ডুবোজ্বর
এখনো বৃষ্টির দাগ লুকিয়ে রেখেছি বাঁশবনের একটি পাতায়। একটি পাতায় চিরদিন কাঁপে জল আর জলের কুসুম। জলের ইঁদারায় ধূপের গ্রামখানি ঝিমধরা মুহূর্তের দেয়াল-- আটকে রাখে অহমিকা আর জন্মান্তর। তিন প্রান্তরের তিনটি শাদাফুলে অনাবৃষ্টির চিহ্ন-- এই চিহ্ন কেবলই বাঁশবনের প্রতীক্ষায় রত। আমার আরতি চিরদিন লুকিয়ে থাকে বাঁশের ফুল।
তেপান্তর জানবে না বাঁশবন আমার মাথার চুল। শাদাফুল বাঁশের, শাদাফুল জবাকুসুম।
এই ছবিটা কিভাবে আঁকা যায়? কখানি ক্যানভাসে ধরবে দৃশ্যসকল? কী রঙ, কী কালার প্যালেট? শাদা হলুদ সবুজ নীল ধূসর, ধূসর মানে ছাই, ছাই মানে ভস্ম, ভস্ম মানে আষাঢ়ের মেঘ; তারপর গাঢ় সবুজ রঙ। এই বিক্ষিপ্ত দৃশ্যসমগ্র কিভাবে বাঁধা যায়? ঝিমধরা মুহূর্তের দেয়ালের ঘরখানি কেমন হবে? আয়নায় মুখ দেখি; আয়নায় আমার মুখ, চোখ; চোখের মধ্যে আরেক আয়নায় আবারও আমি। এইসব গভীরতর পথের স›ধান কখন ফুরোবে! অ›ধকার জ্বলে উঠো, জ্বলে উঠো গাঢ়তর বেগুনি-নীল...
আমি অনেকদিন আগে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম শরীরে জ্বর নিয়ে।
আমার শরীরের জ্বর মাথার ভিতর সূক্ষ্ম একটা ঢেউয়ের মতো উঠা-নামা করছিলো। জলের ভিতর চোখ খুলে সবুজাভ আলোয় আমি যেনো একটা স্বপ্নকে উল্টে পাল্টে দেখছিলাম। স্বপ্নের রঙ লাবণ্যময়, নোনতা। আমার শরীর স্যাঁতসেতে, পিচ্ছিল। একটি মাছের চোখে দুইটি জবাফুল ফুটে উঠেছিলো।
মাছটি এলো; ডানা ঝাপটালো, চোখ টিপলো; চোখ হতে খসে পড়লো একটি ফুল। ফুলটি ভেসে উঠে যাচ্ছিলো-- আমি হাতে নিলাম জবাকুসুম। মাছটি থামলো, তার বুদ বুদ থামলো না...
তোমার রঙ কী?
রূপোলি।
তোমার রঙ কী?
সবুজাভ।
তোমার রঙ কী?
হলুদাভ।
তোমার রঙ কী?
ধূপছায়া।
তোমার রঙ কী?
নীলাভ, সোনালি, কচি লেবুপাতা...
বলতে বলতে মাছটি সবকটি রঙে পরিবর্তিত হলো পরপর।
একটি পাতায় কাঁপে চিরদিন জল। কিসের পাতা? বাঁশের, ঘাসের, চোখের, জবার, লেবুর...? মাছটি ভিন্ন ভিন্ন রঙে আবর্তিত হচ্ছে। শুধালাম, জবাফুল কেনো?
এই জবা শাদা।
জবা শাদা হওয়াই ভালো। দূর থেকে বরফকে শাদা মনে হয়।
উত্তরের ইতিহাসে শাদা ছাড়া কিছু নেই। বুদ বুদ, বুদ বুদ...
আমার মাথার ভিতর খট খট শব্দ হলো। মাথার ভিতর থেকে শব্দদল কানের দিকে যাচ্ছে, আমি দেখতে পাচ্ছি, শব্দের শরীর আমার হাতে ধরা জবাফুল।
শব্দদল কানের দোরগোড়ায় আসতেই আমি চোখ খুললাম। আমি চোখ খুললাম সূর্যের ভিতর। আমার ঘরভর্তি সূর্য। আমার বিছানা, বালিশ, আধখাটানো মশারির একাংশ কুরে কুরে খাচ্ছে সকালের সস্তা রোদ। শব্দেরা এখন দরজার ওপাশে-- খট খট, খট খট...
দরজা খুললাম।
চোখ কচলে তাকালাম-- বাবা। একহাতে লেবুগাছ, ঠিক লেবুগাছ নয়, লেবুগাছের কলম। আর হাতে টব।
কটা বাজে?
দশটা-টশটা হবে।
মানে কী?
রাতে ঘুমাই না।
ভালো। তোর মা-ও রাতে ঘুমাইতো না।
ভিতরে আসো।
রাতে কী করিস? বাবা ঢুকেই মেঝেতে বসলেন। তার হাতে এখনো লেবুগাছ আর টব।
কিছু করি না। শুয়ে থাকি। এপাশ-ওপাশ করি।
লেবুগাছ নিয়ে এলাম। টবে লাগালেই লেবু হবে।
দ্যাখ, ফুল পড়েছে। বাবা মুখ টিপে হাসলেন। তুই চিঠিতে লেবুপাতার কথা লিখেছিলি; তোকে কে যেনো একটা লেবুপাতা দিয়েছে-- আর তুই সেটা গীতবিতানের ‘আমার নিশীথরাতের বাদলধারা’ গানের উপর রেখে দিয়েছিস! তাই নিয়ে এলাম। তোর মা কলম করে রেখেছিলো। লেবু না হোক, বোতলের পানিতে দুইটা লেবুপাতা কচলে দিবি।
লেবুপাতার ঘ্রাণ লেবুর চেয়ে ভালো।
আমার এখনো স্বপ্নের ঘোর কাটে নি। মনে হচ্ছে বাবা নয়, এখনো সেই বাহারি মাছটাই আমার সাথে কথা বলছে।
যা, মাটি জোগাড় কর।
মাটি কই পাবো? এইখানে ইট আর সিমেন্ট ছাড়া কিছু নাই।
কুমোরপাড়ায় যা, মাটি কিনে নিয়ে আয়। বাবা পঞ্চাশটাকার একটা নোট বের করে দিলেন।
টাকা লাগবে না, আছে।
আরে! নে নে। লাগলে আরো নে।
টাকার অভাব নাই। ঘর বেইচ্চা দিছি।
সরল দেহাতি টোনে কথাগুলি বলে যেনো বাবা খানিকটা লজ্জা পেলেন। নতমুখে মুখ টিপে হাসলেন। আমি অবাক হলাম না।
আড়মোড় ভাঙলাম।
কই থাকো এখন?
মন্দিরে মসজিদে থাকি। মন্দিরে থাকলে নিজেরে হিন্দু হিন্দু লাগে। আর মসজিদে থাকলে মুসলমান মুসলমান লাগে। তবে মসজিদে শান্তি নাই।
শ্যাষ রাইতে মুয়াজ্জিনের বেটা ঘুম ভাঙাইয়া দেয়, অযু করতে কয়। আমি বাইর হইয়া রাস্তায় হাঁটাহাটি করি, ভালাই লাগে। মইধ্যে মইধ্যে শালবনে চইলা যাই, শালপাতার গ›ধ শুঁকি। শুকনা পাতার উপর হাঁটি, মর্মর বাজে। শালবনের ওপারে ল্যান্ডস্কেপ দেখি।
আইচ্ছা, দিগন্তের ওপারেও কি ল্যান্ডস্কেপ আছে?
বাবা থামলেন। আমি চুপ করে আছি, চুপিচাপ। হঠাৎ তিনি বলে উঠলেন, দিগন্ত বইলা কিচ্ছু নাই রে, কিচ্ছু নাই...
আমি তার চোখের ভিতর তাকালাম, কেমন খা খা করছে!
তুই ল্যান্ডস্কেপ আঁকিস না?
না।
ক্যান?
ভাল্লাগে না।
কবিতা তো লেখিস, আগের মতো...
আগের মতো না, দুয়েকটা লিখি মধ্যে মধ্যে।
যা, মাটি নিয়া আয়।
তুমি খাইছো কিছু?
হ, খাইছি তো। এইখানে একটা দোকানে ভালা তেহারি বানায়।
আমি চাবির রিং হতে একটা চাবি খুললাম, এইটা রাখো। আমার আসতে দেরি হবে।
বাবা অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর সহসা আমাকে দুহাতে বুকের সাথে চেপে ধরলেন। আমি এইবার অবাক হলাম। ছেলেবেলায় কবে শেষবার বাবা আমাকে বুকে চেপে ধরেছিলেন মনে নেই।
একা একা ঘর পাহারা দিতে ভাল্লাগে না।
তাই বেইচ্চা দিছি।
কৈফিয়ৎ দিচ্ছো কেনো? তোমার ঘর তুমি বেচবা, সেইটা তোমার ব্যাপার।
গাছগুলার জন্য মায়া লাগতাছে। কতো কষ্ট করে তোর মায়ে গাছগুলারে লাগাইছিলো। কতো আলাইয়ে বালাইয়ে পাশে দাঁড়াইছে...
আমি কী বলবো ভেবে পাচ্ছি না।
বাবা অকস্মাৎ আমাকে ছেড়ে দিয়ে স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ালেন। কেমন করে যেনো বললেন, ছবি আঁকা ভুইলা গেছি; আমারে ছবি আঁকতে শিখাবি?
বাবার জন্যে ভয়ানক মায়া হলো আমার, হ্যাঁ, শিখাবো।
যা যা, মাটি নিয়া আয়। লেবুগাছটারে আমি নিজের হাতে লাগাইয়া দিয়া যাবো।
আমি চোখে মুখে একটু পানির ঝাপটা দিলাম।
তারপর বের হলাম। মোড়ের দোকান থেকে দুইটা সিঙ্গারা কিনে হাঁটতে হাঁটতে খেলাম। বাসে উঠার আগে একটা ডাব কিনে খেলাম। বাসের সিটে বসে বুঝলাম আমার ঘুম পুরো হয় নি।
ঝুমঝুম বৃষ্টি হচ্ছে।
অবিশ্রান্ত বর্ষায় আমি হাঁটছি। একটি মাঠ পার হচ্ছি। মাঠে ঘাসবন। একটুও কাদা নেই। স্বচ্ছ জলে আমি পা ডুবিয়ে হাঁটছি।
আমার খালি পা। বৃষ্টির দংশনে আমি ক্রমশ সবুজ এবং সুন্দর হচ্ছি। হাঁটতে হাঁটতে কখন যে ঘাসবনে বসে পড়েছি আমি টের পাই নি। অভাবনীয় সৌন্দর্য আমাকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে আমি স্পষ্ট টের পাচ্ছি। আমি প্রতিটি ঘাসকে আলাদা করে দেখছি।
স্পষ্ট শুনতে পেলাম দুইটা দূর্বাঘাস পরস্পর কথা বলছে।
তুই সখি এতো সবুজ কেনো?
তুই এতো হরিৎ কেনো?
সবুজ আর হরিৎ কি এক জিনিশ?
তোর তো চিকন কোমর।
তোর তো কাঁপছে অধর।
তোর চূড়িদার কই?
বর্ষায় কিসের চূড়িদার?
তোর তো গা কাঁপছে।
যাহ্! শিশির পড়ছে।
শিশির না ছাই, বৃষ্টি হচ্ছে।
তোর চোখ তো লেবুপাতা রঙ।
কচি লেবুপাতা রঙ?
যা যা, কাদা নিয়ে আয়।
কাদা দিয়ে কী হয়?
কাদা দিয়ে মূর্তি হয় লো, মূর্তি হয়।
এইখানে তো কাদা নাই।
যা তবে কুমোড়পাড়ায় যা।
কুমোরপাড়া তো বহুদূর, বহুদূর।
এই মাঠ শেষে আর দুইটা মাঠ
তারপর...
তেপান্তরের মাঠ যে দীর্ঘ পথ।
বৃষ্টিতে দীর্ঘপথ পলকেই শেষ হয়।
যাই তবে, যাই।
তোর গায়ে তো লেবুপাতা ঘ্রাণ।
তোর চোখের পাতা গীতবিতান...
একটা ঘাসফড়িং আমার হাতের পিঠে এসে বসলো। আমি উঠে দাঁড়ালাম। আমার মনে পড়লো, বাবা আমার জন্যে বসে আছেন। বৃষ্টি থামছে না।
ঝমঝম মেঘমল্লার কানে বাজছে। আমি হাঁটতে হাঁটতে চোখ বুজলাম। আমার চোখের পাতায় বৃষ্টির ছাট লাগছে। চোখের পাতায় কম্পমান চিরদিন জলের কাজল। কী সুন্দর! কী সুন্দর!
ঘাসফড়িংটা মনে হয় হূল ফোটাচ্ছে।
মৃদু ব্যথা লাগছে। আমি চোখ খুললাম। বাসের এসিস্টেন্ট ভাড়া চাচ্ছে। ভাড়া দিতে গিয়ে জানলাম আমার গন্তব্য পার হয়ে এসেছে বাস। বেশি দূর না।
হেঁটেই যাওয়া যাবে নামলে। আমি নেমে পড়লাম। আর বৃষ্টি শুরু হলো।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে মনে হলো মাটির ব্যাগটা ক্রমশ ভারি হচ্ছে। ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালাম যখন-- দেখলাম দরজায় তালা।
ব্যাগটা একপাশে নামিয়ে রেখে দরজা খুললাম। বাবা কি খেতে গেলেন? মনে হয় না। ঘরে ঢুকে অবাক হলাম; সমস্ত পরিপাটি, গোছানো। দড়িতে ঝুলানো কাপড় জামা ভাঁজ করা, ইজেল, কালার প্যালেট, রঙের টিউব, ব্রাশ, পেন্সিল প্রতিটি কিছু গোছানো। বিছানার চাদরটা উল্টিয়ে বিছানো।
এ কী! বিছানার উপর একটা মোটা খাম পড়ে আছে একপাশে। বুকের ভিতরটা ধক করে উঠলো আমার। খামটা খুললাম, যা আশঙ্কা করেছিলাম তাই-ই, টাকা। গুনলাম। ঘর বিক্রির টাকা।
মেঝেতে একটা ছবি এঁকে রেখে গেছেন, বাবা। দেখলেই বুঝা যায় আনমনে এঁকেছেন। প্যাস্টেল ঘষে আঁকা। ধানক্ষেতের উপর দিয়ে কাক উড়ে যাচ্ছে, যাচ্ছে দিগন্তে। আমার সমস্ত মূন্য মনে হলো।
এইরকম ভিনসেন্টের একটা পেইন্টিং আছে। গমক্ষেতের উপর দিয়ে কাক উড়ে যাচ্ছে। তার ছবিতে সূর্য দুইটা, আর বাবার ছবিতে তিনটা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।