কোথায় যেন কী একটা জট পাকিয়ে গেছে......টাইফয়েডের দৌরাত্মে মাস খানেক বাসা বন্দী থাকার পর যখন ‘ওষুধ আর খেতে হচ্ছে না, তাই সুস্থ’ এমন একটা ভাব নিয়ে শারীরিক দুর্বলতাকে উপেক্ষা করে আবার শহরময় দৌড়ে বেড়ানো শুরু করেছি, তখন দেখছি, এক মাসে স্তুপীকৃত হতে হতে কাজের সূত্রগুলো সব জট পাকিয়ে গেছে। কোনো একটারও জটসূত্র খুঁজে পাচ্ছি না। হাতের কাছে কোনো একটার সুতো পেয়ে মহা আনন্দে টানছি......’আরে, এই তো! একটা সুতো পেয়ে গেছি, এটাকে আগে ছাড়াই......’ কিন্তু সেই সুতো অনেকখানি কিংবা একটুখানি বের হয়ে এসে তারপর আটকে যাচ্ছে ‘সব সুতোর পাকিয়ে যাওয়া জট’-এ......’কি করি’ ‘কি করি’ করতে করতে মাথায় হাত......
যতদূর জানি এখনো পর্যন্ত, ১৬ মে থেকে আমার তৃতীয় বর্ষ সম্মান চূড়ান্ত পরীক্ষা। নোটিশ টাঙ্গিয়ে রেখেছে পরীক্ষা শুরুর তারিখ দিয়ে, যদিও এখনো ফর্ম ফিল আপ কিংবা রুটিন কোনোটারই কোনো খবর নেই। পরীক্ষা পিছিয়েও যেতে পারে।
সেটা ব্যাপার না। ব্যাপার হলো প্রস্তুতির। যেই মাসটায় সবাই ক্লাস সাস্পেন্ড হয়ে যাওয়ার পরের কয়েকদিন নিয়মিত এসে নিজেদের পড়াশোনা’র সব উপাদান যোগাড় করে ফেলেছে, বই-পত্র যা যা লাগে সব কিছু ম্যানেজ করেছে, আর এতদিনে পড়াশোনায় প্রায় পুরোটাই শেষ করে ফেলেছে কিংবা রিভিশন দিচ্ছে, সেখানে আমি ওই একটা মাসই ডিপার্টমেন্ট এর ত্রিসীমানায়ও নেই। কি হচ্ছে, কী পড়তে হবে, কোথা থেকে কী পাবো, কিছুই জানি না......পুরাই অন্ধকারে। ফোন দেই দুই-একজনকে, ‘আমার তো টাইফয়েড।
সামনে পরীক্ষা। পড়াশোনা’র ব্যাপারে একটু হেল্প করবা ? কী পড়বো?? কোন বইয়ে কোন টপিকের লেকচার মিলবে......’ ‘ হ্যা......পড়ার আর কি ? এই বই , ওই বই.........আর সব টুকিটাকি ফটোকপি......তেমন কিছু না......আর তোমার আবার এসব লাগে নাকি ? এক মাস পড়তে হবে তোমার?? তুমি তো পরীক্ষার আগে রাতে পড়েই ফাটাবা......’ সূক্ষ্ম খোঁচা এবং কন্ঠের টোন শুনে আর জিজ্ঞেস করার সাহস হয় না, ‘ফটোকপির শিটগুলা দিবা? আমি কপি করবো?’ কিংবা ‘টপিক গুলা কোন বইয়ে কত পেজ এ পাওয়া যাবে জানাবা? আমি খুঁজে নিয়ে কপি করে নিবো...’...ফলে পড়াশোনার সেইরকম এক জট পাকানো অবস্থা নিয়ে আমি ঘুরছি......কিচ্ছু করার নেই বোধহয়......ব্যাপক হতাশ হয়ে যাচ্ছি......পড়াশোনা নিয়ে এম্নিতেই হতাশ, তার মধ্যে এখন যদি সেই পরিমাণ আরো বৃদ্ধি পায়, ক্যামনে কি?
তারপর টিউশনি। ছাড়বো ছাড়বো করেও যেটা ছাড়তে পারছিলাম না। যখন সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি, ‘এবার তবে ছাড়বোই’...তখনি অসুস্থ হয়ে গেলাম। আর এই কয়দিন যাওয়াও হয়নি, কথা হলেও ওই প্রসঙ্গ তোলা হয়নি।
এখন ছাত্রীরও পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। আন্টি প্রতিদিন ফোন দেয়, ‘আসো’...আমি ‘আজ না কাল’ করে কাটিয়ে যাচ্ছি। ছাড়তে হবে। একটা জট এটা। এটাও খুলতে পারছি না।
প্রাচ্যনাট এ গ্রুপে জয়েন করলাম। ১৫ এপ্রিল করার কথা। কিন্তু অসুস্থতার জন্য হলো না। ব্যাচমেটদের সাথে একসাথে জয়েন করতে পারলাম না। কথা দিয়েছিলাম ২২ তারিখের পর জয়েন করবো, কথামতো ২৩ তারিখ গিয়েই জয়েন করলাম।
তারপরদিন সন্ধ্যায় যাওয়া হলো না। যাওয়ার পরিকল্পনা মনে মনে করেও দিনশেষে হলো না। অফিসে আটকা পড়লাম। ফর্মা বের হবার প্রক্রিয়া চলছে। আমাকে দেখেই, ‘তুই তো সুস্থ’ ভাব নিয়ে কাজ ধরিয়ে দিলো।
আমিও ‘আমি তো সুস্থ’ ভাব নিয়ে কাজ করে দিলাম। তারপর দিনশেষে শরীরে ‘শক্তি আর নাই’ অবস্থা। ভাবলাম, একদিনই তো, কাল গিয়ে বলবো, শরীর খারাপ লাগছিলো। কথা তো মিথ্যা নয়। পরদিন, ২৫ তারিখ, যাবো কি যাবো না করতে লাগলাম।
একবার প্রায় রেডি মনে মনে, যাবোই...কিন্তু হলো না। ঘড়ির কাঁটা চোখের সামনে দিয়ে ৬টা-৭টা-৮টা বেজে গেলো......শরীরও বাপধন বিদ্রোহ করে। আজব! প্রতিদিন ভাবি, বিকেলের আগে আর বের হবোই না......কিসের কি! সকাল-সন্ধ্যা লোকাল বাস সার্ভিস চলতেই থাকে......ফলাফল, শরীর আর চলে না। অফিসে নইলে শাহবাগেই নেতিয়ে পড়ে থাকি। উঠে যে অন্য কোথাও যাবো তার কোনো শক্তি পাই না।
মনে মনে ভাবি, ‘এইটা বেশি বেশি হচ্ছে...প্রাচ্যনাটে ‘ফাঁকিবাজ’ ইমেজ তৈরি হয়ে যাবে। তখন আর ‘উৎসাহ’ ও কেউ দেখবে না, ‘ডেডিকেশন’ এর কথা বললেও বিশ্বাস করবে না। শত হলেও, ‘ফার্স্ট ইম্প্রেশন ইজ দ্য লাস্ট ইম্প্রেশন’ বলে একটা কথা আছে.........প্রথমেই যদি এরকম হয়, ভেবেই নেবে ‘এতদিন উৎসাহী চোখে তাকিয়েছি সবার চোখে শুধুমাত্র গ্রুপে চান্স পাবার জন্য’......তা তো নয়!... শরীরকে বকি, ‘তুই তো সুস্থ হোসনি...সারাদিন টো টো করে আর কয়দিন পর ঘুরতে যা। এই এক জায়গায় এসে আর নড়তে না পারা শরীর নিয়ে কি আর তিন-চার জায়গায় যাবার পরিকল্পনা করা যায়???’...তাও শরীর শুনলোনা। গতকাল প্রতিজ্ঞা করলাম মনে মনে, আজ কোথাও বের হবো না...বিকেলে একবারে বের হয়ে প্রাচ্যনাট যাবো।
কপালের নাম গোপাল! সকাল সকাল ফোন আসে প্রেমিক প্রবরের, ‘আমি ক্যাম্পাসের দিকে যাবো, তুমি কি যাবা?’...আমিও জাহাঙ্গীরনগর এর নাম শুনে লাফিয়ে উঠি, কতদিন যাই না! রেডি হয়ে সোজা দৌড়। কিন্তু মনে কঠিন প্রতিজ্ঞা, ‘৫ টার বাসে ফিরে আসবো, তারপর সোজা প্রাচ্যনাট’...আজকে আর এদিক-ওদিক হবে না...যাবোই......কপালের দোষ!...৫টার বাস নিয়ে ক্যাচাল। বাস নাই...বাস ফার্স্ট ইয়ারের জন্য...এসব দেখতে দেখতে আর যাওয়ার কথা মাথায় আসে না...ভাবি ৬টার বাস ধরবো ... কখন যে ৬টা বেজে যায়, মনোযোগ হারিয়ে মিস করে ফেলি......বাসে উঠলাম যখন, তখন বাজে ৭টা! মনে মনে গজরাই...আজকে দোষটা আমারই!...৬টাতেও যদি রওয়ানা দিতাম, তাইলেও ৮টা বাজলেও প্রাচ্যনাটে চেহারা দেখায় আর দুই দিনের ‘বিনা নোটিশে অনুপস্থিতি’কে ‘তিন দিন’এর হ্যাটট্রিকে রূপান্তরিত হতে দিতাম না! না হয় বাইরের বাসেই আসতাম...'মানে...আমি একটা...' নিজেকে বসে বসে গালি দেই মনে মনে। আর কি করবো! এর মধ্যেই প্রাচ্যনাট থেকে ফোন আসে, নোবেল ভাই। জানের পানি সব শুকিয়ে সাথে সাথে মরুভূমি হয়ে যায়।
‘গ্রুপে আসেন না কেন?’ প্রশ্ন আসে, অ্যাজ এক্সপেক্টেড...... মুখ দিয়ে কথা বের হয় না...আমতা আমতা করি......’শরীর খারাপ’ সেটা আর মুখ দিয়ে বের হয় না, ‘ভেজালে পড়ে গেছি!’ উত্তর বের হয় ভেতর থেকে। ‘গ্রুপে জয়েন করার সময় মনে ছিলো না ভেজালে পড়বেন?’...এবার দেখি যাও এক-দুইটা মরুদ্যান জান শুকিয়ে যাওয়া মরুভূমিতে ছিলো, তাও নাই! খালি শুকনা বালি আর বালি! মনে হয়, এক্ষুনি গুপি-বাঘার মতো কোনো জাদু চপ্পল পেয়ে গেলে তালি বাজিয়ে প্রাচ্যনাট চলে গিয়ে যদি নোবেল ভাইকে বলতে পারতাম, ‘এই দ্যাখেন, চলে এসেছি!’...তা তো আর হয় না। মুখ দিয়ে বের হয়, ‘সরি...কাল আসবো...আসলে...কি বলবো......মনে...কালকে এসে বলবো......’ আর কথা বের হয় না...’হ্যাঁ, আসেন’...বলে ফোন কেটে দেয় ওপাশ থেকে। আমি মনে মনে ভাবি, ‘কই যাই???’...ঠিক যেই ফাঁপরটায় পড়তে চাই না বলে মুহুর্তখানেক আগেই ভাবছিলাম, সেই ফাঁপরের চেয়ে ‘হাই ডোজ’ ফাঁপর! ...
মনে মনে ভাবি, কাজগুলো কেন সবসময় এরকম জট পাকিয়ে যায়?? কেন কখনোই হাতে 'এক্টাই কাজ' এমন অবস্থা হয় না ??? আমারই সমস্যা! আই কান্ট ম্যানেজ মাল্টিপল থিংস...অথচ, আমারই সবসময় একাধিক 'কাজ' এর ফাঁপরে থাকতে হয়......ভাবতে ভাবতে বিষন্নতা ভর করে,। এটা হলে ওটা হয় না...ক্যামনে কি ??...কোনো দিশা পাই না......অসুস্থতার গুষ্টি উদ্ধার করি মনে মনে, ‘এই একটা মাস অসুস্থ না হলেই তো......!!!!!’......ক্যামন জানি লাগে সবকিছু......মনের মধ্যে হতাশারা আবার উঁকি মারে।
‘আমাকে দিয়ে কিস্যু হবে না...আমি একটা গুড ফর নাথিং, যে একসাথে অনেক কাজের ফাঁপরে সবসময় পড়ে থাকে। যখনই সব গুছিয়ে আনতে যায়, তখন আবার ফাঁপরে পড়ে......’
বন্ধু অঙ্কনের মতো বলি, ‘হতেছে না...’
বাসায় ফিরতে ফিরতে অনুভব করি, জ্বরটা আবার ফিরে আসার একটা মৃদু আভাস দিচ্ছে......
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।