
হ্যাঁ মামী। মিনোসোটায়।
অ।
বিলকিস মামীর কন্ঠস্বর কেমন দূর্বল শোনাল। শাড়ির আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছলেন। সেদিন রামপুরা থেকে রানু খালারা গেছিল মারুফদের উত্তরার বাড়িতে। রানু খালাই ক্যান্সারের কথাটা জানাল। আরলি স্টেজ অবশ্য।
মারুফ নরম স্বরে জিজ্ঞেস করে, রানু খালারা আসছিল?
হ।
মারুফ আমতা আমতা করে বলে, শুনলাম-আপনার শরীর নাকি-
ঠিকই শুনছ বাবা । ডাক্তার দেখাইতেছি। কেমো নিতে হইব। অষুধপত্তরের অনেক খরচ।
হাতে তেমন টাকা পয়সাও নাই। কী যে করি- তোমার মামার রডসিমেন্টের দোকানই একমাত্র ভরসা। দোকানের আয়রুজি দিয়াই চলি। অখন দোকানটা বিক্রি না করলে আমার চিকিৎসা হবে না। কালকে বিশ্বাসবাবু বলল, শ্যামপুরের আজাদ মুনশী নাকি সর্বমোট পঁচিশ লাখ বলছে।
মারুফ কৌতূহলী হয়ে উঠল, বিক্রি করবেন?
কেমনে করি? নূপুরের কথা ভাবতে হইব না? মামীর কন্ঠস্বরে তিক্তটা টের পেল মারুফ। আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে বললেন, মেয়েটা ভালো হইলে কথা ছিল। ধিঙ্গি মাইয়া। পড়ালেখা করে না- এর-ওর লগে প্রেম কইরা বেড়ায়। কোচিংয়ের নাম কইরা সকাল-বিকাল ঘর থেইকা বাহির হইয়া যায়।
কী কোচিং করে আল্লায় জানে। খালি সাইজা গুইজা ঘুইরা বেড়ায়। কিছু কওনও যায় না। কথায় কথায় -মা টাকা দাও বসুন্ধরা যাব।
নূপুর এবার কোন্ ক্লাসে উঠল?
ক্লাস টেনে।
এই সময় কলিং বেলটা বাজল। মারুফই উঠে দরজা খুলল। নূপুর। মারুফ ভাইয়া। নূপুর উচ্ছসিত হয়ে ওঠে।
মারুফ হাসল। শ্যামলা মতন মিষ্টি দেখতে নূপুর। সাদা রঙের শালোয়ার-কামিজ পড়েছে। হাতে কী একটা প্যাকেট। ‘আসতেছি’ বলে নূপুর দ্রুত ভিতরে চলে গেল।
মারুফ এসে সোফায় বসল। বিলকিস মামী বললেন, ওরে বুঝাও বাবা। ওরে বুঝানোর কেউ নাই। হায়, আজ আমার ছেলে যদি বাঁইচা থাকত।
কথাটা শুনে মারুফ দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
বিলকিস মামীর বড় ছেলে বাবু ভাই। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। কীভাবে যেন আমর্স পলিটিক্সে জড়িয়ে যায়। একবার নাকি আমানউল্ল্যা আমান বাবু ভাইকে থ্রেট দিসিল। হাজী সেলিম তখন নাকি বাবু ভাইকে শেল্টার দিয়েছিলেন।
সেই সময় বাসায় নাকি পুলিশ এসেছিল। বাদল মামার হার্টের সমস্যা। এইসব টেনশন সহ্য করতে পারে নি। এক বন্ধুর পরামর্শে গত বছর বাবু ভাইকে ইতালিতে পাঠিয়ে দিলেন বাদল মামা। ছয় মাসের মাথায় বাবু ভাইয়ের লাশ আসল।
কে বা কারা বাবু ভাইকে রড দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। বাদল মামা ছেলের লাশ দেখে স্ট্রোক করলেন। মারুফ দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে।
নূপুর আসে। এরই মধ্যে ড্রেস চেঞ্জ করে ফেলেছে।
নীল রঙের লং স্কার্ট আর শাদা গেঞ্জি পরেছে। উৎকট লাগছিল না; আগরবাতির গন্ধ ছাপিয়ে পারফিউমের হালকা মিস্টি গন্ধ পায় মারুফ। নূপুরের এক হাতে একটা পুরনো মডেলের নকিয়া। অন্য হাতে একটা প্লেট। প্লেটে শন পাপড়ি।
টেবিলের ওপর রাখল প্লেটটা।
মামী উঠতে উঠতে বললেন, তোমরা কথা কও; আমি একটু শুইয়া থাকি। আমার হাতপা ঝিনঝিন করতেছে। তুমি বাবা নূপুররে একটু বুঝাও । মাথার উপরে ওর বাপে নাই, ভাইও নাই।
বাচ্চা কবুতরের মতন যেন ফাল না পারে। আমি আর পারি না। মারুফও উঠে দাঁড়িয়েছিল। পকেট থেকে খয়েরি রঙের একটা মোটা খাম মামীর দিকে বাড়িয়ে বলল, মামী এটা রাখেন। খামটা নিতে নিতে বললেন, কী দরকার ছিল বাবা।
তোমরা মনে রাখছ। তুহিনরা তো আসেই না। এক সময় ওদের জন্য কত করছি। বলে ধীরে ধীরে হেঁটে মামী ভিতরে চলে যান।
মারুফ আবার সোফায় বসল।
নূপুর ওর দিকে চেয়ে আছে। চুল সরিয়ে নূপুরের প্রথম প্রশ্ন- মারুফ ভাই আপনি মনপুরা দেখছেন?
না।
আজকে মনপুরা দেইখা আসলাম।
একা?
না না, একা না, একা না। সঙ্গে শান্তা আর ইমরান ভাই ছিল।
ইমরান ভাই হইল শান্তার আপন ভাই। আর শান্তা হইল আমার ক্লাস মেট। আমরা একসঙ্গে এবার মেট্রিক দিব। মারুফ ভাই আপনি গান পারেন?
আরে না। টুকটাক গিটার বাজাই।
এখন তো সময়ই পাই না।
আমি একটু একটু গান পারি। বলে নূপুর গাইল- যাও পাখি বল তারে/ সে যেন ভোলে না মোরে। বাহ্! দারুন গলা। মারুফ একেবারে মুগ্ধ।
নূপুরের গলা দারুন। মারুফের প্রায়ই মনে হয় সত্যিকারের শিল্পীরা কখনও মিডিয়ায় আসে না- ঘরে থাকে। গান থামিয়ে নূপুর ফস করে জিজ্ঞেস করে বসল, আপনি কার সঙ্গে প্রেম করেন মারুফ ভাই?
এই প্রশ্নে চকিতে মেহনাজের ফর্সা মুখটা মরে পড়লেও মারুফ বলল, কারও সঙ্গে না।
ইশ্। বললেই বিশ্বাস-আপনার মোবাইলে টাকা আছে?
আছে।
কেন?
দেন একটা কল করি।
কর। বলে মারুফ পকেট থেকে সনি এরিকসনটা বের করে নূপুরকে দিল। মুখস্ত নম্বর টিপে নূপুর বলে, এ্যাই তোমরা ফিরছ? এদিকে আমি চিন্তায় শেষ। না, এইটা আমার নতুন নম্বর না।
এইটা হইল মারুফ ভাইয়ের নম্বর। আরে মারুফ ভাইরে মনে নাই-উত্তরায় থাকে? ... তারপর কথা শেষ তারপর ফোনটা ফেরত দিয়ে নুপূর বলল, তাকেই ফোন করলাম যার সঙ্গে আমি প্রেম করি।
আচ্ছা। মারুফ কৌতূক বোধ করে। মুখ টিপে হাসে।
সময় কেমন করে বদলে গেল; এরা এত স্ট্রেটফরোয়ার্ড। নূপুর তো মামীর তো দুচোখের বিষ হবেই। নূপুর আপনমনে বলল, পাত্রর নাম ইমরান। সে আমার বান্ধবী শান্তার ভাই। যাদের সঙ্গে মনপুরা দেইখা আসলাম।
ইমরান ভাই জগন্নাথে পড়ে । বংশাল থাকে। ওদের সাইকেলের দোকান আছে।
ও।
ইমরান ভাই লম্বা ।
ফরসা । পাঞ্জাবি পরলে ইমরান ভাইকে দারুন মানায়। ইমরান ভাই আজকে পাঞ্জাবি পরছিল । নীল রঙের। সাদা ফুল ফুল।
মারুফ বলে, পাঞ্জাবি আমারও ভালো লাগে।
সত্যি?
হ্যাঁ।
আপনারে আমি একটা পাঞ্জাবি গিফট করব। নীল রঙের। সাদা ফুল ফুল।
আচ্ছা করো।
এইবার তাহলে আপনার মোবাইল নম্বরটা দেন।
আমার মোবাইল নাম্বার দিয়ে কী হবে? মারুফ অবাক।
মাঝেমধ্যে ফোন করে আপনাকে বিরক্ত করব। ধরেন বসুন্ধরা গেলাম- ফোন করে আপনারে আসতে বলব।
এই রকম আর কী-
মারুফ হেসে ওর নাম্বারটা বলল। নূপুর ওর নকিয়ায় নাম্বারটা সেভ করে। নূপুর এবার মারুফকে অবাক করে দিয়ে বলল, এইবার আপনি যাকে ভালোবাসেন তার নাম্বারটা দেন।
কেন? মারুফ কিছুটা বিস্মিত।
কেন আবার-ভাবীর সঙ্গে কথা বলব।
আমি এখনও বিয়ে করি নাই।
জানি। যারে করবেন তার নাম্বারটা দেন। তাড়াতাড়ি দেন।
আমি সত্যি একা।
মিথ্যা কথা বইলেন না আমার সঙ্গে। আমার সঙ্গে মিথ্যা কথা বললে আপনের মানিব্যাগ হারায় যাবে। বাবু ভাই একদিন আমার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলছিল-বাবু ভাইয়ের মানিব্যাগ হারায়ে গেছিল। বাবু ভাইয়ের মানিব্যাগের ভিতরে সাতশ তেইশ টাকা ছিল।
মারুফ হাসে।
নূপুর হঠাৎ বলল, আপনি সত্য সত্য একা হইলে আপনার নাম্বারটা আমি একজনকে দিব।
আমার নাম্বার আবার কাকে দিবা?
সে আছে একজন।
বল না কে?
বলব না। তবে সে খুব সুন্দরী। আপনি দেখলেই প্রেমে পড়ে যাবেন।
তাই?
হ্যাঁ।
মারুফ কৌতূহল বোধ করে। কে সে?
নূপুর আর রহস্য করল না। সিরিয়াস মুখ করে বলল, সুন্দরী মেয়েটা হইল আমার কলি আপা। সুন্দরী-তবে শ্যামলা মতন;
আবার চশমাও পরে।
কলি আপা শ্যামপুর থাকে। দনিয়া কলেজ থেকে এইবার ইন্টার দিবে। কলি আপা খুব ভালো । কোথাও গেলে শাদা ওড়নায় মাথা ঢেকে রাখে। বাবু ভাইয়া মারা যাওয়ার পর থেকে কালো রঙের শালোয়ার -কামিজ পরে।
কলি আপার সঙ্গেই তো বাবু ভাইয়ার বিয়ের কথা ছিল। হইল না-
ওহ্।
কলি আপা কথা কম বলে আর বেলি ফুলের গন্ধ ভীষন ভালোবাসে।
বেলি ফুলের গন্ধ?
হ্যাঁ। বেলি ফুলের গন্ধ? নূপুর মাথা ঝাঁকাল।
কলি আপা সব সময় বেলি ফুলের গন্ধঅলা সেন্ট মাখে।
এরপর সরল বলেই হয়তো নূপুর বলেই বসল, আপনি কলি আপারে বিয়া করে ঘরে তুলবেন মারুফ ভাই? কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই কারেন্ট চলে যায়। লোড শেডিং। তবে ঘরটা একেবারে অন্ধকার হয়ে যায়নি- জানালায় গলির আলো ছিল। মারুফ মোবাইল ফোনটা অন করে সময় দেখল।
বলল, আমি এখন যাইরে নূপুর-সেই উত্তরা যেতে হবে। বলতে বলতে উঠে দাঁড়াল। নূপুরও উঠে দাঁড়াল। দরজার কাছে এসে বলল, আবার আইসেন।
আসব।
মারুফ বলল। সিঁড়িতে অন্ধকার। নূপুর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। নূপুরের ফোনে টর্চ লাইট আছে। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আলো ফেলছিল।
উত্তরা ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হল। খেতে বসে মারুফ বলল- বিলকিস মামী তো একেবারে শুকায় গেছে আম্মা।
আমাকে একদিন নিয়ে চল। তোর তো ছুটি নাই। এই শুক্রবার ...যাবি?
দেখি।
মারুফ ‘দেখি’ বলল বটে; তবে এই শুক্রবার ফরাশগঞ্জ যাওয়া যাবে না। মেহনাজের সঙ্গে বসতে হবে। ওর সঙ্গে বসা জরুরি। আজকাল মেহনাজের কথা বলার টোন ভীষন বদলে যাচ্ছে। মেহনাজের সঙ্গে মারুফ বি বি এ পড়ত; দুর্দান্ত স্মার্ট।
বি টি ভিতে ইংরেজি খবর পড়ে মেহনাজ; এখন এশিয়াটিকে আছে। মারুফ ওর এক কলিগের মুখে শুনেছে এশিয়াটিকের ইন্তিখাবের সঙ্গে মেহনাজ আজকাল ঘুরাঘুরি করছে।
মারুফের প্লেটে আচার তুলে দিতে দিতে আম্মা বললেন, বিলকিস ভাবির এখন চিকিৎসার টাকা দরকার- রডসিমেন্টের দোকানটা বিক্রি করে দিলেও তো পারে। ছেলে নাই। মেয়ের তো বিয়ে হয়ে যাবে।
কী ভাবে? নূপুরের পড়ার খরচ আছে না? মাত্র টেনে পড়ে। তাছাড়া বিয়ের খরচও রাখতে হবে । বাদল মামা তো তেমন কিছু রেখে যায়নি।
ওহ্। বলে মারুফের আম্মা চুপ করে থাকেন।
তারপর প্রসঙ্গ পালটে বলেন, মেয়েটাকে এবার ঘরে তোল মারুফ। আমি একা একা থাকি। মেয়ে মানে মেহনাজ। মারুফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, দেখি।
শুক্রবার মেহনাজ আর মারুফ বিকেলের আগে ক্যাফে ম্যাঙ্গোতে মুখোমুখি বসল।
মেহনাজ শাড়ি পরে এসেছিল। বলল, আমাদের কি হইছে মারুফ ? বেশি দিন একে অন্যকে ভালো লাগে না। এক মোবাইল সেট বেশি দিন ভালো লাগে না।
মারুফ সিগারেট ধরিয়ে বলল, জানি না।
মেহনাজ বলল, আমি লন্ডন চলে যাচ্ছি মারুফ।
ঢাকায় লাইফ নাই। কনঝারভেটিভ একটা শহর। কোনও চার্ম নাই, মিস্ট্রি নাই- জোর করে মেয়েদের নান -মানে সতীসাব্ধী বানায়া রাখছে। রেডিসনে নাচলেই মেয়েরা খারাপ হয়ে যায়। এখান থেকে চলে যাওয়াই ভালো।
মারুফ আর কী বলবে-ও চুপ করে থাকে।
মেহনাজ বলল, আমি জানি, আমি যারে বিয়া করুম তার উপরেও আমি ভেরি সুন ফেডাপ হয়ে যাব। শিট।
তারপর সাতশ ছাব্বিশ টাকা বিল তুলে মেহনাজ চলে যাওয়ার সময় মারুফ দূর্বল কন্ঠে বলল, তুমি ভালো থেক নাজ।
এরপর মারুফের দিনগুলি বিষময় হয়ে উঠল।
মেহনাজ টের পায়নি মারুফ বলে একজন ওকে গভীরভাবে ভালোবাসত। মারুফও বোঝেনি যে ও সত্যি সত্যি মেহনাজকে ভালোবাসত। সিগারেট খাওয়া বেড়ে যায় ওর । বন্ধুরা সব ব্যস্ত। মাকেই সব খুলে বলে মারুফ।
মেহনাজ লন্ডন চলে যাচ্ছে আম্মা।
মেহনাজ উত্তরার বাড়িতে বেশ কয়েকবারই এসেছিল। ওকে আম্মার পছন্দ ছিল। মার মুখ গম্ভীর হয়ে যায়।
থাক।
মারুফ বলে, মেহনাজের কথা বাদ দাও- ওরে ভূতে ধরছে আম্মা। ভূত।
ওহ্ ।
একদিন। অফিসের কাজে মারুফ ব্যস্ত ছিল।
ফোন এল। নূপুর। মারুফ ভাইয়া?
হ্যাঁ। বল।
ফোন করে তোমাকে বিরক্ত করলাম?
আসল কথা বল।
কিছুটা বিরক্ত। আজ কাস্টমার কেয়ারে ভীষন ভিড়।
তোমার জন্য একটা পাঞ্জাবি কিনছি। নীল রঙের। সাদা ফুল ফুল।
শান্তার কাছে আছে। নিয়া নিও।
কে শান্তা?
তোমার মনে নাই? সেই দিন যে বললাম। আমার বান্ধবী শান্তা। ইমরান ভাইয়ের ছোট বোন।
ও হ্যাঁ।
শান্তা তোমাকে পাঞ্জাবিটা দিয়ে দিবে। ও তোমার সঙ্গে পরে যোগাযোগ করবে।
মারুফের মনটা অস্থির ছিল। মেহনাজ টের পায়নি মারুফ বলে একজন ওকে ভালোবাসত।
ও বলল, আজ সন্ধ্যার পর আমি তোদের বাড়িতে আসব?
না। আপনার আসার দরকার নাই। বলে নূপুর ফোন কেটে দিল।
হ্যালো হ্যালো। এই নূপুর ...আশ্চর্য! পাগলী মেয়ে তো।
হয়তো সন্ধ্যার পর ফরাসগঞ্জ যেত মারুফ। কলিগের বার্থডে ছিল। অ্যাভোয়েড করা যাবে না; কলিগ ভীষনই হেল্পফুল। ফরাশগঞ্জ যাওয়া হল না।
পরের দিনই দুঃসংবাদটা শুনল মারুফ।
সেদিন টিঅ্যান্ডটি নাম্বার দিয়ে এসেছিল। মামী কাঁদতে কাঁদতে বললেন, নূপুর সুইসাইড করছে। মারুফ দেখল ওর মায়ের মুখচোখ আতঙ্কে নীল হয়ে গেছে। থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, আমাকে ফরাশগঞ্জ নিয়ে চল মারুফ।
মারুফ বলল, না আম্মা।
আমি ...আমি ওই বাড়িতে যেতে পারব না। গেলে তুমি একাই যাওয়।
একাই সিএনজি ডেকে আম্মা ফরাসগঞ্জ চলে গেলেন।
অফিসে ভীষন চাপ। কাজের ফাঁকে ফাঁকে মারুফ ভাবে- নূপুর আত্মহত্যা করল? কেন? মায়ের চিকিৎসার খরচ যোগাতে স্যাক্রিফাইস করল? এখন রডসিমেন্টের দোকানটা অনায়াসে বিক্রি করা যাবে।
মারুফ অস্থির বোধ করে। নূপুরের সঙ্গে মেহনাজের তুলনা করে মারুফ ভীষনই মুষড়ে পড়ে। অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকতে হয় বলেই মানসিক যন্ত্রণা থেকে বেঁচে গেল মারুফ। অবশ্য সিগারেট খাওয়াটা বাড়ল। মেহনাজের মুখটাও মনে পড়ে।
লন্ডনে কি বৃষ্টি ঝরে? ওই দেশটায় কখনও যাওয়া হয়নি। মারুফের ভালো লাগে রোমাঞ্চকর এই শহর ঢাকা। আর এই শহরে তো এখন বৃষ্টির সিজন এসে গেল। নূপুরের প্রেমিক ইমরানের (না-দেখা) মুখটাও মনে ভাসে। ইমরানের নম্বরটা আছে।
নূপুর ইমরানকে ফোন করেছিল। বলেছিল- তাকেই ফোন করলাম যার সঙ্গে আমি প্রেম করি। এই সেদিন নূপুররা মনপুরা দেখতে গেল। ইমরান ছেলেটি এখন কি করবে? এখন কি সে ড্রাগ ধরবে?
কিছুদিন পর। অচেনা নাম্বার থেকে ফোন এল।
হ্যালো। মারুফ ভাইয়া আমি শান্তা। আমাকে চিনতে পারছেন? না। কে? আমি নূপুরের বান্ধবী শান্তা। ও বল।
নূপুর আপনার জন্য একটা পাঞ্জাবি কিনছিল। পাঞ্জাবিটা আমার কাছে আছে। আমি কি পাঞ্জাবিটা নিয়ে আজ বিকালে বসুন্ধরার সামনে আসব ভাইয়া? মারুফ বলল, না। তা হলে? মারুফ গম্ভীর কন্ঠে বলে, পাঞ্জাবিটা আমি নেব না শান্তা। ওটা তোমার কাছেই রেখে দাও।
কিন্তু-ভাইয়া ...
ফোনটা মারুফ অফ করে দিল।
সহসা ওর মনে পড়ে গেল কলি নামে একটা মেয়েকে ফোন নম্বরটা দেওয়ার কথা ছিল নূপুরের।
যে কলি বেলি ফুলের গন্ধ ভালোবাসে ।
নূপুর কি কলিকে ফোন নাম্বারটা দিয়েছে? শান্তা তো ফোন করল। কলি কি ফোন করবে? এই ভাবনায় মারুফ ভীষন আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে ।
কী এক অজানা কারণে কলিকে দেখার জন্য ক্রমশ সে ভীষন অস্থির হয়ে উঠতে থাকে। কলি শ্যামপুর থাকে। দনিয়া কলেজে পড়ে। বাবু ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল ... মারুফের অস্থিরতা বাড়ে। কলি যদি ফোন করে তো মারুফ অফিসের কাজ ফেলে ছুটে যাবে।
কলির ফোন নম্বর বিলকিস মামীর কাছে নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু, ও বাড়িতে যেতে মারুফের ইচ্ছে করে না। মামীর ওপর মারুফের রাগ আছে। ‘চিকিৎসার খরচ’, ‘চিকিৎসার খরচ’ করে ওমন নাটক না-করলেও পারতেন মামী। বেচারী নূপুর ... ও বাড়িতে গেলেও মামীর কাছে তো কলির ফোন নম্বর চাওয়া ঠিক হবে না।
আম্মা কে বলব? না, অড দেখায়। হঠাৎই মনে হল-শান্তার কাছে কি কলির মোবাইল নাম্বারটা আছে? দুরুদুরু বুকে শান্তার নাম্বারটা মারুফ প্রেস করে।
মারুফ ভাইয়া!
শোন, শান্তা। তুমি তো নূপুরের বড় ভাই - মানে বাবু ভাইরে দেখছ না?
শান্তা উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল, হ্যাঁ, দেখছি ভাইয়া।
একজনের সঙ্গে বাবু ভাইয়ের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল ... শ্যামপুর বাড়ি ...জান?
হ্যাঁ।
কলি আপা।
মারুফের বুকটা ধক করে ওঠে। তোমার কাছে কলি আপার ফোন নম্বর আছে?
না, নাই। নূপুরে হিংসা কইরা আমারে কলি আপার নম্বর দেয় নাই।
হিংসা করে দেয়নি মানে?
আমার বড় ভাইয়ের জন্য আমরা পাত্রী খুঁজতেছিলাম।
নূপুর সেই কারণে কলি আপার মোবাইল নাম্বার দেয় নাই।
ও। মারুফ হতাশ বোধ করে।
শান্তা বলল, কলি আপারে সেইদিন দেখছি।
মারুফের বুকটা ভীষন কাঁপছে।
কবে?
নূপুর মারা যাবার দিন আসছিল।
ওহ্ ।
আপনি পাঞ্জাবি নিবেন না মারুফ ভাই?
কিছু না-বলে মারুফ ফোন কেটে দেয়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
তারপর ব্যস্ত শহরে মারুফের দিনগুলি কাটতে থাকে।
আম্মা বিয়ের কথা বলে; পাশের ফ্ল্যাটের মমতাজ আন্টির মেয়ে-শাহরিন; শান্তা মারিয়ায় পড়ছে। একমাত্র মেয়ে। ফ্ল্যাটটা ওই পাবে; তা ছাড়া রংপুরে আশি বিঘা সম্পত্তি।
এসব কথা আমাকে বইল না আম্মা । প্লিজ।
কলির ফোন আসে না। নূপুর কি নাম্বারটা দেয়নি? আবার এও ভাবে মারুফ-নূপুর নাম্বারটা দিলেও একটা মেয়ে কী করে অচেনা একটা লোককে ফোন করে?
মারুফ এইসব ভেবে ভেবে ভিতরে ভিতরে ভীষনই অস্থির বোধ করে।
মাঝে মাঝে অফিসের পর মারুফ শ্যামপুর যায়। সন্ধ্যার পর গলি ধরে হাঁটে। জুরাইন, পূর্ব জুরাইন, শ্যামপুর হাই স্কুল।
জুরাইন কবরস্থান। ওখানে নূপুর শুয়ে আছে। কখনও বৃষ্টি ঝরে ... মারুফ ভিজে যায়। মারুফের বুকটা খাঁ খাঁ করে। সে বেলি ফুলের গন্ধসহ একটা বাড়ি খুঁজে।
অনেক রাতে মারুফ বাড়ি ফিরে আসে।
মারুফের বুকটা খাঁ খাঁ করে।
আম্মা পাশের ফ্ল্যাটের মমতাজ আন্টির মেয়ে শাহরিনের সঙ্গে বিয়ের কথা বলে। বলে, তোর বাপ বেঁচে নাই। নাসরিন বিদেশে, তুই সকালে অফিস চলে যাস-রাতে ফিরিস।
আমি একা একা থাকি। আমরা এখন শুধু কলেমা পড়ায় মেয়ে ঘরে তুলব। অনুষ্ঠান পরে করব। মমতাজ আপা জানে, তুই এখন গাড়ি কেনার জন্য টাকা জমাচ্ছিস।
মারুফ বলে, আমি গাড়ি কিনব না।
কেন?
গাড়ি মেহনাজের আব্দার ছিল। গাড়ি তোমার লাগলে বল।
না। আমার গাড়িটারি দরকার নাই। আমার দরকার ছেলের বউ।
মারুফ অস্থির বোধ করে। মাকে কষ্ট দিতে গ্লানি বোধ করে। কি করবে বুঝতে পারে না। কলি ...কলিগের থ্রুতে দনিয়া কলেজের এক তরুন প্রভাষকের খোঁজ মিলল; কলিগের দূর সম্পর্কের চাচাতো ভাই-কাজলা থাকে। কলিগের মটর সাইকেলে এক শুক্রবার সকালের দিকে গেল কাজলা।
সব শুনে দনিয়া কলেজের হিসাব বিজ্ঞানের রফিকুল ইসলাম বললেন, আরে ডাক নামে কি কেউ কলেজে ভর্তি হয় নাকি? দনিয়া কলেছে কত কলি আছে। আমি এক নাসরিন জাহান কলিরে চিনি। মারুফের বুক ধক করে ওঠে। কই থাকে?
কোনা পাড়া। হাসান সাহেবের রোকেয়া আহসান ডিগ্রি কলেজের পাশে।
ও।
ওরা চা খেয়ে ফিরে আসে।
কয়েকদিন পর। দুপুরে লাঞ্চের পর মারুফ অফিসে নিজের সিটে এসে বসেছে-এমন সময় ফোন এল। আম্মা।
তোর মামীর শরীর নাকি ভীষন খারাপ। বিলকিসের কাজের মেয়েটা ফোন করছিল। পারলে তুই একবার যা। আমিও সি এন জি নিয়ে যাচ্ছি।
সাধারনত এমন হয় না।
অফিসে কাজের খুব চাপ থাকে। তারপরও কলিগকে বলে মারুফ অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ল। ফরাশগঞ্জ পৌঁছতে পৌঁছতে বিকেল । দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে দরজার সামনে। দরজা খুলল সেই মেয়েটা।
বুকটা ভীষন ধড়ফর করছে। মামী কই?
একটু আগে অসীম কাকায় আইসা হাসপাতালে নিয়া গেছে? বসেন।
কোন্ হাসপাতাল জান?
মেয়েটি মাথা নাড়ে।
মামীর নাম্বার তো নেই। নূপুরেরটা ছিল।
কী করবে মারুফ বুঝতে পারছে না। ভীষন ঘামছে। সি এন জি থেকে নেমে প্রায় দৌড়ে এসেছে। কে নিয়ে গেছে বললা? রডসিমেন্টের দোকানের অসীম বাবু ...বিশ্বাস
হ। মেয়েটি মাথা নাড়ে।
একবার রডসিমেন্টের দোকানে গেলে হয়। ওখানে অসীম বাবুর নাম্বার পাওয়া যাবে নিশ্চয়ই। মারুফ ঘুরে দাঁড়ায়। সিঁড়িতে নামে। সিঁড়িতে বিকেলের ঝলমলে আলো।
আর বেলি ফুলের গন্ধ; ও থমকে যায়। দেখল-মা উঠে আসছে। মায়ের ঠিক পিছনেই একটি মেয়ে। শ্যামলা মতন; শাদা ওড়নায় মাথা ঢাকা। চশমা পরা; পরনে কালো রঙের শালোয়ার -কামিজ।
মেয়েটি মুখ তুলে তাকাল।
নিজের হৃদপিন্ডের প্রচন্ড শব্দ শুনতে পায় মারুফ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।