আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প: গভীর কুয়াশার স্টেশনে

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ

সেলিনা আপা আর আমি একই হোস্টেলে ছিলাম। আমার ...আমার রুমমেট ছিলেন সেলিনা আপা... একদিন হঠাৎ সুইসাইড করেন সেলিনা আপা । তখন আমি সেকেন্ড ইয়ারে।

সেই সেলিনা আপাই এখন আমার কাছে আসে; বলে, তুই খুব সুখি হইছিস না রে নাহিদ? নাহিদের কথাগুলি শুনতে শুনতে মঈনের শীত শীত করে। মৃত মানুষ আবার কি করে ফিরে আসে -মঈনের কপালে ভাঁজ পড়ে। নাহিদের মুখের দিকে তাকায় সে। চশমা-পরা ফরসা মুখটা কেমন শুকনো; জানালা দিয়ে শীতের সকালের আলো এসে পড়েছে। নাহিদের মুখটা ফরসা বলেই ওর চোখের কোণের কালচে ছোপ স্পস্ট বোঝা যায়।

মুখের ছাঁচটা মিষ্টি হলেও মলিন। সব মিলিয়ে ক্লান্তির ছাপ। রাতে ঘুম তেমন হয় না। নাহিদ বলল, সেলিনা আপা পড়ত সোসিওলজিতে। আমার এক বছরের সিনিয়র ছিলেন।

উনি কেন সুইসাইড করলেন-জানতে পেরেছ? মঈনের কন্ঠস্বর গম্ভীর। নাহিদ মাথা নাড়ল। না। সেলিনা আপার কি কোনও অ্যাফেয়ার ছিল? জান? না। জানি না।

মানে আমাকে বলেননি-চাপা স্বভাবের। তবে মাঝেমাঝে কাঁদত। রাত্রে। কাঁদত? হ্যাঁ। ও কিছু না।

সব মেয়েই মাঝেমাঝে কাঁদে রাতের বেলা। ও। আর আমরা মাত্র দুই মাস একসঙ্গে ছিলাম। নাহিদ বলল। সেলিনা আপা রাজবাড়ির মেয়ে।

জানই তো হোস্টেলে ওঠার আগে আমি লালমাটিয়ায় আমার সেতারা ফুপুর বাড়ি ছিলাম। ইউনিভারসিটিটা কাছে হয় বলেই হোস্টেলে উঠলাম। খুব সুন্দর দেখতে ছিল সেলিনা আপা। ফরসা, টল, টলটলে চোখ। মঈন জিজ্ঞেস না-করে পারল না: তুমি কি সত্যি সত্যি তোমার সেলিনা আপাকে দেখতে পাও নাহিদ? না।

দেখতে ঠিক পাই না। তবে আমার মনে হয় যেন সেলিনা আপা আসেন। কথাও পরিস্কার শুনি। খালি বলেন- তুই খুব সুখি হইছিস না রে নাহিদ? ও। সেলিনা সুইসাইড করার সময় তুমি কোথায় ছিলে? বলতেছি।

সেলিনা সুইসাইড করছিলেন দিনের বেলা। সকালের দিকে। তো, সেদিন দুপুরে ক্লাস থেকে হোস্টেলে ফিরে আসি-দেড়টার মতো বাজে। দরজা বন্ধ ছিল। চাবি আমার কাছেও ছিল।

খুলে ভিতরে ঢুকে লাশটা দেখি-বলে নাহিদ চুপ করে থাকে। কী ভাবে ... সিলিং ফ্যানে ... ওড়নায় গলা পেঁচিয়ে। ওহ্ ! আমি চিৎকার করে উঠি। অন্য মেয়েরা ছুটে আসে। আমার মাথা কাজ করছিল না।

পরে সেন্স ফিরলে আমি সেতারা ফুপুকে ফোন করি। ফুপা এসে আমাকে লালমাটিয়ায় নিয়ে যায়। লালমাটিয়ার বাসায় পুলিশ এসেছিল। সেলিনা আপা সম্পর্কে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনেক কথা জিজ্ঞেস করল পুলিশ, আমি যা যা জানি বললাম, ... ফুপা তখন এন এ সাই-এ ছিলেন। পুলিশ আমাকে বেশি বিরক্ত করেনি।

ও। তারপর ফুপুর বাড়ি থেকেই ক্লাস করতাম। পাস করলাম। তারপর তোমার সঙ্গে বিয়ে হল। সেলিনা আপা এতদিন আমার কাছে আসেনি।

বিয়ের পরই প্রথম এল। কখন আসে? ধর, তুমি ঘুমিয়ে আছ-আমি জেগে ... বিছানায় শুয়ে। তখন এসে বলে-তুই খুব সুখি হইছিস না রে নাহিদ? কথাটা শুনে মঈন কী যেন ভাবল। তারপর বলল, আচ্ছা নাহিদ, এমন কি হতে পারে না- ধর সবটাই হেলুসিনেশন; মানে, অবচেতন মনে তুমি ভাবছ আমি সুখি হলাম আর সেলিনা আপা সুখি হল না; অসুখী প্রেমের জন্যই আত্মহত্যা করল? তুমি মনে মনে অপরাধবোধে ভুগছ। অপরাধবোধ থেকেই কল্পনা করছ সেলিনা আপা তোমার কাছে আসেন-এমন হতে পারে না? হতে পারে।

নাহিদ বলল। আচ্ছা। সেলিনা আপার মোবাইল নম্বর তোমার কাছে ছিল না? হ্যাঁ। ছিল। ওনার সুইসাইডের পর ট্রাই করনি? না? না।

করিনি; ভয়ে। নাম্বারটা কি আছে? না ডিলিট করে ফেলছ? না, ডিলিট করিনি। দেখ তো-কত? নাহিদ ওর নকিয়াটা তুলে নিয়ে সার্চ করল। বলে,এই তো- 010154461006 মঈন নম্বরটা ওর সনি এরিকসনে সেইভ করে । তারপর নীল বাটনটা চাপে।

ওপ্রান্তে শোঁ শোঁ শব্দ। হালকা পিয়ানোর আওয়াজ। আশ্চর্য! মঈন সেটটা অফ করে দেয়। ও গা শিরশির করছে। মুখে গভীর চিন্তার ছাপ স্পস্ট।

বিকালের আগে নাহিদ সিগারেট খেতে দেয় না। তারপরও একটা ধরাল। একমুখ ধোঁওয়া ছাড়তে ছাড়তে গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। নাহিদের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে একমাসও হয়নি। বিয়ের পরপরই নাহিদের মানসিক অস্থিরতা মঈন টের পায়।

নাহিদ একা থাকতে পারে না; ওর ভয় করে। সব সময়ই মঈনকে নাহিদের পাশে থাকতে হয়। মঈনদের পারিবারিক ট্র্যাভেল এজেন্সির ব্যবসা। একবেলা হলেও এ্যালিফ্যান্ট রোডের অফিসে বসতে হয়। ছোট ভাই বসে; নাঈম- সে আবার বিবিএর স্টুন্ডেন্ট।

নাহিদের মানসিক সমস্যার দ্রুত একটা সমাধান দরকার। নইলে সব ওলোটপালোট হয়ে যাবে। মঈন জিজ্ঞেস করল, সেলিনা আপার বাড়ি কোথায় বললে? রাজবাড়ি। কেন? ওখানে সেলিনা আপার কে কে আছে-জান? বাবা বেঁচে নেই বলেছিলেন। মা আছে।

মাঝেমাঝেই মোবাইলে ফোন করত। রাজবাড়িতে ওদের বাসা কোথায় বলেছেন জান? হ্যাঁ। রাজবাড়ি মহিলা কলেজের পাশে। ওর আব্বাকে নাকি একনামে রাজবাড়ির সবাই চেনে। ইব্রাহীম ... ইব্রাহীম মোল্লা।

ওদের স মিল ছিল। চল রাজবাড়ি যাই। মঈন বলল। রাজবাড়ি? কেন? নাহিদ অবাক। ধোঁওয়া ছেড়ে মঈন বলল, তুমি মেন্টালি আপসেট, ঢাকার বাইরে গেলে হয়তো তোমার ভালো লাগতে পারে।

তা ছাড়া সেলিনা আপা কেন সুইসাইড করল তা রাজবাড়ি না গেলে জানা যাবে না। সেলিনা আপার আত্বহত্যার প্রকৃত কারণ জানতে পারলে সম্ভবত তোমার অস্থিরতা কমে আসবে। নাহিদ ক্লান্ত গলায় বলল, চল, তাহলে। দুপুরের আগে ওরা ঢাকা থেকে রওনা দিতে পারেনি। দৌলদিয়া ফেরিঘাটে ঘন কুয়াশার কারণে বিশাল জ্যাম ছিল।

রাজবাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা গড়াল। রাস্তায় আলো জ্বলে উঠেছে। বাসস্ট্যান্ডে বাস থেকে নেমে হাঁটতে থাকে। ভীষন শীত। গলির মুখে একটা মিষ্টির দোকান।

দুই কেজি চমচম কিনল ওরা। গলি দিয়ে হাঁটার সময় ওরা খড়িকাঠ পোড়ার গন্ধ পেল। সেলিনাদের বাড়িটা রাজবাড়ি মহিলা কলেজের পাশের গলিতে। বেশিক্ষণ খুঁজতে হয়নি। ইব্রাহীম মোল্লার নাম বলতেই দেখিয়ে দিল।

সুপারি গাছে ঘেরা বাগান। টিন সেডের এক তলা বাড়ি। । বাড়ির সামনে একটা পেয়ারা গাছ। লাল সিমেন্টের বারান্দা।

বাল্ব জ্বলেছিল। একটা শাদা রঙের বেড়াল বসে আছে। বারান্দায় কাঠের বেঞ্চ। সবুজ রং করা দরজা। মঈন অবাক হয়ে যায়।

ওর সব চেনা চেনা লাগে। যেন আগে এখানে একবার এসেছে। কড়া নাড়ার কিছুক্ষণ পর হলুদ সালোয়ার-কামিজ পরা দশ-এগারো বছরের ছোট একটা মেয়ে দরজা খুলে দিল। বাড়িতে বড় কেউ নাই? মেয়েটি বলল, আছে। নাহিদ মিষ্টি করে বলল, গিয়ে বল ঢাকা থেকে মেহমান এসেছে।

বসেন। বলে মেয়েটি সরে যায়। ওরা ভিতরে ঢুকে। বাল্ব জ্বলেছিল। ধূপের গন্ধ পেল।

মফস্বলের মধ্যবিত্তের ছিমছাম বসার ঘর। বেতের সোফা। একপাশে খাট। পুরনো ফিলিপস টিভি। ওরা বসল।

কাঠের টেবিল। মিষ্টির বাক্সটা রাখল। দেওয়ালে একটা মেয়ের বড় রঙিন বাঁধানো ছবিতে নাহিদের চোখ আটকে যায়। ঘোমটা পরা বিয়ের সাজ। গলায় হার।

সোনার। নাহিদ চাপাস্বরে বলল, ছবিটা সেলিনা আপার। তুমি সিওর? হ্যাঁ। বিয়ের ড্রেস যে! কিছুই বুঝতে পারছি না। নাহিদ আর কী বলতে যাবে-একজন মহিলা ঢুকলেন।

মাঝবয়েসি; পরনে শাদা শাড়ি। খয়েরি রঙের শাল জড়ানো। পাকা চুল। চশমা। গায়ের রং ফরসা।

বেশ লম্বা আর ভারি শরীর মহিলার। সেলিনা আপার সঙ্গে মিল আছে। ইনিই সেলিনা আপার মা? নাহিদ আর মঈন উঠে দাঁড়াল। সালাম দিল। বস।

বস। বলে মহিলা বসলেন। ওরাও বসল। মঈন বলল, আমরা ঢাকা থেকে এসেছি। ও।

আমি ... আমি সেলিনা আপার সঙ্গে একই হোস্টেলে ছিলাম। মহিলা অবাক করে দিয়ে বললেন, তোমার নাম কি নাহিদ? হ্যাঁ। নাহিদ। নাহিদের গলাটা কাঁপছে। সেলিনায় তোমর ছবি আমাকে দেখাইছে।

ওহ্। মঈনের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার জামাই? হ্যাঁ খালাম্মা। তুমি কী কর বাবা? আমি ব্যবসা করি খালাম্মা। নাহিদ বলল, ওর ট্যাভেল এজেন্সি আছে। ও।

আমাদের স মিলের ব্যবসা। বড় ছেলেই দেখে। জানই তো সেলিনার বাবা বেঁচে নেই। বউমা আজ সকালেই পাংশা গেছে। সেলিনা? সেলিনার তো গত মাসে বিয়ে হয়ে গেছে।

সেলিনায় তার শ্বশুড়বাড়ি আছে। ঘরের ভিতরে বজ্রপাত হল। মানে! ও। তুমি মনে হয় জান না। সেলিনা পাস করার পর বলে, আম্মা আমি বসে থাকব না।

নিজেই কামাই করে খাব। এই বলে এখানে একটা বাচ্চাদের স্কুলে পড়াইতে ঢুকে। তারপর সেলিনার বিয়ের প্রস্তাব আসে। পাত্র সূর্যনগরের সরকার বাড়ির মেজ ছেলে। আমার বড় ছেলে পাত্রকে চিনে।

ওদের পঁচিশটা ট্রাক আছে, পেট্রল পাম্প আছে। অবস্থা ভালো। গত মাসের ২৬ তারিখে সেলিনার বিয়া হইয়া যায়। নাহিদ ভীষন চমকে ওঠে। গত মাস মানে তো নভেম্বর; নভেম্বরের ২৬ তারিখে ওরও তো বিয়ে হল মঈনের সঙ্গে।

মঈনের দিকে তাকাল। মঈন তীক্ষ্মচোখে সেলিনার মায়ের চোখে দিকে তাকিয়ে আছে। মঈন দ্রুত ভাবতে থাকে। সেলিনার বিয়ে হয়ে গেছে? তা হলে সুইসাইড করল কে? ভুল ঠিকানায় আসি নিতো? না-তা কি করে হয়। সেলিনার মা নাহিদকে তো চিনলেন।

মঈনের ভ্র“ঁ কুচকে । এমন কি হতে পারে না-সেলিনা আসলে সুইসাইড করেনি। নাহিদ কল্পনা করছে। তা হলে? ভাগ্যিস সেলিনা আপা সুইসাইড করেনি। নাহিদকে এখন জীবিত সেলিনা আপার সামনে নিয়ে গেলে নাহিদের মনের বিকার কি ঠিক হয়ে যাবে? সম্ভবত।

মঈন আশান্বিত হয়ে ওঠে। নাঃ, রাজবাড়ি আসা সার্থক। মঈন বলল, সেলিনা আপার শ্বশুড়বাড়ি কোথায় বললেন? সূর্যনগর বাবা। সূর্যনগর? রাজবাড়ির কোন্ দিকে? সূর্যনগর বেশি দূরে না বাবা। রাজবাড়ির পরের স্টেশন।

ট্রেনে যাওয়া যায়। সরকার বাড়ি- সবাই চেনে ওদের। স্টেশনের একেবারেই কাছেই সেলিনার শ্বশুড়বাড়ি। দাঁড়াও সেলিনারে ফোন করতেছি। বলে সেলিনার মা চেঁচিয়ে বললেন, অ্যাই শিউলি, আমার ফুনটা আন তো।

হায় রে-দুইদিন যদি আগে আসতা। গত পরশু জামাই নিয়া আইসা সেলিনা ঘুরে গেল। একটু পর সেই হলুদ সালোয়ার-কামিজ পরা ছোট্ট মেয়েটি ঘরে ঢুকল। হাতে একটা ছোট নীল রঙের মটোরোলা । সেলিনার আম্মা অনেকক্ষণ চেস্টা করলেন।

লাইন পেলেন না। বিরক্ত হয়ে বললেন, ধুরও। মোবাইল আইজ ফোনের কী হইল। সকালেও তো কথা বললাম। সেলিনার শ্বশুড় নামাজী।

এখন নামাজের টাইম ... মনে হয়-এ্যাই, শিউলী। মিষ্টির বাকশোটা নিয়া যা। আর চায়ের পানি বসা। আমি আসতেছি। মঈন বলল, আমরা একবার সূর্যনগর যেতে চাই খালাম্মা।

যাইবা? হ্যাঁ। এতদূর এসেছি যখন- যাও তাহলে। আজ আর ট্রেন নেই। কাল ভোরে আছে। রিশকায় যাওয়া যায়।

এখন সন্ধ্যা হইয়া গেছে। অত দূর রিশকা নিয়া কেউ যাইব না। আজ রাতটা এইখানেই থাক তুমরা-বলে নাহিদের দিকে তাকিয়ে বললেন, সেলিনা তোমার কথা কত বলত। আজ রাইতটা থাইকা একেবারে কাল ভোরে রওনা হইয়ো কেমন? নাহিদ মাথা নাড়ল। ওরও সূর্যনগর গিয়ে একবার সেলিনা আপার সামনে দাঁড়াতে ইচ্ছে করছে।

মঈন বলল, সেলিনা আপার নাম্বারটা দেন খালাম্মা। আমরা সূর্যনগর স্টেশনে থেমে সেলিনা আপাকে ফোন করব। সেলিনা আপার আম্মা নাম্বারটা বললেন, 010154461006 আশ্চর্য! নম্বর তো ঠিকই আছে। মঈন অবাক হয়ে যায়। পরদির ভোর।

ঘন কুয়াশায় চারদিক ছেয়ে আছে। কুয়াশার ভিতর দিয়ে হেঁটে হেঁটে রাজবাড়ি স্টেশনে ওরা পৌঁছে যায়। স্টেশনে ট্রেন থেমে ছিল। ট্রেন ছাড়ল পাঁচটা দশে । হুইশেল দিয়ে ছুটল ঘন কুয়াশার ভেতর দিয়ে।

পয়তাল্লিশ মিনিটের মতন লাগল সূর্যনগর স্টেশনে পৌঁছতে। নির্জন স্টেশন। ঘন কুয়াশার কারণে বাইরে কিছুই স্পস্ট দেখা যায় না। একটা বাল্ব জ্বলেছিল। লোকজন নেই একেবারে।

ফাঁকা স্টেশন। মঈন অবাক হয়ে যায়। ওর সব চেনা চেনা লাগে। যেন আগে একবার এসেছে। মঈন ঘড়ি দেখল: সকাল ছ’টা।

ওপাশে একটা বেঞ্চ। নঈম বলল, ওখানেই বসি। রোদ উঠলে বেরুবে। ঠিক আছে। নাহিদ বলল।

একটু পর বলল, এই মঈন, সেলিনা আপাকে ফোন কর না। এত সকালে উঠবে? উঠবে। গ্রামের মেয়ে। জ্যাকেটের পকেট থেকে সনি এরিকসন বার করে মঈন নাম্বার চাপে। সেই শোঁ শোঁ শব্দ; আর হালকা পিয়ানোর আওয়াজ।

শীতে কুঁকড়ে যায় মঈন। কী বলতে যাবে- হঠাৎই কুয়াশা ফুঁড়ে একটা লোক উঠে এল। বেশ বৃদ্ধ। বয়স অন্তত সত্তরের কম না। মাথায় ধূসন রঙের মাঙ্কি ক্যাপ।

মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। গায়ে রঙীন সোয়েটার। খাকি প্যান্ট। বেঞ্চের একপাশে বৃদ্ধ বসল। মঈন বিড়ির গন্ধ পেল।

অস্বস্তি লাগলেও তো আর ‘না’ করা যাবে না। সরকারি স্থান। দু-হাত কচলে বৃদ্ধ বলল, বড় শীত সার। অচেনা জায়গা। মুড দেখিয়ে লাভ নেই।

নঈম বলল, হ্যাঁ। বৃদ্ধ বলল, লোকে আমাকে বলে, রহমত মাস্টার। আশেপাশেই থাকি। অনেক বছর স্টেশন মাস্টারি করছি। মায়া ছাড়তে পারি না।

তাই এসে বসে থাকি। এখন ফজরের নামাজ পড়ে আলাম। ও। আপনারা ঢাকা থেকে আরছেন বলে মনে লয়? হ্যাঁ। তা ইদিকে কই যাইবেন আপনেরা? সরকার বাড়ি।

ও। আপনারাও সরকার বাড়ি যাইবেন? লোকটার কন্ঠস্বরে হতাশার সুর। আমরাও সরকার বাড়ি যাব মানে? মঈনের কন্ঠস্বর তীক্ষ্ম হয়ে উঠল। না। মানে নাই কিছু।

তয় যাইয়েন না। বিপদে পড়বেন। দুজনেই চমকে ওঠে। কেন? যাব না কেন? পুলিশ। পুলিশ মানে? মানে হইল-সরকার বাড়িতে পুলিশ আর পুলিশ।

পুলিশ কেন? কাল রাইতের বেলায় সরকার বাড়ির মেজবৌ গলায় দড়ি দিসে। দুজনেই চমকে ওঠে। কি! মেজবৌয়ের কি নাম জানেন? মঈনের কন্ঠস্বর কর্কস শোনাল। হ। সেলিনা আক্তার।

রাজবাড়ির ইব্রাহীম মোল্লার মাইয়া। কি! নাহিদের শরীরটা জমে ওঠে। ও নঈমের দিকে তাকাল। নঈম চোখের দৃষ্টি ভীষন উদ্ভ্রান্ত দেখাচ্ছে । নাহিদের হঠাৎ চোখে পড়ল দূরের কুয়াশার ভিতরে কে যেন দাঁড়িয়ে।

একটা মেয়ে। চাদর জড়ানো। নাহিদ মেয়েটাকে চিনতে পেরে ভীষন চমকে ওঠে। চাপাস্বরে বলে ওঠে, মঈন। কী? মঈন ভীষন চমকে ওঠে।

সেলিনা আপা! কই? ঝট করে ঘুরে তাকাল। ওই, ওই যে- মঈন উঠে দাঁড়ায়। নাহিদও উঠে দাঁড়ায়। আতঙ্কে মুখটা নীল হয়ে গেছে। মঈন ফিসফিস করে বলে, নাহিদ, তুমি বস।

যা করার আমি করছি। বলে সেলিনার দিকে মঈন এগিয়ে যেতে থাকে। বুকটা ভীষন কাঁপছে। রহমত মাস্টার বলল, গত মাসে সূর্যনগরের সরকার বাড়ির মেজ ছেলের বিবাহ খাইছি। আল্লারে কত মানুষ আইছিল।

আমার কুসুম বাঁইচা থাকলে লইয়া যাইতাম । নাহিদ লোকটার কথা শুনছিল না। সেলিনা আপার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর বুকটা ভীষন কাঁপছে। শ্বাস টানল নাহিদ।

ততক্ষণে মেয়েটির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে মঈন। গায়ে চাদর জড়ানো। মাথা ঢাকা। ফরসা, লম্বা, টলটলে চোখ। আপনি কি সেলিনা ...? মেয়েটি মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।

আমি মাইনুল ইসলাম- নাহিদের হাজব্যান্ড। নাহিদ কে তো আপনি চিনতেন? সেলিনা মাথা নাড়ল। হ্যাঁ, চিনতাম। বলে একবার নাহিদের দিকে তাকাল। আপনার কাছেই আমরা এসেছি।

মঈন বলল। জানি। আম্মা, ভোরে ফোন করছিল। আমি আবার ফজরের ওয়াক্তে উঠি। কালরাত্রে লাইন পায়নি।

আমার শ্বশুড় ভীষন কনঝারভেটিভ। আপনারা গেলে নানা কথা বলবে। তাই লুকিয়ে স্টেশনে এলাম। আশা করি আমাকে ভুল বুঝবেন না। না, না ঠিক আছে।

বলে মঈন চুপ করে থাকে। তারপর বলে, ইয়ে ...মানে ...গত মাসে নাহিদের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। বিয়ের পর ওর ...মানে নাহিদের মানসিক সমস্যা টের পাই...নাহিদ বলে, একদিন আপনি নাকি সুইসাইড করলেন। তারপর আপনি নাহিদের কাছে আসেন। এসে বলেন, তুই সুখি হইছিস না নাহিদ? সেলিনা ম্লান হাসল।

না, আমি সুইসাইড করিনি। দেখতেই পাচ্ছেন। আসলে নাহিদেরই সেকেন্ড ইয়ারে থাকার সময় একবার নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়েছিল। নার্ভাস ব্রেকডাউন? কেন? ইয়ে ...মানে আরিফ ভাইয়ের সঙ্গে নাহিদের অ্যাফেয়ার ছিল। আরিফ ভাই সূর্যসেন হলে থাকত।

ফাস্ট ইয়ারের এক মেয়ের সঙ্গে আরিফ ভাইয়ের কেলেঙ্কারী জানাজানি হয়ে গেলে নাহিদ মেন্টালি ভেঙ্গে পড়ে। ওর সেতারা ফুপু এসে নাহিদকে লালমাটিয়ার নিয়ে যায়। তারাই নাহিদকে মানসিক রোগবিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। নাহিদকে অনেকদিন অষুধও খেতে হয়েছিল। নাহিদ আর কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে উঠে আসে।

সেলিনা আপা তুমি এখানে? সেলিনা ম্লান হাসল। তুমি ... তুমি গতকাল রাতে সুইসাইড করনি? নাহিদ জিজ্ঞেস করে। আশ্চর্য! আমি কেন গতকাল রাতে সুইসাইড করতে যাব? নাহিদ হাত তুলে বলল, ঐ যে বুড়াটা বলল, কাল রাইতের বেলায় সরকার বাড়ির মেজবৌ গলায় দড়ি দিসে। কে? কোন্ বুড়া? তিনজনই ফিরে তাকায়। বেঞ্চটা ফাঁকা।

ওখানে কেউই বসে নেই। কুয়াশা কেটে অল্প অল্প রোদ উঠছে। আশ্চর্য! রহমত মাস্টার কোথায় গেল? নাহিদের কন্ঠস্বর কেমন বিমূঢ় শোনাল। ও। রহমত মাস্টার আসছিল? সেলিনা জিজ্ঞেস করে।

হ্যাঁ। বুঝছি। কী বুঝছ? সেলিনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, সে অনেক কথা। আমার বিয়ার পর আমার জামাইয়ের মুখে শুনছি। রহমত মাস্টার -মানে ঐ বুইড়াটা ...এই স্টেশনের স্টেশনমাষ্টার ছিল।

তার এক মেয়ে ছিল । নাম কুসুম; ফুটফুটে কিশোরী-তখন কুসুমের ষোলসতের বছর হবে -শামসুল নামে এক ডাকপিওনের প্রেমে পড়ল কুসুম। সূর্যনগরের মন্ডল বাড়ির বিধবা বৌয়ের সঙ্গে শামসুল কেলেঙ্কারী জানাজানি হলে কুসুম মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে ...মনের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে ওড়নায় গলায় আত্মহত্যা করে। ওহ! হ্যাঁ। তারপরই রহমত মাস্টার মেয়ের শোকে পাগল হয়ে যায়।

এইসবই সেই পাকিস্তান আমলের কথা। এইখানকার লোকে বলে-মাঝেমাঝে নাকি রহমত মাস্টারকে দেখা যায়। স্টেশনে এসে বসে থাকে। কেউ বলে লোকটা মরে গেছে। কেউ বলে বেঁচে আছে।

নাহিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সেলিনা বলল, আমি যাই। দেরি হলে আমার সর্বনাশ হবে। আমার শ্বশুড় আবার ভীষন কনঝারভেটিভ। তুমি ভালো থেক নাহিদ।

অতীত মনে রাখতে নেই ভাই। আর, নাহিদ তুমি ভালো একটা বর পাইছ। বলে, সেলিনা ঘুরে দ্রুত পায়ে চলে যায়। ওরা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে বেঞ্চের কাছে এসে বসে।

ক্লান্ত। অবসন্ন। ওরা অনেক ক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। কেউ কোনও কথা বলে না। নাহিদ ফিসফিস করে বলে, ফিরবে? হু।

এখানে আর বসে থেকে কী লাভ। মঈন বলল। রাজবাড়ি ফেরার আর ট্রেন নেই মনে হয়। মনে হয় না । রিক্সা নিই তাহলে? চল।

বলে মঈন উঠে দাঁড়াল। তারপর হাঁটতে হাঁটতে ওরা স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে আসে। একটা সিগারেট ধরায় মঈন । স্টেশনের বাইরে শীত সকালের রোদ ঝলমল করছিল। বাতাসে বুনো মালঞ্চের মৃদু গন্ধ।

লোহার রেলিংয়ের এপাশে একটা বড় কড়–ই গাছ। রাজনৈতিক শ্লোগান লেখা স্টেশনের লাল দেওয়াল। চায়ের দোকান। ভ্যান। কয়েকটা রিক্সা।

মঈন জিজ্ঞেস করল, রাজবাড়ি যাবে? যামু। রিক্সাওয়ালা মাথা নাড়ে। ওরা রিক্সায় উঠে বসল। নাহিদ জিজ্ঞেস করে, সেলিনা আপা তোমাকে সূর্যসেন হলের আরিফ ভাইয়ের কথা বলছে না? হ্যাঁ। বলছেন।

ধোঁওয়া ছেড়ে মঈন বলল। সূর্যসেন হলের আরিফ ভাইয়ের সঙ্গে আমার অ্যাফেয়ার ছিল। নাহিদের কন্ঠে সামান্য জেদ। ও। রিলেশন খুব ডিপ ছিল।

সপ্তাহে দুইতিনবার আমাকে রুমে নিয়া যেত। হু। এই কথাটা বিয়ের পর তোমাকে বলতে পারি নাই। এখন বললা। শুনলাম।

নাহিদ চুপ করে থাকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে। খোঁচায়-তুমি কিছু বলবা না? কী বলব? আমাকে তোমার ঘৃনা হচ্ছে না? না। সত্যি? সত্যি। রিক্সাটা এখন স্টেশনের পাশ দিয়ে যাচ্ছে।

নাহিদ একবার রোদ ঝলমলে স্টেশনের দিকে তাকায়। ওর কেন যেন মনে হল রেলস্টেশনে সেলিনা আপা কি রহমত মাষ্টার কেউই ছিল না। এমন কী ভোরের ঘন কুয়াশাও ছিল না। কী সুন্দর রোদ ঝলমল করছে। সেলিনা আপা বললেন, নাহিদ তুমি ভালো একটা বর পাইছ।

সেলিনা আপার এই কথাটা খালি সত্য। নাহিদ শ্বাস টানে- শীত মাখানো ঝলমলে রোদে টের পায় মনের অসুখবিসুখ সব সেরে গেছে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.