বাংলার লাখ লাখ মানুষ যখন শাহবাগের মোড়ে চিৎকারে ফেটে পড়ছে, শত শত তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরী তাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টুকু পার করছে, তখন হাজার হাজার মাইল দূরে আমরা পড়ে আছি অন্য এক মহাদেশে। ছোট্ট এই জীবনে অনেক মিছিলে গিয়েছি, মিনমিন করে স্লোগানের সাথে সুর মিলিয়েছি; কিন্তু, সে হয়তো নিজের ইচ্ছায় নয়; অন্যের ইচ্ছায়, অন্যদের ইচ্ছায়। সেটা যতটুকু না নিজের চাওয়া-পাওয়াকে তুলে ধরার জন্য, যতটুকু না নিজের ইচ্ছাকে পূরণ করার জন্য, তার চেয়ে অনেক বেশি অন্যদের চাওয়া-পাওয়া তুলে ধরার জন্য, অন্যদের ইচ্ছা পূরণ করার জন্য। অথচ, আজ যখন সমস্ত বাংলার মানুষের ইচ্ছা পূরণের দাবী উঠেছে, দাবী উঠেছে এত দিন ধরে জমে থাকা পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার, ঠিক তখনটাতে মিছিলে যাবার জন্য, স্লোগান দেবার জন্য আমি কিংবা আমরা উপস্থিত নেই শাহবাগের মোড়ে।
আমার আবাসস্থল শিকাগো শহরের সব জায়গা থেকে উঁচু সিয়ার্স টাওয়ারটা দেখা যায়, যেটি বর্তমানে উইলিস টাওয়ার নামে পরিচিত।
প্রতিদিন চোখের সামনে ভেসে থাকা সে টাওয়ারটা গত কয়েক্দিন ধরে হঠাৎ করে যেন বিব্রত হবার কারণ হয়ে দাঁড়ালো। এই টাওয়ারের সৃষ্টির সাথে, স্থাপনার সাথে জড়িয়ে আছে বিশ্বখ্যাত বাংলাদেশি ফজলুর রহমান খানের নাম। এই সেই ফজলুর রহমান খান, যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য জনমত গঠন করতে এবং আর্থিক অনুদান সংগ্রহ করতে শিকাগোতে গঠন করেছিলেন Bangladesh Emergency Welfare Appeal। শিকাগোতে অবস্থানরত হাজার হাজার মানুষ আজও শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করে এই মহান মানুষটিকে। আর বোধ করি, সে-স্মৃতির তাড়না থেকেই সিয়ার্স টাওয়ার আমাদেরকে বিব্রত করে দিয়ে জিজ্ঞেস করতে থাকে- কি করছো তোমরা? তোমাদের শাহবাগের মোড়তো রচনা করছে এক অনন্য মহাকাব্য।
কি করা যায়, কি করতে পারি সেটা নিয়ে চিন্তা করছিলাম। শাহবাগে না যেতে পারি, অন্তত ছোট করে হলেও কিছু একটাতো করতে পারি। আমেরিকাসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে অধ্যয়ণরত বাংলাদেশী স্টুডেন্টরা এর মধ্যে সামাজিক যোগাযোগের সাইট্গুলোতে প্রতিবাদ জানিয়ে, পরোক্ষভাবে সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে শুরু করেছে। কিন্তু, আমদের ইউনিভার্সিটিতে (ইউনিভার্সিটি অভ ইলিনয় অ্যাট শিকাগো- ইউআইসি ) সমস্যা হলো বাংলাদেশী স্টুডেন্ট খুব কম। এর মধ্যেই এক্দিন আর্ট এন্ড ডিজাইনের নাফিস যোগাযোগ করে জানালো আমাদের কিছু করা উচিত।
আমি তখন বলছিলাম, আমাদেরতো খুব কম স্টুডেন্টস, সবাইকে এক দিন জড়ো করাও খুব কঠিন। নাফিস বললো, করতে পারি না পারি চেষ্টা করতেতো দোষ নেই। অবশেষে পরিকল্পনা অনুযায়ী, আমরা ফেইসবুক গ্রুপ খুলে অন্যদেরকেও জানালাম। মাত্র দুই দিনের নোটিশ দিয়ে স্থান ও সময় জানালাম।
এরপর আমাদের অবাক হবার পালা।
কে জানতো, বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে থেকেও, চেতনায় ধারণ করে, দেশ প্রেম লালন করছে অসংখ্য বাংলাদেশী। সেই চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েই হয়তো দেড় শত মাইল গাড়ি ড্রাইভ করে কয়েক ঘণ্টার নোটিশে অন্য স্টেইট থেকে ছুটে এসেছেন জিএম তানিম। আরেক শহর মেডিসন থেকে এসেছ্নে আসিফ আর রানিয়া। অন্য বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ ওয়েস্টার্ন ক্যাম্পাস থেকে ছুটে এসেছেন ঝঙ্কার,আশরাফ ভাই আর মেহ্জাবীন আপু। মোস্তাফা ভাই আর নাদিরা ভাবীর সাথে ছিলেন ছোট্ট নিভৃতি।
সাবার্ব থেকে এসেছেন এস এম মাহবুব মুর্শেদ ভাই। উপস্থিত ছিলেন ইউআইসির মুসা, কায়সার, নাসির, তানিম, উর্মি, সুম সায়েদ।
আসার সময় কেউ সাথে আনলো কাগজ, কেউ আনলো কালি। আবার, কেউ কেউ সাথে আনলো লাল সবুজের পতাকা, সে-রঙের রং পেন্সিল। এর মধ্যে নাফিস আবার স্থপতি, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ছিলো।
কিন্তু, স্থপতি হলে কি হবে, বস্তুত সে স্থপতির ছদ্মবেশে আর্টিস্ট। দশ মিনিটের মধ্যে বিশটা রাজাকার এঁকে ফেলে। তাই বলে অন্যরাও বসে থাকেনি। রঙ করতে শুরু করে দিয়েছে হৃদয়ে শাহবাগ, আঁকতে শুরু করেছে ছোট ছোট যুদ্ধাপরাধী। কিন্তু, রাজাকার আঁকতে গিয়ে দেখা গেলো, একটা হয়েছে আলিফ লায়লার দৈত্যের মত, কিন্তু, অন্যটা দেখতে হয়েছে রবীন্দ্র নাথের মত।
সবাই প্রতিবাদ জানালো- না না না! এই রাজাকার দেখতে অনেক সুন্দর হয়ে গেছে, তাকে আরো কুৎসিত করা চাই। যেই ক্থা সেই কাজ, তুলির খোঁচায় মুহুর্তে যেটুকু সুন্দর অবশিষ্ট ছিলো সেটাকেও কুৎসিত অর্থাৎ রাজাকার বানিয়ে দেয়া হলো।
সব কিছু প্রস্তুত হয়ে গেলে কিছু ছবি তুলে নিই আমরা। তারপর, অপেক্ষার পালা, অনেক দূর থেকে যারা আসছেন তাদের জন্য। কথা ছিলো আমরা যারা ক্যাম্পাসের আশপাশে থাকি, তারা দূর থেকে আগতদের জন্য অপেক্ষা করবো।
আরা যারা ক্যাম্পাস থেকে দূরের এরিয়াগুলো থেকে এসেছেন, তারা বাসায় চলে যাবেন। কিন্তু, একটা মানুষও জায়গা ছেড়ে নড়লো না। সবাই অপেক্ষা করছেন যারা অনেক পথ পাড়ি দিয়ে আসছ্নে, তাদের জন্য। যুক্তি হলো, তারা যদি শত শত মাইল পাড়ি দিয়ে আসতে পারেন, তাহলে আমরা কেন দু-একটা ঘণ্টা অপেক্ষা করতে পারবো না।
আমি জানি, এরকম গল্প শুধু আমাদের নয়।
অন্য আর সব ইউনিভার্সিটির যারা এই আয়োজনগুলো করেছেন তাদের সবার এই একই গল্প আছে। হয়তো গল্পটা সামান্য একটু ভিন্ন, কিন্তু, সুরটা এক। ফেইস বুকে, ব্লগে সেই গল্পগুলো যখন দেখি, তখন বড় বেশি আশাবাদী হয়ে উঠি, অনুপ্রেরণা পাই।
আমাদের বাস্তব গল্পে অবশেষে সবাই এসে উপস্থিত হলেন। সবার সাথে পরিচয় হলো।
তারপর, ফজলুর রহমান খানের সিয়ার্স টাওয়ারকে পিছনে রেখে ছবি তুলি আমরা। ছোট্ট নিভৃতি তখন অবাক চোখে বুঝতে চেষ্টা করছে- কি হচ্ছে এই সব। আমি নিশ্চিত, আজ থেকে অনেক অনেক বছর পর, তার মা-বাবা তাকে গর্বের সাথে এই গল্প শোনাতে পারবেন। আমারও মনে হলো, আজ থেকে সিয়ার্স টাওয়ারে দিকে তাকিয়ে আর বিব্রত হতে হবে না। কিছু একটা জবাবতো দিতে পারবো।
হয়তো খুব সামান্যই, কিন্তু, তারপরও অংশগ্রহণতো করতে পেরেছি। জানি, সবচেয়ে বড় চেতনা অন্তরে, সব্চেয়ে বড় মূল্যবোধ অন্তরে; তবু, সবাই যখন একসাথ হয়, তখন সাহস খুঁজে পাই, ভালো লাগে। কিছু কিছু সময় একলা চলতে যে বড় বেশি কষ্ট হয়! কিছু কিছু আহবানের ডাক শুনে কেউ যদি না আসে, তাহলে যে বড় বেশি অভিমান হয়!!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।