আমি কোনো আগন্তুক নই। এই খর রৌদ্র জলজ বাতাস মেঘ ক্লান্ত বিকেলের পাখিরা আমাকে চেনে
ছেলেবেলায় কেবল গল্পের বইয়ের রঙিন পাতাতেই "কার্নিভাল" শব্দটির সাথে আমার দেখা হত। কাজেই ছাপার অক্ষরের সেই কার্নিভাল শব্দটির গায়ে মোড়ানো রঙ-নকশা আর উচ্ছ্বসিত খুশিকে কল্পনার চোখ দিয়েই ছুঁয়ে ছেনে দেখতে হত আমায়। বাস্তবে এর সাথে কখনও আমার দেখা হয়নি। আজ যখন আমি এই এত্তো বড়, যখন স্বদেশ ছেড়ে অনেক দূরের এক দেশে আমার দিনগুলো বিষণ্নতায় হাঁফিয়ে উঠেছে, ঠিক তখন হঠাৎ করেই শৈশব-কল্পনার রঙে মোড়ানো কার্নিভালের দেখা পেলাম আমি।
তবে এবার আর বইয়ের পাতায় কাল্পিক মানসভ্রমণ নয়, বার্লিনে থাকার সুবাদে দিব্যি স্বশরীরে ঘুরে দেখে এলাম বার্লিনের সাংস্কৃতিক কার্নিভাল (২০০৯ এর ২৯ মে - ১ জুন)।
বার্লিনের ষষ্ঠ উন্মুক্ত পথোৎসব কার্নিভাল। প্রতিবছরই এ গ্রীষ্মোৎসবে জার্মানিসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত বিচিত্র সাংস্কৃতিক বলয়ের মানুষেরা পথের উন্মুক্ত মঞ্চে শোভাযাত্রার মাধ্যমে নিজেদের বহুকালের যাপিত সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় পথের দু'ধারের উৎসুক দর্শকদের। এছাড়া দর্শকদের পাশাপাশি প্রতিটি দেশের বিচিত্র সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড উপভোগ করেন বিচারকদের একটি দল, যাঁরা দিন শেষে চুলচেড়া বিশ্লেষণ করে যে কোন একটি দেশকে শ্রেষ্ঠ সংস্কৃতি উপস্থাপক দেশ হিসেবে প্রথম হবার সম্মান প্রদান করেন। তবে বলে রাখা ভাল যে, কার্নিভালে অংশ নেয়া দেশগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবের চাইতেও নিজস্ব সংস্কৃতিকে ভালবেসে উপস্থাপন করার আগ্রহ বা আবেগটাই বেশি থাকে।
এবছর বার্লিনের এই গ্রীষ্মোৎসবে প্রায় সত্তরটি দেশের মা্নুষ অংশগ্রহণ করেছিল, বাংলাদেশও বাদ পড়েনি সে তালিকা থেকে। আর এ কারণেই ব্রাজিলিয়ান সাম্বা, ল্যাটিন আমেরিকান সালসা ড্যান্স থেকে শুরু করে ভারতীয় রথযাত্রা, বাংলাদেশের পল্লীগীতি কিছুই বাদ পড়েনি এতে। প্রায় ১৪ লক্ষ লোকের সমাগম ঘটেছিল এই প্রাণোৎসবে। দেশপ্রেমে আবেগায়িত বিচিত্র দৈহিক কাঠামোর মানুষেরা স্বদেশীয় পোশাক-অলংকার এবং মুখোশে নিজেদের সজ্জিত করে নাচ গান আর বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গিতে দর্শকদের মনোরঞ্জন করছিল। স্বদেশীয় পুরাণ-কথা, আর রূপকথার চরিত্রের ছদ্মবেশেও সেজেছিল কেউ কেউ।
সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় হল প্যারেড করে নেচে গেয়ে লম্বা পথ পাড়ি দিলেও শোভাযাত্রীদের চোখেমুখে ছিল না কোন ক্লান্তির ছাপ, তার বদলে ছিল দেশের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসার আবেগ।
কার্নিভাল উপভোগ করতে করতেই আমার চোখ বার বার চলে যাচ্ছিল ক্ষুদে দর্শকদের দিকে। এতো রঙ - এতো খুশি আর এমন আনন্দিত মানবস্রোতের সঙ্গে এর আগে হয়তো পরিচয় ঘটেনি বলেই তাদের চোখে ছিল অবাক বিস্ময়। উপরন্তু কার্নিভালের জন্য সাদা বা রঙিন কাগজে তৈরি দানবাকৃতির মানুষ বা কঙ্কালের নখর শোভাযাত্রার সময় বার বার নেমে আসছিল তাদের দিকে, যেন শিশুদের নরম চিবুকগুলোই ছিল তাদের একমাত্র আকর্ষণ। শিশুরা তাই ভয়ে মুখ লুকোচ্ছিল সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় মায়ের বুকের উষ্ণতায়।
যদিও পরক্ষণেই মায়ের অভয়বাণী শুনে মুখ তুলছিল ভয়ে ভয়ে। কোন কোন শিশুর আবার ভয়ের চাইতে কৌতূহলই বেশী ছিল। তারা ছোট্ট হাতের নরম তেলোতে ছুঁয়ে দেখতে চাইছিল দানবের কদর্য থাবাগুলোকে। বাবার কাঁধে চড়ে কিম্বা মায়ের হাত ধরে গুটি গুটি পায়ে কার্নিভাল দেখতে আসা এই ছোট্ট শিশুগুলো এতসব চমকপ্রদ আয়োজনে ভুলেই গিয়েছিল তাদের স্বভাবসুলভ হাজার বায়নাক্কার কথা।
কিশোর-তরুণ-মধ্যবয়সী আর বৃদ্ধ দর্শকেরাই কি কম যান! তাদের চোখে মুখেও ছিল অবাক আনন্দ।
এমনিতেই কার্নিভাল উপলক্ষে পুরো বার্লিনে চারদিন ধরে বইছিল ছুটির হাওয়া। সেই সুবাদে কাজের চাপে জং ধরা নির্জীব প্রাণগুলোতে লেগেছিল স্বস্তির আমেজ। পারিবারিক উষ্ণ আন্তরিকতায় কফি-সসেজ আর আইসক্রিম হাতে কার্নিভাল উপভোগ করা জর্মনদের খুশিভরা মুখের দিকে তাকিয়ে মনেই হচ্ছিল না যে এরাই আবার কাজের দিনগুলোতে গাম্ভীর্যের মুখোশ এঁটে পা বাড়ায় কর্মস্থলের দিকে। ছুটির আমেজ আর কার্নিভালের রঙের মিছিল ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছিল তাদের সেই গাম্ভীর্যের মুখোশগুলোকে। চারদিকে ছিল শুধু জীবনের উত্তাপ আর খুশির রঙ।
এতো মানুষের ভিড়েও আমার সবচাইতে ভাল লাগছিল দর্শকদের সুশৃঙ্খলতা।
এতো ভাললাগার মাঝেও আমার সতৃষ্ণ নয়নযুগল খুঁজে ফিরছিল বাংলাদেশের দলটিকে। অবশেষে দেখা মিলল তার। নানান রঙা সুরের মাঝে হঠাৎ কানে ভেসে এলো পল্লীগীতির কয়েকটি চরণ। শুনেই ভিড়ের মাঝে হেঁটে খুঁজে বের করলাম দলটিকে।
ঢাক-ঢোল-বাঁশি হাতে বাঙালি সাজে শাড়ি লুঙ্গি পরে নেচে গেয়ে দর্শকদের মাতিয়ে তুলেছিল ছোট্ট সেই বাঙালি দলটি। একজন বাঙালির হাতে ছিল এক কৌটো আবির। জর্মন-ইংরেজ নির্বিশেষে পথের ধারের সকল দর্শকের কপালে তিনি পরিয়ে দিচ্ছিলেন জয়-টীকা। আমিও আস্তে করে মাথা নোয়ালাম, সহাস্যে গ্রহণ করলাম সিঁদুরে লাল টিপ। বুকের ভেতর অনুভব করলাম একধরনের অহংবোধ।
নিজের অজান্তেই আবেগাপ্লুত আমি সাধারণ একজন দর্শক হয়েও পা বাড়ালাম দলটির সাথে। হয়ত বিশাল বিশাল শোভাযাত্রার ভিড়ে আমার দেশের ছোট্ট এই শোভাযাত্রাটির অস্তিত্ব খুব সরবে ঘোষিত হয়নি, তবু বিদেশের মাটিতে অল্প কিছু বাঙালি প্রাণ যেভাবে প্রাণোৎসারিত আন্তরিক ভালবাসায় নিজের সংস্কৃতিকে সগর্বে উপস্থাপন করেছিলেন তা ছিল সত্যিই প্রশংসনীয়। সত্যিই গৌরব বোধ করছিলাম আমি।
কার্নিভাল শেষে ঘরে ফিরলাম ক্লান্ত শরীর আর অদ্ভুত ভাল লাগা নিয়ে। ছোট্ট বেলার গল্পের বইয়ে পড়া সেই কার্নিভাল আজ স্বশরীরে ধরা দিল আমার কাছে, হতে পারলাম শৈশবের গন্ধবহ সেই রঙিন কার্নিভালের আমিও একজন।
এ অনুভূতি সত্যিই অতুলনীয়, মধুর।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।