আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জাপানী চোরাদের কিছু "কস্কি মমিন!!" কাহিনী

যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে, ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

১. টোকিও শহরের ট্রেনগুলোতে অনেকরাত পর্যন্ত ভীড় থাকলেও একটু দূরের এলাকাগুলোর ক্ষেত্রে রাত এগারোটা/বারোটার দিকেই একা এক বগিতে নিজেকে আবিষ্কার করার সম্ভাবনাটা একেবারে কম না। খুব বেশী পরিমাণ ভূতের ভয় না থাকলে একা একা ট্রেনে চড়াটা খারাপ কিছুনা, তবে সমস্যা একটা আছে, যেটা হলো, চোরগোত্রীয় ব্যক্তিবর্গও সঙ্গত কারণে এসময়টাতেই ট্রেনে বেশী চড়েন। রাতের ট্রেনে ক্লান্ত যাত্রী সাধারণতঃ ট্রেনের ঢুলুনির সাথে সাথে এক পশলা আরামের ঘুম দিয়ে নেয়, ফাঁকা বগিতে তখন যাত্রীর শরীরে অবহেলায় ঝুলতে থাকা কোটটার পকেট থেকে মানিব্যাগ হাপিস করাটা মহামান্য চোরদের জন্য নিতান্তই কয়েকটি আঙুল নাড়ানোর ব্যাপার মাত্র, আর কিছু না। তেমনি এক চোরামশাই একদিন ফাঁকা ট্রেনে উঠলেন, টার্গেট বগিতে বসে থাকা একমাত্র যাত্রীটি যিনি যুগপৎ নাক ডেকে এবং মুখ হা করে ঘুমোচ্ছেন, তাঁর পকেট সাফ করা। নাকডাকা আর মুখ হা করে থাকা -- এদু'য়ের সম্মিলন দেখে আমাদের এই চোরসাহেবের মনে আর সামান্যতম সন্দেহও রইলোনা যে অন্ততঃ এই কেইসটা পানির মতো সহজ হতে যাচ্ছে।

অথচ মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক, ম্যান প্রপোজেস, গড ডিসপোজেস! চুপচাপ গিয়ে লোকটার পাশে বসে, তারপর টুক করে তার প্যান্টের পকেট থেকে মানিব্যাগটা নিয়ে নিজের পকেটে ঢুকিয়ে রাখলেন জনাব চোর। সব ঠিকঠাক। এখন শুধু অপেক্ষা, কখন আসবে পরের স্টেশন। সটকে গেলেই হলো। বেশী অপেক্ষা করতে হলোনা, এদেশে দু'চারপাঁচ মিনিট পরপরই একেকটা স্টেশনে থামে ট্রেন।

ট্রেন থামতেই মাননীয় চোর নেমে যাবার প্রস্তুতি নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, দরজার দিকে পা বাড়িয়ে বেশ খানিকটা এগিয়েও গেলেন, আর ঠিক তখনই কি যেন একটা টের পান! কেমন যেন টানটান লাগে, "সামথিং ইজ রং!" ভাবেন তিনি। তাকিয়ে দেখেন, একটা সাদা ইলাস্টিক ফিতা (আমাদের দেশের পাজামার ফিতার মতো) ঘুমন্ত যাত্রীর প্যান্টের বেল্ট থেকে টান খেয়ে আছে একেবারে আমাদের চোরবাবাজীর পকেট পর্যন্ত! সে এক অদ্ভুত বাঁধন, যেন সাবিনা ইয়াসমিন কিন্নর কন্ঠে গেয়ে উঠেছেন, "একই বন্ধনে, বাঁধা দুজনে, এবাঁধন ছিড়ে যেওনা। " ওদিকে এই স্টেশন থেকে ট্রেনে ওঠা নতুন দুয়েকজন যাত্রীর চোখ কপালে উঠে গেছে চোরের কান্ড দেখে। ইলাস্টিকওলা যাত্রীও সুখনিদ্রা ভেঙে জেগে উঠেছেন, হয়তো চোরমশায় বাঁধন ছিঁড়ে যাননি বলেই। স্টেশন মাস্টারকে ডেকে এনে এসপার ওসপার করার বাকী ব্যাপারটা সামলাতে তাদের আর কতক্ষণ লেগেছিলো সেটা জানা না গেলেও, খুব বেশী যে লাগেনি সেটা ঠিকই আঁচ করা যায়।

টিভিতে দেখেছিলাম ঘটনাটা, দেখতে দেখতে মনে হলো, বাংলা জানলে চোর মহাশয় নির্ঘাৎ মনের কষ্ট চাপতে চাপতে গাইতে থাকতেন, "এ কি বাঁধনে বলো, জড়ালে আমায় ... " ২. এবার আরেক মশায়ের (ইনিও চোর) কথা বলবো, যাকে কিনা এককথায় বলা যায় একজন "কপালপোড়া চোর"। মানে তিনি যেখানেই হানা দেন সেখানেই যেন সাগর শুকিয়ে যায়! দেখা যায় গৃহকর্তার নিজেরই এমন করুণ অবস্থা যে উল্টো আমাদের চোর সাহেবেরই কিছু দানছত্র করে যেতে ইচ্ছে হয়। যে বাসায়ই ঢোকেন, সে বাসারই মালপত্র সব যেন হঠাৎ উধাও হয়ে যায়! এমনি এক সকালে এক বাসায় চুরি করতে ঢুকলেন মহাশয়, যথারীতি শূণ্য ঘর খা খা করছে। একটা পড়ার ডেস্ক, ওয়ারড্রোব আর কিচেন সেফ ছাড়া কিচ্ছু নেই। রাগে দুঃখে জর্জরিত চোর সাহেব তাও "যেখানে দেখিবে ছাই ... " স্পিরিটে উদ্বুদ্ধ হয়ে সারাঘরের যত ড্রয়ার, ক্লোজেট আছে সব খুলে, হাতড়ে পাতড়ে দেখলেন।

কিছু না পেয়ে আবারও যখন নিজের ভাগ্যকে দোষ দেবার জন্য মনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন এই হতভাগা চোর, ঠিক তখনই দেখলেন, ডেস্কের উপরে বইপত্রগুলোর পাশে একটা মানিব্যাগ দেখা যায়! কি সৌভাগ্য!! দৌড়ে গিয়ে মানিব্যাগ হাতে নেন, মনে মনে আশা এবার অন্ততঃ উপরওয়ালা তার পানে চেয়েছেন; কিন্তু "যার হয়না নয়য়ে, তার নব্বইয়েও হয়না" -- গুরুজনেরা এমনি এমনি তো আর বলেননা। আমাদের চোরটিও তাই মানিব্যাগ খুলে যা পেলেন তা সর্বসাকুল্যে একটা এক হাজার ইয়েনের নোট!! এদেশে দু'চার কাপ চা খাওয়ার পয়সা হবে হয়তোবা!! যাই হোক, "শামসুদ্দিনের ব্যাটার ঘরের নাতিন" বলে কথা, সেই একমাত্র নোট নিয়েই বের হয়ে এলেন চোর মশাই। তবে তখনও তিনি জানেননা কপালে তার জন্য কি অপেক্ষা করে আছে, কারণ, বিকেলে যখন বাসায় ফিরলেন, তখন দেখা গেলো যে দরজার সামনে পুলিশের দুজন লোক দাঁড়িয়ে!! ঘটনা কি? পুলিশ দুজনের মধ্যে নেতাগোছের লোকটি একটি মানিব্যাগ বাড়িয়ে ধরলো চোরের দিকে, জিজ্ঞেস করলো, "আপনার মানিব্যাগ?" আকাশ থেকে পড়লেন আমাদের চোরা। কখন যে তার নিজের মানিব্যাগটিই হাপিস হয়ে গেছে টেরও পাননি!! হন্তদন্ত হয়ে "আরিগাতো, আরিগাতো" (মানে ধন্যবাদ) বলতে বলতে যেই না মানিব্যাগ নিতে হাত বাড়ালেন, অমনি পুলিশ তার ঘাড় চেপে বললো, "থানায় চল্ ব্যাটা!" ঘটনা হয়তো আর ভেঙে বলার দরকার নেই, তাও বলি, সকালে যে বাসায় মানিব্যাগ থেকে এক হাজার ইয়েন চুরি করেছিলেন, সে বাসাতেই ড্রয়ার আলমারী ঘাঁটতে ঘাঁটতে কখন যে তাঁর নিজের পকেট থেকেই মানিব্যাগ পড়ে গেছে সেটা জনাব খেয়ালও করেননি। তবে তারচেয়েও মজার ব্যাপার হলো, তাঁর নিজের মানিব্যাগেই ছিলো তিন হাজার ইয়েন! ভাগ্যিস পুলিশে ধরেছিলো, না হলে যা চুরি করেছেন, চোরসাহেব তার তিনগুণ হারাতে বসেছিলেন।

৩. এটা সিরিয়াস লেভেলের চোরদের কাহিনী, একেবারে ওশান'স ইলেভেন স্টাইল। এরা পাঁচজন একসাথে দিনের আলোতেই চুরি করেন। কিভাবে? জাপানে প্রতিবেশীর খবর লোকে খুব একটা রখেনা, তাছাড়া দিনের বেলা ছেলেবুড়োদের প্রায় সবাইই বাসার বাইরে থাকে। সেসুযোগে এঁরা পিকআপ ভ্যান নিয়ে লোকজন বাসায় নেই এমন বাসা টার্গেট করেন, দরজা খুলতে পারলেই হলো। পাঁচজন মিলে এমনভাবে প্যাকআপ করে বাসা থেকে জিনিসপত্র সরাতে থাকেন যে আশপাশের প্রতিবেশীরা দেখে ভাববে যে বাড়ীর মালিক বাসা বদলাচ্ছে।

এভাবেই এই পঞ্চরত্ন দিনেদুপুরে লোকের বাসা থেকে ইচ্ছেমতো আসবাব, ইলেকট্রনিকস, জামা-কাপড় এসব চুরি করতেন, তারপর অতি পছন্দের জিনিসগুলো নিজেদের বাসায় নিয়ে বাকীগুলো বিক্রী করে পয়সা ভাগাভাগি করতেন। এভাবেই দারুণ সুখে দিন কাটছিলো তাদের -- নো ডাউট!! চোরাই মাল ঘর শুধু টাকা আয়ই নয়, ঘরও সাজান তাঁরা। এমনকি দল নেতার বাসার ড্রয়িং রূমে একটা দামী পেইন্টিংও ঝুলতে দেখা গেছে, যেটাও অতিঅবশ্যই চুরির মাল! সর্দারের ড্রয়িং রূমের খবর কিভাবে জানা গেলো -- প্রশ্নটা আপাতত থাক। গৃহস্তের একদিন বলে একটা কথা আছে, তেমনি একদিন সকালে দেখা গেল পাঁচ চোরের আস্তানায় পুলিশ, হাতে কিছু ছবি, আর কয়েকটা হাতকড়া। ঠিক, পঞ্চরত্নকে গ্রেফতার করার জন্যই কষ্ট করে পুলিশ মশাইদের তশরীফ আনা।

পুলিশ দেখে শান্তচিত্তে যখন চোরসর্দার তাদের আগমনের হেতু জানতে চাইলেন, পুলিশ অফিসার ততোধিক শান্তমেজাজে নিজের হাতে থাকা ছবিগুলো চোরসর্দারের সামনে তুলে ধরলেন। সর্দার তো হতবাক! ছবিতে দেখা যাচ্ছে দুসপ্তাহ আগে যে আলীশান বাড়ীটায় তাঁরা চুরি করেছিলেন সে বাড়ীতে তোলা সব ছবি-- একেবারে তাদের চুরি করার ছবি; শুধু তাই না, একটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে, দামী একটা পেইন্টিং (এটাই সর্দারের ড্রয়িংরূমের দেয়ালে আবিস্কার করে পুলিশ) দেয়াল থেকে নামাতে নামাতে সর্দারজী রীতিমতো "ভি" সাইন দেখিয়ে ক্যামেরার দিকে দাঁত কেলিয়ে আছেন!! আবার অপারেশন শেষে সর্দারের ড্রয়িংরূমে বসে যে সবাই সেলিব্রেশন পার্টি করছিলো সে ছবিও বাদ যায়নি; এ ছবিতেও দামী পেইন্টিংটা দেখা যাচ্ছিলো, তবে আলীশান বাড়ীর দেয়াল থেকে সেটা নেমে এসেছিলো সর্দারজীর দেয়ালে। কথা হলো, পুলিশ এসব ছবি পেলো কিভাবে? ভেবেছিলাম এই ঘটনাটা নিয়ে একটা গেসবল বানিয়ে ফেলবো নাকি! আজ বাংলা নববর্ষ না হলে হয়তো বানিয়েও ফেলতাম, নববর্ষের দিন লোকজন একটু কম ভাবুক, খানা-পিনা, ফুর্তি-উর্তি করুক। ঘটনা হলো, আলীশান বাড়ীর আলীশান সব জিনিসের সাথে একটা প্রফেশনাল ক্যামেরাও ছিলো। ক্যামেরা হাতে পেয়ে মহাত্ননদের একজন জগৎ-সংসার প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন, ইচ্ছেমতো নিজেদের চুরি করার ছবি (একেবারে পোজসহ), পার্টির ছবি এমনকি এর পরে পরিবার নিয়ে একসাথে ঘুরতে যাবর ছবিও তুলে ফেলেছিলেন।

এপর্যন্তও কোন সমস্যা ছিলোনা, শুধু সমস্যাটা হলো যখন ক্যামেরার দোকানে ক্যামেরাটা বিক্রী করতে গিয়েছিলেন তখন। তিনি ভুলেই বসে ছিলেন যে ক্যামেরার ভেতরে একটা ফিল্ম "মুহাহাহাহা মুহাহাহাহা" করে হাসছে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।