যে গাছ হ'য়ে গেছে...
শেষ ক’ লাইন
দেওয়ালঘড়ির পাশ থেকে কেউ বলল – ‘টিক!’ পটলবাবু ভালো ক’রে দেখার জন্যে বালিশের পাশ থেকে টর্চটা নিয়ে জ্বালাতে গেলেন। কিন্তু গত পরশু থেকেই ব্যাটারিটা তার অন্তিম সময়ের জানান দিচ্ছে। টর্চটা জ্বালাতে গেলে মাঝে মাঝেই দপদপ ক’রে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এখনও জ্বললো না। অগত্যা মাথার কাছে খোলা জানালা দিয়ে বাইরের চাঁদের আলো যতটা আসে, তাতেই চোখটা সইয়ে নিয়ে দেখার চেষ্টা করলেন তিনি।
দেওয়ালঘড়ির আশেপাশে কেউ নেই। তবু ‘টিক’ কে বলল? যেই বলুক, পটলবাবু বুঝলেন এবারের ডিসিশানটা একেবারে ঠিকঠাক নেওয়া হয়েছে। কাল সকালেই মান্দার পর্বতে খবর দিতে হবে। ডানার অর্ডার দেওয়া, ক্লাসরুম বানানো, হ্যান্ডবিল ছাপানো কত কাজ বাকি।
বোধিলাভের ইতিহাস
বছর তিনেক আগে পটলবাবু একবার বোধিলাভের চেষ্টা করেছিলেন।
ভরদুপুরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে খাদিনান ব্রিজের কাছে দামোদরের একটা শ্মশানঘাটে পৌঁছে গিয়েছিলেন। তখন বিকেল হয়ে এসেছে। এতক্ষণ এতটা পথ গনগনে রোদে হেঁটে এসেছেন। রাগের মাথায় ছিলেন, তাই বুঝতে পারেন নি। কিন্তু শ্মশানের পাশেই শানবাঁধানো অশ্বত্থ গাছের ছায়ায় বসে বুঝলেন তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে।
এমনিতে পটলবাবু রাগেন কম। শেষবার তিনি রেগেছিলেন বছর পাঁচেক আগে। অফিসের সিনিয়ার ক্লার্ক বিষাণ মন্ডল তাঁকে ‘গৃহপালিত পতি’ বলেছিলেন।
কথোপকথন অনেকটা এরকম ছিল।
- পটল, তুমি লটারি কাটো?
- না।
কেন?
- গত পরশু আমার মেজো শালা লটারিতে ৫০০ টাকা জিতেছে। সেই থেকে আমার গিন্নি আমায় লটারির টিকিট কেনার জন্যে খোঁচাচ্ছেন।
- আচ্ছা।
পটলবাবু তখনও বুঝতে পারেন নি হঠাৎ ক’রে বিষাণ মন্ডলের মত ঘুঘু তাঁর মত নিরীহ মানুষের টেবিলে ব’সে কেন পা দোলাচ্ছেন। এবার বিষাণ পটলবাবুর দিকে ঝুঁকে পড়ে বললেন – ‘আসলে কী জানো, একা যেতে সাহস পাচ্ছি না।
লটারি তো একধরনের জুয়া। তাই না? কেউ যদি দেখে ফেলে?’ পটলবাবু কখনও ভেবে দেখেন নি লটারির দোকানে বিষাণ মন্ডলকে কেউ দেখে ফেললে কী হবে। অফিসে আসার পথে রেলস্টেশনের পাশের গলিতে অনেককেই দেখেছেন মিঠুন লটারিতে দাঁড়িয়ে টিকিটের দরদাম করতে। তার মধ্যে ২-৪ জন পটলবাবুর চেনাও বটে। কিন্তু তাদের দেখে আলাদা ক’রে কিছু মনে হয় নি।
বিষাণ মন্ডল ঝুলি থেকে বেড়াল বের করলেন – ‘ভাবছি আজ একটা টিকিট কিনেই ফেলি। তুমিও চলো আমার সঙ্গে। ’ পটলবাবু ফিকে একটা হাসলেন। তারপর আঙুলের ফাঁক থেকে পেনটা নামিয়ে রেখে বললেন – ‘কুঁক!’ বিষাণ মন্ডল বিপজ্জনকভাবে পটলবাবুর মুখের একেবারে কাছে কান এনে বললেন – ‘কুঁক? মানে?’ হেঁচকি উঠছিল, তাই টেবিলে রাখা গ্লাসটা টেনে নিয়ে একচুমুক জল খেয়ে পটলবাবু বললেন – ‘আজ তো যাওয়া হবে না। আজ আমাদের গোরুটার শরীর খারাপ, তাই গিন্নি তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে বলেছেন।
’ বিষাণ মন্ডল টেবিল থেকে নেমে আড়মোড়া ভেঙে বললেন – ‘বুঝলে হে পটলকুমার, তোমার মত গৃহপালিত পতিদের দিয়ে আজ পর্যন্ত দেশের কোনও উন্নতি হয়নি, হবেও না। ’
গোরুর শরীর খারাপটা বানিয়ে বলা। আসলে বিষাণ মন্ডলকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্যে অজুহাতটা সদ্য বানানো। লোকটা সম্পর্কে যা শোনা যায়, তার যদি ১৫ শতাংশও সত্যি হয়, তাহলে পটলবাবুকে ভুলিয়ে ভালিয়ে লটারির দোকানে নিয়ে গিয়ে ওনার পয়সাতেই টিকিট কিনবেন এই বিষাণ মন্ডল। কিন্তু তার বদলে এই ‘গৃহপালিত পতি’ তকমাটাও যথেষ্ট অপমানজনক।
বিষাণ মন্ডলের বাঁকা হাসির জবাবে পটলবাবু সেদিন ছুটি হ’তে না হ’তেই গিয়ে পৌঁছলেন মিঠুন লটারির কাউন্টারে। তারপর লক্ষ্মী আঁকা একটা পাতলা টিকিট পকেটে গুঁজে অগৃহপালিত আনন্দে বুক ফুলিয়ে রওনা দিলেন বাড়ির পথে। সেই থেকে প্রত্যেক বুধবার নিয়ম ক’রে লটারির টিকিট কেটেছেন। সেইসব টিকিটের টাকা যোগ করলে আর একটা বড়সড় গোরু কেনা হয়ে যেত। কিন্তু আজ পর্যন্ত একটা পয়সাও ফেরত আসেনি তাঁর পকেটে।
এই নিয়ে গিন্নি মাঝে মাঝে গজগজ করেছেনও বটে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে বিষাণ মন্ডলের তাচ্ছিল্য পটলবাবুকে লটারির টিকিট কেনা থেকে নিরস্ত করতে পারে নি।
বিকাল ঢলে সন্ধ্যে হতে চলল। পটলবাবু ঠায় বসে রইলেন দূরের নিভু নিভু চিতার দিকে তাকিয়ে। একজন শ্মশানবন্ধু তাঁর কাঁধে হাত রেখে বলল – ‘এবার বাড়ি চলুন দাদা। যে গেছে, সে কি আর ফিরে আসে?’ পটলবাবু মনে মনে বললেন – ‘যে গেলে হাড় জুড়োতো, সে আর যাচ্ছে কই?’
শনিবার।
অফিস থেকে দুপুর বেলা ফিরেই গিন্নির সাথে তুমুল ঝগড়া হয়েছে। অবশ্য লড়াইটা বরাবরের মতোই একপাক্ষিক ছিল। ঠিক সময়ে বিল জমা না দেওয়ায় ফোন লাইন কেটে দিয়েছে টেলিফোন অফিস থেকে। সেই নিয়ে পটলবাবুর ওপর অগ্ন্যুৎপাত শুরু হয়েছিল। বিধ্বস্ত পম্পেই নগরীর মত পটলবাবু একবার রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন – ‘ফোন তো তুমিই বেশি ব্যবহার করো।
তুমিই তো যেতে পারো বিল জমা দিতে। ’ পুরুষের কয়েকটা ভুলের মধ্যে একটা, বউয়ের মুখের ওপর কথা বলা। পটলবাবু সেটা একটু দেরিতে হৃদয়ঙ্গম করলেন। কিন্তু যখন উপলব্ধি হল, ততক্ষণে আক্রমণ থেকে বাঁচতে তিনি রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছেন।
ক্ষিধে আর তেষ্টায় প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে উঠেছে।
তার ওপর মশার কামড়। পটলবাবু ইস্কুলের ইতিহাস বইয়ে বুদ্ধদেবের কথা পড়েছিলেন। সংসার ত্যাগ ক’রে কোন একটা গাছের তলায় বসে বোধিলাভ ক’রে বিখ্যাত হয়ে গেছলেন। তাছাড়া এ যুগেও তো অনেকে ঘরদোর ছেড়ে বিবাগী হয়ে যায় – কাশী-গয়া এইসব জায়গায় গিয়ে আস্তানা গেড়ে বসে। শারীরিক কষ্ট উপেক্ষা ক’রে পটলবাবু গভীর মনোযোগের সাথে সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেষ্টা করলেন।
এখানেই শ্মশানঘাটের অশ্বত্থ গাছের তলায় বসে বোধিলাভের চেষ্টা করবেন, নাকি কাশী গিয়ে গঙ্গার ধারে শিকড় গাড়বেন। কাশী যাওয়ার হাজার ঝামেলা। জায়গাটা ঠিক কোথায় বা কীভাবে যেতে হয় তা জানা নেই। শুনেছিলেন ট্রেনে যাওয়া যায়। কিন্তু ট্রেনের টিকিট কেনার মত পয়সাও এখন পকেটে নেই।
শোওয়ার ঘরের দেওয়াল আলমারির ওপরের তাকে একটা পাউডারের ডিবেতে হাজার তিনেক টাকা গিন্নির নজর বাঁচিয়ে জমা ক’রে রেখেছিলেন। কিন্তু ও বাড়িতে আর পা রাখা যাবে না। বুদ্ধদেবের মত তিনিও সংসার ত্যাগ ক’রে এসেছেন।
সব দিক ভেবেচিন্তে পটলবাবু শেষ পর্যন্ত ঠিক করলেন এই গাছের তলায় বসে থেকেই বোধিলাভের চেষ্টা করবেন। বাল্মিকীর মত গায়ে হয়তো উইয়ের ঢিপি গজাবে।
দিনের পর দিন চান না করায় গায়ের গন্ধে বাঘ-ভালুকও কাছে ঘেঁষবে না। কিন্তু তবু তিনি অটল থাকবেন নিজের প্রতিজ্ঞায়। যদিও বোধিলাভ ব্যাপারটা কী, তা পটলবাবু নিজেও জানেন না। আন্দাজে বুঝলেন তাঁর মাথার পেছনে একটা চাকা ঘুরতে থাকবে। কান দুটো সামান্য বড় হয়ে যাবে।
মাথার চুলে খোঁপা বেঁধে তাতে আতা ফলের স্বর্গীয় ডিজাইন করা হবে। ইতিহাসের বইয়ে বুদ্ধদেবের ছবি থেকে যা মালুম করা যায় আর কী!
এইসব চিন্তা ভাবনাতে কাজ হল। শরীরের ক্লান্তি, মশার কামড় সব উপেক্ষা ক’রে পটলবাবু গাছের তলায় বসে বসে ঘুমিয়ে পড়লেন। রাত কত জানেন না, টর্চের আলো আর লোকজনের কথাবার্তার আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। ভেবেছিলেন হয়তো দাহ করতে আসছে কেউ।
কিন্তু একটু পরেই শুনলেন চেনা গলায় কে যেন তাঁর নাম ধরে ডাকছে – ‘পটল। কোথায় তুই?’ তাঁর বড়দা – এই এলাকার প্রভাবশালী নেতা। পুলিশ নিয়ে এসেছেন তাঁকে পাকড়াও করতে। উঠে বসে আন্দাজে চটিজোড়া খুঁজতে লাগলেন পটলবাবু। কিন্তু পালানো হল না।
পুলিশের দুটো কনস্টেবল তাঁকে চ্যাংদোলা ক’রে জিপে নিয়ে গিয়ে তুললো। পটলবাবু তখন তারস্বরে চেঁচাচ্ছেন – ‘ছেড়ে দাও আমায়। আমি বোধিলাভ করব। বাড়ি ফিরব না। ’ একজন কনস্টেবল তাঁর বড়দাকে বললো – ‘আপনার ভাই মনে হয় মাল খেয়েছে স্যার।
’
এই বোধিলাভের ব্যাপারটা অফিসে কীভাবে যেন চাউর হয়ে গিয়েছিল। যদিও ঘটনাটা অনেক পুরানো হয়ে গেছে, তবু মাঝে মাঝে তাঁকে বিষাণ মন্ডলের মত কেউ কেউ পিন ফোটানোর জন্যে কথা প্রসঙ্গে ব’লে থাকেন – ‘সবাই তো আর তোমার মত গৌতম বুদ্ধ নয়। ’ পটলবাবু ওসব কথা গায়ে মাখেন না। কারণ এই ঘটনায় যিনি সবথেকে বেশি ক্ষুব্ধ হয়ে আক্রমণ শানাতে পারতেন, সেই পটলবাবুর গিন্নিই বরং এই নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য করেন না। গিন্নির মতিগতি দেখলে মনে হয়, যেন এমন কোনও ঘটনাই ঘটেনি।
ঐ ঘটনার পরও বেশ কয়েকটা দাম্পত্য কলহ ঘটে গেছে। সেখানে গিন্নি তাঁর লটারির টিকিট কেনা, ইলেকট্রিক বা টেলিফোন বিল জমা দিতে ভুলে যাওয়া, সাইকেলের চাবি হারিয়ে ফেলা, অতিরিক্ত মাত্রায় গুড়াকু ব্যবহার করা ইত্যাদি নিয়ে অতিশয় ধারালো সব বাক্যবাণ শানিয়েছেন। কিন্তু কোনও সন্দেহজনক কারণে পটলবাবুর বোধিলাভের ঘটনা ঘূণাক্ষরেও উচ্চারণ করেননি। তাই পটলবাবু তাঁর বোধিলাভের ইতিহাস নিয়ে বিশেষ চিন্তাভাবনা করেন না।
[ক্রমশঃ]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।