[কিছু গান নিয়ে লিখি,কিছু গান শোনানোর চেষ্টা করি। গান গুলো প্রিয় কিন্তু শুধু গানের জন্য না,তাই প্রিয় গান বললাম না,বরং এগুলো জীবনের গান। কোন না কোনভাবে টুকরো টুকরো স্মৃতি জড়িয়ে আছে,যখন শুনি আবারো নানা রঙের সুখ-দুঃখের দিনগুলোতে ফিরতে ইচ্ছা করে। আসবে,যখন-তখন,টুকরো টুকরো হয়ে,একদমই ব্যক্তিগত আলাপ, তবে কারো কারো সাথে মিলেও যেতে পারে। শুরু করি,কেমন?]
তখনো গান শুনি না,অন্তত শখ করে শুনি না।
শোনার উপায়ই নেই অবশ্য,সবেধন নীলমণি ক্যাসেট রেকর্ডারটা চোর নিয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই,আর কেনা হয়নি। তার আগে যা শোনা হতো সেটা রবীন্দ্রসঙ্গীত, অন্তত ৭-৮ বছরের বাচ্চার কানে সেটা খুব একটা মধুবর্ষণ করতো না। তারপর শূন্যতা। বাসায় টেলিভিশন নেই,রেডিও নেই, কালেভদ্রে ম্যাকগাইভার বা এ-টিম দেখতে চাইলেও পাশের বাসার সাদা-কালো টিভিতে দল বেঁধে। স্বীকার করি অবশ্য,তখন মেঝেতে দল বেঁধে বসে পাড়ার লোকজন মিলে আসর জমিয়ে ১৪" সাদা-কালো টিভিতে ম্যাকগাইভার দেখে যে অনাবিল আনন্দ পেতাম,এখন বাসায় ২১" কালার টিভি বা পিসিতে হাই কোয়ালিটি ডিভিডিতে কোন ম্যুভি দেখেও অমনটা পাই না।
মাঝে মাঝে দেশে আগমন ঘটতো নামকরা শিল্পীদের,হেমন্ত মুখোপধ্যায় বা পঙ্কজ উদাস,একবার হৈমন্তী শুক্লা,ওদিকে পাকিস্তান থেকে আগত আলমগীরের হেলেদুলে গাওয়া 'আমায় ভাসাইলি রে', এমন ২-১টা উপলক্ষ পেলে ঐ সাদা-কালো টিভিতেই ২-১টা গানের অনুষ্ঠানও দেখা হয়ে যেত।
অন্যের বাসায় কালে-ভদ্রে হল্লা করার দিন ফুরালো বাসায় ১টা ১৪" রঙিন টিভি আমদানি হবার পর,সেকেন্ড হ্যান্ড,তাতে বয়েই গেছে! ফুটবল খেলা তো দেখা যায়,সাথে বিকেল হলেই জিলেট ওয়ার্ল্ড স্পোর্টস স্পেশাল,নইলে চ্যানেল নাইনের ক্রিকেট হাইলাইটস,দুপুরের দিকে নিনজা টার্টলস নয়তো ক্যাপ্টেন প্ল্যানেট। কিন্তু গানের অনুষ্ঠান কদাপি নয়,সেই টিপ পরে হেলেদুলে রবীন্দ্র নয়তো নজরুল,পোষায় না ঐ বয়সেও। তখন উঠেছি ক্লাস নাইনে,বেশ পাখা গজানো দিনকাল। বড় স্কুলে পড়ি,সবাইকে দেখে তাল মিলাতেই কিনা,এক ব্যাচে গছিয়ে দিল মা।
মহা বিরক্তিকর কাজ,সকাল ৭টায় উঠে পড়তে যাওয়া,সেই শিক্ষক আবার সেরকম ফাঁকিবাজ,আধা ঘণ্টা পরে এসে আর আধা ঘণ্টা পড়িয়ে ৯টার মাঝে ছুটি। পড়া হয় কচুটা,সকালের ঘুমের রেশ কাটতে কাটতেই দেখি পড়ার সময় শেষ। এদিকে ক্লাস তো ১২টায়,কোথায় যাই? কিছুদিন গেল শাহজাহানপুরের দোকান গুলোতে ভিডিও গেম খেলে। দেখা গেল,এ লাইনে আমার প্রতিভা শূন্যের কোঠায়,২ মিনিট যাবার আগেই গেম ওভার,মাঝ থেকে পয়সা নষ্ট। সঙ্গীসাথীরা ভালই খেলতো,কিন্তু পয়সার মায়াতেই কিনা,এ দিকটায় শখ স্থায়ী হলো না।
সমস্যার সমাধান হলো আরেক বন্ধুর মাধ্যমে। শাহান,আমাদের ক্লাসের গুডি বয়,একটা কম্পিউটার কিনে ফেললো। চেনাজানাদের মাঝে সে-ই প্রথম,আর কি আশ্চর্য একটা যন্ত্র। আমরা মোটামুটি দল বেঁধে সেই যন্ত্র দেখতে গেলাম,উইন্ডোজ ৯৮ এর এখনকার মরা ইন্টারফেস দেখেই আমাদের অজ্ঞান হবার অবস্থা। তার মাঝে কত কিছুই যে করা যায়।
একদিন দেখালো হরোস্কোপ সফটওয়্যার,আবার আছে লাভ ক্যালকুলেটর,তারপর রয়েছে নানা ধরণের গেমস, মোটো রেসিং, এনএফএস,সব মিলিয়ে একদম এলাহী কারবার। স্ক্রিনসেভার দেখেও আমার মুগ্ধতা কাটে না,ওদিকে ওয়ালপেপার বদলানোকেও এক আশ্চর্য ঘটনাই মনে হয়। সব মিলিয়ে এক মায়াবী নেশা ধরানো জগৎ।
কিন্তু আমাদের সবচেয়ে বেশি টানলো একটা গেম,ফিফা ৯৮,আর গান। সকালে কোনমতে পড়া শেষ করেই ছুট দেই শাহানের বাসায়,সাথে কখনো থাকে মেহরাব,কখনো আর কেউ।
গিয়ে শুরুতে
ধুমধাড়াক্কা ফিফা নিয়ে মারামারি হইচই,এরপরে গান শোনা। শাহান আর তার বড় ভাই মিলে গান যোগার করে সেগুলো সিডিতে রাইট করে,আমরা সেগুলো গিয়ে শুনি। ইংরেজি গানের সাথে সেই বলা যায় প্রথম চেনা,এর আগে গান বলতে জেমস বা বাচ্চুর বাইরে জ্ঞান যায়নি। মন্ত্রমুগ্ধ করেছিল কিছু গান,মাইকেল জ্যাকসনের ব্ল্যাক অর হোয়াইট, দে ডোন্ট কেয়ার অ্যাবাউট আস,ফিল কলিন্সের ইনভিজিবল টাচ। একদম পাঁড় ভক্ত হয়ে গেলাম ব্রায়ান অ্যাডামসের,সামার অভ সিক্সটি-নাইন শুনে এখনো পা নাচে।
জন ডেনভার সেই যে ভেতরে ঢুকে গেলেন, কান্ট্রি রোড বা অ্যানি'স সং বা ওয়াইল্ড মনটানা স্কাইয়ের সুর মাথা থেকে আর বের হয়নি। ক্লাস শুরু হবে ১২টায়,শাহান তাগিদ দেয়,আমি তখনো ইট'স মাই লাইফের তালে মাথা দোলাই,রক এন রোলের মত মজা কি আর ক্লাসে পাওয়া যাবে?
এমনি এক সকালে,কোনরকমে বিরক্তিকর আধা ঘণ্টা কাটিয়ে গেছি শাহানের সেই বাসায়। দু'টো সিঁড়ি পরপর, পেছনে একটা প্রেস,ঘটাংঘট শব্দে কান পাতা দায়,অন্ধকার বাঁচিয়ে সাবধানে উঠতে হয়। আরামবাগের সেই গলিটায় একটু বৃষ্টি হলেই কাদাপানি জমে থাকে,কিন্তু গান শোনা আর গেম খেলার নেশায় তার থোড়াই কেয়ার করি। যাবার পরে হঠাৎই বন্ধু বললো,এই গানটা দ্যাখ,নভেম্বর রেইন।
ভাল না লাগলে বলিস। ভিডিও সং,অর্কেস্ট্রার মাঝে পিয়ানো দিয়ে শুরু করলো এক্সেল রোজ,নামটা পরে জেনেছিলাম। হোয়েন আই লুক ইনটু ইয়োর আইজ,আই ক্যান সি আ লাভ রিস্ট্রেইনড।
ক্যামন একটা টান,একটা হাহাকার। অ্যান্ড ইট'স হার্ড টু হোল্ড আ ক্যান্ডল,ইন দ্য কোল্ড নভেম্বর রেইন,কি অদ্ভুত একটা কথা।
গান শুনে লাফঝাঁপ করা বা মাথা দোলানো,ঐ পর্যন্তই আমার দৌড়,না পারি গাইতে না পারি বাজাতে,গানের মর্ম উপলব্ধি করা তো অনেক পরের কথা। কিন্তু ইফ ইউ ওয়ান্না লাভ মি,দ্যান ডার্লিন ডোন্ট রিফ্রেইন,অর আ'ল জাস্ট ইন্ড আপ ওয়াকিন ইন দ্য কোল্ড নভেম্বর রেইন-- শুনতে শুনতে তলিয়ে গেছিলাম নিশ্চিত। বৃষ্টির সুরে এমন ভয়ংকর হাহাকার অন্তত রক গানে আশা করিনি তখনো। তাকিয়ে আছি স্ক্রিনে,আস্তে আস্তে হাঁটতে হাঁটতে খোলা আকাশের নিচে বেরিয়ে এলো স্ল্যাশ,তারপর সেই গীটার সলো। বাকি জীবনের জন্য অপূর্ণতার খাতায় একটা স্থায়ী দাগ দিয়ে দিলো ঐ একটা মুহূর্ত, আহা,একবার,যদি মাত্র একবার ঐরকম গীটারের তারে এমন সুর তুলতে পারতাম।
আমি নিশ্চিত,আরো অনেকের স্বপ্নে ঐ সুর হানা দিয়ে গিয়েছে,দিতেই হবে,ঐ সুর এড়ানোর ক্ষমতা খুব বেশি তরুণের হয়নি।
গান গড়াতে থাকে,সাথে সাথে আমিও। লম্বা গান,৯ মিনিট ৫৭ সেকেন্ড,৯০ এর দশকে অনেক ব্যান্ডই এমন লম্বা গান গাইতো,গানস এন রোজেস এর নিজেরই আছে কয়েকটা। একসময় গান শেষ
হয়,বন্ধু শুধায়,কেমন? কথা বলি না,শুধু মাথা নাড়ি,বলার ক্ষমতা নেই,ঐ বয়সের জন্য মুগ্ধতার ধাক্কা একটু বেশিই হয়ে গিয়েছিল। বৃষ্টির ঝিরঝিরের সাথে মিশে তখন শুধু নাথিং লাস্টস ফরেভার,ইভেন কোল্ড নভেম্বর রেইন,আর কোন শব্দ বা চিন্তা মাথায় আসার অবস্থা নেই।
এরপর যতবার শাহানের বাসায় যাই,একবার করে ঐ গান শুনি,পুরানো হয় না,আজো হয়নি। স্ল্যাশের মত গীটারিস্ট হবার ইচ্ছা মাথা চাড়া দিয়েছিল বলে একটা গীটারও কিনেছিলাম,যদিও সেই গীটারে ২ দিন টোকা দিয়েই বুঝে গেছিলাম,আমার জন্য শোনাই ভাল,সবাইকে দিয়ে সব হয় না।
এরপর দিন কেটে যায়,আমরা বড় হয়ে যাই। কলেজেও শাহানের বাসায় আমাদের হামলা থামেনি,একদম কাছে হওয়াতে প্রতি বেলাতেই আমাদের যন্ত্রণা সহ্য করতে হয় তাকে। ততদিনে ৯৮ গিয়ে এক্সপি এসেছে,ফিফা ৯৮ এর বদলে ফিফা ৯৯ হয়ে ২০০২।
বদলায়না শুধু গানস এন রোজেস,বদলায়না নভেম্বর রেইন, বদলায়না শাহান আর শিপলু ভাইয়ের সংগ্রহ থেকে নিত্যনতুন গান শোনার অভ্যাস।
আড্ডা ভাঙে ভার্সিটিতে ভর্তি হবার পরে,আমরা কেউ বুয়েট,কেউ মেডিক্যাল,শাহান আইইউটি,মাঝে মাঝে যাওয়া হয়,ছুটির দিনে,সেখানেও গান আর গেমস। নিজের বাসাতেও একটা কম্পিউটার আসে ভার্সিটিতে ভর্তি হবার এক বছর পরে,প্রথমেই নিয়ে আসি নভেম্বর রেইন,নিজের বাসাতে মন খুলে শোনার জন্য। দিন কাটে,আমরা বড় হই,বিচ্ছিন্ন হই,শুধু আমাদের সাথে থাকে স্ল্যাশ আর এক্সেল রোজ। একসময় ভেঙে যায় ভার্সিটির আড্ডাগুলোও,কর্মজীবনের ব্যস্ততায় প্রিয় মুখগুলোর দেখা মেলে কদাচিৎ,বৃষ্টি হলেই শুধু মনে পড়ে,নাথিং লাস্টস ফরেভার,ইভেন কোল্ড নভেম্বর রেইন।
গল্পের শেষ নেই,তবে বর্তমানটা বলি। শাহানরা আরামবাগের সেই ঘুপচি গলির বাড়িটা ছেড়েছে ১ বছরের বেশি হলো। গুডি বয় তার মান রেখেছে,বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে বেশ মানিয়ে গেছে। গত এক বছরে মনে হয় একবার দেখা হয়েছে। আড্ডার অন্য বন্ধুদের দু'জন শিগগিরি বাইরে চলে যাবে,একজন বিশাল এক কর্পোরেটের বড়কর্তা হয়ে গেছে।
চাকরি নিয়ে ব্যস্ত ২-১ জন। আর আমি? এখনো বসে আছি,মাঝে মাঝে বৃষ্টির দিনে স্মৃতি আউড়ানোর জন্য। দমকা হাওয়ার মাঝে বজ্রপাতের শব্দে যখন স্ল্যাশ তার গীটার নিয়ে বেরিয়ে আসে,আমার মনে হয় আরামবাগের সেই ঘুপচি
গলি,অন্ধকার সিঁড়ি বাঁচিয়ে ওঠা,প্রেসের ঘটাঘট আওয়াজ,একদল কিশোরের হইহুল্লোড় একটা ছোট্ট ঘরে,আর কোল্ড নভেম্বর রেইন।
[ গানটা শুনতে পারেন এখানে Click This Link
আর গানটার লিরিক এখানে Click This Link ]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।