আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প : সংস্কারের পিছুটান (প্রথম পর্ব)

বাস্তবতা ফেরী করে বেড়াচ্ছে আমার সহজ শর্তের সময়গুলোকে

সারা বিকাল অপেক্ষা শেষে বৃষ্টি নামলো। বিকাল তখন আশ্রয় নেওয়ার অপেক্ষায় সন্ধ্যার বুকে। বিকালের প্রথম প্রহর থেকেই ভাবছি এক পশলা বৃষ্টি নামলে ঘুরতে বের হবো। বৃষ্টিতে ভিজবো রাস্তায় হেটে হেটে। ক্যাম্পাসের রাস্তা অবশ্য পাকা রাস্তা।

চত্বরের ভিতর দিয়ে হাটলে ঘাসের নরম বুকের নিচে মাটির সন্ধান পাওয়া যায়। গেল কয়েকদিনের কাঠফাটা গরমে মাটির আদ্রতাও শুকিয়ে গেছে। টিশার্ট আর জিন্স প্যান্ট পড়ে বের হয়ে আসলাম হলের রুম থেকে। বৃষ্টির তীব্রতা ততক্ষণে কমে এসেছে। এখন বৃষ্টিময় রাস্তায় হাটলে কাকভেজা হতে হবে।

তাই সই, অন্তত গত কয়েকদিনের অসহ্য গরমের পর বৃষ্টির মধ্যে হাটতে ভালোই লাগবে। কিছুক্ষণ পর প্যান্টের পকেটে রাখা মোবাইলটা ভাইব্রেট করতে লাগলো। সাউন্ড বন্ধ করে রেখেছিলাম আগেই। নেহায়তই কল আসলে যাতে বুঝতে পারি তার জন্য ভাইব্রেশন মুড চালু রাখা। বৃষ্টির মধ্যে কল রিসিভ করবো কিনা ভাবতে ভাবতে কল কেটে গেল।

মোবাইল চেক না করেই আবার হাটতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর আবার কল। মোবাইল স্ক্রিনে চোখ রেখেই দেখি কাশফিয়া’র কল। হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসলো- কি করছো? ব্যস্ত নাকি? কল ধরছো না কেন? নাহ! ব্যস্ত না, বৃষ্টির মধ্যে রাস্তায় হাটছি তো তাই কল ধরিনি তখন। ওহ! তুমি আবার কোন রাস্তায় বৃষ্টিতে ভিজতাছো? খুব দুরে কোথাও না।

ক্যাম্পাসের ভিতরেই। আমি বৃষ্টির মধ্যে আজিজে আটকা পড়লাম। ওদিকে গাড়িটাও ছেড়ে দিয়েছি আগেই। তোমার আপত্তি না থাকলে আমি আসি? একসাথে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে হাটা যাবে। আজকে থাক! আমার একা একা হাটতে ভালো লাগছে।

ওপাশ থেকে দীর্ঘশ্বাস ভেসে আসলো। একসাথে বৃষ্টিতে ভিজতে চাইলো কাশফিয়া, আমি আসতে বললেই পারতাম। তবু কেন জানি বললাম না। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কল কেটে দিলো সে। মাথা থেকে কাশফিয়ার চিন্তা সরিয়ে দিয়ে অন্য কিছুতে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা শুরু করলাম।

স্কুলে পড়ার সময় এইভাবে বৃষ্টি নামলে দৌড়ে বের হয়ে যেতাম ঘর থেকে। মাঝেমধ্যে অবশ্য আম্মু বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করতেন। তবে সেইটা প্রায় সময়ই কাজে লাগতো না। গ্রামের কাদাযুক্ত রাস্তায় বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে সারা গায়ে কাদা মাখিয়ে বাসায় ফিরতাম। ফের ঝামেলাটা যেতো আম্মুর উপর দিয়ে।

কলপাড়ে দাড়িয়ে পানি তুলে দেওয়া, তারপর গোসল করার সময় দাড়িয়ে তদারকি করার কাজটা তখন আম্মুকেই করতে হতো। একে একে অনেক স্মৃতি ভেসে আসতে লাগলো। স্মৃতির সময়ের পট দ্রুত সামনে এগিয়ে গিয়ে কাশফিয়া’র সাথে পরিচয়ের সময়টাতে থামলো। তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। প্রায় সময়ই ক্লাস বিকাল পর্যন্ত গড়াতো।

অবশ্য এর জন্য যতোটা না রুটিনের দোষ তার চেয়ে বেশি স্যারদের সিলেবাস শেষ করার তাড়া কাজ করতো। তখন হলের ক্যান্টিনে দুপুরের খাবার খেতে যেতাম না। কাছেই ছিল টিএসসি ক্যাফে সেখানেই দুপুরের খাবারটা সেরে নিতাম। একদিন সকালের ক্লাস শেষে প্রয়োজনীয় কাজে পাবলিক লাইব্রেরীতে গেলাম। পরিকল্পনা হলো পাবলিক লাইব্রেরীতে কাজ সেরে টিএসসি’র ক্যাফেটারিয়ায় দুপুরের খাবার খেয়ে বিকালের ক্লাসটা করবো।

পাবলিক লাইব্রেরীর কাজটা শেষ করে বাইরে বের হতেই রোদের উত্তাপ গায়ে লাগলো। হঠাৎ করেই কোথা থেকে যেন একরাশ বিরক্তি এসে চাপলো। সব বিরক্তি কেন্দ্রিভূত হলো স্যারের প্রতি। স্যার কেন বিকালে ক্লাস নিতে গেলেন। বিকালের ক্লাসটা না থাকলে সকালের ক্লাস শেষে হলে গিয়ে আরাম করে ঘুমানো যেতো।

এই রোদের ভিতর হাটতে হতো না। ভাবনা দীর্ঘায়িত হতে গিয়ে থেমে গেল চারুকলার গেটের সামনে গিয়ে। কেউ কি আমাকে কিছু বলছে! পাশে ফিরতেই দেখি সুদর্শনা একজন আমার দিকে তাকিয়ে আছে। উৎসুক দৃষ্টিতে তাকাতেই জিজ্ঞাসা- এক্সকিউজ মি! জনতা ব্যাংকটা কোথায় বলতে পারেন? ঘ ইউনিটের জন্য ভর্তি পরীক্ষার ফরম কিনতে হবে। এইতো সামনে।

রোদের মধ্যে দাড়িয়ে ঘামতে ঘামতে বললাম। উপরি হিসাবে হাত দিয়ে ইশারা করে দেখালাম। স্যরি, আমি এই ক্যাম্পাসে খুব কম এসেছি। তাই চিনতে পারছিনা। এদিকে গাড়িটাও ছেড়ে দিছি।

ওকে! আমি সেদিকে যাচ্ছি। আপনার আপত্তি না থাকলে আমার সঙ্গে আসতে পারেন। বলেই হাটতে লাগলাম। মেয়েটিও আমার সঙ্গেই হাটছে। কিছুদুর যাওয়ার পর সহসা জিজ্ঞাসা- আপনি কোন ডিপার্টমেন্টে পড়েন? হেটে একটু বেশি সামনে চলে গিয়েছিলাম।

এবার গতি কমিয়ে সমানে সমানে চলে আসলাম। উত্তর দিলাম-ল’ ডিপার্টমেন্টে পড়ি। আরেকটা প্রশ্ন আসতে পারে ভেবে আগেই বলে দিলাম। এইবার তৃতীয় বর্ষ চলছে। আমার পিছিয়ে আসা এবং আগ বাড়িয়ে আরেকটা কথা বলে দেওয়া দেখে মেয়েটা হেসে বললো- আমারও ল’তে পড়ার খুব ইচ্ছা।

ল’ অথবা ইকোনমিক্স। মনে হয় না হবে। আমি পড়ালেখা তেমন করিই না। কথা না বাড়িয়ে চুপ করে থাকলাম। অ্যানিওয়ে, আমরা এতোক্ষণ ধরে একসাথে হাটছি এবং কথা বলছি অথচ একে অপরের নামই জানি না।

আমি কাশফিয়া। অপরপক্ষের কাছে নাম শুনে নিজের নামটা বললাম। জনতা ব্যাংকের কাছাকাছি পৌছানোর আগেই আরো কিছু বিষয় নিয়ে পরস্পরে কথা হলো। জনতা ব্যাংকের সামনে তখন লম্বা লাইন। লাইনে দাড়িয়ে গেল মেয়েটি।

আমি হেসে টিএসসির ভিতরে ঢুকতে যাবো এমন সময় বলে উঠলো- আপনার সঙ্গে আর দেখা হওয়ার সম্ভাবনা নেই? সেইটাতো এখনই বলা যাচ্ছে না। হয়তো দেখা হতে পারে। আবার হয়তো দেখা হবে না। আপনার আপত্তি না থাকলে আপনার মোবাইল ফোন নাম্বারটা কি দেওয়া যাবে? মনে মনে এটাই প্রত্যাশা করছিলাম। মেয়েটির সাথে আরো দেখা হোক এমনটাই চাচ্ছিলাম।

কিন্তু মোবাইল নাম্বার চাইতে দ্বিধা হচ্ছিল। মোবাইল নাম্বারের আদান প্রদান শেষে চলে গেলাম টিএসসির ভিতরে। তারপরের একমাস কোন যোগাযোগই হয় নি। ভাবলাম মেয়েটি হয়তো ভুলে গেছে। আমিও আগ বাড়িয়ে কল করলাম না।

একদিন সন্ধ্যায় হলের বারান্দায় বসে ছিলাম। ঠিক তখনি মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলো। কথা হলো মেয়েটির সাথে। এরইমধ্যে ভর্তি পরীক্ষা হয়ে গেছে, ফলাফলও হয়ে গেছে। তবে সে টিকে নি।

পরীক্ষার আগে পারিবারিক সমস্যার জন্য নাকি মোটেও পড়তে পারেনি। জানালো বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে যাবে। শান্তনা দিতে গেলাম না। অন্য আরো কিছু কথা বলে ফোন রাখলাম। তবে সেদিনের পর কথা বলা থেমে যায়নি।

প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে অনেক কথা হয়েছে। বেশ কয়েকবার একসাথে ঘুরে বেড়ানোও হয়েছে। সম্বোধন আপনি থেকে তুমি’তে চলে এসেছে। কাশফিয়ার সাথে সম্পর্কের ধরণ নিয়ে এখন খুব ভাবি। আমি নিজেও উপলব্ধি করি তাকে আমি অনেক পছন্দ করে ফেলেছি।

কিন্তু এটি কি ভালোবাসা নাকি অন্যকিছু বুঝে উঠতে পারি না। অপরদিকে কাশফিয়াও যে আমাকে পছন্দ করে তা বেশ বুঝতে পারি। তবুও মুখ ফুটে কেউ কিছু বলি না। অসংজ্ঞায়িত সম্পর্ক থেকে যায় আমাদের মধ্যে। মাঝেমধ্যে ভাবি একটু উদ্যোগ নিয়ে সম্পর্কটা সংজ্ঞায়িত করে ফেললেই হয়।

তবুও কিসের যেন একটা ভয় কাজ করে! যদি প্রত্যাখানের মুখোমুখি হতে হয়! অসংজ্ঞায়িত সম্পর্ক নিয়েই বিকালের পর বিকাল একসাথে ঘুরে বেড়ানো চলে। কাশফিয়া সময় পেলেই আমার ক্যাম্পাসে চলে আসে। ততোদিনে কাশফিয়ার পরিবার সম্পর্কে যতোটা জেনেছি তা হলো- তারা মোহাম্মদপুরে থাকে। নিজেদের ফ্ল্যাট। এক ভাই এক বোন।

কাশফিয়ার বড় ভাই এখন আর পড়ালেখা করে না। কারণা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করা হয় নি। কাশফিয়া যখন আমার সাথে দেখা করতে আসে তখন প্রায়ই ক্রিম কালারের একটা গাড়ি নিয়ে আসে। গাড়িতে চলাচল দেখে ধারণা করি তাদের পরিবার অবস্থাসম্পন্ন। আমাদের পরিচয়ের প্রায় এক বছর পর প্রথম পহেলা বৈশাখটা আমরা একসাথে কাটালাম।

সূর্যোদয়ের সাথেই সাথে কাশফিয়ার কল। নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে আমাকে প্রস্তুত হতে বললো। ঘুম জড়ানো কন্ঠে বেশি কিছু না বলে রাজি হয়ে যেতো হলো। রমনার কাছেই একসাথে হলাম আমরা। কাশফিয়া শাড়ি পড়ে এসেছে।

লাল পাড়ের সাদা শাড়ি। হাতে চুড়ি, সেখানে অবশ্য লাল সবুজের সমাহার। কপালে ছোট্ট কালো টিপ। অদ্ভুত সৌন্দর্য্যের দিকে অদ্ভুত মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে থাকলাম অনেকক্ষণ। কাশফিয়া তা টের পেয়ে মুচকি হাসতে লাগলো।

রমনায় বেশ কিছুক্ষণ থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে গেলাম। লোকজনের ভীড়ের মধ্যে ঠিকমতো হাটাই দায়। তারপরেও আমরা পরস্পরে হেটে চলছি। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভিতরে নাগরদোলায় চড়ছে অনেকে। কাশফিয়া তা দেখেই আবদার করলো।

না করলাম না। পাশাপাশি নাগরদোলায় চড়ে বসলাম। নাগরদোলা ঘুরতে আরম্ভ করলো। যখন উপরে ওঠে হঠাৎ করে নিচে নেমে আসে তখন কাশফিয়া ঘনিষ্ট হয়ে আমার কাছে চলে আসে। হয়তো নাগরদোলায় চড়তে গিয়ে কিছুটা ভয়ও পাচ্ছে সে।

জোরে ঘুরলেই সে আরো কাছাকাছি চেপে বসে। তখন তার নিঃশ্বাস পড়ে আমার কাধের উপর। অদ্ভুত এক অনুভুতি। মনে মনে ভাবছি আজকেই কি তবে আমাদের সম্পর্ক সংজ্ঞায়িত করে ফেলবো! আজকে যদি বলি তাহলে কাশফিয়া কিভাবে কিভাবে নিবে! নাগরদোলা থেকে নেমে পাশাপাশি হাটতে গিয়ে তাকে জানালাম- আমার মাথার ভিতর একটা গান ঘুরপাক খাচ্ছে। কি গান? হয়তো বলি নি আমি বললে না কেনো তুমি? চাওনি কি তুমিও তা, বলতে মনের কথা....ভালোবাসি।

গানটা অনেক চমৎকার। কেবল এইটুকু বলেই কাশফিয়া অন্য প্রসঙ্গে কথা বলা শুরু করলো। অভিমান হতে লাগলো তখন। ভাবছিলাম তাকে ভালোবাসার কথা বলবো! তা আর হলো না। (চলবে......)


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.