আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প: ও যখন মৃত্যুকে ছোঁবে ...

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ

তখন খুব সিগারেট খেত রঞ্জু । দিনে এই দু-চার প্যাকেট। সিগারেট কেনার পয়সা যোগায় ভূতে; রঞ্জুর বেলাতেও তাই।

তাছাড়া ইন্টারটা শেষ করেই ও একটা টিউশ্যনি করত। উকিলপাড়ায় সন্দীপের ছোট বোন সন্ধ্যাকে পড়াত রঞ্জু। মাস গেলে মাসিমা ওর হাতে যা গুঁজে দিতেন, তাতেই জুটে যেত গোল্ড লিফ কেনার পয়সা। সেই সন্ধ্যার ইচ্ছেতেই সিগারেট ছেড়েছিল রঞ্জু। সন্ধ্যা আবার ছিল রঞ্জুর মেজ বোন মাধুরীর বান্ধবী।

মাঝেমাঝে বাড়িতে আসত, তখন কথাবার্তা হত। সন্ধ্যা কী ভাবে যেন তখন জেনে গিয়েছিল ধনে পাতা দিয়ে পাবদা মাছ রঞ্জুর বড় প্রিয়। তাই একদিন বাড়ি থেকে রেঁধে এনেছিল । সন্ধ্যার সঙ্গে আড়ালে কথা বলার ছুঁতো খুঁজত রঞ্জু। মাধুরীর জন্য পারত না, কেননা, সন্ধ্যা ছিল ফুটফুটে; ফরসা; মাধুরী ওকে চোখে চোখে রাখত।

পড়ানোর সময় চোখে চোখে রাখতেন সরমা মাসিমা। অসহ্য লাগত রঞ্জুর । অথচ, তখন ছিল সুরম্য দিন আর সুরম্য রাত । রবীন্দ্রসংগীতময়। বৃষ্টির দিনে জানালার ফাঁক গলে মেঘনা আর ধলেশ্বরী নদী থেকে ভিজে হাওয়া আসত।

ঘরে বসে চোখ বুজে থেকে আমোদ বোধ করত রঞ্জু; কিংবা ভোর-ভোর সময়ে মেঘনা নদীটি পেরিয়ে গজারিয়ায় চলে যেত বন্ধু তপনের বাড়ি। দিনভর সাহাবাড়িতে চলত হুল্লোড়। রানী বউদির হাতে রান্না অমৃতের মতো লাগত। সন্ধ্যার মুখে খালপাড়ের ডুমুর গাছের নিচে বসে কিঞ্চিৎ তরল আগুন সেবন। তারপর রাত করে নদী পেরিয়ে বাড়ি ফেরা।

হয়তো তখন নদীর বুকে ও চরাচরে ধবধবে জ্যোস্না ফুটে আছে। তখন শরীর কী অসম্ভব হালকা-হালকা লাগত। মনে হয় নদীর ওপর দিয়ে একটা সাদা সারস পাখির মতন উড়ে যাচ্ছে সে ... তো, দুম করে একদিন বিয়ে ঠিক হয়ে গেল সন্ধ্যার। সন্দীপের মুখে সেই দুঃসংবাদ শোনার পর গভীর এক শোকে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল রঞ্জু। ভিতরে ভিতরে ভীষন ফুঁসছিল ও।

তা হলে কেন ধনেপাতা দিয়ে পাবদা মাছ রেঁধে এনেছিল ও? এই প্রশ্নের উত্তরটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। নিদারুন শোকের ভিতরে আবার সিগারেট ধরল সে। সমস্ত শুভবোধ নষ্ট করার জন্য নারায়নগঞ্জের টান বাজারে গেল এক সন্ধ্যায় । শিউলীর মুখটি দেখতে অবিকল সন্ধ্যার মতন ছিল বলে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত ছিটকে বেরিয়ে এল সেই চারতলা দালানের শুধুমাত্র আস্তর-করা ঘর থেকে। তখন শীতকাল।

একটার পর একটা সিগারেট ধরিয়ে অনেক রাত অবধি গায়ে শীতের কামড় খেয়ে-খেয়ে নিঝুম আর খড়িকাঠ পোড়ানোর গন্ধে ভরা ধোঁওয়াময় অলিগলি ঘুরে বেড়াল সে শেষ রাত অবধি। তারপর ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফিরে এসেছিল। কিছুই ভালো লাগত না সেই সময়- এমনকী তপনের কাছে গজারিয়ায় যেতেও। তপন। ঠিক সেই সময়টায় মেঘনায় ডুবে মরল ।

গজারিয়ার ওরা পিকনিকের আয়োজন করেছিল। রঞ্জু যেতে চায়নি, ও তখন শোকার্ত পাথর, দিনরাত ঘরে বসে থাকত; বেরুত না, আর খুব সিগারেট খেত। তপনই ওকে জোর করে নিয়ে গিয়ে নৌকায় তুলেছিল। বলেছিল, চল, ভালো লাগবে। ফরিদা থাকবে।

ফরিদা? আরে, মাকসুদের বোন। তুলারামে পড়ে, ইন্টার। এখন চল তো। মধ্য-মাঘের সেই দিনটি ছিল রোদে ভরা। সবাই ছৈয়ের ওপর, পাটাতনের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছিল।

সবাই হাসিখুশিই ছিল, চোখমুখগুলি ঝলমল করছিল। জোরে জোরে গান বাজছিল: কোন্ বা পথে নিতাইগঞ্জে যাই ... নৌকায় কী কারণে ফরিদা বিষন্ন হয়ে ছিল। মেয়েটি বিষন্ন চোখে নদী দেখছিল। আকাশ দেখছিল। ওকে অদ্ভূত সুন্দর দেখাচ্ছিল।

ও কারও দিকে তাকাচ্ছিল না। রঞ্জু হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিল। তারপর নৌকা যখন অকস্মাৎ বাতাসের টানে উলটে গেল-তখন রঞ্জুর সমস্ত শরীরে নিমিষেই মেঘনার অথৈ পানিতে ধুয়ে গিয়েছিল। তবে ও তেমন আতংকগ্রস্থ হয়ে ওঠেনি। ও তপনকে খুঁজছিল।

তপনকে কোথাও দেখা যাচ্ছিল না। খুব কাছ থেকে নদীর গায়ের আঁষটে গন্ধ পাচ্ছিল রঞ্জু । সেই সঙ্গে অজস্র জলের কলকল ধ্বনি ... ও খাবি খাচ্ছিল। এত পানি! যেন মেঘনা-ধলেশ্বরীতে অকালে ঢল নেমেছে। তারপর কীভাবে যেন রঞ্জু পাড়ে উঠতে পারল।

পিছল পা, আর খাড়া, বালি-বালি; আর নির্জন আর তীব্র বাতাসের গোঙানি; কিন্তু তার আগেই শক্ত ছৈয়ের আঘাত ওর মাথার তালুতে লেগেছিল বলেই এখন সে ব্যথা টের পেয়ে কঁকিয়ে উঠল... সেই দূর্ঘটনার পর থেকেই এসব অসহায় ছবি বারবার ফিরে ফিরে আসছিল বলেই ঘন ঘন সিগারেট টানতে থাকে সে। আজকাল খুব কাশি হয় তার, তাতে অল্প রক্তের মিশেল; জ্বরজ্বর ভাব। বিশেষ করে সন্ধ্যারাতের পর থেকে। তপনের মৃত্যুর পর তপন ও সন্ধ্যার ভূত দুটো প্রায়ই একসঙ্গে ওর ওপর হানা দিতে থাকে। প্রিয় শহরটি দিনদিন হয়ে উঠছিল বিষময়।

ভূত দুটির জ্বালায় অতিষ্ট হয়ে শেষমেশ ঢাকা শহরে পালিয়ে চলে এল রঞ্জু। অথচ ও একদিন সন্ধ্যাকে বলেছিল: বৃষ্টির দিনে মেঘনা আর ধলেশ্বরী নদীর বাতাস আমার ভালো লাগে সন্ধ্যা। আমি এ শহর ছেড়ে কোথাও যাব না। এমনকী ঢাকা শহরেও না। প্রথম-প্রথম শহরটার ভিড়ের মধ্যে মিশে রইল গুম হয়ে।

তারপর শোকটোক সামলে পড়াশোনা শেষ করল সে। তারপর চাকরিতে ঢুকে পড়ল এক সময়। রঞ্জুকে যে জায়গাটায় কাজ করতে হয় সেটি একটি সরকারী গুদাম। মতিঝিলে। সরকারী ব্যাঙ্কের ঠিক পিছনের গলিতে।

মনে হয় মাটি খুদে ঘরগুলি তোলা হয়েছে পাকিস্তানি আমলে। অন্ধকার-অন্ধকার ঘর। চারদিকে ধূলিমলিন তাক আর তাক। তাতে রাজ্যের উইয়ে-ধরা পুরনো দিনের নথিপত্র। বিকেল অবধি বসে থেকে সে সব নথি ঘাটতে হয় রঞ্জুকে।

এই অফিসের অন্যদেরও তাই করতে হয়। হাবিবুর রহমান খান মজলিস, উত্তমকুমার সাহা, মোখলেসুর রহমান মানিক ও গীতারানী পুরকায়স্থ বিকেল অবধি বসে থেকে ঘন ঘন চা খেতে খেতে পুরনো নথিপত্র ঘাঁটে। ওপাশের টেবিলের বিকাশকেও তাই করতে হয়। এই ডিপার্টমেন্টে সদ্য জয়েন করেছ সে । ফরসা হাসিখুশি আর আলাপি স্মার্ট যুবক।

বেশ লম্বা। ঘন কোঁকড়া চুল। এরই মধ্যে সবার সঙ্গে বেশ খাতির হয়ে গেছে তার। রঞ্জুর সঙ্গেও। আরে আপনারা মুন্সিগঞ্জের? আগে বলবেন তো।

আমার স্ত্রীও তো ওখানকারই মেয়ে। তাই? বলে ম্লান হেসেছিল রঞ্জু। রঞ্জু জানে বিকাশ সন্ধ্যার বর। নতুন বউয়ের ছবি এনে অফিসের সবাইকে দেখিয়েছিল বিকাশ । সন্ধ্যা সুন্দরী, হয়তো এই কারণেই।

তখন সে ছবি দেখে ভিতরে ভিতরে চমকে উঠলেও ম্লান হেসেছিল রঞ্জু। বিকাশ-এর জানার কথা না যে তার বউয়ের সঙ্গে রঞ্জুর এক সময়ে রিলেশন ছিল। সন্ধ্যার সঙ্গে সর্ম্পকটা অবশ্য তেমন জোর ভিতের ওপর সেভাবে কখনোই দাঁড়ায়ানি, তবে সন্ধ্যার বিয়ের খবর শুনে পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়েছিল রঞ্জু। তার আগেই অবশ্য আভাসে-ইঙ্গিতে বলেছিল সন্ধ্যা- ছেলেদের সিগারেট খাওয়া ওর পছন্দ না। তারপর থেকেই (খুব খারাপ লাগলেও) সিগারেট ছেড়ে দিয়েছিল রঞ্জু।

সেই সময়ে সন্ধ্যা একদিন বলেছিল, আপনি বিদেশে যাওয়ার জন্য ট্রাই করেন না কেন রঞ্জু ভাই? রঞ্জু ম্লান হেসে বলেছিল, এমনি। ও বলতে পারেনি: বৃষ্টির দিনে মেঘনা আর ধলেশ্বরী নদীর বাতাস আমার ভালো লাগে সন্ধ্যা। আমি এ শহর ছেড়ে কোথাও যাব না। এমনকী ঢাকা শহরেও না। সন্ধ্যার মুখচোখে বিদেশ সর্ম্পকে কেমন এক ধরনের মায়াঘোর মিশে ছিল।

ওর কেমন এক বোন দুবাই থাকত। তার কথা খুব বলত সন্ধ্যা। সন্ধ্যার সেই ঘোর মাধুরীতেও সংক্রামিত হয়েছিল। মাধুরী এখন কানাডায়। তপনও সে সময়টায় সাইপ্রাস যাওয়ার খুব জোর চেষ্টা করছিল।

তপনের সঙ্গে ঢাকায় এসে পাসপোর্ট অফিসের দালালদের হাতে নিদারুন হয়রান হতে হয়েছিল রঞ্জুকে ... বিকাশরা থাকে টিপু সুলতান রোডে । ওখানে ওদের ঠাকুর্দার আমলের পৈত্রিক বাড়ি। বিকাশের ঠাকুর্দার ছিল স্বর্নালঙ্কারের ব্যবসায় । বাড়িটি তিনিই নাকি তুলেছিলেন। এসবই রঞ্জুকে বলেছে বিকাশ।

রঞ্জু জানে; বিকাশ একদিন ওকে সেই বাড়িতে নিয়ে যাবে। কিন্তু, রঞ্জু কি যাবে?। যাবে। কারণ, আজকাল তার খুব কাশি হয়, তাতে অল্পস্বল্প রক্তের মিশেল থাকে; সেই সঙ্গে জ্বরজ্বর ভাব; বিশেষ করে সন্ধ্যারাতের পর। সন্ধ্যার একটি শিশু সন্তান হয়েছে ।

সন্ধ্যার মুখটি না-হোক; রঞ্জু ওই শিশুর মুখখানাই না-হয় দেখতে যাবে। বিকাশদের গোপীবাগের হলুদ রঙের দোতলা বাড়ি, পুরনো গেইট, ভিতরে সামান্য বাগান, একটা কালো রঙের নষ্ট ভক্সওয়াগেন গাড়ি, একতলায় চওড়া বারান্দা, তারপর চওড়া সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়? বেল বাজানোর পর দরজা কি সন্ধ্যা খুলে দেবে? না খুলুক। রঞ্জু ড্রইংরুমে বসবে। ড্রইংরুমটি বেশ বড়। তখন সন্ধ্যা বলে টিউব লাইট জ্বলে থাকবে।

দেওয়ালটি হলুদ রঙের, তাতে হরিণের একটি স্টাফ-করা কাটা মাথা ও ঠাকুর শ্রী শ্রী অনুকূল চন্দ্রের একটি পুরনো সাদাকালো ছবি ঝুলে থাকবে। সিলিং-এ সবুজ রং-করা কড়িকাঠ। কালো রঙের সোফাগুলি ঢাউস । ওপাশে একটা ২৯ ইঞ্চি সিঙ্গার টিভি থাকবে। টিভিটা অন্ করা।

তবে সাউন্ড কমানো। টিভির ঠিক ওপরে দেওয়ালের সঙ্গে সাঁটা আইফেল টাওয়ারের বিশাল একটি পোষ্টার । রঞ্জুকে বসিয়ে ভিতরে চলে যাবে বিকাশ । রঞ্জু একা বসার ঘরে বসে থাকবে। টিভির ওপর চোখ রাখবে।

এটিএন বাংলার খবর। ইংরেজি। বেগম খালেদা জিয়াকে কোন্ এক সৌদি প্রিন্সের সঙ্গে কথা বলতে দেখা যাবে। কান পেতে ও ঘরে শিশুর কান্না শোনার চেষ্টা করবে রঞ্জু। অথচ শিশুর কান্নার শব্দ শোনা যাবে না।

মুহূতেই ঘরটায় কেমন আতরের গন্ধ ছড়াবে। মরা বাড়ির মত। মনে হচ্ছে কাকে যেন কবরে শুইয়ে দিয়ে এইমাত্র সবাই ফিরেছে গোরস্থান থেকে। সেদিন সন্ধ্যায় আর জ্বরটর আসবে না রঞ্জুর। তেমন দূর্বলও লাগবে না।

তেমন কাশিও হবে না। খানিক বাদে পোশাক বদলে বিকাশ আবার আসবে। সোফার ওপর বসবে, ওর মুখোমুখি, বসে সিগারেট ধরাবে, তারপর সরকারের সা¤প্রতিক ব্যর্থতার প্রমানগুলি দিতে থাকবে। আশ্চর্য! বিকাশ বাড়িতে সিগারেট খায়! রঞ্জুর সিগারেট খাওয়া পছন্দ করত না সন্ধ্যা। মাধুরীর মুখে শুনেছিল রঞ্জু; সন্ধ্যা ওর হবু বরের জন্য দুটি শর্ত স্থির করেছিল।

এক. সিগারেট খাওয়া চলবে না। দুই. বিদেশ যেতে হবে। ইউরোপ-আমেরিকা না-হোক, মালয়েশিয়ায় হলেও চলবে। রঞ্জু আইফেল টাওয়ারের পোষ্টারের দিকে তাকিয়ে ভাববে: বিকাশ কি কখনও বিদেশ গিয়েছে? একজন অল্পবয়েসী ঝি এসে এক ট্রে চানাচুর আর পিরিচ-ঢাকা দুকাপ চা রেখে যাবে। রঞ্জু তখন ভাববে: সন্ধ্যা কি তাহলে বাড়ি নেই? মুন্সিগঞ্জ গেছে? বাড়িতে বউ নেই বলেই রঞ্জুকে ডেকে এনেছে।

অদ্ভুত লোক তো এই বিকাশ! না। রঞ্জুর অনুমান মিথ্যে প্রমান করে সন্ধ্যা আসবে। সন্ধ্যার ভরাট ফরসা শরীর; তাতেমধুর আলস্য আর গভীর ক্লান্তির ছাপ। দীঘল কালো চুল আর পান পাতার মতন মিষ্টি মুখ; তাতে আয়ত দুটি চোখ। সন্ধ্যা ঘরে ঢুকতেই আতরের গন্ধটা আর পাবে না রঞ্জু।

তার বদলে বেলি ফুলের এক ধরনের তীব্র গন্ধ ভরে উঠবে সারা ঘর। না, রঞ্জুকে দেখে চমকে উঠবে না সন্ধ্যা। ওকে চেনার চেষ্টা করবে না। রঞ্জুও না। চোখমুখে ব্যথার ছাপ ফুটে উঠলেও সন্ধ্যা ঠিকই সামলে নেবে।

ধীরেসুস্থ্যে বসবে, সোফায়, মুখোমুখি, কথা বলবে। আপনারা কি ঢাকাতেই থাকেন? এই ভয়ঙ্কর প্রশ্নটি করবে না সন্ধ্যা। তার চে বরং বলবে- আপনার কথা ওর মুখে অনেক শুনেছি। আপনি নাকি এখনও বিয়ে করেননি! কেন? রঞ্জু ম্লান হাসবে। সন্ধ্যাকে দুঃখ দিতেই ফস করে সিগারেট ধরাবে।

তারপর সন্ধ্যার দুটি চোখের ওপর ওর দুটি শীতল চোখ রাখবে। সন্ধ্যার মুখটি কেমন ফ্যাকাশে হয়ে উঠবে। নার্ভাস ভাবটা কাটাতেই সন্ধ্যা চিৎকার করে ঝিকে ডাকবে। দরজার চৌকাঠে ঝি এলে বলবে, যা, শ্রমণাকে নিয়ে আয় বেলি। ঝি চলে গেলে রঞ্জুর দিকে তাকিয়ে সন্ধ্যা বলবে, শ্রমণা আমার মেয়ে।

বিয়ের পাঁচ বছর পরে হলো। কত পিরফকির করলাম;একবার তো ইন্ডিয়া গেলাম। চেন্নাই। ওহ্। একটু পর টিউব লাইটের আলোয় দেখা যাবে কাথা মুড়নো এক শিশু, ন্যাড়া, ছোট্ট ফরসা মুখ, চোখে কাজল, কপালে কাজলের টিপ।

পিটপিট করে চেয়ে থাকবে রঞ্জুর দিকে। তা হলে এই মুখটি দেখার জন্য আমি সেদিন বেঁচে গিয়েছিলাম? কথাটা ভাবতেই রঞ্জুর সমস্ত শরীরে নিমিষেই কোত্থেকে মেঘনার ঘোলা পানির ছিটে লাগবে। যেমন এক শীতে ওর সমস্ত শরীর মুহূর্তেই মেঘনার ঘোলা পানিতে ধুয়ে গিয়েছিল। সেই সঙ্গে ও অজস্র জলের কলকল ধ্বনি শুনতে পাচ্ছিল। আর খাবি খাচ্ছিল।

এত পানি! তবে ও তেমন আতংকগ্রস্থ হয়ে ওঠেনি। ও তপনকে খুঁজছিল। ওকে কোথাও দেখা যাচ্ছিল না। খুব কাছ থেকে নদীর গায়ের আঁষটে গন্ধ পাচ্ছিল রঞ্জু । তারপর কীভাবে যেন রঞ্জু পাড়ে উঠতে পারল।

পিছল পা, আর খাড়া, বালি-বালি; আর নির্জন আর তীব্র বাতাসের গোঙানি; কিন্তু তার আগেই শক্ত ছৈয়ের আঘাত ওর মাথার তালুতে লেগেছিল বলেই এখন সে ব্যথা টের পেয়ে ককিঁয়ে উঠল... শিশুটিকে নিয়ে ঝি চলে যেতেই সন্ধ্যা বলবে, ভাই কিন্তু আজ রাতে আমাদের সঙ্গে খেয়ে যাবেন। আজ না, আরেক দিন। রঞ্জু কোনওমতে বলতে পারবে। সন্ধ্যা কেমন আদুরে গলায় বলবে, আমি কিন্তু রাঁধব। তাতে কী।

না, না। অন্যদিন। রঞ্জু হাত নেড়ে বলবে। সন্ধ্যা ওর স্বামীর দিকে চেয়ে বলবে, ও আজ পাবদা মাছ এনেছে। ধনে পাতা দিয়ে রাঁধব।

না। রঞ্জু ও বাড়িতে কিছুতেই খাবে না। ও বড় অভিমানী। ও আরও কিছুক্ষন থেকে -এটা-ওটা নিয়ে আলোচনা সেরে- বিদায় নিয়ে নিচে নেমে আসবে। রঞ্জু যখন দরজার কাছে, ঠিক তক্ষুনি, পাশের ঘর থেকে সন্ধ্যার শিশুটির চিৎকার শুনতে পাবে।

তারপর ও দ্রুত পায়ে গলিমুখে এসে থামবে। সিগারেট ধরাবে। এখন কোথায় যাওয়া যায়? হঠাৎই ওর মনে পড়ল: দৈনিকবাংলার মোড়ে একটা হোটেলে পাবদা মাছ রাধে ভালো। ও নিশ্চিন্ত হয়ে সেদিকে হাঁটতে থাকবে। আজকাল রাতে কিছু খেলে বমি হয়ে যায়।

হয় হোক। বমি তো কুকুরের খাদ্য। ভাতের হোটেলের সামনে এসে বিভ্রান্ত বোধ করবে রঞ্জু। আমি এখানে কেন এসেছি? আমি এখানে কেন এসেছি? আমি এখানে কেন এসেছি? ও ঠিক নিশ্চিন্ত হতে পারে না। তারপর মতিঝিল-গুলিস্থান-পুরানা পল্টন ইত্যাদির গলি নিঝুম গলি ধরে বহুক্ষণ হাঁটবে; কী এক ঘোরের মধ্যে; সিগারেট টানতে টানতে।

পেট্রোলের গন্ধের ভিতর রিকশার টুংটাং শব্দ শুনতে শুনতে, ট্রাকের হর্ণের আওয়াজের ভিতর, ভিখিরি শিশুর কান্না দেখেশুনে। ওর মনে হবে শিশুটি সন্ধ্যার ...একবার মনে হলো পাশ দিয়ে চলে যাওয়া রিক্সায় তপন বসেছিল। একটা মেয়ের পাশে। মনে হলো মাধুরী। তপন কি মাধুরীকে ভালোবাসত? মাধুরী এখন কোথায়? শেষমেশ ও যখন রামপুরার মেসে এসে পৌঁছবে-তখন রাত প্রায় ১টা।

ছোট্ট এক টুকরো মাটির উঠান ঘিরে টিনসেডের ঘুমন্ত ঘরবাড়ি; ছায়াছায়া, নিশ্চুপ কলাগাছ, নিথর টিউবওয়েল; ম্লান জ্যোস্না পড়ে থাকবে উঠানের ওপর, ওপাশের দেওয়ালের ওপর। সে উবু হয়ে বসে হরহর শব্দে বমি করতে থাকবে। সেই কুচ্ছিৎ শব্দে যদিও কারও ঘুম ভাঙ্গবে না। ছড়ানো বমির ওপর জ্যোস্নার আলো প্রতিফলিত হয়ে উঠবে হলুদ। সে চেয়ে চেয়ে হলুদ দেখবে।

ম্লান হাসবে। তারপর একটা কুকুর আসবে উঠানে। তার মনে হবে কুকুরটা কুষ্টরোগগ্রস্থ; কারণ, সে এই সময়ে বমি খেতে আসে। ও এই সময়ে ফেরে, উবু হয়ে উঠানে বসে, তারপর হরহর করে বমি করে। কখনও-বা তপন এসে ওর হাত ধরে টান দেয়; নদীর আর্বতে তীব্র টেনে নিয়ে যেতে চায় ...ও বাধ দেয় না ...তখন ওর কুকুরটিকে বড় আপন মনে হয় ... দিন কয়েক বাদে অফিসে গেলে বিকাশ ওর সামনে এসে দাঁড়াবে।

কী ব্যাপার? এই কদিন ছিলেন কই? আর ...আর এ কী চেহারা হয়েছে আপনার? সে ম্লান হাসবে। এই নিন। আপনাকে দেব বলে তিনদিন ধরে পকেটে নিয়ে ঘুরছি। বলে ওর দিকে এক প্যাকেট বেনসন এগিয়ে দেবে বিকাশ। রঞ্জু খানিক বিস্মিত।

সিগারেট ... কেন? বিকাশ হেসে বলবে, এই প্যাকেটটা আমার বউ আপনাকে দিতে বলেছে। রঞ্জু কাঁপা কাঁপা হাত বাড়িয়ে মৃত্যুকে স্পর্শ করবে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.