আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জনস্বাস্থ্যঃ সোয়াইন ফ্লু বনাম ব্যবসা----[মাইক ডেভিস]

আমি চাই শক্তিশালী স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ

মেক্সিকোয় এখন বসন্ত। পর্যটন দ্বীপ কানকুন থেকে দলে দলে মানুষ ফিরছে অদৃশ্য কিন্তু মারাত্মক এক ্নৃতিচিহ্ন নিয়ে। মেক্সিকান সোয়াইন ফ্লু সম্ভবত জন্মেছে কোনো বড় শূকর খামারের বিষ্ঠার গর্ত থেকে। শেষ বড় মহামারির নাম ছিল হংকং ফ্লু, ১৯৬৮ সালে। তার থেকে এই ফ্লু ছড়িয়ে পড়ার গতি অনেক বেশি।

এই ভাইরাসটির ভয়াবহতা কতটা তা এখনো নিশ্চিত নয়, তবে সার্স ভাইরাসের থেকে এটি কম ক্ষতিকারক হলেও স্থায়িত্ব সার্সের থেকে বেশি। এটি আরেকটু শক্তিশালী হওয়ার ক্ষতি যেকোনো বড় যুদ্ধের থেকে বেশি হওয়ার কথা। এ ঘটনায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ব্যর্থতাই বেশি। তারা ভেবেছিল, স্থানীয় জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা যা-ই হোক তাদের দক্ষ মেডিকেল আমলাতন্ত্রই যেকোনো মহামারি ঠেকাতে পারবে। ১৯৯৭ সালে হংকংয়ে ঐ৫ঘ১ ভাইরাসে মৃত্যু ঘটার পর ডব্লিউএইচও বিভিন্ন দেশের সরকারের সঙ্গে মিলে মহামারি রোধের একটা কৌশল দাঁড় করায়।

কৌশল আর কিছুই নয়, মহামারি-আক্রান্ত এলাকাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা এবং তারপর ওই এলাকার সব মানুষকে ধরে ধরে ভ্যাক্সিন (যদি থাকে) দিয়ে দেওয়া। সন্ত্রাস দমনের কায়দায় ভাইরাস দমনের এই কৌশল সব ক্ষেত্রে কাজে দেবে না। কারণ, এখনকার অণুজীবাণু দ্রুতই দুনিয়াময় ছড়িয়ে পড়তে পারে, যেমনটা বার্ড ফ্লুর বেলায় হয়েছিল। যেসব কারণে মহামারির জন্ম হয় সেসব কারণ দূর করা এবং যেসব এলাকা ঝুঁকিপূর্ণ বিদেশের সেসব এলাকাকে সহায়তা করার বদলে ব্রিটেন ও আমেরিকার মতো ধনী দেশগুলো কেবল নিজেদের জৈব-গবেষণায় টাকা ঢেলেই খালাস। এরই ফল হলো দৈত্যাকারের ওষুধ কোম্পানির একচেটিয়া।

অথচ বিপরীতে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো দাবি করে আসছে, অ্যান্টি-ভাইরাল টিকাগুলো ওষুধ কোম্পানিগুলোর মুনাফালোভী ব্যবসার হাত থেকে উন্মুক্ত করে দেওয়া হোক, যাতে সরকারিভাবেই এগুলোর উৎপাদন ও বণ্টন করে সবার জীবন বাঁচানো যায়। সোয়াইন ফ্লু আবারও সেই প্রয়োজনটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল যে স্বাস্থ্য তদারকি, বৈজ্ঞানিক ও রোগনিয়ন্ত্রণকারী অবকাঠামো, সবার জন্য মৌলিক চিকিৎসাসেবা এবং বৈশ্বিকভাবে জীবনরক্ষাকারী ওষুধের সহজপ্রাপ্যতা সৃষ্টি করা দরকার। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মনে হয় এর দায়িত্ব বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির ব্যবসার হাতেই ছেড়ে রাখতে চায়। যেমন তামিল ফ্লুর প্রতিষেধকের একচেটিয়া নিয়ে নিয়েছে রোশে কোম্পানি। তাই এত বড় মহামারির আশঙ্কার মুখেও উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের আদতে কোনো প্রস্তুতিই নেই।

অথচ ছয় বছর আগেই বিখ্যাত সায়েন্স পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল যে ‘কিছু বছর স্তিমিত থাকার পর সোয়াইন ফ্লু খুবই সক্রিয় হয়ে উঠেছে। ’ ১৯৯৮ সালে মন্দার শুরুতে এটা শনাক্ত হওয়ার পর ভাইরাসটি এর আদি গঠন থেকে কিছুটা পরিবর্তিত হয়। নর্থ ক্যারোলিনার একটি শূকরের খামারে দেখা দেওয়ার পর প্রতিবছরই এর নতুন রূপ দেখা দিতে থাকে। এই হাইব্রিডগুলোর একটি জাত মানুষকে সংক্রমিত করতে পারে। তখন থেকেই বিশেষজ্ঞেরা সোয়াইন ফ্লু ঠেকানোর নজরদারি ব্যবস্থা গড়ে তোলার ডাক দিয়েছিলেন।

কিন্তু মার্কিন সরকার কাল্পনিক জীবাণু অস্ত্র প্রতিরোধে শত শত বিলিয়ন ডলার ব্যয় করলেও বাস্তব ভাইরাসের বিপদ মোকাবিলায় কিছুই করেনি। ইতিমধ্যে যে প্রক্রিয়ায় বার্ড ফ্লু তৈরি হয়েছিল, সেই প্রক্রিয়াই সোয়াইন ফ্লুর বিবর্তনকে এগিয়ে দিয়েছিল। ভাইরাস বিশেষজ্ঞেরা বিশ্বাস করেন, দক্ষিণ চীনের অতি উৎপাদনশীল যান্ত্রিক কৃষিই হলো ইনফ্লুয়েঞ্জার এ রূপান্তরের কারণ। কিন্তু করপোরেট বাণিজ্যিক গবাদিপশু উৎপাদন এ বিষয়ে চীনকে ছাড়িয়ে গেছে। ১৯৬৫ সালে আমেরিকায় ১০ লাখ খামারে পাঁচ কোটি ৩০ লাখ শূকর ছিল।

এখন সাড়ে ছয় কোটি শূকর পালিত হয় মাত্র ৬৫ হাজার কেন্দ্রে। সাবেকি পারিবারিক খামারের জায়গায় চলে এসেছে বিরাট বিরাট বাণিজ্যিক খামার। সেখানকার নোংরা, দুর্গন্ধ, গরম, মলমূত্রের বিরাট ভাণ্ডার ও দূষণ যা প্রকৃতিকে আগে কখনো সইতে হয়নি। সেখানে যে প্রাণীগুলো থাকে, সেগুলোর রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা খুবই দুর্বল। সেই পরিবেশে শূকরগুলো পরস্পরের সঙ্গে মেশামেশি করে এবং তাদের শরীরের বিভিন্ন জৈব উপাদান মেশামেশি হতে থাকে, তাতেই সৃষ্টি হয় ভয়ঙ্কর জীবাণু।

গত বছর মার্কিন পিউ রিসার্চ সেন্টার তাদের এক যুগান্তকারী প্রতিবেদনে জানায়, ‘বিরাট আকারে গবাদিপশু উৎপাদন শিল্পে মারাত্মক ভাইরাসের চক্র সৃষ্টি হয়ে চলেছে। এসব থেকে জন্ম নেওয়া সাধারণ ভাইরাসও একপর্যায়ে মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হওয়ার মতো রোগব্যাধির জন্ম দিতে পারে। ’ তাঁরা শূকর কারখানাগুলোতে ক্ষতিকারক জীবাণুনাশক ব্যবহার নিয়েও আপত্তি তোলেন। কিন্তু এসব কোম্পানি অমিত ক্ষমতাধর, যেমন ্নিথফিল্ড ফুডস (শূকর ও গরুর মাংস) এবং টাইসন (মুরগি)। এরা পিউ রিসার্চ সেন্টারের গবেষণাকে বাধা দেয় এবং এসব প্রতিষ্ঠানে তহবিল বন্ধ করে দেওয়ার হুমকিও জানায়।

এটা এখন বৈশ্বিক শিল্প, সুতরাং বিশ্বব্যাপী এদের রাজনৈতিক ক্ষমতাও কম নয়। যেমন ব্যাংককভিত্তিক যে দানবীয় কোম্পানি শারোয়েন পকফান্ড বার্ড ফ্লু ভাইরাসের জন্য দায়ী, তাদের মাধ্যমেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বার্ড ফ্লু ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু এদের কোনো শাস্তিই হয়নি। এ ফ্লু-র অজুহাতে তখন মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রোনাল্ড রামসফেল্ড এক বিলিয়ন ডলারের প্রতিষেধক আগাম মজুদ করে এবং কংগ্রেস আরো ২ বিলিয়ন ডলার তহবিল দেয়। যে কোম্পানিটি এতে লাভবান হয় রামসফেল্ড নিজেই ছিলেন তার শেয়ার-মালিক ও চেয়ারম্যান।

এবং সেসময় তাঁর কারসাজিতে কোম্পানিটির শেয়ারমূল্য ৭০০ শতাংশ বাড়ে। তাই আবারও সোয়াইন ফ্লু ভাইরাস প্রতিরোধের উপায়গুলো কর্পোরেট খাদ্য ব্যবসায়ী আর আর ওষুধ কোম্পানিগুলোর করপোরেট পাথুরে দেয়ালে মাথা খুঁড়ে মরবে। কিন্তু আগুন কে লাগিয়েছে তা গোপন থাকবে না। এর মধ্যেই মেক্সিকোর গণমাধ্যমে আসতে শুরু করেছে যে এই মহামারির উৎপত্তিস্থল সেখানকার ভেরাক্রুজ প্রদেশের মার্কিন ্নিথফিল্ড খাদ্য কোম্পানির আশপাশে। এর থেকেও মারাত্মক সংবাদ হলো, ডব্লিউএইচওর মহামারি মোকাবিলা কৌশল ব্যর্থ হয়েছে।

এর মানে জনস্বাস্থ্যের আরও অবনতি এবং জীবন বাঁচানো ওষুধের ওপর বড় ওষুধ কোম্পানিগুলোর আরও একচেটিয়া বাজার কায়েম হওয়া। বার্ড ফ্লু-র সময় মার্কিন সরকার পরিণাম অনিয়ন্ত্রিত ও অস্বাস্থ্যকর খাদ্য ও মাংস উৎপাদনের ফলে আমাদের এই গ্রহজুড়ে আরও বিপর্যয় নেমে আসা। (জেড নেট থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ ফারুক ওয়াসিফ) মাইক ডেভিসঃ মার্কিন অধ্যাপক ও গবেষক। Click This Link

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.