যে গাছ হ'য়ে গেছে...
মান্দার পর্বত
আজ বাড়ি থেকে বেরিয়ে অফিসে যাওয়ার পথে একটা অদ্ভূত ঘটনা ঘটলো। বাড়ি থেকে দূরত্ব কম ব’লে পটলবাবু সাইকেলেই অফিস যাতায়াত করেন। অন্যান্য দিনের মতই রেলওয়ে ক্রসিং-এ আটকা পড়ে পটলবাবু ৮টা ৪৫-এর মেচেদা লোকালের হুটহাট ক’রে চলে যাওয়া দেখছিলেন। ট্রেন চলে যাওয়া আর লেভেল ক্রসিং-এর গেট খুলে যাওয়ার ভেতর যেটুকু সময় থাকে, সেই সময়ে সবাই নিজের তালে ছোটার জন্যে আবার প্রস্তুতি নেয়। পটলবাবুও মনে মনে ‘রেডি-স্টেডি-গো’ বলছেন, এমন সময় তাঁর সাইকেলের পাশে আরও একটা সাইকেল এসে দাঁড়ালো।
এই ব্যস্ততার মধ্যে পটলবাবু ঘুরেও দেখতেন না সেদিকে, যদি না পাশের সাইকেল আরোহী নিজে থেকে যেচে কথা বলতেন – ‘যাচ্ছেন তো?’ কথাটা এমনভাবে বলা যে পটলবাবুকে ঘুরে দেখতেই হল। মুচকি হেসে আবার প্রশ্নটা করলেন সেই ভদ্রলোক – ‘যাচ্ছেন তো?’ পটলবাবু প্রশ্নের মাথামুন্ডু বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসা করলেন – ‘কোথায়?’ উত্তর শোনার আগেই ক্রসিং-এর গেট খুলে গেল। পাশ থেকে উত্তরের মত ক’রে হালকা ভেসে এল – ‘মান্দার পর্বত। ’ পেছন থেকে হাজার রকম শব্দে প্যাঁ-পোঁ-পিঁ হর্ণ বাজতে শুরু করেছে। গড্ডালিকা প্রবাহের সাথে পটলবাবুও সাইকেল চালিয়ে দিলেন।
এই তালগোলের মধ্যে সেই ভদ্রলোককে আশেপাশে আর দেখা গেল না। সাইকেল চালাতে চালাতেই এদিক ওদিক দেখলেন পটলবাবু। নাঃ! যেমন এসেছিল, তেমনই চলে গেছে লোকটা।
কিন্তু মান্দার পর্বত জিনিসটা কী? শুনে মনে হয় পাহাড়-টাহাড় হবে। সবাই বেড়াতে-টেড়াতেও যায় হয়তো, যেহেতু লোকটা যাবার কথা জিজ্ঞাসা করছিল।
কিন্তু জীবনেও এমন কোনও জায়গার নাম শোনেননি পটলবাবু। অত ভিড়ভাট্টার মধ্যে ঠিক শুনেছেন কি না, তাও বুঝতে পারলেন না। মনের মধ্যে কেমন একটা খচখচানি রয়ে গেল। এত লোকের মধ্যে তাঁকেই কেন একজন অজানা লোক এসে জিজ্ঞাসা করবে মান্দার পর্বতে যাওয়ার ব্যাপারে? নিশ্চয় পটলবাবুকে অন্য কোনও লোক ঠাউরে এমন প্রশ্ন করেছে লোকটা। এরকম তো কতই হয়।
এই তো গত মাসে তাঁর বন্ধু রাধাশ্যামকে এসে ভোররাত্তিরে পুলিশ উঠিয়ে নিয়ে গেল। সে নাকি গোপনে চোলাইয়ের ব্যবসা করত। ব্যাপার-স্যাপার শুনে পাড়াময় ছি-ছি-কার পড়ে গেল। রাধাশ্যামের ছেলে-মেয়ে-বউ বাড়ির বাইরে বেরোতে পারছে না লজ্জায়। এমন একটা পরিস্থিতিতে সেদিন দুপুরেই একটা পুলিশের ভ্যান রাধাশ্যামকে সসম্মানে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেল আবার।
ধরার কথা ছিল ওয়াগান ব্রেকার ঘনশ্যামকে, এসে পাকড়াও করেছিল রাধাশ্যামকে। তা রাধাশ্যামও ছেড়ে কথা বলে নি। সে মানহানির মামলার নোটিশ পাঠিয়েছিল পুলিশকে। লোকমুখে শোনা পুলিশের পক্ষ থেকে শেষে নগদ পঁচাত্তর হাজারে রফা হয়েছিল। নিজের মনেই মাথা নাড়তে আরম্ভ করলেন পটলবাবু।
নাঃ! এ নিশ্চয় সেই রাধাশ্যাম-ঘনশ্যামের কেস। তাই মান্দার পর্বত মন থেকে সরিয়ে পটলবাবু কাজে মনোযোগ দেবার চেষ্টা করলেন।
কিন্তু মন থেকে সরাতে চাইলেই কি আর সরে? তাই অত সহজে মাথা থেকে মান্দার পর্বত বের হল না। ২-৩টে ফাইল সারার পর অফিসের পিয়ন নিবারণ খুশি খুশি মুখে এসে জানালো – ‘বড়বাবু আপনাকে ডাকছেন। ’ বড়বাবু মানে ম্যানেজার ঘোষদস্তিদার সাহেব ‘ডাকছেন’ মানে গতিক সুবিধের নয়।
যাকে ইনি নিজের কেবিনে ডেকে পাঠান, তার শনি নারাজ ব’লেই ধরে নেওয়া হয়। দুরুদুরু বুকে ম্যানেজারের কেবিনে ঢুকলেন পটলবাবু। ঘোষদস্তিদার তাঁর জন্যেই অপেক্ষা করছিলেন মনে হল – ‘আসুন পটলবাবু। বসুন। ’ মধুঢালা গলায় এমন আসুন, বসুন জাতীয় কথা শুনলে রীতিমত ভয় হওয়ার কথা।
পটলবাবুর পেটের মধ্যে গুড়গুড় ক’রে উঠল অশুভ মেঘ।
ঘোষদস্তিদার দুটো হাত সামনের দিকে এনে ফার্স্ট স্লিপে ক্যাচ ধরার ভঙ্গিতে জিজ্ঞাসা করলেন – ‘কেমন আছেন পটলবাবু?’ পটলবাবু আসন্ন বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে একটা মরিয়া চেষ্টা করলেন। হাসি হাসি মুখে বললেন – ‘ভালোই তো আছি। ’ ঘোষদস্তিদার এমনটা ভাবেননি। একটু ঘাবড়ে গেলেন।
লোকটা তাঁকে ভয় তো পাচ্ছেই না। উলটে মুচকি হাসছেও তাঁর দিকে তাকিয়ে। আজকাল ইউনিয়ন-ফিউনিয়ন করছে না তো এই লোকগুলো? যাই হোক, নিজের বক্তব্য মনে মনে গুছিয়ে নেওয়াই ছিল। এবার শুরু করলেন ঘোষদস্তিদার – ‘পটলবাবু, আপনি শেষ কবে ছুটি নিয়েছিলেন?’ পটলবাবু মনে মনে হিসাব কষতে লাগলেন। তারপর চটজলদি উত্তর দিলেন – ‘১৯৭৯-র পয়লা সেপ্টেম্বর স্যার।
গিন্নির বমি হয়েছিল। ’ ম্যানেজার ঘোষদস্তিদার বিষম খেতে খেতে সামলে নিলেন – ‘তা এখন আপনার বউ ভালো আছেন তো?’ পটলবাবু মাথাটা একদিকে হেলিয়ে জবাব দিলেন – ‘ভালো আছেন। ’ ঘোষদস্তিদার একই সুরে জিজ্ঞাসা করলেন – ‘আর ছেলেমেয়েরা?’ পটলবাবু একটু সতর্ক গলায় হাত কচলে বললেন – ‘আমার ছেলে মেয়ে নেই স্যার। মানে হয়নি। ’
পারিবারিক কুশল বিনিময়ের জন্যেই বোধহয় তাঁকে ডাকা হয়েছে, এমন কিছু যখন ভাবতে শুরু করেছেন পটলবাবু; তখনই টেবিলের ওপার থেকে বোমা ফাটলো – ‘তা হলে আপনার প্রবলেম কী মশাই? আপনি ভালো আছেন।
বউ ভালো আছে। আপনার তো ছেলেপুলেও নেই বলছেন। তাহলে কীসের অত সমস্যা আপনার?’ ম্যানেজারের আচমকা এই আবহাওয়া পরিবর্তনে পটলবাবু একটু দিশেহারা হয়ে পড়লেন। কারণটা বোঝার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু বেশি চিন্তাভাবনা করার আগেই আজ সকালের সদ্য শেষ করা মহিষরেখা কালভার্টের সবুজ ফাইলটা পাখনা মেলে উড়ে এল তাঁর দিকে – ‘আজকাল কী আর মাথায় মাথা থাকছে না আপনার? যদি মনে হয় দিনে ক’টা ফাইল সেরে আমার গুষ্টি উদ্ধার করছেন, তাহলে ছুটিতে যান। ’ পটলবাবু ফাইলটার খোলা পাতায় চোখ রাখলেন।
সমস্ত হিসাবের শেষে নীট ফলের জায়গায় বড় বড় ক’রে তাঁর নিজের হাতে লেখা – মান্দার পর্বত মাত্র। ‘মান্দার পর্বত? মানে কী? আপনার কী আজকাল ভীমরতি হয়েছে? এই ফাইল আজ বিকেলের মধ্যে আমার টেবিলে না জমা পড়লে আপনার কপালে দুর্গতি আছে। ’
অতএব ম্যানেজারের ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের জায়গায় বসে পটলবাবু এক চুমুক জল খেলেন। তারপর মাথার ওপর ঘুরতে থাকা ফ্যানের দিকে তাকিয়ে হাঁ ক’রে ভাবতে লাগলেন। হাঁ-টা অবশ্য পটলবাবু নিজে থেকে করেননি।
তিনি কোনও বিষয় নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে শুরু করলেই আপনা থেকে তাঁর মুখটা হাঁ হয়ে যায়। মান্দার পর্বত আজ সকাল থেকে মগজে যে খিচুড়ি পাকিয়েছে, পটলবাবু হাঁ ক’রে তা-ই নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছেন। এমন সময় টপ্ ক’রে একটা আওয়াজ হল তাঁর টেবিলে। তাকিয়ে দেখলেন একটা টিকটিকি টেবিলের ওপর থেকে তাঁকে পর্যবেক্ষণ করছে। বোধহয় সিলিং থেকে খসে পড়েছে।
পটলবাবু টিকটিকিটাকে তাড়ানোর চেষ্টা করলেন – ‘ফুঃ! ফুঃ!’ তাঁর ফুঁ-এর জোরেই হোক বা টিকটিকিটার বাথরুমে যাওয়ার তাড়াই থাকুক, টিকটিকিটা টেবিল থেকে নেমে কোথায় যেন পালিয়ে গেল। তার অন্তর্ধানের পর দেখা গেল, যে জায়গায় টিকটিকিটা পড়েছিল সেখানে একটা পোস্টকার্ড। কোত্থেকে এল? মা গত হওয়ার পর থেকে তাঁকে কেউ চিঠি লেখেন নি কখনও। এদিক ওদিক তাকিয়ে অদম্য কৌতূহলে পোস্টকার্ডটা হাতে তুলে নিলেন পটলবাবু। ঠিকানার জায়গায় তাঁর অফিসের নাম ঠিকানা লেখা।
পড়তে শুরু করলেন।
প্রিয় পটলবাবু,
আশা করি এ চিঠি পড়ার আগে পর্যন্ত আপনি জানতে পারেন নি মান্দার পর্বত কী এবং কেন। আগে থেকেই বলে নেওয়া ভালো, এ চিঠি পড়ার পরেও আপনি এ সব তথ্য জানতে পারবেন না। আমাদের উপদেশ আপনি শুধু চোখ-কান খোলা রাখুন। অচিরেই আপনার সঙ্গে আমাদের সাক্ষাত হবে।
বিনীত
সাধারণ সম্পাদক,
জাটিঙ্গা ফ্লাইং ক্লাব
পুনশ্চঃ বাড়ি ফেরার পথে একটা নতুন মাজনের টিউব কিনে নেবেন, কাজে আসবে।
ব্যাস! ১ মিনিটে চিঠি খতম। যদিও মাথামুন্ডু কিছুই বোঝা গেল না। তবু এটুকু বুঝতে পারলেন পটলবাবু, কোনও ভুল নেই এবার। ভুল ক’রে কেউ তাঁকেই পাঠিয়েছে এই রহস্যময় চিঠি।
নো রাধাশ্যাম-ঘনশ্যাম! হঠাৎ চিন্তায় ছেদ পড়ল। কে যেন তাঁকে ডাকছে। বাড়ি থেকে ফোন এসেছে।
অফিসে ফোন না করার জন্যে গিন্নিকে পই-পই ক’রে বারণ করেছিলেন পটলবাবু। তাঁর মত সাধারণ কেরানীদের জন্য একটাই ফোন, সেটাও আবার বিষাণ মন্ডলের ডেস্কে।
ফোনের রিসিভারটা নামানো আছে। বিষাণ মন্ডল ইশারায় রিসিভারটা দেখিয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগলেন। অমন হাসি দেখলেই গা পিত্তি জ্বলে যায়। ওদিক থেকে আদেশ ভেসে এলো – ‘বাড়ি ফেরার সময় বড়দার ওখান থেকে হয়ে আসবে। উনি বিশেষ ক’রে যেতে বলেছেন।
’ নাক থেকে একটা আওয়াজ বের হল পটলবাবুর – ‘হুঁ!’ ওপার থেকে আবার কড়কানি এলো – ‘বড়দার ওখানে গিয়েও শুধু হুঁ ব’লে ফিরে আসবে না যেন। নাহলে দুদিন পরে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে। ’
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।