যখন বিকাল হতে থাকে, হতে হতে সূর্যটা ঢলে পড়ে, পড়তে থাকে
মামুনুর রশীদ হয়েছেন গাজী সাহেব মনপুরাতে। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তার চরিত্রের ধারাবাহিকতা অক্ষুন্ন থাকে নি। চরিত্রটিকে সিনেমার সবচেয়ে দুর্বল অংশ বলেও মনে হয়েছে। প্রথম দিকে যিনি দৃশ্যত স্ত্রীর সিদ্ধান্তে নির্ভরশীল, সরল বলে মনে হয়, পাগল ছেলে শিমুল কাজের মেয়েকে খুন করার পরে, সত্য কথা বয়ানের উচ্চারণ থেকে স্ত্রীর প্ররোচনায় সরে আসাতে যেমন মেরুদন্ডহীনতা প্রকাশ পায় - তেমনি শেষেরদিকে এসে মনে হয়েছে তিনিই আসলে নাটের গুরু। সোনাইকে ধরিয়ে দেয়া, নামাজ, মদ্যপান, সোনাই এর প্রতি বাৎসল্য প্রকাশের মাধ্যমে তার উপস্থিতির এক বিচিত্র অস্বাভাবিকতার প্রকাশ ঘটেছে।
মনে হয়েছে মামুনুর রশীদের অভিনয় গাজী সাহেবের চরিত্রানুগামী হয়নি - কারণ গাজীর চরিত্রের মধ্যে জটিলতা প্রথম থেকেই ছিল - যা কখনও মনে হয়েছে সরল কেবল ঐঐ মুহূর্তের অঅভিনয়ের কারণে। সম্ভবত পরিচালক মামুনুর রশীদকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছেন অথবা তার নিজের লেখা চিত্রনাট্যে তিনি চরিত্রটির বিষয়ে মনস্থির করতে পারেননি।
মনপুরাতে চঞ্চল ভাল অভিনয় করেছেন। কিন্তু গল্প ও সিনেমাটোগ্রাফীর ডিমান্ড এড়িয়ে গেছেন গিয়াসউদ্দিন সেলিম। সোনাই চরিত্রটি অনেক বেশী সিনেমাটিক এবং এমন চরিত্রকে রূপায়ন ও উপস্থাপনের জন্য চঞ্চল উপযুক্ত নয় বলেই মনে করি।
মনপুরা সম্বন্ধে আমার বসের মন্তব্য - গল্প ভালো, নিটোল কিন্তু টেনে বড় করা হয়েছে..দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়তে হয়; এবং সে ঘুমিয়েও পড়েছিলো। সিনেমাগ্রাফী মুগ্ধ করার মত তবে নিঁখুত নয়। যেমন নৌকা যে বৈঠায় চলছে না, অন্য কেউ সামনে বা পেছন থেকে টানছে এটা বোঝা যাচ্ছিলো। সোনাই মনপুরাতে কতদিন থাকলো, সেই সময়ের দৈর্ঘ্য বোঝা যায় নি - বাড়ীঘর, ল্যান্ডস্কেপিং, সোনাইর চুল, আবহাওয়া কোন কিছুই পরিবর্তন হয়নি। নদীর যে প্রস্থ দেখিয়েছে তা বিভ্রান্তিমূলক।
পরীর সাথে দেখা করার জন্য সোনাই সাতরিয়ে নদী পার হতে এলে নদীর প্রস্থ গেলো বেড়ে। পরিচালক ভুলে গেছিলেন সম্ভবত যে এর আগে কমপক্ষে তিন/চারটা দৃশ্যে ভিন্ন দিক থেকে ঐ প্রস্থের চেয়ে অনেক কম দেখিয়েছেন।
বাবুর নিথুয়া পাথারে গানটি অসাধারণ। পরীর বাবার চরিত্রে বাবুর অভিনয় অসাধারণ। কিন্তু এই চরিত্রটিও ভঙ্গুর, অস্বচ্ছ ও জটিল মনে হয়েছে গাজী সাহেবের মত।
ঠিকমত নির্মিত নয়। মাছ ধরা যার জীবিকা, সরলতা যার পরতে পরতে - সে মেয়ের বিবাহে যে ইউ-টার্ন নেন, পাগল ছেলের নামে সমস্ত জমি লিখে দেবার সংবাদে সেটা তার চরিত্রের এ-পর্যন্ত বিকাশের সাথে মেলে না। হয় তিনি প্রথম থেকেই আগ্রহী হবেন, অথবা প্রথম থেকে নিরাগ্রহী - যেহেতু পাগল ছেলের নামে সম্পদ থাকে এটা তার অভিজ্ঞানের মধ্যেই পড়ে।
"যাও পাখী বলো তারে" দিলারার গলায় অদ্ভুত লেগেছে। পাশের বাড়ীর চাচির গানের দল এমন একটা আবহতে মেয়েকে সম্পৃক্ত না হতে দেবার পিতৃসুলভ আচরণ খাপছাড়া মনে হয়েছে।
জেলেতাতীদের প্রতিবেশ-সংস্কৃতিতে এমন মধ্যবিত্তীও আচরণ অমানানসই। তবে দিলারা যতটুকু ছিলেন পর্দায় চমৎকার লেগেছে। পরীর নানীর মাত্র এক মিনিটির উপস্থিতিও সপ্রতিভ ছিলো। অনেক দিন যাবত দাদিনানির চরিত্রে তিনি অভিনয় করছেন কিন্তু নাম জানি না।
মনপুরা দেখে মনে হয় নি এটা এত সুপারডুপার হিট হবার মত ছবি।
সচারচর বাংলা ছবির যে দর্শক তাদের চেয়ে এর দর্শক ভিন্ন হবার কথা। মানে একেবারেই সুশীল ও মধ্যবিত্ত। কারণ এতে রয়েছে দৃশ্যকাব্য, লম্বা শট - বিশেষত গানের চিত্রায়নে প্রকৃতির সৌন্দর্য্য উঠে এসেছে চমৎকারভাবে। আমার বস বললো, ছবিতে আসলেই গ্রামের সবুজ প্রান্তর অদ্ভুতসুন্দরভাবে উঠে আসে। আমি অবশ্য একটু ডিফার করেছি ফ্রেমিং এর মুনসিয়ানার সাথে।
পরিচালকের শিল্পময় উপস্থাপনার পরিচয় ফুটে উঠলেও এগুলোর মধ্যে তার নিজস্বতা চোখে পড়ে নি। মনে হয়েছে এমন দৃশ্যায়ন অনেক চমৎকার চমৎকার সিনেমা থেকে তুলে আনা বা সেই দৃশ্যায়নগুলো দেখে শেখা। ফলে নৌকার ঘূর্ণি, ক্ষেতে ফসলের ঠেউ এই রপময় ফ্রেমিংগুলো দেখে স্মৃতির সঞ্চয়ের সাথে মিলে যতে পারে। তবে পুরা ছবিটাতে উপস্থাপনার নান্দনিকতা খেয়াল করা হয়েছে যত্নসহকারে - কিন্তু গিয়াসউদ্দিন সেলিমকে সেখানে সুনির্দিষ্ট করা একটু মুশকিল বটে।
যা বলছিলাম - এই ছবি হিট করার কথা নয়, দেখতে গিয়ে ক্লান্তি লাগবে, কিন্তু অস্বাভাবিকভাবে এটি সচারচর ঢাকাইয়া ছবি দেখা পাবলিকও গিলেছে।
যার কারণ হিসাবে কেবল গানকে নির্বাচন করতে হয়। গানগুলা বাদ দিলে ছবিটি সিনেপ্লেক্স, নিউমার্কেট ছাড়া অন্য কোনো হলে চলতো কিনা আমার সন্দেহ হচ্ছে।
পরিশেষে - ছবিটাকে পথিকৃত বলা যায় ব্যবসা সফল মধ্যবিত্তীও ছবির নতুন ধারার সূচক হিসাবে, তবে মনপুরা দেখার আগে যতটা চমৎকার মনে হয়েছে দেখার পরে ততটা প্রত্যাশা পূরণ না হলেও আশাবাদী করেছে। এমন ছবি আরো বেশী নির্মাণ হওয়া উচিত - নিদেনপক্ষে আইসব্রেকিং তো হলো, ভালো ছবি চলে না জাতিয় নির্লিপ্ত চলচিত্রপঠনে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।