আহসান জামান
[উৎসর্গ: বন্ধু, আহমাদ মোস্তফা কামালকে, যার অনুপ্রেরণায় আজও লিখি]
ওপাশে দরজা বন্ধের শব্দ শুনে মায়া মুখ তুলে ঘড়ির দিকে তাকালো; শ্বশূর-শাশুড়ীর এশার নামায শেষ, ঘুমানোর ব্যবস্থা চলছে উনাদের ঘরে। বাড়ীর মেজ ছেলে, আসিফ অফিস থেকে ফিরেছে সেই বিকেলে। বাসায় এসে হাতমুখ ধুয়ে চাপানি সেরে শুরু হয় তার নিত্যদিনের ফর্দ্দ - খবরের কাগজ পড়া, ই-মেল চেক করা, টিভি দেখা, ছোফায় চিৎকাৎ - তারপর রাতের খাওয়ার সময়। বছর দু’য়ের বিবাহিত জীবন, স্ত্রী রুপা; দুজনের ভীষণ ভালোবাসা, ছিমছাম প্রেমেভরা সংসার। ছোট ছেলে কলেজ পড়ুয়া হাবিব, এখনও বাড়ী ফিরে নি।
বাড়ীর বড় বৌ মায়া, দেবরের অপেক্ষার অজুহাতে লিভিং রুমে বসে বসে টিভি দেখছেন।
সারাদিনের হাকডাক, সংসারের কাজকাম সেরে এই বসে থাকাটা তারও কাছে ভালো লাগে। বাড়ীর কাজের মেয়েটারও চোখজুড়ে থাকে অই টিভির পর্দ্দা। ওদিক থেকে তখনও রুপার গুনগুন গানের শব্দ মায়ার কানে ভেসে আসছে; ভালই গান করে সে। মাঝে মাঝে হাসিকথার কল্লোল নিস্তব্ধ বাড়ীতে কুচি কুচি বাতাসে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে; মায়া জানে এরও সমাপ্তি খুব তাড়াতাড়ি।
এরই মধ্যে রিমুট টিপে টিপে কয়েকবার দেশবিদেশ চ্যানেলও বদল হয়েছে মায়ার। টিভিতে বিজ্ঞাপণ, নাটক, গান, খবর পালা ক্রমে দেখে দেখে ঘড়ির দিকে আবারও চোখ রাখে মায়া। ঘড়ির সময় পড়ে, ফিরে তাকায় টিভির পর্দ্দায়।
মনে চলে আর এক প্রচ্ছদ - অতীত; এফোঁড়-ওফোঁড়। এই বাড়ীঘর-পরিবার কত আপন করে নিয়েছে সে।
সেই প্রথম যখন সে বৌ হয়ে এলো এই ঘরে, হাবিব সপ্তম শ্রেনীর ছাত্র। সারাক্ষণ তার পিছু পিছু ... ভাবী এটা খাও ... ওটা দাও ... হাবিব যেনো তার অক্লান্ত শ্রমে দেখতে চায় ভাবীর হাসিমুখ। মায়া যেন নিজের বাড়ীঘর রেখে এসে আপন ঘরবাড়ী পেলো। তার বিয়ের দু’বছর পর, বাবা মারা যান। বড় ভাই বিয়ে করেছেন কবেই।
মাও মারা গেছেন, তা আজ বছর তিনেক হবে। আজ মায়ার গুরুজন বলতেই শ্বশুর-শাশুড়ী; মাটির মানুষ, ভীষণ ধর্মপ্রাণ - সারাদিনরাত চলে তাঁদের নেকীর সমীকরণ। দুনিয়ার চাওয়া কম তাই মায়ার হাতে সংসার; বাজারঘাট ... বিল পাঠানো ... জামা-কাপড় কেনাকাটি ... সবই মায়ার হাতে। ভাবতে ভাবতে মায়ার চোখে একটু হয়রানী আসে, অমনি দরজায় কলিং বেল। মায়া এসে দরজা খুলতে খুলতে বলে, কীরে; হাবিব এতোরাত করলে যে!
ঃ সরি ভাবী, আজ পুরান এক বন্ধুর সাথে দেখা ... গল্পে গল্পে ... একটু দেরী হলো আজ ... আর বলো না ওদিকে মোবাইলে মিনিটও শেষ ...
এরমধ্যে-ই মায়া ডাইনিং টেবিলে খাবার খুলতে খুলতে বলে, যাও হাতমুখ ধুয়ে টেবিলে এসো।
হাবিব টেবিলে ফিরে এসে ভাত নিতে নিতে বলে, আচ্ছা, তুমিতো ঘুমাতে পারো ভাবী ... এতোরাত করে বসে থাকার কী দরকার ... তারপর কথোপকন চলে খাওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে ... একসময় উভয়ই শেষ হয়। হাবিব ফিরে যায় তার ঘরে।
মায়ার ও গোছানো শেষ তখন। রান্নাঘরে বাতি নিভে গেছে, কাজের মেয়ে ঘুমুতে গেছে। টিভি বন্ধ আগেই, ড্রইং রুমে বাতি কমিয়ে জিরো পাওয়ারে রাখে মায়া।
সারা বাড়ীময় তখন নিঃশব্দের প্রহর ছড়িয়ে পড়েছে; কেবল দূরে হাবিবের ঘরে মৃদু আওয়াজে রবীন্দ্রনাথ বাজছে।
দরজা ঠেলে নিজের ঘরে ঢোকে মায়া; তার ক্লান্ত শরীরে শুরু হয় শূন্যতার হুহু ডাক ... গতবছর স্বামীর সড়ক-দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পর ... একা সে ... বয়স ভেবে ... সমাজ ভেবে ... আবারো সাজতে ইচ্ছে হয়নি তার ... আকঁড়ে ধরে আছে স্মৃতির কপাট ... থপ করে বসে পড়ে, ড্রেসিং টেবিলের সামনে, টুলে ... আয়নার ওপাশে পড়ে থাকে সারাদিনের ক্লান্ত অচীনসুখচাবির বিষণ্ন বিধবা মুখ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।