আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প: ঘোর লাগা মানুষের গল্প

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ

আজকাল রুপহাটি ইষ্টিশনের একটা বেঞ্চিতে বসে থাকে সে । প্ল্যাটফর্মের ওপর বেঞ্চিতে বসে থাকতে থাকতে কত কী যে দেখে সে? রেলের যাত্রী-ফেরিওয়ালা- ফকির... ওই পারের রেললাইন, ওভার বিরিজ । কত কী যে দেখে সে।

দিনভর দেখে। অনেক রাত পর্যন্ত স্টেশনের বেঞ্চিতে বসে থেকে থেকে এসবই দেখে: ঘন ঘন চা খায়, একটার পর একটা সিগারেট টানে। রুপহাটির ইষ্টিশনটি এমন আহামরি কিছু নয় । এমন কী জংশনও নয় এটি । দিনে দু-তিনবার লোকাল ট্রেন থামে।

আন্তনগর না থেমে- বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ঝমঝম ঝমঝম করে চলে যায় ঈশ্বরদীর দিকে। ইষ্টিশন মানে- লাল রঙের ব্রিটিশ আমলের পুরনো ঝরঝরে একটা দালান; ঢোকার মুখে একটা দীর্ঘ পুরনো কড়ই গাছ। সামান্য সেড, এবড়োথেবড়ো প্ল্যাটফর্ম, কয়েকটা মলিন বেঞ্চি-তারি একটায় বসে থাকে মনিরুল। হলুদ পাঞ্জাবি, কালো প্যান্ট আর ঘন কালো ঝাঁকড়া চুলের নিচে কপাল, ... তারপর ঘন জোরা ভুরুর নিচে জ্বলজ্বলে দুটো আয়ত চোখে তাকে কেমন যেন ঘোর-লাগা দেখায় ... স্বাস্থ ভালো নয় মনিরুলের, লম্বা-ঢ্যাঙা, রংটা মিশমিশে না-হলেও কালোর দিকেই বলা যায়, ডান হাতে একটা কালো রঙের লোহার বালা-সুজারগরের বিনয় বাউলা দিসিল বছর কয়েক আগে চইত সংক্রান্তির দিনে ভাটুপাড়ায় মেলায় । মনিরুলের কালো রঙের আঙুলগুলি সরু সরু-মধ্যমায় একটি রুপার আঙটিতে মরকত পাথর বসানো।

একবার আটঘরিয়ায় মোল্লা পাড়ার বেতাব গাজির বাড়িতে এক কামেল পীর এসেছিলেন। আবাবিল শাহ- তিনিই এক ঘর মানুষের সামনে শূন্য থেকে ছোঁ মেরে পাথরটা তুলে চোখের নিমিষে গুঁজে দিয়েছিলেন মনিরুলের হাতে- না, মরকত পাথরটার জন্য আবাবিল শাহ পয়সা নেননি। পাথরটা লাকড়ি পাড়ার শঙ্কর স্যাকরাকে দিয়ে বানিয়ে মধ্যমায় পরার পর থেকে মনিরুলের গলা শুকানিটা অনেকখানি কমে গেছে। আগে ঘন ঘন গলা শুকাতো মনিরুলের । কাজেই, পীর-ফকিরে ভারি ভক্তি মনিরুলের।

মনিরুলের বাবা হাসেম হাজীও বেঁচে থাকতে বিস্তর পীর ফকিরের মুরিদানী করছিলেন । অনেক অনেক দিন আগে কালো পাঞ্জাবী পরা এক ফকির এসেছিল মদিনা মহলে, মানে মনিরুলদের বাড়িতে। নয়নপুরের আলেম ফকির। মনিরুলের তখন চৌদ্দপনেরো বছর বয়স। জ্বীন দেখার নেশায় পড়ে যাওয়াতে পীর-ফকিরে ভীষন আগ্রহ।

সেই আলেম ফকির মনিরুলকে কোন্ এক আলীজান পীরের কথা বলছিল: কবে মইরা গেছিল আলীজান পীরে। একদিন বিহান বেলায় আমার কাছে আইসা অজুর পানি চাইল আলীজান পীরে । আতরের খোশবু- আমি তো কাইত, দিলাম অজুর পানি কোনওমতে। তারপরে দেখি নাই। কন কি? সত্য? বালক মনিরুলের চোখেমুখে বিস্ময়।

হ, বাবা, সত্য। মিছা কথা কমু ক্যান-আমি পিরালি করি। বলে, আলেম ফকির হেসেছিল। ... তো, বেঞ্চির ওপর বসে বসে রুপহাটির ইষ্টিশনে মানুষজন দেখে মনিরুল। কত রকম মানুষ যে রুপহাটির ইষ্টিশনে রাতদিন ঘুরঘুর করে।

এরই মধ্যে অন্ধ ফকিরের কন্ঠে আলাউদ্দীন বয়াতির গান কানে আসে -আমার প্রানের মন্দিরায়/কেড়ে নিল সাত জন চোরায় .. কোণ্ এক ঘোরলাগা মানুষের গান। সে নিজেও এক ঘোর লাগা মানুষ। ঘোরের মাথায় বাড়ি ফিরতে মনে থাকে না। তা, আজকাল তার বাড়ি ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায় বটে । বাড়ি কাজেই- স্টেশন থেকে হাঁটা পথে মিনিট দশকের পথ।

রাতে বাড়ি ফেরার পথের ওপর অন্ধকার কিংবা জ্যোৎস্না ঝরে ঝরে পড়ে। শোনা যায় ঝিঁঝির ডাক। মাঝে মাঝে দূর থেকে শিয়ালের ডাক । সে নির্বিকার হাঁটে। সিগারেট টানে, শিস দেয় কিংবা গান গায়; আমার বাবা আলহাজ আলী/ যের কাছে মারফতের কলি/ কলব হইয়া যায় নূরানী চাইলে এক নজর...গান থামিয়ে হা হা করে হাসে।

মনিরুল কিছু পাগল আছে বটে। শৈশব থেকেই ... এবং কথাটা রুপহাটির সকলেই কমবেশি জানে। খাওয়া পরার চিন্তা নাই-পাগলামী সে করতেই পারে। পৈত্রিক একটা ‘স’ মিল আছে মনিরুলের। সাত/আট বছর ধরে সেই হাসেম ‘স’ মিলটা দেখাশোনা করছে রঞ্জন ।

রঞ্জন তার ছোটবেলার বন্ধু। একসঙ্গে রুপহাটির প্রাইমারীতে পড়ত (হ্যাঁ, কিছুকাল পাঠশালায় গিয়েছিল বটে মনিরুল)। রঞ্জনের বাপের ভিটে উয়ভপুর- রুপহাটি থেকে খানিক দূরে বলেই ‘স’ মিলেরই পিছনে একটা ছাপড়া ঘরে থাকে রঞ্জন; বিয়ে-থা করেনি । ফরসা আর শান্ত -সুবোধ রঞ্জনের স্বাস্থও ভালো, ওকে বিশ্বাস করা যায়। রঞ্জনের এবার একটা বিয়ে দিতে হয়।

কথাটা ভেবে মুচকি হাসে মনিরুল। ঠিক তখনই দূর থেকে ট্রেনের হুইসেল ভেসে আসে ... ঐ তীক্ষ্ম শব্দে কী কারণে আরিফার মুখটি ভেসে ওঠে তার মনে। মনিরুল জানে রুপহাটির ষ্টিশনটিকে সতীন ভাবে আরিফা ... আরিফার মনের জ্বালা এখানেই। বিয়ার আগে কেউ কয় নাই যে পোলার খারাপ ... তারপরেও বিয়াটা হইছিল। আরিফার বাপের সংসারে ততদিনে ধস নেমেছিল ।

বড় মেয়েকে পার করতে মরিয়া হয়েই ছিল উত্তরপাড়ার আসলাম মাস্টার। পাত্র রুপহাটির হাসেম হাজীর একমাত্র পুত্র। কাজেই ...। হাসেম হাজীর অবস্থা বেশ ভালো। কাজেই, বিয়েটা ধুমধামের সঙ্গেই হল।

বিয়ের পর থেকেই আরিফা দেখতেছে যে ...তার স্বামী উদাসী। মানুষটা ইষ্টিশানে গিয়া বইসা থাকে। ইষ্টিশনে কী করে সে? ভেবে ভেবে কূলকিনারা পায় নি আরিফা। এদিকে আরিফা বাড়িতে একা সারাদিন । শ্বশুড় বিয়ার দুই মাস আঠারো দিন পর ইন্তেকাল করেছেন; শ্বাশুড়ি অনেক দিন থেকেই জীবিত নাই।

মনিরুলের কী কারণে ভাইবোনও নাই। এমনটা হইতে পারে। উত্তরপাড়ার আজিজুল ভাইয়েরও ভাইবোন ছিল না। কত শখ ছিল আজিজুল ভাইয়ের সঙ্গে ঘর করবে আরিফা। হইল না।

বাপে আর শ্বশুড়ে বইসা যুক্তি কইরা কী একটা ঘাড়ে চাপাইয়া দিল। শূন্য বাড়িতে দীর্ঘশ্বাস পড়ে আরিফার। ভিতরে একটি মানুষ বাড়তে থাকে। কয় মাস হইল? কে রাখে হিসাব? মনিরুলদের পুরনো ইঁটের উঠান-ঘেরা একতলা দালান-বাড়ি: ‘মদিনা মহল’। মনিরুলের দাদা ছিল জোরদার।

তাঁর স্ত্রীর নাম ছিল মদিনা । এই বড় দালানটা অবশ্য তার আমলের নয়। আগে নাকি লম্বা আটচালা ছিল ঘর। - হাসেম হাজীর দিয়াশেলাইয়ের ফ্যাক্টরি ছিল লাকড়ি পাড়ায়- পাকিস্তানি সৈন্যরা পুড়িয়ে দিয়েছিল-যাক ... মদিনা মহলের উঠানে বৃষ্টিবাদলের দিন প্যাঁক কাদায় ভরা থাকে। সদর থেকে বারান্দা পর্যন্ত ইট বসানো।

হাঁস-মুরগীর দঙ্গল উঠানে: সারক্ষণ প্যাঁক প্যাঁক কক কক কক কক করে। একটা বাদামী রঙের নেড়ি কুকুরও আছে। দালানের পিছনে একটা পুকুর। পুকুরের ওপারে ঘন বাঁশের ঝাড়। মেঘলা দিনে অন্ধকার হয়ে থাকে।

শন শন হাওয়া-বাতাস বয়। তখন ভারি কষ্ট হয় আরিফার। বাপের অসুখ। দেখতে যে যাবে তার উপায় নেই। আরিফা বেহুলার মতন কান্দে।

স্বামী উদাসী। উদাসী মানুষ মরা ... এ বাড়ির রান্নাবান্না করে সেতুর মা। মাঝবয়েসী, বেঁটে, কালো, থলথলে। কথা বলে কম। সেতুর মায়ের সঙ্গে কথা বলে মনের ভার নামানো যায় না।

মর্জিনার আরও ফাপড় লাগে। কাঁদে। মোল্লা পাড়ার টুনটুনি জড়ায় ধরে বলে-কাইন্দো না বু। মেয়েটা মাঝেমাঝে আসে। বিয়ার বয়স হইছে টুনটুনির।

স্বামী নিয়া স্বপ্ন দেখে, খালি বিয়ার কথা, উদাসী মানুষ বুঝে না। ওর লগে কথা হবে কী! এ বাড়ির বাজার-সদাই করে যে লোকটা- তার নাম সোলায়মান, লোকটা বুড়া, তার ওপর কানে খাটো। আদা আনতে বললে জিরা আনে। তবে প্রায় প্রতি রাতেই সেতুর মায়ের ঘরে যায় সালায়মান । আরিফার কেমন যেন সন্দেহ হয়।

শ্বশুড়ও কি সেতুর মায়ের ঘরে যাইত? মনিরুল? তখন সোলায়মান কোথায় যাইত? শ্বশুড় বাঁইচা থাকতে? ইষ্টিশনের পাশের চিপা গলিতে পাড়া আছে আরিফা জানে। সেখানে? আরিফার শরীর ঘিনঘিন করে ওঠে। আল¬ারে আমি কোথায় আইসা পড়লাম? আরিফা বিধবার মতন কান্দে। ... ‘স’ মিলের ম্যানেজার রঞ্জন এসে মাস শেষে টাকা দিয়ে যায়। তখন বুকের দিকে তাকায় লোকটা ।

আরিফার শরীর ঝিম ঝিম করে ওঠে। রঞ্জনের হাত থেকে যন্ত্রের মত টাকা নেওয়ার সময় তলপেটের কাছে শিরশির করে আরিফার । রঞ্জনের ফরসা রঙের নিরীহ মুখ। অথচ আরিফা জানে লোকটার নাভীর কাছে লকলক করছে লোভ। “বৌদি, জল খামু।

” পানি এনে দেয় আরিফা। রঞ্জনের লোভী চোখ আরিফা ভরাট বুকের ওপর ঘোরে-আঁচলটাও খানিক না সরিয়ে পারে না আরিফা। আপনি একটা বিয়া করেন রঞ্জন ভাই। আরিফা চাপা স্বরে বলে। আপনি আমার লগে যাইবেন বউদি? কথাট একদিন রঞ্জন বলেই ফেলেছিল।

আরিফার শরীরে বৃষ্টিবাদলার দিনের মদিনা মহলের উঠানের ময়লা পানি ঢুকে গেছিল। আর, হাঁসের গায়ের নোনা গন্ধ পাচ্ছিল ... আপনি চইলা যান। চইলা যান কইলাম। আরিফা ফিসফিস করে বলে। চিৎকার করতে পারে না।

রান্নাঘরে সেতুর মা বসে মসলা বাটতাছে। রঞ্জন পানি না খেয়েই চলে যায়। মনিরুলকে সে ভীষণ ভয় খায়। মনিরুল তার পায়ের তলার মাটি। ... সেই মনিরুল অনেক রাতে বাড়ি ফিরে এসে ঘুমায়া পড়ে ।

কোনও কোনও দিন খায়ও না। এত কম খায় মানুষটা। আল্লা কি দিয়া তারে বানাইছে। বউরে আদরসোহাগ করতে মনে থাকে না। ...অথচ, রঞ্জন? উত্তরপাড়ার আজিজুল ভাই? আজিজুল ভাই সারাক্ষন ঘুরঘুর ঘুরঘুর করত ... সম্পর্কে খালাতো ভাই ... ঘন ঘন বাড়ি আসত।

আমিনার জন্মের পর থেকে মায়ে অসুস্থ-বিছনায় পড়া। । বাবায় ইসকুলে। আমিনা কিছু বুঝত না। আজিজুল ভাই জড়ায়া ধরত, চুমা খাইত; বুক দইটা ডলত ... আরও কত কী করত।

আর এই লোকটা? দিন কয়েক হলো আরিফার কেমন সন্দেহ হয়-মানুষটা অন্য কোথাও বিয়া বসে নাই তো? কয়েক দিন পর। সকালবেলা মনিরুল বাইরে যাবে-আরিফা তাকে আটকালো। আপনি কই যান, কি করেন বইলা যান। কন্ঠস্বরে মৃদু অনুযোগ। মনিরুল বলবে কেন? সে পুরুষ মানুষ।

মোল্লা পাড়ায় বেতাব গাজির বাড়িতে নাকি এক কামেল পীর আসছেন। তারে একবার নজর করতে হয়। রোদটা চড় চড় করে বাড়তেছিল। কামেল পীর আবার কখন চলে যায়। আরিফা দুইহাত তুলে পথ আগলে রেখেছিল।

পথ ছাড় ...। মনিরুলের স্বরটা শীতল। না। পথ ছাড়! এবার ক্রদ্ধ স্বরে গর্জন। না।

আমারে বলেন আপনি কই যান কি করেন। বিয়ের পর এই প্রথম মনিরুল আরিফাকে থাপ্পড় কষল। তারপর হনহন করে বেরিয়ে গেল। সন্ধ্যের মুখে মনিরুলকে স্টেশনের সামনে দেখতে পেয়ে ছুটে যায় সোলায়মান । তারপর হাঁপাতে হাঁপাতে কী বলতে কী বলল বুড়া ।

মনিরুল কামেল পীরের মজবা দেখে দুপুর থেকেই সামান্য টাল হয়ে ছিল। বুড়োকে হাত নেড়ে তাড়িয়ে দিল। তারপর ইষ্টিশনে গিয়ে বসে থাকল। মাঝরাতের কিছু আগে বাড়ির পথ ধরল সে। বাড়িটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে।

আরিফাকে দেখতে পায় না। গেল কই? অন্য সময় যতই রাত করে ফিরুক- কাছে এসে দাঁড়ায়, ভাত খেতে বলে। আজ বলল না। সকালে থাপ্পড় মারছি বইলা রাগ করছে। কিন্তু, গেল কই সে? ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে সে।

পরদিন সকালে দেরি করেই ঘুম ভাঙ্গল মনিরুলের। ঘরে রোদ ঝলমল করছিল। আরিফাকে না দেখে ভীষন চিন্তিত হয়ে পড়ল । সেতুর মা এসে বলল, কালো পাঞ্জাবি পইরা একঝন ফকিরব্যাটায় আসছিল। আমি আইটা থালাবাডি লয়া ঘাটলায় গেছিলাম।

পুকুর ঘাটলা থেইকা ফির‌্যা দেখি কেউই নাই। সেতুর মায়ের কথা শুনে বুকটা ভীষন ধকধক করতে থাকে মনিরুলের। কালো পাঞ্জাবী পরা ফফির ... ভীষন অবাক হয়ে যায় মনিরুল। অনেক অনেক দিন আগে কালো পাঞ্জাবী পরা এক ফকির এসেছিল মনিরুলের বাড়িতে। নয়নপুরের আলেম ফকির।

মনিরুলের তখন চৌদ্দপনেরো বছর বয়স ... কিন্তু, তা কী করে সম্ভব! পায়ে স্যান্ডেল গলিয়ে হন হন করে হেঁটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় । মদিনা মহলের বাইরে রোদে রোদে ভরে আছে। কলাঝোপে রোদ। কাটা গুঁড়ির ওপর রোদ। সে ধীরে ধীরে উঠান পেরিয়ে পিচ রাস্তার সামনে চলে আসে।

পিচরাস্তায় একটা ট্রাক চলে যায়। ধীরে ধীরে স্টেশনের দিকে যেতে থাকে সে। ইস, কেন যে আরিফারে থাপ্পড় মারলাম! দিন কয়েক আগে আরিফার মুখে শ্বশুরের অসুখের কথা শুনেছিল মনিরুল। রাগ কইরা বাপের বাড়ি চইলা যায় নাই তো? বারোটার লোকালে উঠল সে। সোওয়া একটায় উত্তরপাড়ায় নামল।

তারে দেখে ছোট শালী আমিনা কী খুশি? শ্বশুড়ও। আমার মা রে আনলা না যে? তাইলে আরিফায় এইখানে আসে নাই? গেল কই সে? বিস্ময় সামলে নিয়ে মনিরুল তার শ্বশুড়কে বলল, আমি এই দিকে অন্য কাজে আরছিলাম আব্বা। আচ্ছা। সন্ধ্যার মুখে রুপহাটি ষ্টেশনে এসে নামল মনিরুল। বাড়ি আর ফিরল না।

স্টেশনেই একটা বেঞ্চির ওপর বসে থাকল। বাড়ি ফিরে কী লাভ? তখন থেকেই খালি মনে হচ্ছিল-ষ্টেশনের এই বেঞ্চে বইসা বইসা আমি কত কী দেখি। রেললাইনের ওইপারে খাম্বা। ইলেকট্রিকের লাইন। খাল।

পিচরাস্তা। জিকা গাছ ... খালি আরিফারে দেখলাম না। হায়, ও চইলা গেল! পোয়াতি হইছিল। ইস, ক্যান যে থাপ্পড় মারলাম! আমি মুছাফির মানুষ। আমার কী হইছিল? দেশান্তরী হল মনিরুল ।

অনেক অনেক দিন আগে আলেম ফকিরের দ্যাশ ছিল ভাটি অঞ্চলে। ঘর সংসার ছিল তার, ঘর ভর্তি পুলাপান আর জুয়ান একটা বউও ছিল; তয়, একরাত্রের খোয়াবে খিজির নবী নাখোশ হয়ে আলেমকে কী বললেন - পর দিনই গায়েব হয়ে যায় সে। তবে সেসব অনেক দিনের পুরনো কথা ... আলেম ফকিরের আস্তানা এখন বিলহাটার পশ্চিমে নয়নপুর ইষ্টিশনের দক্ষিণে। নয়নপুর ইষ্টিশন থেকে আড়াই ক্রোশ পথ পার হয়ে পুরনো একটা মসজিদ লাগোয়া দালানে। নয়নপুরের লোকেরা বলে: আলীজান পীরের মসজিদ।

মসজিদের সামনে একটি অনতিবৃহৎ দীঘি - গজার মাছে ভরতি সেই দীঘিতে কালো টলটলে পানি-কী কারণে কচুরিপানা নেই, আইষ্টা গন্ধও নাই । কালচে পুরনো ইঁটের আটখানা ঘাটলা আছে; পশ্চিম দিকের ঘাটলায় একটা কৎবেল গাছ ... তারপরে বেশুমার গাছপালার মইধ্যে কালা ইঁটের পুরনো দরদালানের ভগ্ন¯ত’প । দালানকোঠার পিছনে আবার ঘন বাঁশের জঙ্গল। সেখানে ঘন ছায়ার মধ্যে সার সার পুরানা পাকা কবর। নয়নপুরের লোকের বিশ্বাস: ঐ ঘন ছায়ায় আলীজান পীরের কবরও আছে।

দরদালানে অন্ধকার অন্ধকার কোঠা, ইঁটের মেঝে, ফাটল ধরা। কোঠাগুলায় আগে কবুতরে বিষ্টা, ছাগলের লাদি, সাপের খোলাশ আর স্থানীয় ডাকাতদলের ফেলে যাওয়া জঞ্জালে ভর্তি ছিল - আলেম ফকিররের দোওয়ায় নাকি মুরিদানের মকসুদ পূর্ন হয়-কাজেই মুরিদরাই সাফসুতরো করে দিয়েছে কোঠাগুলি। আস্তানাটি লোকালয় থেকে অনেকটা দূরে শুনশান এলাকায় হলেও দু-বেলা ভিড় কমবেশি লেগেই থাকে। সে যা হোক। সফরকালে ফকিরের নেয়ামত বাড়ে।

আলেম ফকিরও বৎসরে একবার সফরে যাত্রা করেন: এইবারে যেমন সে রুপহাটির দিকে গেল। অনেক বছর ঈশ্বরদির পানে যাওয়া হয় না। রুপহাটির হাসেম হাজী আলেম ফকিরের বিশেষ পরিচিত ছেলেন; পরিচিত মানে-দশবারো বছর আগে একবার হাসেম হাজীর ‘মদিনা মহলে’ গেছিল আলেম ফকির। তখন হাজী সাহেব বাড়ির পিছনের পুকুরে জাল ফেলার নির্দেশ দিয়ে আর আতপ চালের ফিরনি পাকিয়ে বেশুমার খাতিরযত্ন করছিলেন। আফসুস- হাজী সাহেব আর জিনদা নাই।

তবে যারা জিন্দা আছে তারা খুব খাতিরযত্ন করল। ছুট মিঞার ফুটফুটে বউ- ছুট মিঞা বাইত ছেল না। হাজীবাড়ির খাদেম বুড়া সোলায়মান বলল: বছর দেড়েক হইল ইন্তেকাল ফরমাইছেন হাসেম হাজী । শুনে আলেম ফকিরের দিলটা চইত মাসের মাঠের মতন ফাইটা গেল। আহা,হাজী ছাহেব বড় ভালো লোক ছিল।

মদিনা মহলের পিছনে পুকুর-তারপর বাঁশঝাড়। বাঁশঝারের মইধ্যে হাজী বাড়ির গোরস্তান। সোলায়মান বুড়ায় পথ চিনায়ে নিয়া গেল- হাজী ছাহেবের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে ঝরঝর ঝরঝর করে কাঁদতে কাঁদতে কবর জিয়ারত করল আলেম ফকির। তারপর পর জোহরের নামাজ আদায় করে খেতে বসল। বারান্দায় বসে পালং শাক ডলে ভাত খেতে খেতে ছোট মিঞার বৌটির মলিন মুখখানা দেখে যা বোঝার বুঝেছিল আলেম ফকির।

বউটি কেমন মনমরা হইয়া ছিল। সংসার করিয়া সুখি না হইলে সংসারে থাকিয়া কী লাভ? উপরোন্ত, অন্য পথের হদিশ জানে আলেম ফকির। সবই আল¬ার ইচ্ছে। কী এক ঘোরে ছোট মিঞার বউরে সে নিয়া যাবে বলে ঠিক করে ফেলে। এখন আম্মাজানের অনুমতি প্রয়োজন।

পূর্ণিমার মতন বদনখানাও কেমন থমথম করছিল সেদিন । কাঁসার গেলাসে দুধ আনার সময় আলেম ফকির আলগোছে প্রস্তাব দিল ...না, আরিফায় চমকায় নাই ...অনেক দিন ধরেই পালিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছিল ...কালো পাঞ্জাবি পরা ফকিরের কথায় (আমার লগে তুমি যাইবা মা?) কালো পাঞ্জাবি পরা ফকিরের কথায় কী ঘোর লাগল - যামু বাবা-বলেই ফেলল। না, ফকিরের হাত ধরে পথে নামতে বুক কাঁপেনি আরিফার। আত্মহত্যার চেয়ে ভালো। ভিতরের মানুষটা পাঁচ মাস ধরে না-বাড়লে আত্মহত্যাই করত আরিফা।

কেমন স্বামী আমার-শরীরে হাত তুলে! পিছনের পুকুরের ঘাটলায় আইটা থালাবাটি নিয়ে গেছিল সেতুর মা । সোলায়মান বুড়ায় থাকা না-থাকা সমান; তারপর, কালো বোরখাটা পরে আলেম ফকিরের সঙ্গে পথে নেমে কত ঘটনা ... ট্রেনে টিকিট লাগে না, হোটেলে খাইলে বিল লাগে না ... রিকশায় উঠলে ভাড়া লাগে না। আরিফাকে নয়নপুরের আস্তানায় নিয়ে এসে মুরিদদের ডেকে ‘বেটি’ বলে পরিচয় দিল আলেম ফকির। মুরিদদের মুখচোখে সমীহের ভাব ফুটে উঠেছিল। আরিফার নতুন নাম দিল আলেম ফকির: আলেয়া।

...তারপর থেকে নয়নপুরের আস্তানায় দিন কাটছে আলেয়ার। আলেম ফকিরের শিষ্যরা আলেয়াকে বিশেষভক্তি শ্রদ্ধা করে । তাতে আলেয়ার মনের কষ্ট কমে যেতে থাকে। তার মন ঠান্ডা হতে থাকে। আর, এই জায়গাটিও কেমন ঠান্ডা ঠান্ডা।

আলেয়া আর কোনওদিনই রুপহাটি ফিরবে না। স্বামী এমন উদাসী এমন পাষন্ড ...উত্তরপাড়ায় বাপের বাড়িও যাবে না কোনওদিন ...তারা জেনেশুনে পাগলের সঙ্গে বিয়া দিল ... আলেম ফকিরকে সব খুলে বলে আলেয়া । আলেম ফকির বলে, থাউক মা। কান্দিস না। আল্লার মর্জিতে আগের দিন সব কবর হইয়া গেছে।

কথাটা আলেয়া বোঝেনি। তবে বুকের অশান্তি কাটাতে নামাজ ধরল আলেয়া। আলেম ফফিরের ইচ্ছা আলেয়া নামাজ পড়ুক- তবে জোরজবরদস্তি করে না আলেম ফফির; সে আলীপন্থি মারাফতী তরিকার ... আস্তানায় মাঝে মাঝে বয়াতি-গায়েনরা আসে। আব্বাস গায়েন গায়-আমার বাবা আলহাজ আলী/ যার কাছে মারফতের কলি/ কলব হইয়া যায় নূরানী চাইলে এক নজর... তারপর এক সময় আলেয়া টের পেয়ে যায় আস্তানায় জ্বীন আছে। এবং জ্বীনের নাম ইসমাইল।

বড় উদার এই ইসমাইল। কত কী যে এনে খাওয়ায়। হালুয়া-রুটি; সেমাই-পায়েস-ফিরনী। সাদা কাচের গেলাসে নীল সরবত...। একবার মরকত পাথর এনে দিল ইসমাইল।

মরকত পাথর বসানো রুপার আঙটি পরে মানুষটা ... আলেয়ার বুক হা হা করে ওঠে। কান্দে ... মর্জিনা জ্বীন দেখলেও কখনও মৃত মানুষকে জীবিত দেখে নাই। এক সন্ধ্যায় তাও দেখল। আলেম ফকির আস্তানায় ছিল না। নাজির হাটের আটি বুড়ি আলেম ফকিরের বয়স্কা মুরিদানী।

সেই আটি বুড়ির নাকি জ্বর, তাকে দেখতে গেছিল। মাগরিবের নামাজের আগে উঠানে শুকনা কাপড় তুলছিল আরিফা। হঠাৎই চোখ গেল পিছনের অন্ধকার অন্ধকার ঘন বাঁশের জঙ্গলের দিকে-যেখানে সার সার কবর.. সে দিক থেকেই কে যেন এদিকে আসতেছিল -বুড়া মতন। একটু পর উঠানে উঠে এল কালো জোব্বা পরা এক বৃদ্ধ। বৃদ্ধের মাথায় কালো পাগড়ি।

গায়ের রং ধবধবের রং ধবধবে সাদা, মুখে পাকা দাড়ি। ভুরুও পাকা। কী রকম নীল নীল চোখ। বৃদ্ধ কাছে আসতেই ্র আতরের তীব গন্ধ পায় আরিফা। খসখসে কন্ঠে কী যেন বললেন বৃদ্ধ ।

ভাষাটা বোঝা গেল না। আরবী? আরিফা যা বোঝার বুঝে গিয়েছিল। আরিফার শরীর ভিজে যায়, শীত করে, হাত থেকে কখন কাপড়গুলি খসে পড়ে ... আরিফা এলিয়ে পড়ে। তারপর কখন যে চেতন ফিরল। পরে সব শুনে আলেম ফকিরের কী হাসি।

তারপর হাসি থামিয়ে দরদ ভরা কন্ঠে বলল, তোর কাছে আলীজান পীরে আইছিল মা- অজুর পানি চাইতে। সবার কাছে চায় না। এই অধম নালায়েকের কাছে একবার চাইছিল। যখন প্রথম প্রথম এই আস্তানায় আইলাম। আলেম ফকিরের কথাটা আরিফা বোঝেনি।

তার নয় মাস চলছিল। এসব ব্যাপারে নাজির হাটের আটি বুড়ির বিদ্যা দশ গেরামের লোকে জানে। তারপর এক সন্ধ্যাবেলায় আরিফার তলপেটে বেদনা উঠলে আটিবুড়ি আরিফাকে চাটাইয়ের ওপর শোয়ায়; তারপর হারিকেনের আলোয় পেটিকোট সরিয়ে আরিফার তলপেটের নিচে রোমশ জন্মনালীর ওপর ঝুঁকে পড়ে বুড়ি ... দেশান্তরী হয়ে এখানে সেখানে ঘুরছে মনিরুল । পথে পথে আরিফাকে খোঁজে সে। খুঁজলেই কী ...।

বুকের ভিতরে চইত মাসের গরম বাতাস খল খল খল খল করে। কোথাও শান্তি পায় না। মাজারে মাজারে ঘুরে সে ... খালি সেতুর মায়ের কথা মনে পড়ে: কালো পাঞ্জাবি পরা ফকিরব্যাটায় আসছিল। বহুদিন আগে দেখা আলেম ফকিরও কালো পাঞ্জাবি পরত। নয়নপুরের আলেম ফকির।

নয়নপুর কোথায়? এই দেশে নয়নপুরের অভাব নাই। বুকের ভিতরে অশান্তি বাড়ে তার। একদিন আলাউদ্দীন বয়াতির সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর মনিরুলের মনের অশান্তি কিছু কমে। চিত্রা নদী পার হয়ে রাস্তার বাঁ পাশে একটা কড়ুই গাছের নিচে চায়ের দোকানের সামনে বেঞ্চিতে বসে ছিল সে। এই দেশের লোকেরা সাধারনত আলাপীই হয়।

যারা গানবাজনা করে তারা আরও বেশি। আলাউদ্দীন বয়াতি সেরকমই লোক। চা খাওয়াল মনিরুলকে। চা খেতে খেতে আলাপ জমে উঠলে আলাউদ্দীন বলল -লন, আমাগো বাইত যাই। মনিরুল তখনও আলাউদ্দীন বয়াতির উদ্দেশ্য টের পাই নাই।

টের পেয়েছিল অনেক পরে। মনিরুল আলাউদ্দীনের বাড়ি যেতে রাজী হয়-সে ঘোরের মধ্যে আছে। আলাউদ্দীনও এক ঘোর লাগা মানুষ। ভালো দোতরা বাজায়, গান বাধে-গানের দলও আছে। বাড়ি যেতে যেতে কত কথা বলল আলাউদ্দীন- ঘরে বাজা বউ ।

পোলাপান হয় নাই। বউরে জানপ্রাণ দিয়া ভালোবাসে আলাউদ্দীন। “দয়াল আমারে কত কিছু দিল; খালি সন্তান দিতে বনচনা করল দয়াল। ” আলাউদ্দীনের দুঃখ এইখানে। গভীর দুঃখ।

লাউমাচা আর ছোট্ট উঠান ঘেরা চকচকে টিনের বাড়ি আলাউদ্দীনের । নাড়িকেল গাছে ঘেরা হাঁস আর কচুরিপানায় ভর্তি পুকুরও আছে । উঠানের এক পাশে খড়ের গাদা, গোয়াল ঘর। বউকেও আড়ালে রাখল না আলাউদ্দীন। নতুন দোস্তের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল।

মর্জিনার বয়স ত্রিশ-পয়ত্রিশের মতন হবে। আটোসাঁটো শরীরের বাঁধন মর্জিনার; শ্যামলা মতন সুন্দর চেহারা-তবে আরিফার মতো না। স্বামীর সামনেই কেমন করে যে মনিরুলের দিকে তাকাল। মনিরুল অস্বস্তি বোধ করে। রাতে খাওয়াদাওয়ার পর উঠানে মাদুর পেতে বসেছিল ওরা।

উঠানটা ভাদ্রের জ্যোৎস্নায় ভরে ছিল । সেই সঙ্গে উথালপাথাল হাওয়া; বাতাসে লাউমাচা কাঁপে। কাঁপে নারকেল পাতারা। পুকুরের দিক থেকে কচুরিপানার গন্ধ ভেসে আসে। সব স্বপ্নদৃশ্যের মতো মনে হয় মনিরুলের।

হায়, এখন আরিফা কোথায়? এবং, আলাউদ্দীন গানও গায়- আমার প্রানের মন্দিরায়/কেড়ে নিল সাত জন চোরায়। ...গান শুনে কী রকম যেন লাগে মনিরুলের। অনেক অনেক দিন আগে রুপহাটির ইষ্টিশনে এই গানটা শুনেছিল মনিরুল। আলাউদ্দীন আরও গায়-আমার বুকের ভিতর কঠিন তেপান্তর/ তোমার বন্ধু পাষাণী অন্তর ... গান শুনে কেমন যেন লাগে মনিরুলের। কত কত মনে পড়ে তার।

অনেক রাতে মনিরুলকে কাচারি ঘরে নিয়ে এসে মশারি টাঙ্গিয়ে দিয়ে চলে যায় আলাউদ্দীন । মনিরুলের ঘুম আসে না। আরও রাতে কাচারি ঘরের দরজা খুলে যায়। মর্জিনা অন্ধকারে হারিক্যান জ্বালায়, বিছানার কাছে আসে, মশারি সরায়; তারপর ঝুঁকে মনিরুলের ঠোঁটে চুমু খায় ...মনিরুল জেগেই ছিল ... অনেকদিন পর জেগে ওঠা পুরুষঙ্গ স্পর্শ করে মর্জিনা। তারপরে মর্জিনার ভিতরে প্রবেশ করতে করতে সে সহসা বুঝতে পারে পথ থেকে কেন তাকে আলাউদ্দীনে তুলে এনেছে।

আলাউদ্দীনের বাড়িতে দিন পনেরো কাটল। সুখে-সঙ্গমে; গানে-গানে। মনিরুল মাছ খেতে ভালোবাসে। কত রকম যে মাছ খাওয়াল আলাউদ্দীন। কত রকম করে সে মাছ যে রাঁধল মর্জিনা।

আশ্চর্য! রুপহাটি থাকতে খিদে পেত না। এখন এত খিদে কোত্থেকে পায়? বিদায় নেওয়ার সময় মর্জিনার চোখে পানি। ভরাট শ্যামলা মুখটা অবশ্য ঝলমল করছিল। ঝলমলে মুখে চোখের জল- ওরকম মুখ সারাজীবনে আর দেখবে না মনিরুল। মনিরুল জানে সে তার বীজ মর্জিনার গর্ভে রেখে গেল।

একদিন সেই বীজটি আলোর মুখ দেখবে। এই রোদে বাতাসে খেলে বেড়াবে। আলাউদ্দীনের কাছে দোতরা শিখবে। মেয়ে হলে? মর্জিনার কাছে রান্না ...পথে নেমে আরিফাকে আর খোঁজে না সে। বরং সে রুপহাটির পথ ধরে।

বাড়ির পিছনে বাঁশঝাড়ে তার বাপদাদার কবর-সে ওখানেই মরবে। এই জনমে তার কাজ শেষ। তার জন্যই মর্জিনাকে অপেক্ষায় রেখেছিল দয়াল। এখন মরণের জন্য অপেক্ষা। অন্য জনমের কথা কেউই জানে না।

দয়াল তোমারও লাগিয়া যোগীনি সাজিব গো। ট্রেনে এক অন্ধ ফকির গায়। রুপহাটি স্টেশনে নেমেই প্রথমে সে ‘হাসেম স’ মিলের দিকে যেতে থাকে। রঞ্জন ওকে দেখে চমকে না উঠলেও ভুরু কোঁচকালো। কিছুই আর আগের মতো নাই।

রঞ্জন বিয়া করছে। এবং তারেই “স” মিলের মালিক মনে হইল। ‘স’ মিলের পাশে হাসেম হাজীর জমির ওপর ধান ভাঙ্গার কলও একখান বসাইছে। মনিরুলকে দেখে বিশেষ পাত্তা দিল না রঞ্জন। মনিরুল কাঁধ ঝাঁকায়।

মুচকি হাসে। আমার তো কাম শেষ। আমি এখন ইজারাদারির কি বুঝি? বাড়ির দিকে যায় সে। মদিনা মহল খাঁ খাঁ করতেছিল। শূন্য বাড়িটা পুরনো ইটগুলি ভাঙ্গা পাঁজর নিয়ে ভুতের মতন দাঁড়িয়ে ছিল।

ও কাঁধ ঝাঁকায়। মুচকি হাসে। গান গায়। কী ঘর বানাইমু আমি ...কী ঘর বানাইমু আমি ... শূন্যেরও মাঝার ...(গানটা আলাউদ্দীনের মুখে শুনেছিল) নাঃ বাড়িতে সেতুর মা বা সোলায়মান কেউই নাই। মদিনা মহল খাঁ খাঁ করে।

এক বুড়িকে দেখল। ভিতরের একটা ঘরে কাঁথা মুড়িয়ে দিয়ে শুয়ে আছে। কে এই বুড়ি? আর সাত আটটা বিড়াল দেখল। ঘুরঘুর করছে। আগে এই বাড়িতে এতগুলা বিড়াল ছিল না।

কুকুর ছিল। নেড়ি কুকুরটা গেল কই। মানুষ বাপদাদার ভিটামাটি থেকে উচ্ছেদ হইয়া গেলে তখন বাস্তু কুকুরের কী হয়? বাড়িতে সেতুর মা বা সোলায়মান কাউকেই পেল না সে । গেল কই তারা? মইরা গেছে? ও মুচকি হাসে। ও স্টেশনে ফিরে আসে।

প্ল্যাটফর্মের ওপর বেঞ্চিতে বসে থাকে। এভাবে আরও কয়েকটা বছর কাটল। আজও প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চিতে বসে থাকে মনিরুল। তখন কত কী যে দেখে সে । আগে যেমন দেখত।

ফকির-যাত্রী-ফেরিওয়ালা ওভার বিরিজ ... ওইপারের রেললাইন খাম্বা। ইলেকট্রিক লাইন। দোয়েল পাখি খাল পিচরাস্তা জিকা গাছ ছাগল-চরা মাঠ আবাদি জমাজমি নদী পাড় বটের ঝুড়ি আকাশ ...কখনও কখনও রঞ্জন এসে মনিরুলের পাশে বসে থাকে। পুরান দিনের কথা বলে। সেও এখন এক ভোগসুখে ক্লান্ত মানুষ।

একদিন দুপুর; স্টেশনের বেঞ্চিতে বসে ছিল মনিরুল। কেমন ঝিমুনি পেয়েছিল তার। আচমকা হুইসেলের শব্দে জেগে উঠে সে। একটা লোকাল এসে থেমেছে। দৃষ্টি স্বচ্ছ হলে যাত্রীর ভিড়ে আরিফাকে দেখল সে।

মনিরুলের বুকের ভিতরে তেমন অনুভূতি হলো না। হয়তো বহুবছর কেটে গেছে বলে। হয়তো তার বীজ অন্য কোথাও ফুল হয়ে ফুটে আলো দেখছে বলে। আরিফার কোলে একটি শিশু। কার? আলেয়া ওকে দেখে থমকে দাঁড়াল।

তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে থাকে ...

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.