আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আছিয়া...



মেয়েটি কোনো বলিউড বা ঢাকাই ছবির হিট নায়িকা শাবনুর, শাবনাজ-ইত্যাদি নাম বলেনি। নারায়নগঞ্জের গোদনাইলের সরকারি ভবঘুরে আশ্রয় কেন্দ্রের অন্য ভাসমান পতিতাদের ভীড়ে অল্প বয়সী ফর্সা মতোন মেয়েটি একটু দূরে একা দাঁড়িয়ে ছিলো। তার কোলে এক রত্তি একটি দুধের শিশু। সে বোধহয় তার সত্যিকারের নামটিই সেদিন আমাকে বলেছিলো, আমার নাম আছিয়া, আছিয়া বেগম। আমি ও আরেক সহকর্মি মুন্নী সাহার সঙ্গে ভবঘুরে আশ্রয় কেন্দ্রটি ঘুরে ঘুরে সেখানের আশ্রিতাদের সমস্যার কথা শুনছিলাম, নোট নিচ্ছিলাম দ্রুত, মুন্নী আপা অটো ক্যামেরায় সাদা-কালো ছবি তুলছিলেন।

সেটা ১৯৯৯ সালের কথা। তো আমি হঠাৎ সস্তার সালোয়ার-কামিজ পরা, শিশু কোলের ওই মেয়েটিকে লক্ষ্য করি। তার মুখ ও হাতের অনাবৃত অংশটিতে অসংখ্য কাটাকুটির চিহ্ন। চোখ দুটি অসম্ভব মায়াময়, বিষন্ন। যতো বারই তার সঙ্গে কথা বলতে চাই, ততবারই সে সভয়ে একটু করে পিছিয়ে যায়; আশ্রয় নেয় ইসকুল ঘরের মতো টানা টিনের চালার কেন্দ্রটির বারান্দায়।

আমি জানতাম, এইসব ভাগ্যহত, সমাজ নিগৃহিত মেয়েদের সম্ভবত শেষ আশ্রয়স্থল পিতৃপরিচয়হীন গর্ভজাত সন্তান! তাই বুদ্ধি করে মেয়েটি কাছে গিয়ে কুশল বিনিময় করার ফাঁকে চট করে ওর আদুর গায়ের মাথা ন্যাড়া শিশুটিকে কোলে নেই। আন্তরিকভাবেই দেব শিশুটির কপালে বোধহয় একটি চুমুও খাই। এবার আছিয়ার আগল খুলে যায়। তার মনোযন্ত্রণার কাহিনী বলতে থাকে নীচু স্বরে। ... কয়েক বছর আগের কাস্টমারের আশায় এক সন্ধ্যায় আছিয়া দাঁড়িয়েছিলো সংসদ ভবন এলাকায়।

একটি গাড়ি নিয়ে দুজন ছেলে আসে। কন্টাক্ট হয় সারারাতের। দুজন মিলে সারারাত 'কাজ' করবে, ওকে দেবে এক হাজার টাকা। আছিয়া রাজি হয়। তখন তার বয়স পনেরো কি ষোল।

ওরা গাড়ি নিয়ে মেয়েটিকে নিয়ে যায় উত্তরার একটি নির্জন এলাকার নির্মাণাধীন এক ভবনে। সেখানে আরো তিন-চারজন যুবক আসে। সারারাত ধরে চলে মদ্যপান এবং আছিয়াকে গণধর্ষণ। এক সময় আছিয়া জ্ঞান হারায়। ... কয়েকদিন পর তার জ্ঞান ফেরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে।

সারা শরীরে অসহ্য ব্যাথা, পুরো শরীর জুড়ে ব্যাণ্ডেজ, রক্ত আর স্যালাইন চলছে সমান তালে। প্রায় দেড় মাস পরে আছিয়া হাসপাতাল থেকে ছাড়া পায়। পরে সে জানতে পারে, পুরো শরীরে তার ১২০টির ওপরে সেলাই লেগেছে। সে সময় একটি সার্জারি বিভাগের একদল বিদেশী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তার শরীরের কাটাকুটিগুলো সেচ্ছাশ্রমে সেলাই করে দেয়। তারাই তার জন্য যোগাড় করে বেশ কয়েক বোতল রক্ত ও অন্যান্য অষুধপত্র।

আছিয়াকে উত্তরার বাউনিয়া এলাকার একটি ডাস্টবিন থেকে স্থানীয়রা কুড়িয়ে এনে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়ে ছিলেন। তার সারা শরীর তখন ধারালো ক্ষুরের আঘাতে রক্তাক্ত, জখম। ওর তো বেঁচে থাকারই কথা ছিলো না!... এইসব কথা বলতে বলতে আছিয়ার চোখ ছলছল করে। ... সে আমার সামনে একটানে উন্মোচন করে আরেক রুঢ় সত্য। ও ভাই, দেহেন তো, অহন এই কাঁটা-ছেঁড়া করা বেশ্যা-মাগীরে আর কে লইবো? আমার তো অহন আর আগের মতো বাজার নাই।

তার ওপর হাউশ কইরা বাচ্চা নিলাম; বুকে দুধ আইছে। কাস্টমাররা দুধওয়ালা মাগীর লগে কাজ করবার চায় না!... আছিয়ার অতীত, বর্তমান ও সম্মুখের অনিশ্চিত ভবিষ্যত আমাকে নির্বাক করে দেয়। খর দুপুরের বাতাসের অক্সিজেনটুকুতেও বুঝি আগুন ধরে গেছে; আমার এমনই অস্বস্তি হতে থাকে। আমি মুন্নী আপাকে তাড়া দেই, মুন্নী আপা, বাইরে চলুন তো। এখানে খুব গুমোট গরম...আমার আর ভালো লাগছে না।

...

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।