আহসান মোহাম্মদ
আলফাজ আনাম
শ্রীলঙ্কায় প্রায় তিন দশক ধরে চলা গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটেছে। একই সাথে জাফনায় অবসান হয়েছে প্রভাকরণ যুগের। দেশটির সেনাবাহিনী নিশ্চিত করেছে, বিশ্বের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ গেরিলা বাহিনীগুলোর একটি লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলম বা এলটিটিই’র প্রধান ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণ যুদ্ধে মারা গেছেন। দক্ষিণ এশিয়ায় শিক্ষা ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অগ্রসর এ দেশটি দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের এই ক্ষত কিভাবে কাটিয়ে ওঠে, তা এখন দেখার বিষয়। অধিকারবঞ্চিত তামিলদের মূল স্রোতোধারায় ফিরিয়ে আনা হবে শ্রীলঙ্কার সরকারের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
পিছিয়ে পড়া তামিলদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বঞ্চনা দূর করার উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হলে তাদের আন্দোলন নতুন রূপ নিতে পারে। এ ছাড়া বিদেশী সাহায্যপুষ্ট বিচ্ছিন্নতাবাদ সহজে লয়প্রাপ্ত হয় না। এ ধরনের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের নানা শর্ত সমাজের মধ্যে গড়ে ওঠে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র তার নিরাপত্তা কৌশলের অংশ হিসেবে আবার তাদের ব্যবহার করতে পারে। তামিলদের ক্ষেত্রেও তেমনটি ঘটেছে।
তামিলদের এ বিচ্ছিন্নতাবাদ একদিনে গড়ে ওঠেনি। তামিলদের স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ার যে স্বপ্ন, তাকেও কাজে লাগানো হয়েছিল বৃহৎ প্রতিবেশীর নিরাপত্তা কৌশল হিসেবে। শ্রীলঙ্কার প্রাতিষ্ঠানিক সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এলটিটিই’র দীর্ঘ সময়ের যুদ্ধের শক্তি সঞ্চয়ে এই কৌশলই কাজ করেছে। তামিলরা শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সময়ে। দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, ১৯৯১ সালে এই তামিলদের হাতে নিহত হয়েছিলেন তার পুত্র ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী।
কেন ইন্দিরা গান্ধী তামিলদের সহায়তা করেছিলেন, এর একটা ধারণা পাওয়া যাবে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং র-এর কর্মকর্তা এবং র-এর কাউন্টার টেরোরিজম শাখার সাবেক প্রধান বি রমনের লেখা দি কাওবয় অব র ডাউন মেমোরি লেন বইয়ে। রমন লিখেছেন, ‘সিআইয়ের হয়ে সিঙ্গাপুরভিত্তিক একটি কোম্পানি শ্রীলঙ্কা সরকারের কাছ থেকে পেট্রল স্টোরেজ ট্যাংক ভাড়া নেয়ার চেষ্টা চালায়। একই সাথে ভারতীয় ও সোভিয়েত নৌবাহিনীর জাহাজগুলো মনিটর করার জন্য ভয়েস অব আমেরিকার সম্প্রচার বাড়ানোর অনুমতি প্রদান করে। শ্রীলঙ্কা সরকারের এ ধরনের তৎপরতায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন ইন্দিরা গান্ধী। ’
রমনের ভাষায়, ‘ভারতের নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট বিষয়ের প্রতি বারবার তাদের সংবেদনহীনতার ঘটনা ইন্দিরা গান্ধীকে মর্মাহত করে।
এ দিকে শ্রীলঙ্কার সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলি ও সংখ্যালঘু তামিলদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে। এর ফলে ১৯৮৩ সালে কলম্বোতে তামিলবিরোধী দাঙ্গা এবং এলটিটিই’র নেতৃত্বে একটি স্বাধীন তামিল আবাস ভূমির আন্দোলন শুরু হয়। ইন্দিরা গান্ধীর বরাবরই দক্ষিণ ভারত, বিশেষ করে তামিলনাড়ুর প্রতি মমত্ববোধ ছিল। ওই এলাকার লোকরা সুদিনে-দুর্দিনে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। সিংহলিদের হাতে শ্রীলঙ্কার তামিলদের নির্যাতনের খবরে ইন্দিরা ব্যথিত হন।
ফলে তিনি তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। তিনি র’কে শ্রীলঙ্কার তামিলদের সাহায্য করতে সক্রিয় ভূমিকা পালনের নির্দেশ দেন। ভারতের নিরাপত্তার ব্যাপারে শ্রীলঙ্কা সরকারের সংবেদনহীনতা এবং শ্রীলঙ্কার তামিলদের দুর্ভোগ দুটোই ইন্দিরা গান্ধীকে এ ধরনের নীতি অবলম্বনে প্রভাবিত করে। ’
বি রমন তামিলদের প্রতি ইন্দিরা গান্ধীর সহমর্মিতার দিকটি বড় করে দেখানোর চেষ্টা করলেও সে সময় ভারতের নিরাপত্তা কৌশল ছিল প্রতিবেশী দেশগুলোকে অস্থির রাখা। শুধু শ্রীলঙ্কা নয়, বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদীরাও এ সময় থেকে ভারতীয় সমর্থন নিয়ে সশস্ত্র তৎপরতা চালাতে থাকে।
একই সময়ে পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আর্থিক ও সামরিক সহায়তা প্রদান করে ভারত। সে সময় র আফগানিস্তানের সোভিয়েত সমর্থিত সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা খাদ’কে ব্যবহার করে। এখনো বেলুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ভারত সামরিক ও আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে বলে পাকিস্তান অভিযোগ করছে। আফগানিস্তানে ভারত খুবই তৎপর রয়েছে, যা পাকিস্তানের নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের মাথাব্যথার কারণ। ভারত কিভাবে এ ধরনের সংগঠনগুলোকে সহায়তা দিয়ে থাকে, তার চিত্রও পাওয়া যাবে রমনের বইয়ে।
তামিলদের সাহায্য প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘তারা (এলটিটিই) আইবি এবং সামরিক গোয়েন্দার অজান্তেই র থেকে টাকা নেয় আবার সামরিক গোয়েন্দা থেকে টাকা নেয় র এবং আইবিকে না জানিয়ে। একই সাথে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কোনোটাকেই না জানিয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অনুদান গ্রহণ করে। তামিলনাড়ু পুলিশের কাছ থেকে টাকা নেয় তারা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে না জানিয়ে। ’
রমনের জবানিতে এলটিটিইকে বহুমুখী আর্থিক সাহায্য দেয়ার চিত্র আমরা দেখছি। নিঃসন্দেহে শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এলটিটিইকে অস্ত্র, গোলাবারুদও ভারত সরবরাহ করেছে।
ভারত এলটিটিইকে সব ধরনের সাহায্য দিলেও তামিলদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ে উঠুক, তা ভারত চায়নি। কারণ এর প্রভাব পড়বে ভারতীয় রাজ্য তামিলনাড়ুতে। তারা তামিলদের ততটুকুই সহায়তা করেছে, যতটুকুর মাধ্যমে শ্রীলঙ্কা অস্থির থাকে। আর এ কারণে রাজিব গান্ধীর শাসনামলে শ্রীলঙ্কায় ভারতীয় সৈন্য প্রেরণ নিয়ে এলটিটিই’র সাথে ভারতের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট জুলিয়াস জয়বর্ধনের সময়ে জরুরি অবস্থা জারিসহ দেশটির অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি খুব খারাপের দিকে গেলে ভারত শ্রীলঙ্কার ওপর নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করতে থাকে।
১৯৮৭ সালে রাজিব গান্ধীর সময়ে ইন্দো-শ্রীলঙ্কা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী দেশটিতে শান্তি ফিরিয়ে আনতে ভারতীয় সৈন্য পাঠানোর ব্যাপারে শ্রীলঙ্কাকে অনেকটা চাপের মুখে রাজি করানো হয়। আসলে শ্রীলঙ্কার ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাই ছিল ভারতের কৌশল। কিন্তু ভারতের সৈন্যদের উপস্থিতি সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলিরা যেমন মেনে নেয়নি, তেমনি ভারতীয় সৈন্যদের আচরণে তামিলরাও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। যে তামিলদের তারা আগে সাহায্য করেছিল, ভারতীয় সৈন্যরা শ্রীলঙ্কায় প্রবেশ করে তাদেরই দমনের চেষ্টা করে।
শ্রীলঙ্কার তামিল এলাকায় শান্তি রক্ষার জন্য পাঠানো ভারতীয় শান্তিরক্ষী বাহিনীর হাতে তামিলরা নানাভাবে নিগ্রহের শিকার হয়। এলটিটিই’র পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, সেখানে ভারতীয় বাহিনী ব্যাপকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটিয়েছে। তামিলদের বিরোধিতার সাথে সাথে সিংহলি জনগণের প্রবল বিরোধিতার মুখে ভারত সৈন্য প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়।
মা ইন্দিরা গান্ধী শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে তামিলদের ব্যবহার করতে চাইলেও এ ঘটনার পর তামিলরা পুত্র রাজিবের ওপর ক্ষুব্ধ ছিল। ১৯৮৯ সালে রাজিব গান্ধীর নেতৃত্বে নির্বাচনে কংগ্রেস হেরে যায়।
কিন্তু তামিলরা এ ঘটনার প্রতিশোধ নিতে ১৯৯১ সালে তামিলনাড়ুতে এক নির্বাচনী জনসভায় আত্মঘাতী বোমা হামলা চালায়। এতে নিহত হন রাজিব গান্ধী। তখন তিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না। বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে তিনি জনসভায় বক্তব্য রাখার জন্য তামিলনাড়ুতে গিয়েছিলেন। রাজিব গান্ধীর মৃত্যুর পর থেকে ভারত সরকার তামিলদের সামরিক ও আর্থিক সহায়তা দেয়ার নীতি থেকে সরে আসে।
পরে সোনিয়া গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকার বলতে গেলে তামিলদের কাছ থেকে পুরোপুরি মুখ ফিরিয়ে নেয়। অবশ্য ধর্মীয় কারণে ও তামিলনাড়ুর আঞ্চলিক রাজনীতির প্রভাবে তামিলদের প্রতি ভারতীয়দের একধরনের দুর্বলতা আছে। এখানে উল্লেখ করা দরকার, ফিলিস্তিনিরা আত্মঘাতী হামলা চালালে পাশ্চাত্যে নিন্দার ঝড় ওঠে। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের আগেই দক্ষিণ এশিয়ায় আত্মঘাতী হামলার সূচনা করেছিল এলটিটিই।
এলটিটিইকে সামরিক ও আর্থিক সহায়তা দিয়েছে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।
আর এটি করা হয়েছিল ভারতের নিরাপত্তা কৌশলের অংশ হিসেবে। এই এলটিটিইর হাতে ভারতের একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী নিহত হলেন। এ ঘটনার পর ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ব্যর্থতা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়। সংবাদপত্রেও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সমালোচনা হয়। এ হত্যাকাণ্ডকে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ব্যর্থতা হিসেবে দেখা যায় বলে কোনো কোনো বিশ্লেষক মন্তব্য করেন।
কিন্তু এলটিটিইকে একটি ফ্রাংকেনস্টাইন হিসেবে গড়ে তোলা কিংবা রাজিব গান্ধী হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে গোয়েন্দা ব্যর্থতার জন্য র, আইবি কিংবা ভারতের অন্য কোনো সামরিক গোয়েন্দা সংস্থাকে এ জন্য বিচারের মুখোমুখি হতে হয়নি। এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে একটি বিষয় উল্লেখ করা যায়। সম্প্রতি বাংলাদেশে জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার দু’জন মহাপরিচালককে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে। এমনকি তাদের জিজ্ঞাসাবাদে কী পাওয়া যাচ্ছে, সে খবরও সংবাদপত্রে প্রকাশিত হচ্ছে। এটি কতটা গোয়েন্দাবৃত্তিক নিরাপত্তা কৌশলের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ, তা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।